ডেভিড হিলবার্ট
১৯০০ সালের আগষ্টে প্যারিসে ইন্টারন্যাশনাল কংগ্রেস অভ ম্যাথমেটিশিয়ানে মুলবক্তা হিসাবে ডেভিড হিলবার্ট তার বক্তৃতায় ২৩টি ধাঁধার এক তালিকা দিলেন, তার জীবদ্দশাতেই এই তেইশটি ধাঁধার অধিকাংশ সমাধান হয় একটা সমাধান হয় তার মৃত্যুর পর ১৯৯৩ সালে যা সবাই ফার্মা’স লাষ্ট থিওরম নামে জানেন। শুধু বাকী থাকে একটি ধাঁধা যেটাকে হিলবার্ট তার ধাঁধার তালিকায় আট নাম্বারের রেখেছিল যার পোষাকি নাম রিম্যান হাইপোথিসিস। এর ১০০ বছর পর। ২০০০ সালে সেই প্যারিসেই আবারো এক হন দুনিয়ার সেরা গনিতজ্ঞরা উদ্যোক্তা আমেরিকার ক্লে ম্যাথমেটিকস ইন্সটিটিউট, যার পরামর্শক কমিটিতে ছিলেন ফার্মা’স লাষ্ট থিওরোমের সমাধানদাতা এ্যান্ড্রু উইলস।
জর্জ ফ্রেডারিখ বার্নার্ড রিম্যান
গনিতের সব শাখা নিয়ে সাতটি সেরা প্রবলেম বাছাই করা হয়, ২০০০ সালের ২৪শে মে মহা ধুমধামের সাথে শত খানেক টিভি ক্যামেরার সামনে সেই সাতটি প্রবলেম পেশ করা হয়, যার একটি নামও দেয়া হয় “মিলেনিয়াম প্রবলেম” দেখুন ক্লে ম্যাথমেটিকস ইন্সটিটিউট এর ওয়েব সাইটে মিলেনিয়াম প্রবলেম (Millennium Problems )। হিলবার্টের সেই ২৩ টি ধাঁধা থেকে মাত্র একটি আনসলভ ধাঁধা এখানে স্থান পায় নিজ গুনেই কারন ওই একটি ধাঁধা আজ পর্যন্ত কেউ সমাধান করতে পারে নি। ২০০০ সালে প্রস্তাবিত সাতটি ধাঁধার সমাধানে যে কেউ পাবেন ১ মিলিয়ন ডলার করে। তো আজকে চলুন সেই বিখ্যাত রিম্যান হাইপোথিসিস নিয়ে জেনে আসি। প্রবলেম টা কিন্তু খুব একটা কঠিন না, কঠিন যেটুকু....... সেটুকু পোষ্টের শেষে আপনাকে সমাধান করতে হবে এবং সেক্ষেত্রে ১ মিলিয়ন ডলার নগদ প্রাপ্তি। আপাতত চলুন এই রিম্যান হাইপোথিসিসটা কি জেনে নেই। তার আগে -
১৭৪০ সালে লিওনার্ড অয়েলার গনিতের একটা ফাংশান নিয়ে কাজ শুরু করেন। ব্যাপারটার পোষাকি নাম “জিটা ফাংশান”। ভয় পাবার কিছুই নাই এটা স্রেফ একটা নাম আসলে পানির মত সোজা। জিটা ফাংশান হল – (আমি দুঃখিত এই খানে কিভাবে গনিতের এই সংখ্যাগুলো টাইপ করে লিখতে হয় আমি জানি না তাই হাতে লিখে ছবি আকারে ইনসার্ট করে দিলাম।)
এই যে ফর্মুলা, যা চলছে অসীমের দিকে মানে যোগফল এসেছে ওই নিয়মের পর পর সংখ্যা এসে, আয়েলার ভাবছিলেন এই সিরিজে অসীম সংখ্যার যোগফল কি হবে, ভাবতে গিয়ে আর একটা অদ্ভুত সম্পর্ক আবিস্কার করেন (আবারো দুঃখিত গনিতের এই সংখ্যাগুলো টাইপ করে কিভাবে লিখতে হয় আমি জানি না তাই হাতে লিখে ছবি আকারে ইনসার্ট করে দিলাম।)
এক অদ্ভুত সম্পর্ক কতগুলো জিনিসের যোগফল হয়ে যাচ্ছে অন্য কিছু জিনিসের গুনফল। সব আবার নিয়ম মেনে। যোগফল গুলো হয়ে যাচ্ছে অন্য কিছু সংখ্যার গুনফল। যোগফলের সংখ্যাগুলো ১,২,৩,৪,৫,৬…… সিরিয়াল নাম্বার দিয়ে গড়া আর এর সমান সমান অন্য দিকে যে সংখ্যাগুলো আসছে সেগুলো কিছু সংখ্যার গুনফল ২,৩,৫,৭,১১……. যা কিনা মৌলিক সংখ্যা। ভারী অদ্ভুত এক ব্যাপার।
পেছনের দিকের একটু কথা বলে নেই, মৌলিক সংখ্যা নিয়ে কারো কোন ধারনা থাকলে সে জানেন এই মৌলিক সংখ্যা যেমন ২,৩,৫,৭,১১,১৩……… নিয়ে গবেষনার শেষ নাই। সব থেকে বড় মৌলিক সংখ্যা কোনটি? এক থেকে এক লাখের মাঝে কয়টি মৌলিক সংখ্যা থাকতে পারে? সংখ্যারাশির মধ্যে মৌলিক সংখ্যার কি কোন নিয়ম আছে? আজ পর্যন্ত এ রকম অসংখ্য প্রশ্নের জবাব গনিতজ্ঞরা দিতে পারে নি। তাই মৌলিক সংখ্যা একটা রহস্য হয়ে এখনো অনেক কিছু অধরা হয়ে আছে এই আধুনিক সুপার কম্প্যুটারের যুগেও। এ যেন গনিত ফ্যামিলির উচ্ছৃঙ্খল ছেলে যে কিনা ধরা বাধা নিয়মের মাঝে থাকতে অভ্যস্থ না।
তো অয়েলার জিটা ফাংশানের মাধ্যমে আপাত উচ্ছৃঙ্খল মৌলিক রাশির মাধ্যমে একটা সুপ্ত নিয়মের দেখা পেলেন। এটাই অয়েলারের জিটা ফাংশান। এই পর্যায়ে নাটকে আবির্ভাব জর্জ ফ্রেডারিখ বার্নার্ড রিম্যানের। জার্মান এই গনিতজ্ঞের জন্ম ১৮২৬ সালে হ্যানোভারের ব্রেসলেনৎজ শহরে। ছয় ভাই বোনের মাঝে রিম্যান ছোট বেলা থেকেই কিছুটা লাজুক। রিম্যান কোন দিন স্কুল কলেজে মেধাবী ছাত্র হিসাবে পরিচিত ছিলেন না। লাতিন গ্রামারও যেমন বুজতেন না তেমনি নিজ মাতৃভাষা জার্মানেও ছিলেন অপটু। ছত্রিশ বছর বয়সে নিজ বোনের বান্ধবী এলিস কখ কে বিয়ে করেন। ১৮৬৬ সালে মারা যান এই গনিতজ্ঞ বয়স তখন মাত্র ৪০। এই স্বল্পায়ু সময়ের মধ্যে একটা বিষয়েই তি স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করতেন সেটা হল গনিত। ১৮৫৯ সালে মাত্র দশ পৃষ্ঠার একটি পেপার লিখেন “উবের ডাই আনঝালে ডার প্রিমঝালেন উনটের ইনের গেগবেনেন গ্রসে” বাংলায় মানে দাড়ায় “নির্দিষ্ট মানের কম মৌলিক সংখ্যা” রিম্যান হাইপোথিসের জন্ম ওই পেপার থেকেই।
রিম্যান অয়েলারের জিটা ফাংশানে x এর জায়গায় পূর্ন সংখ্যার বদলে “জটিল সংখ্যা” বসিয়ে ফাংশানটার মান বের করার চেষ্টা করেন। এখানে আবার গনিতে “জটিল সংখ্যা” কথাটির একটু ব্যাখ্যা দিতে হয় না হলে অনেকেরই প্রশ্ন থেকে যাবে।
ইতালির ইঞ্জিনিয়ার রাফায়েল বামবিনো ষোড়শ শতাব্দীতে অনেক কাজ করেন ঋনাত্মক সংখ্যার বর্গমুল নিয়ে। যেমন ১ এর বর্গমুল হল “+১” এবং “-১” কারন
+১ X +১ = ১
-১ X -১ = ১
কিন্তু -১ এর বর্গমুল কত? √(-১) ? বলা অসম্ভব। কিন্তু বমবেলি দেখলেন গনিতের বিভিন্ন হিসাব নিকাষে এই অবাস্তব জিনিসটা বার বার উকি দিচ্ছে, এবং ওটার অস্তিত্ব অস্বীকার করলে অনেক হিসাবই করা সম্ভব না। তাই তিনি গননার সুবিধার্থে √(-১) কে ওভাবেই রেখে দিলেন, মান যাই হোক না কেন। বাস্তবে এই √(-১) এর অস্তিত্ব অসম্ভব। তাই বমবেলি এর নাম দিলেন “ইমাজিনারি নাম্বার” বাংলায় যাকে বলে “অবাস্তব সংখ্যা” এর সাংকেতিক চিহ্ন ইংরেজী ছোট হাতের “আই” (i) যেমন ২i, ৩i, ৪i, ৫i মানে হল ২√(-১) , ৩ √(-১), ৪√(-১), ৫√(-১) এখানে একটা ব্যাপার বলে রাখা ভাল, এই অবাস্তব সংখ্যা যতই অবাস্তব হোক না কেন বাস্তব জীবনে কিন্তু এর গুরুত্ব অপরিসীম এ্যারোনোটিকস থেকে শুরু করে সেল ফোন সব জায়গায় এই অবাস্তব সংখ্যা ছাড়া অচল। জটিল সংখ্যা হল বাস্তব এবং অবাস্তব সংখ্যার মিশ্রন। তাদের চরিত্র আলাদা তাই তারা মিশে এক হয়ে যেতে পারে না। থাকে পাশাপাশি। যেমন (২+৩i), (৭+১১i), (১৭+২৩i)..... এক কথায় (a+bi); a এবং b এর মান যা খুশী তাই হতে পারে।
অয়েলারের জিটা ফাংশানে এ x এর জায়গায় জটিল সংখ্যা বসিয়ে রিম্যান যা পেলেন তা অনেকটা নিম্নরূপঃ
এটাকেই বলে “রিম্যান জিটা ফাংশান” রিম্যান একাধিক জটিল সংখ্যা ওই ফাংশানে বসিয়ে তার মান বের করেন, আর তাতেই লক্ষ্য করেন এই আজব ব্যাপার। জটিল সংখ্যা a+bi এর মধ্যে যদি a এর মান ½ হয় অর্থ্যাৎ সংখ্যাটি যদি ১/২ + bi (b এর মান যা খুশী তাই) তাহলে রিম্যান পরীক্ষা করে দেখলেন ফাংশানটির মান শুন্য “০” হয়। রিম্যান বেশ অবাকই হলেন। রিম্যান অনুমান করলেন (১/২ + bi) এই চেহারার সব জটিল সংখ্যা ব্যাবহার করলে মান শুন্য। b মান যা খুশী তাই বসান সেটা পূর্ন সংখ্যা হতে পারে (১,২,৩,৪…..) অথবা ভগ্নাংশ হতে পারে (২/৫, ৭/১১, ১৯/২০, ৫০১৩/৫৫২৯…..) তো এই সংখ্যার শেষ নাই। সংখ্যা সব অগন্য। তাই [(১/২) + bi)] চেহারার জটিল সংখ্যা গুনে শেষ করা যাবে না। তো সব ক্ষেত্রেই এই রিম্যান জিটা ফাংশানের মান শুন্য? হ্যা সব ক্ষেত্রেই এই ফাংশানের মান শুন্য।
রিম্যান এই ফাংশানে জটিল সংখ্যা বসিয়ে সবার মান পেলেন শুন্য। রিম্যান তো মান বের করেই খালাস, কিন্তু কেন এই মান শুন্য হবে তা কিন্তু বুজতে পারলেন না তার এক সহকর্মীকে কার্ল ওয়াইয়ারষ্ট্রস কে চিঠি লিখলেনঃ " জটিল সংখ্যার মান [(১/২) + bi)] চেহারার হলে জিটা ফাংশানের মান হবে শুন্য, তবে এর একটা নিশ্চিদ্র প্রমান অবশ্যই কাম্য। ইতিমধ্যে একটু এদিক ওদিক ব্যার্থ চেষ্টা করার পর তেমন প্রমানে পৌছানোর কাজটা আমি সাময়িকভাবে সরিয়ে রেখেছি। কারন আমার গবেষনার পরবর্তী বিষয় ছিল অন্য দিকে।”
বন্ধুকে লেখা এই চিঠির মুল মন্তব্য থেকে জন্ম নিয়েছে রিম্যান হাইপোথিসিস। যার মুল কথাঃ [(১/২) + bi)] চেহারার সমস্ত জটিল নাম্বারের ক্ষেত্রে জিটা ফাংশানের মান শুন্য। এটাই রিমানের অনুমান বা হাইপোথিসিস। রিম্যান বা তারপর আজ পর্যন্ত কেউ যুক্তি দিয়ে বা অংক কষে দেখাতে পারেনি কেন এই জিটা ফাংশানের মান শুন্য হবে? আর হয়নি বলেই রিম্যান হাইপোথিসিস আজ পর্যন্ত অংকের ইতিহাসে “মোষ্ট ওয়ান্টেড”। এ যেন অনেকটা ফার্মা’স লাষ্ট থিওরম বা এফ এল টির মত (দেখুন পিথাগোরিয়ান ট্রিপল এবং ফার্মার লাষ্ট থিওরম সাড়ে তিন শতাব্দীর রহস্যর সমাধান )। এর আগে আমার একটা পোষ্ট ফার্মার লাষ্ট থিওরোম নিয়ে দিয়েছিলাম তাতে দেখিয়েছিলাম ঘাত ২ এর জায়গায় ৩ হলেই আর দুই লাইনের সুত্র মিলছে না যা প্রায় সাড়ে তিনশত বছর পর এই সেদিন স্যার এন্ড্রু উইলস কেন মিলছে না তা প্রায় ২০০ পৃষ্ঠার এক গনিত বিশ্লেষান দ্ধারা প্রমান করে অমর হয়ে গিয়েছেন।
এখন প্রশ্ন আসতে পারে এই রিম্যান হাইপোথিসিস প্রমান করা এত জরুরী কেন? জরুরী এই কারনে যদি এই হাইপোথিসিস প্রমান করা যায় সত্যি তবে কোন সংখ্যার নীচে কতগুলো মৌলিক সংখ্যা আছে তা বের করা যাবে যেমন ১০০ এর নীচে মৌলিক সংখ্যা কেন ২৫ টি বা ১০০,০০০,০০০ এর নীচে মৌলিক সংখ্যা কেন ৫৭,৬১,৪৫৫ টি তার নিয়ম জানা যাবে অথবা সব থেকে বড় মৌলিক সংখ্যা কত হবে তাও বের করা সম্ভব হবে যা আজ পর্যন্ত জানা অসম্ভব এই সুপার কম্প্যুটারের যুগেও।
তাহলে সবই তো জানলেন এখন কেউ কি একবার চেষ্টা করবেন কেন রিম্যান জিটা ফাংশনের মান শুন্য হয়? নিশ্চিত ওয়ান মিলিয়ন ডলার আয়।
আরো জানতে চাইলে দেখুন