দারুন সচেতনতা চলছে সারা জাতির মধ্যে। রাজনীতি থেকে শুরু করে ধর্মনীতি বা স্বাস্থ্যনীতিতে আমরা সর্বদাই সচেতনতার উদাহরন তৈরী করে চলছি। কানাডা থেকে একটা বাচ্চা মেয়ে দেশে আসছে, বয়স বোধহয় চব্বিশ (নিউজ পেপারে তো তাই দেখলাম)। মেয়েটা পেটে ব্যাথা নিয়ে মোহাম্মদপুর একটা ক্লিনিক ভর্তি হয়ে সেখান থেকে দেশের সব থেকে ভালো মেডিকেল ঢাকা মেডিকেলের কোন এক ওয়ার্ডে ভর্তি হয়। এক পর্যায়ে ওয়ার্ড নার্সরা জানতে পারে মেয়েটি কানাডা থেকে ফেরত এবং গায়ে জ্বরও আছে। ব্যাস আর যায় কোথায়? চিল্লা পাল্লা করে ওয়ার্ড তো ওয়ার্ড পুরা মেডিকেল নার্সরা মাথায় তুলে ফেলে কেউ আর সচেতনতার জন্য মেয়েটির কাছে যায় না, যখন কোন এক ডাক্তার গেল ততক্ষনে মেয়েটি সমস্ত চিকিৎসার উর্ধ্বে চলে গেছে। মাত্র চব্বিশ বছর বয়স। মৃত্যুর পরে অবশ্য তার রক্ত পরীক্ষা করে দেখা গেল তার করোনা নেগেটিভ। কি নিদারুন সচেতনতা আমাদের!
বিদেশ থেকে যাত্রী আসলেই তাদেরকে হাজী ক্যাম্পে কোয়ারেন্টাইনে রাখা হচ্ছে। পত্রিকায় ছবি দেখলাম একটা গন রুমের মত কিছু যেখানে ফ্লোরে একটা তোষক এবং মশারী টানিয়ে বিদেশ ফেরত মুলতঃ ইউরোপ থেকে আগত যাত্রীদের সেখানে কোয়ারান্টাইন করা হচ্ছে। দারুন সচেতনতা। আচ্ছা এদের মাঝে যদি কারো করোনা থেকে থাকে তবে কি ঐ মশারী দিয়ে করোনা আটকানো যাবে? অবশ্য বিদেশ থেকে আসার সময় এদের জ্বর চেক করে বিমানে উঠায় ঐটাই যা বাচোয়া, কিন্তু এদের কারো যদি করোনা থেকে থাকে তবে হাজী ক্যাম্পে তার সাথে যারা কোয়ারেন্টাইনে থাকবে তারা কিভাবে ইনফেকটেড হবে না তার গ্যারান্টি কি? তবে ভালো লাগছে ইউরোপ আমেরিকার চিকিৎসা সেবা নিয়ে দেশে এসে একই সাথে তারা তুলনা করে দেখতে পারছে যে আমরাও কত সচেতন এবং জাতির জন্য উদ্বিগ্ন!!!
বাসা থেকে বের হয়ে মোড়ের দোকানে চা খেতে যাচ্ছিলাম, প্রায়ই যেমন যাই আর কি, আমার আবার এই করোনা ফরোনার ভয় একটু কম, যেতে যেতে অন্তত দুই জন ওয়াক থু বলে ছ্যাপ ফেলল, একজনের টা অল্পের জন্য আমার পা মিস করছে। ভালো লাগছে মানুষটা অনেক সচেতন ছ্যাপ ফেলে হাতের উল্টা দিক দিয়ে মুখটা মুছে ফেলছে।
চা খেতে গেলে আমাকে দোকানী গরম পানি দিয়েই চায়ের কাপটা ধুয়ে দেয়, যদিও সবার জন্য এই ভি আই পি সুবিধা নেই, অল্প কিছু স্থানীয় খদ্দেরদেরই এই সুবিধা দেয়া হয়, বাকীদের ঠান্ডা পানিতে (সে পানিও অনেক সময় কাপ ধুতে ধুতে ঘোলা হয়ে যায়) কাপটা এক চুবানী দিয়ে গরম চা ঢেলে আন্তরিকতার সাথেই পরিবেশন করে।
আমি আমার চায়ের কাপটা নিয়ে একটু দূরে গিয়ে সুড়ুৎ সুড়ুৎ টানে চা খাচ্ছিলাম, এক মাঝেই দেখলাম একজন সর্দিক্রান্ত একটু সরে দাঁড়িয়ে বাম হাতের বুড়ো আঙ্গুল এবং তর্জনীর মাধ্যমে নাকটা চেপে ধরে ফড়াৎ করে এক গাদা নাকের ছ্যাৎ (শুদ্ধ ভাষায় সর্দি) ঝেড়ে হাতটাকে লুঙ্গিতে মুছে তার চায়ের কাপটা ধরে সবাইকে সচেতন এবং পরিস্কার পরিচ্ছন্ন থাকার উপদেশ দিল এই করোনা থেকে বাচার জন্য। আমি বেশ মুগ্ধ এই লোকটার সচেতনতায়।
দোকানেই একজনকে দেখলাম সম্ভবতঃ দু এক দিনের পুরানো খবরের কাগজ উল্টাচ্ছে আর চা খাচ্ছে তাতে প্রায় দেখলাম সাড়ে তিন হাজার হোম কোয়ারেন্টাইনে থাকার জন্য নির্দেশ দেয়া হয়েছে, আজকে সকালে কোন পত্রিকা না টিভির কোন চ্যানেলে দেখলাম এই সব হোম কোয়ারেন্টাইনে রাখা তিনজনকে ফোন দিলে তাদের একজন বাজার থেকে বাজার করা রত অবস্থায় ফোন ধরছে, একজন এলাকায় ঘুরাঘুরি করছে (স্বাভাবিক ভাবেই অনেক দিন পর বিদেশ থেকে আসলে যা হয় আর কি, এটাও কিন্তু সচেতনতা) আর একজন জানি কি অবস্থায় ছিল খেয়াল নাই, এই হল হোম কোয়ারেন্টাইনের কাহিনী।
আমার চা খাওয়া শেষ, দোকানিকে টাকা দিতে গেলে নিজের কপালের ঘামটুকু ঝেড়ে টাকা নিয়ে আমাকে তার ক্যাশ বাক্স থেকে টাকা দিল। আমি পাচশত টাকার নোট দিয়েছিলাম, কারন এক কাপ চা আর পাচটা সিগারেট সব মিলিয়ে বিল আসছে ৭০ টাকা আমি ফেরত পাব ৪৩০ টাকা, দোকানি মিলন ভাই সেই ৪৩০ টাকা গুনতে গিয়ে দুই বার ডান হাতের বুড়ো আঙ্গুলে জিহ্বা বের করে ছ্যাপ দিয়ে ভিজিয়ে অবশেষে আমাকে টাকা ফেরত দিল। আমি তার কাছ থেকে আমার সিগারেট আর টাকা ফেরত নিয়ে নিশ্চিত মনে একটা সিগারেট ধরিয়ে বাসায় ফেরত যাবার পথ ধরলাম।
এত দিন ধরে যে সব প্রবাসীরা দেশে আসছে তাদের অনেকেরই কোয়ারেন্টিনকাল নিশ্চয়ই শেষ হয়ে গেছে, আমি আশা করি সবাই কর্তৃপক্ষের যথাযথ নির্দেশ মেনেই চলছিলো, ঝামেলা বাধালো আজকের আর একটা নিউজে তিন জন নতুন করে করোনা আক্রান্ত এরা নাকি কোন প্রবাসীর স্ত্রী এবং তার বাচ্চা, কি ঝামেলা বলুন তো দেখি? যত দোষ নন্দ ঘোষদের মত করোনা মানেই আমাদের ধারনা প্রবাসীদের দ্ধারা আমদানী কৃত।
সচেতনতা দেখিয়ে আজকে স্কুল কলেজ বন্ধ দিয়ে দেয়া হয়েছে। সবাই এখন জীবন বাচাতে ছুটবে নিজের উৎসে মানে গ্রামে বা নিজ মফঃস্বল শহরে। যেন ওখানে যেতে পারলেই বাচোয়া। তবে বাচোয়া না হোক শান্তি অবশ্যই আছে এই ঢাকা শহরের তুলনায়। আচ্ছা এই মানুষ গুলোর মাঝে যারা নিজ এলাকায় ফেরত যাবে কেউ তো করোনা আক্রান্ত না! স্থানীয় ভাবে চেক করার কোন সিষ্টেম আছে? ইতালী, স্পেন তো এক শহর থেকে আর এক শহরে যাওয়া নিষিদ্ধ।
প্রযুক্তির গর্বে উন্মাতাল বিশ্ব এখন নিজেকে কিভাবে এক ঘরে করে রাখবে তার প্রতিযোগিতা চলছে, আমরা কিছুটা ধীরে হলেও সেই ফ্যাশানে সামিল হচ্ছি করোনার করুনাধারা পাবার জন্য। সমানে বন্ধ হয়ে যাচ্ছে ছোট ছোট কল কারখানা গুলো। আজকে দেখলাম পোষাক শিল্প মালিকদের কি একটা সংগঠনের সভাপতি যেন সরকারের কাছে ঋন চাচ্ছে আগামী তিন মাস যেন তারা কাজ না থাকলেও কর্মচারীদের বেতন দিতে পারে। সব জায়গায় ছ্যাপাক্রান্ত সচেতনতা।
ঢাকা মেডিকেলে যে মেয়েটা মারা গেছে নাজমা তার নাম। অতি অল্প বয়স মাত্র ২৪ ফুটফুটে মায়াবী চেহারা। আমাদের অতি সচেতনতায় করোনা না হয়েও জীবন হারালো (দেখুন যে কারণে প্রাণ হারালেন কানাডা ফেরত শিক্ষার্থী)। আবার যখন এই করোনা আঘাত হানবে (আল্লাহ মাফ করুক) তখন অসচেতনতায় যে কত জীবন যাবে তার কোন পরিসংখ্যান আমাদের হাতে থাকবে না। কেন জানি আমার ভীষন হাসি পাচ্ছে, অবশ্য আমাদের কাছে হাসি আর কান্নার মাঝে পার্থক্য কিন্তু এক চুল।
আচ্ছা বিভিন্ন জেলা উপজেলায় নাকি করোনা ইনফেক্টেড রোগীদের জন্য আলাদা হাসপাতাল খোলা হয়েছে কিন্তু যারা চিকিৎসা দেবে তারা মানে সেই সব ডাক্তার বা নার্স রা কি প্রস্তত চিকিৎসা দেবার জন্য? মানসিক বা প্রফেশান গত ভাবে? জিনিসপত্রের দাম উর্ধ্বমুখী, স্বাভাবিক জীবন বজায় রাখতে খুব কষ্ট হচ্ছে, কার কাছে অভিযোগ জানাব একটু জানালে কৃতজ্ঞ থাকব।
করোনার একটা বিষয় আমার খুব ভালো লাগছে তা হল সাম্যতা। ধনী, গরীব, রিক্সাওয়ালা, প্লেনের ড্রাইভার, গ্লোরিয়া জিনসের কফিশপ বা আমাদের মিলন ভাইদের চায়ের দোকান এই গুলো আলাদাভাবে সনাক্ত করতে পারে না, তাই অনেকটা নিশ্চিত আছি অন্তত বৈষম্যের শিকার হব না। আচ্ছা হাল্কা জ্বর, হাচি, কাশি এগুলো কি করোনার উপসর্গ? ব্লগের মাধ্যমে ছড়ানোর চান্স আছে? সেক্ষেত্রে……… আজকে বিকাল থেকে নিজের কেমন যেন………. এই ব্লগারের ব্লগ পাঠ থেকে দূরে থাকার জন্য সবাইকে সতর্ক করা হল।
সর্বশেষ এডিট : ১৬ ই মার্চ, ২০২০ রাত ৯:৫১