গোপাল কৃষ্ণা গোখলে একদা বলেছিলেন, “যা বাঙ্গালী আজকে ভাবে ইন্ডিয়া ভাবে পরদিন”। কথাটা একটু ঘুরিয়ে বললে কি অন্যায় হবে “যা এই দেশের সাধারন মানুষ আজকে ভাবে দায়িত্বশীলরা ভাবে দুই মাস পর।” দুই মাস আগে থেকেই সরকারী সংস্থা (আইইডিসিআর) প্রধান মীরজাদী সেব্রিনা ফ্লোরার নাম এবং চেহারার সাথে পরিচিতি লাভ করছি। একই সাথে অভয়ও পেয়েছি উনার শান্তশিষ্ট মুখভঙ্গিতে প্রেস ব্রিফিং এর মাধ্যমে। সব কিছু আন্ডার কন্ট্রোল এই টাইপের বক্তব্যে জাতি অশেষ সাহসের সাথে অতি স্বাভাবিক ভাবে যার যার কর্মযজ্ঞ করে গেছে। একই সাথে নিশ্চয়তা পেয়েছিলাম বিভিন্ন মন্ত্রী মহোদয়দের অভয়বানীতে আর যাই হোক এই দেশে করোনা আসবে না।
দুই মাস না হোক এই ব্লগের মাস খানেক আগে কিছু ব্লগ খুজলেই পাওয়া যাবে যারা লিখছিলো এই দেশে করোনা আসলে কপালে দুঃখ আছে। সেই দুঃখ এসে গেছে। অফিশিয়ালি দুই জন মারা গেছে আর চব্বিশ জন আক্রান্ত হয়েছে। এবং করোনা ছড়ায় জ্যামিতিক হারে।
জিনিসপত্রের দাম বেড়ে যাবে বলে অনেক আগে থেকেই ভবিষ্যতবানী করা হয়েছিল। ঠিক সেই কথাটিই এখন বাস্তবে এসে গেছে। (দেখুন করোনা সচেতনতার পাশাপাশি আমাদের দরকার) চালের দাম বেড়ে গেছে, সেটা যে কারনেই হোক আর কারন যে খুব একটা অন্যায় তাও মনে হয় না, কারন যদি কোন শহর লক ডাউন হয়ে যায় স্বাভাবিক ভাবেই দাম বেড়ে যাবে। না এটা শুধু আমাদের মানসিকতা না, এ মানসিকতা সারা বিশ্বের। তো আমাদের দোষ দিয়ে লাভ কি? এগুলো বড় কোন ব্যাপার না, এগুলো সাধারন বিষয়। কারন এই ধরনের মহামারীতে এটা অতি স্বাভাবিক।
আমার কাছে অস্বাভাবিক যেটা মনে হয় সেটা হল গত দুই মাস মীরজাদী যতটা অভয় দিয়েছেন, সেই অনুযায়ী কি কাজ করছেন? কোথায় জানি একটা ঘটনা পড়ছিলাম, সত্যি মিথ্যা জানি না, ঘটনাটা এমন, কেউ একজন খুব সম্ভবতঃ মহানবীর সাথে দেখা করতে আসছে, এসে বলল, “হে নবী আমি আপনার সাথে দেখা করতে আসছি।” নবী বললেন, “ভালো কথা তা তোমার উটটা কি করছ?”
“আমি আল্লাহর ওপর ভরসা করে উটটা বাইরে ছেড়ে রেখে আসেছি?” লোকটি বিশাল বিশ্বাসের সাথে বলল।
আল্লাহর নবী স্মিত হেসে বলল “আল্লাহর ওপর অবশ্যই ভরসা রাখবে, কিন্তু উটটা বেঁধে রেখে আসা উচিত ছিল, বিশ্বাসের সাথে কাজটাও করতে হবে।” শেষ পর্যন্ত উটের কি হয়েছিল সে ঘটনা আমার মনে নেই, এটাও মনে নেই এই ঘটনা কোথায় পড়ছিলাম না শুনছিলাম।
যাই হোক, মাননীয়া মীরজাদী থেকে মাননীয় দায়িত্বশীলদের মুখের কথায় আমরা বিশ্বাস করে বসেছিলাম, অবশ্য এর বাইরে আমাদের করারই বা কি আছে? তো বিপদ যখন ঘাড়ের ওপর এসেই গেল দেখলাম কোন হাসপাতালে ডাক্তার নার্স কারো পিপিই (পার্সোনাল প্রটেকটিভ ইক্যুইপমেন্ট) নেই। জোড়াতালি দিয়ে নাকি পিপিই নামে কিছু জিনিস দেশে তৈরী হচ্ছে। পিপিই এত সহজ জিনিস না। সেক্ষেত্রে এর মুল্য থাকত না। বিভিন্ন পত্র পত্রিকায় নিশ্চয়ই দেখছেন কিভাবে পিপিই পরে আছে যারা বিদেশে চিকিৎসা দিচ্ছে। এই দুইটা মাসে কি প্রতিদিন আমাদের অভয় দেয়ার পাশাপাশি বিদেশ থেকে পিপিই আনা খুব কঠিন কিছু ছিল?
ডাক্তারদের পিপিই আমার কাছে ফার্ষ্ট প্রায়োরিটি। সেখানে আজকে পত্রিকায় দেখলাম মিডফোর্ড হাসপাতালে মাস্ক সরবরাহ সম্ভব না, আবার কয়েক ঘন্টা পরই ঘোষনা আসল মাস্কের কোন অসুবিধা নাই, (দেখুন সম্পদ স্বল্পতায় সকলকে মাস্ক দেওয়া যাচ্ছে না: মিটফোর্ড হাসপাতাল পরিচালক ) কোনটা সঠিক ধরে নেব? আবার দেখুন এই করোনায় মনে হয় একটা মাস্ক দিয়েই সব প্রটেকশান হয়ে যাবে! বাস্তবতা হল মাস্ক কোন ব্যাপারই না, বায়োহ্যাজার্ড ডিসপোজাবেল স্যুট সহ সারা দেহ ইনক্লুডিং চোখের গগলসই পারে একটা মানুষ কে থিওরিটিক্যালি যথাযথ প্রটেকশান দিতে। আছে কি সে প্রটেকশানের ব্যাবস্থা? অধিকাংশ স্থানে চিকিৎসা সেবা ভয়াবহ আঁকার ধারন করছে, সিজন চেঞ্জ হচ্ছে স্বাভাবিক ভাবেই সর্দি, কাশির প্রকোপ। সর্প ভ্রমে রজ্জু দশায় ডাক্তাররা এখন সাধারন সর্দি, কাশির চিকিৎসাও দিচ্ছে না। সর্বোচ্চ প্রস্তুতির নিদর্শন। (দেখুন খুলনায় দুজনের মৃত্যু নিয়ে উৎকণ্ঠা)
গত দুই মাস মীরজাদীর অভয় বানীতে মনে করছিলাম কাজ হয়ে যাবে, সেখানে ভয়াবহ ব্যাপার হল দুই মাসেও হাতে এই রোগ নির্নয়ের কীট আসে নাই, এখন শুনি সিঙ্গাপুর কিছু দেবে, চায়না কিছু দেবে দয়া করে। আর কি দয়ার দানের ওপর এখনো আছি, করোনা নির্নয়ের কীট কি এতই অমূল্য যে গত দুই মাসেও দেশে আসল না? দয়ার দান হিসাবে যা আসবে তা কতটুকু আমাদের মত সাধারন পর্যন্ত পৌছাবে? অবশ্য মাননীয় অর্থমন্ত্রী এর মাঝেই বলে দিয়েছেন করোনার চিকিৎসায় প্রয়োজনে চীনের মতো হাসপাতাল: অর্থমন্ত্রী প্রশ্ন হল সেই প্রয়োজনটা কবে হবে? যাই হোক উনারা বিজ্ঞ মানুষ নিশ্চয়ই উনাদের প্রয়োজন বুজবেন।
ডাক্তারদের কথা বাদ দেই, পাবলিক ট্রান্সপোর্ট গুলোতে যারা দায়িত্ব পালন করছেন, ধরেন বাসের কন্ট্রাক্টর বা ট্রেন লঞ্চের টিকিট চেকার, কেবিন বয় এদের নিরাপত্তা দেবার জন্য নির্দেশনা কি? আচ্ছা কোর্টে, আদালতে যে সব আইনজীবি বা ম্যাজিষ্ট্রেট দায়িত্ব পালন করছেন তাদের নিরাপত্তা কি? কোর্ট কাচারী গেলে দেখবেন, গিজ গিজে মানুষ কাকে বলে? অবশ্য ওখানে না গিয়েও তো উপায় নেই। ব্যাঙ্কের কর্মচারীরা এক খানা মাস্ক নাকের আগায় লাগিয়ে পাব্লিক ডীল করে মনে হয় মাস্কের মাধ্যমে করোনা ঠেকাবে ওদিকে হাতে যে টাকা গুনতে গিয়ে হাজারো জীবানু লাগিয়ে ফেলছে (আশা রাখি তার মাঝে করোনা ভাইরাস নাই) তার কি হবে? আর সাধারন পুলিশদের কর্মকর্তা থেকে কনেষ্টবলরা তো সারাদিন পাব্লিক সংস্পর্শে থাকে তারা কতটা নিরাপদে আছে?
এগুলো বর্তমান সমস্যা। একটু সামনের দিকে তাকান। পাচ ছয় লাখ প্রবাসী দেশে এসেছেন গত দুই মাসে (দেখুন দু’মাসে দেশে ফিরেছে সোয়া ৬ লাখ), এরা আপাতত আর বিদেশে যেতে পারছেন না, মানে এদের পাঠানো বৈদিশিক মুদ্রা যেমন আমরা হারাচ্ছি, তেমনি এই ভয়াবহ পরিস্থিতিতে তারা দেশেও খুব বেশি কিছু করতে পারবেনা। করোনার কারনে যেখানে প্রচুর ছোট খাট গার্মেন্টস এবং ইন্ডাষ্ট্রি বন্ধের হুমকির মুখে সেখানে দেশে আসা প্রবাসীদের এই চাপ পরিস্থিতি আরো খারাপ করে দেবে নির্ধিদ্ধায়।
এই দেশের বিরাট একটা অংশের মানুষ দিন আনে দিন খায়, এই যে লক ডাউনের ভয়, বা স্কুল কলেজ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান পূর্ন আংশিক বন্ধ হওয়ায় এই সব প্রান্তিক আয়ের মানুষ গুলোর পরিবার কি খাবে? স্বাভাবিক অবস্থাতেই তাদের হিমশিম খেতে হত, এখন তাদের কি হবে? এক বারো ভাবছেন? এই পরিস্থিতি যদি আরো দুই তিন মাস চলে তবে মধ্যবিত্তের অবস্থা কি হবে? না আমি ভাবতে চাই না, ভাবার দায়িত্বও আমার না। আমি আমার পরিবার নিয়ে ভাবি, এই ধরনের পরিস্থিতিতে মানুষ বড় স্বার্থপর হয়ে যায়। গ্যাষ্ট্রিকের সমস্যা আছে আমার "প্যান্টোনিক্স ২০" খাই। ১০ টার ষ্ট্রিপ কিনতাম ৭০ টাকা, আজকে কিনতে গেছি বলে ৮৪ টাকা। আরো ওষুধ কিনতে হয় নিজের জন্য, নিজের মায়ের জন্য, নিশ্চিত তার দামও বেড়ে গেছে। তবে কি ওষুধ খাব না? চাল কেজি প্রতি ৫/৭ টাকা বেড়ে গেছে।
রিক্সাওয়ালা, বা নিম্ন মধ্যবিত্তরা কি ভাত খাবে না? অবশ্য না খেয়েও ৮/১০ দিন বেচে থাকতে পারবে, তার পর? সেই ৮/১০ দিন পর? যদি আগামী দুই তিন মাস এই অবস্থা বিরাজ করলে আমরা মধ্যবিত্তরা কি ভাবে বাচব? আমেরিকায় নাকি আগামী তিন চার মাস বাড়ী ভাড়া না দেবার জন্য আন্দোলন তৈরী হচ্ছে, আমাদের দেশে তো আন্দোলন করার উপায় নেই। আন্দোলন অনেক আগেই হিমাগারে গেছে। কিভাবে কি হবে?
আজকে না হয় মাস্ক পরে বীর বাঙ্গালী করোনা প্রতিরোধ করল অথবা মীরজাদী সেব্রিনার অভয়বানীতে বুক বেঁধে করোনাকে দেখে নিলাম, কিন্তু এক মাস, দুই মাস, তিন মাস বা চার মাস এই পরিস্থিতি থাকে তবে দায়িত্বশীলরা কি জানবেন, কি হবে? নাকি তখন আমাদের শুনতে হবে, ইউরোপ আমেরিকায় রিসেশান বা অর্থনৈতিক মন্দা চলছে সে তুলনায় আমরা অনেক ভালো আছি এ অবস্থায় সপ্তাহে এক দিন খেয়ে থাকার উপদেশও কি শুনতে হবে?
করোনার কারনে উচ্চবিত্তদের মৃত্যুভয় দেখা দিয়েছে, মধ্যবিত্তদের আতংক কিন্তু নিম্নবিত্তদের? তাদের ভাত খেয়ে থাকাটাই এখন বড় চিন্তা, এদের জন্য তখন হয়ত এই ব্লগেই সহায়তার জন্য ফান্ড হবে, কিন্তু সে ফান্ডে কয়জনকে কয়বেলা খাওয়াবেন? আর এটা তো আপনার আমার দায়িত্ব না। যাদের দায়িত্ব তারা কি ভাবছেন?
করোনা হলে বুজতেও পারব না, কারন আমাদের করোনা ভাইরাস নির্নয় কীট নেই, চিকিৎসা তো অনেক পরে। সাধারন সর্দি কাশি নিওমোনিয়া হলেও মারা যাওয়া এখন স্বাভাবিক কারন সাধারন চিকিৎসা না পেলে নিওমোনিয়াও মারাত্মক অষুখ। কিন্তু এগুলো থেকে বেচে থাকার পর পেটের ক্ষুধা কিভাবে নিবারন করব সামনের দিন গুলোতে? কেউ কি বলবেন?
লেখাটা কি খুব নিম্ন শ্রেনীর হয়ে গেল? কিছুই যায় আসে না, বাস্তবতা এর থেকেও নিষ্ঠুর। আপনি হয়ত বিদেশে থেকে ভালো আছেন, কিন্তু এই দেশেই আপনার আত্মীয় পরিজন পরিচিতরা থাকে।