১.
"স্বপ্ন" বা "ড্রিম" এর সংজ্ঞা একেক মানুষের কাছে একেক রকম। কারো কাছে নোটের প্রাসাদে জমকালো জীবন যাপনের নাম স্বপ্ন, কারো স্বপ্ন প্রিয় কথা বলা মানুষটিকে চিরজীবনের জন্য কাছে টেনে নেওয়া। ছোটবেলার স্বপ্ন ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার হওয়া। বড়বেলার স্বপ্ন কোনমতে একটা চাকরি করে সংসার চালানো।
উল্লেখিত প্রতিটি স্বপ্নই আমার কাছে খুবই স্বল্পস্থায়ী বাসনা বলে মনে হয়। এই পোস্টে আমি যা বলছি তা কেবলই আমার নিতান্তই ব্যক্তিগত ধারণা। অনেকেই এর সাথে একমত হবে না আমি জানি। তাদেরকে আগেই বলে রাখছি, আমি আপনাদের ভুল বলছি না। কেবলই নিজের মনের ভাব প্রকাশ করছি।
২.
স্কুলে রচনা লেখা শুরু করি ক্লাস টুতে গরু রচনার মধ্য দিয়ে। একসময় স্যারের নোট মুখস্ত করে লিখে ফেললাম "মাই এইম ইন লাইফ"। সবার মত আমার টাও এসে দাড়ালো ডাক্তারের স্টেটেস্কোপ আর ইঞ্জিনিয়ারের টুল বক্সে। প্রথম যখন উপলব্ধি করা শুরু করলাম স্বপ্ন বলে কিছু একটা থাকা দরকার, তখন দেখলাম আমার সে স্বপ্ন নির্ধারণের দায়িত্ব নিয়েছে পিতা-মাতা। সন্তানের ভালো ভবিষ্যতের কথা চিন্তা করে আমার উপরও চাপিয়ে দেয়া হয়েছিল ডাক্তার-ইঞ্জিনিয়ার হবার গুরু দায়িত্ব। কিন্তু, তাদের কথা গুলো কখনই আমার মনে দাগ কাটেনি।
৩.
মাধ্যমিক শ্রেণীতে উঠার পর ইংরেজি স্যারের বাসায় পড়তে গিয়ে স্বপ্নের নতুন সংজ্ঞা জানতে পারলাম। তৃতীয় বেঞ্চে বসা মায়াবী চোখের এক কিশোরীর প্রতি হৃদয়ের উষ্ণ অনুভূতি দেখা দিল। পরক্ষণেই জানতে পারলাম, সে দলে আমি একা নই। অর্ধেক ছেলেই তার হৃদয়ে আশার-ভালোবাসার বীজ বপনের চেষ্টা চালাচ্ছে। যথেষ্ট ইচ্ছা থাকা সত্ত্বেও সে জমিতে আর সার ঢাললাম না। কিছুদিন পর আমার এক বন্ধু এসে জানালো, মেয়েটি আমার পড়াশোনা আর রেজাল্টে খুব মুগ্ধ। কয়েক রাত্রি তাহার সহিত বার্তালাপের পর সে জানতে চাইল আমার ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা কি? সে জানালো ডাক্তার ছেলে ছাড়া তার বাপ তাকে বিয়ে দিবে না। যথারীতি আমি আবারো সেই ডাক্তার ইঞ্জিনিয়ারের ক্লিসে স্বপ্নের বাজারে ফিরে এলাম।
এক বন্ধু বলল, তোর মত ভালো ছাত্র তো এক পলকেই ডাক্তার হয়ে যাবে। মেয়েটাকে হাত ছাড়া করিস না। তাছাড়া ডাক্তার হওয়াটাও তো অনেক সম্মানের। কিন্তু, তার এ কথা আমার মনে দাগ কাটলো না। অনেক টাকা, সুন্দরী জীবনসঙ্গী, জনমানুষের সম্মান আমাকে আকৃষ্ট করল না।
৪.
এ পর্যায়ে পাঠক হৃদয়ে হয়তো বা দুচিন্তা দানা বাধাঁ শুরু করেছে। ভাবছেন, জগতের বুকে এমন নির্লিপ্সু এ কোন বান্দা?
আসলে আমি হচ্ছি সবচেয়ে বড় স্বপ্ন লিপ্সু। স্বপ্নটা ঠিক করার আগে হাজার বার চিন্তা করেছি, এর শেষ ফলটা কি হবে? এর প্রভাব কতদূর পড়বে?
আমার মতে, মানুষের সব থেকে বড় স্বপ্ন হওয়া উচিত অমরত্বের স্বাদ লাভ করা। কিন্তু, সমস্যা হচ্ছে ছোট আমাদের এ জীবনটাতো অল্পতেই শেষ হয়ে যাবে। কি বা করার আছে? আসলেই সংসার করে আপনি সুখী থাকতে পারবেন। ডাক্তার-ইঞ্জিনিয়ার হয়ে আপনি সম্মান লাভ করবেন। কিন্তু, সেটা কতদিন? আপনার নাম দিকে দিকে রটবে। আপনার মৃত্যুর পর সন্তানরা আপনার নামে মিলাদ পড়াবে। তাদের সন্তানরা দাদার কৃতিত্বে গর্ব বোধ করবে। তারপর একসময়, আপনার নাতি নাতনিদের মৃত্যুর সাথে সাথে আপনার নাম চিরতরে মুছে যাবে। আপনি আসলে সে দিনই মারা গেলেন। কারণ কেউ আর কোনদিন আপনার নাম বলবে না ।
কিন্তু, একবার চিন্তা করে দেখুন লেনিন, কার্ল মাকর্স, নিউটন, আইনস্টাইন, গ্যালিলিও, আব্রাহাম লিংকন, চে গুয়েভারা, সিদ্ধার্থ গৌতম বুদ্ধ, মুহম্মদ (স.) এর কথা পৃথিবীর শেষ দিন পর্যন্ত বিশ্ববাসী স্মরণ করবে। আসলে তাদের কারো মৃত্যু এখনো হয়নি। তারা এখনও অমর। কারণ, তারা নিজের জীবনের তুচ্ছ সুখ শান্তি ত্যাগ করে শ্রম দিয়েছিলেন মাতৃভূমি আর জ্ঞানের সৌন্দর্যমন্ডায়নে।
স্বপ্ন বলে যদি কিছু থাকে, আমার মতে সেটা এরকম মহৎ হওয়াই উচিত। যদি বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে চিন্তুা করি, আমাদের সবথেকে ভালো ছাত্ররা লেখাপড়া শেষ করে বিদেশে চলে যাচ্ছে চাকরির জন্য। তারপর কোনদিন তারা সেদেশে মহৎ কিছু করলে পরিচিতি পাচ্ছে বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত মার্কিন নাগরিক হিসেবে। কিছুদিন কেটে যাবার পর বিদেশী নাগরিকরা তাদের এই ভিনদেশী জ্ঞানীর আর কদর করবে না। আর আমরা তার পদচুম্বন করতে চাইলেও সে সৌভাগ্য আমাদের কোনদিনই হবে না। এ দেশ তার দেখা আর কোনদিনই পাবে না।
যারা দেশে থেকে চাকরী করছেন, তাদের অধিকাংশরই স্বপ্ন মাল্টিন্যাশনাল কোম্পানীর বেনিয়া হওয়া। কারণ, তাতেই তো এ গরীব দেশে আভিজাত্য। ভাগ্য প্রসন্ন হলে কোন রাত্রিকালীন পার্টিতে পরিচয়ের সুবাধে মডেল কন্যাও ঘরের বউ হয়ে আসতে পারে।
আপনার স্বপ্ন যদি এত ছোট হয় তাহলে কিছু দিনের মধ্যেই তা পূরণ করে আপনি স্বপ্নহীন এক মানুষে পরিণত হবেন। অন্যদিকে আপনার যদি ইচ্ছা থাকে নিজের শেষ বিন্দু দিয়ে হলেও কেবল এই বিশ্বের মানুষের জন্য কাজ করে যাবেন, কোন সম্মান-অর্থ-প্রতিপত্তি না পেলেও আপনার কোন অসুবিধা নেই; তাহলে দেখবেন আপনি কত বড় স্বপ্নচারী।
৫.
জীবনে আপনার লক্ষ্য যদি হয় অন্যকে দেয়া, তাহলে দেখবেন আপনি কোনদিনই হতাশ হবেন না। একসময় এসে উপলব্ধিও করবেন আপনি অনেক কিছূই পেয়েছেন। কিছুদিন আগেই দেখলাম দেশের বেশ কিছু মেধাবী ইঞ্জিনিয়ার বিদেশের মোহ ত্যাগ করে বাপেক্সে যোগ দিয়েছে। দিনরাত কাজ করে যাচ্ছে দেশের সম্পদ আরোহণের জন্য। গর্বে তাদের জন্য বুকটা ভরে উঠল। চাইলেই তারা আরামদায়ক জীবন বেছে নিতে পারত। কিন্তু, তারা বেছে নিয়েছে আরো সুখকর কিছু।
মকসুদুল আমান নামক বাংলার এক জিনগবেষক একের পর এক সফলতার পরিচয় দিয়ে যাচ্ছেন। পাটের পর আবিষ্কার করলেন ছাত্রকের জীবন রহস্য (জিনোম সিকোয়েন্স)। দেশের জন্য করা এ গবেষণার জন্য নির্ধারিত ৬কোটি টাকা সম্মানির একটা পয়সাও তিনি নিলেন না । কারণ, তার স্বপ্নই ছিল এমন কিছু করবেন যাতে করে বিশ্বের সামনে দেশের নামটা বড় করে লেখা থাকে। ছোট হরফে মকসুদুলের নামটা না থাকলেও তিনি মন খারাপ করবেন না। তিনি কি পেলেন এ থেকে? যা পেয়েছেন তা ঐ ৬কোটি টাকা থেকে ঢের বেশী। এর নাম অমরত্ব। এদেশের মানুষ তাকে শেষদিন পর্যন্ত স্মরণ করবে।
মাতৃভূমির জন্য জীবন দেয়ার থেকে বড় অমরত্ব লাভের পন্থা আর জানা নেই। গ্রীকদের আক্রমণ থেকে মাতৃভূমিকে বাচাতে গিয়ে জীবন দিয়েছিলেন ট্রোজান বীর হেক্টর। তার বদান্যতা বিশ্ববাসী আজো করে। ভিন্ জগতে যদি কেউ থেকে থাকে, এবং আপনি যদি কোনদিন তার দেখা পান তাহলে দেখবেন... সে বলে উঠবে ,"ও তুমি হেক্টরের গ্রহের বাসিন্দা?" হ্যা! আমার হেক্টরের গ্রহ, তার সময়ের বাসিন্দা। কারণ হেক্টর তার জীবনের বিনিময়ে ঢের দামী কিছু কিনে নিয়েছে।
তাই, ভাই আপনাকে বলছি। জীবনটা এত তুচ্ছ না। চাইলেই আপনি তাকে অনেক বড় করে তুলতে পারেন। কেবল মাত্র যদি সংসার ধর্ম পালনকে নিজ জীবনের প্রধান ব্রত করে না তোলেন। নিজে দিয়ে যান, অন্যের কাছ থেকে আশা করুণ অনেক অল্প। দেখবেন খুশি আছেন। ছোট অপ্রাপ্তিতে আপনি নিরাশ হবেন না। নিজেকে নিয়োজিত করুণ এমন কাজে যাতে আপনার থেকে দেশের উন্নতি বেশী হবে। নিজের নামটা থেকে দেশের নামটা বড় হবে। দেখবেন কোনদিন আপনি ছোট হবেন না। সবাই একদিন বলবে "আমরা ঐ জমানার মানুষ যে জমানায় আপনি থাকতেন"।
আসুন, একটু ভিন্ন স্বপ্ন দেখতে চেষ্টা করি। স্বার্থপরতার এ জীবন ত্যাগ করি। স্বার্থপরতার দরজার ওপাশেই আছে এক মহা পুরস্কার। তার নাম অমরত্ব। তাকে গ্রহণ কর!! তাকে গ্রহণ কর!!
সর্বশেষ এডিট : ১৮ ই জুন, ২০১৪ দুপুর ২:০৫

অনুগ্রহ করে অপেক্ষা করুন। ছবি আটো ইন্সার্ট হবে।



