somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

ছায়াশিল্প ভাস্কর আমানুল হক

০৫ ই নভেম্বর, ২০১৩ রাত ১০:৩৭
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :




শুচি সৈয়দ

’’স্মৃতিতম্ভ গড়ে ওঠে
কবরের ’পর,
প্রতিভাবানেরা শুধু
জানে সে খবর’’

প্রয়াত বাঙালির বিবেক শওকত ওসমান উপরে উদ্ধৃত পঙক্তিমালা লিখে তাঁর একটি কবিতার বই উপহার দিয়েছিলেন শিল্পী আমানুল হককে। ওই পঙক্তিমালার নিচে গদ্যে যে শব্দমালা লেখা ছিল তাতে তিনি আমানুল হককে ’আলোকচিত্রশিল্পাচার্য’ বলে অভিহিত করেছিলেন। লেখা ছিল, যতদূর মনে পড়ে, ’ছায়াশিল্প ভাস্কর’ বলেও। আমি সেই বিশেষণ সমূহ ভেদ করে মানুষ আমানুল হককে উদ্ধারের চেষ্টা করি ভয়ে ভয়ে।
তাঁকে সামনাসামনি দেখি ১৯৮৮তে। খুব শৈশবে আব্বার মুখে শুনতাম তাঁর কথা। জানতাম আমাদের এক চাচা আছেন যিনি বিশ্বখ্যাত চলচিচত্রকার সত্যজিৎ রায়ের স্নেহধন্য। তখন স্বাধীনতার পরপর ’বেতার বাংলা’, ’শাপলা শালুক’ পত্রিকায় শিসার ব্লকে ’আমারদেশ চিত্রমালা’র ছবি ছাপা হত, ক্যাপশনের সঙ্গে ছাপা আমানুল হকের নাম দেখিয়ে আব্বা বলতেন শিল্পী তাঁর চাচাতো ভাই। একধরনের গৌরব বোধ করতাম। সেই গৌরবের সামনাসামনি দাঁড়াবার সাহস সেদিনও পাইনি কারণ জানতাম ছোটখাটো হালকাপাতলা লিকলিকে শরীরের মানুষটি অসম্ভব রাশভারী। তাঁর ছিল আলাদা জগত। সেই জগতে ঢোকা দুঃসাধ্য ছিল বটে! আব্বা যত সহজে বলতেন, আমার চাচাতো ভাই। আমি কিন্তু তত সহজে কখনওই বলতাম না আমার কাকা এত সহজ এত অনায়াস তাঁকে আমার মনে হত না যদিও আমি জানি প্রথম দিন থেকেই আমি তাঁর মনে অনায়াস প্রবেশাধিকার পেয়েছিলাম তবে সেই প্রবেশাধিকারের মর্যাদা রাখাও ছিল বেশ কষ্টসাধ্য।

কেমন কেমন করে আলোকচিত্রী নাসির আলী মামুন জেনেছিলেন যে আমানুল হক আমার কাকা। যাকে বলে জোঁকের মত ধরা, তেমনই আমাকে ধরে বসলেন তিনি। তিনি যত ধরেন, আমি তত পিছলাই, তাকে নিরুৎসাহিত করি, বলি, সামান্য ঘটনায় তাকে অসামান্য পরিস্থিতির সম্মুখীন হতে হবে ইত্যাদি ইত্যাদি। কিন্তু তার ধনুর্ভঙ্গ পণ ! সব সামলাবেন তিনি। আমাকে শুধু নিয়ে যেতে হবে। তার নাছোড়বান্দা জেদ। আমানুল হক তখন থাকেন মহাখালীতে আরেক কাকার বাসায়। নাসির আলী মামুনের সঙ্গে তাঁর ক্যামেরা, ভিডিও ক্যামেরা, টেপ রেকর্ডার সব। পরিচয়ের পর কথা শুরুর আগেই তাঁর নিষেধাজ্ঞা, কোনও ছবি তোলা যাবেনা, ভিডিও করা যাবেনা...প্রভৃতি। নাসির আলী মামুন সুবোধ বালকের মত সব শর্ত মেনে নেন। কথাবার্তা শুরু হয়, পাঁচ মিনিটও হয়নি কাকা বলেন, ’মামুন ক্যামেরা বন্ধ করুন!’ আমি স্তম্ভিত!! কখন মামুন ভাই ক্যামেরা চালু করে দিয়েছেন আমি জানতে বা বুঝতেও পারিনি... অথচ...! মামুন ভাই লজ্জা পান। এরপরে আর কথা আগায়নি। কিছুক্ষণ পর তাঁর হাতে বানানো চা খেয়ে আমরা চলে এসেছিলাম। ভাগ্যিস মামুন ভাইকে আমি আগেই নিরুৎসাহিত করে রেখেছিলাম। ফলে তার সঙ্গে আমার কোন ভুল বোঝাবুঝি হয়নি। এমনকি আমি ধারণা করি, নাসির আলী মামুনও তাঁকে ভুল বোঝেননি। তাঁর খেপামি বা স্বাতন্ত্র্যকে উপলব্ধি করেছেন।
চট্টগ্রাম থেকে প্রকাশিত প্রথমশ্রেণীর দৈনিক পূর্বকোণের আনোয়ার হোসেন পিন্টু সত্যজিৎ রায়ের আরেকভক্ত। সত্যজিৎ রাযকে নিয়ে একটি স্মারকগ্রন্থ বের করবেন। সম্ভবত শিল্পী মোমিন উদ্দীন খালেদের কাছ থেকে জেনেছেন। ধরলেন আমাকে, তাকে আমানুল হকের কাছে নিয়ে যেতে হবে। আমি একই ভাবে তাকে নিবৃত করার চেষ্টা করি কিন্তু সেও আরেক নাছোড়বান্দা চরিত্র। পিন্টু ভাই সম্ভবত কিছুটা সফল হয়েছিলেন তাঁকে উদ্দীপিত করতে। এই হচ্ছে বাইরে থেকে দেখা প্রচার বিমুখ, নিভৃতচারী শিল্পী আমানুল হক।
’আমারদেশ চিত্রমালা’র এই শিল্পীকবির ভেতরটা ছিল প্রকৃত শিশুর মত সরল। যাঁরা তাঁর সাহচর্যে গেছেন তারা স্বীকার করবেন উপভোগ্য ছিল তাঁর আলাপআড্ডা। ’আমারদেশ চিত্রমালা’র ছবি তোলার জন্য মাসের পর মাস গ্রামে থাকতেন আজীবন শুচিবায়ুগ্রস্ত এই ছোট্ট লিকলিকে শরীরের মানুষটি কিভাবে তা ভাবতেও বিস্ময় লাগে আমার! ১৯৮৮র বন্যার সময় ছবি তুলতে গিয়ে নিজেই খবর হয়ে যাবার উপক্রম হয়েছিলেন। এরকম একজন মানুষের বুকের ভেতর একটুকরো ঠাঁই পাওয়া বেশ কঠিন কিন্তু তার বুকের ভেতর পুরো বাংলাদেশটাই জুড়ে রয়েছিলো। তাই উনিশ শ’ বায়ান্নোয় তরুণ বয়সে যেমন জীবনমৃত্যু তুচ্ছ করে বক্স ক্যামেরায় শাদাকালো ফিল্মে ভাষা আন্দোলনের শহীদদের ইতিহাস লিখেছিলেন তেমনই জীবনের শেষ প্রান্তে আবারও জেগে ওঠা বাংলার তারুণ্যকে তিনি প্রত্যক্ষ করেছেন, করেছেন ক্যামেরা বন্দি অসুস্থ শরীরে। শাহবাগের জাগরণ মঞ্চে তরুণেরা যখন স্লোগানে স্লোগানে ৫৫ হাজার বর্গমাইলে বিস্তৃত তখন দেখেছি যেন পুনর্জীবন পেয়েছেন শিল্পী আলোকচিত্রী আমানুল হক। আবার জ্বলে উঠেছে তাঁর ক্যামেরার ফ্ল্যাশ বাংলাদেশের তারুণ্যকে উদ্ভাসিত করতে!

এলিফেন্ট রোডে যখন তিনি তার ছোট বোন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রফেসর আয়শা বেগমের বাসায় থাকতেন তখন একদিন একটি শাদাকালো ছবি দেখিয়েছিলেন, ৭ মার্চ ১৯৭১ এর জনসভার। ছবিটিতে জনসভায় আসা একজনের হাতের লাঠি দেখিয়ে প্রশ্ন করেছিলেন, ’দেখতো এই লাঠিটি চিনতে পারো কিনা?’ আমি, অপু, ফুপু সবাই অবাক ! লাঠি তো লাঠিই, তাও আবার জনসভার লাঠি, সেটিতে চেনার কি আছে আলাদা করে? ’আছে!’ আমানুল হক বললেন, দেখ এটা বাঁশ বা শক্ত কোনও গাছের ডাল কেটে বানানো লাঠি নয়। এটা একটা গাদাফুল গাছ উপড়ে বানানো লাঠি! একমুহূর্তে এক লহমায় আমরা অভিভূত হয়ে পড়েছিলাম সেদিন কি আশ্চর্য এক স্থির আলোকচিত্র শিল্পী! কি গভীর ভালোবাসায়, কি গভীর মর্মবেদনায় তিনি তার দেশের মানুষের অনুভূতিকে ক্যামেরার শাটার টিপে শাদাকালো ফিল্মে ধারণ করেছিলেন। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের সেই অবিনশ্বর ভাষণ ’’যার যা কিছু আছে, তাই নিয়ে শত্র“র মোকাবিলা কর’’ যে তাঁর দেশবাসীর মনে কি গভীর উদ্দীপনা জাগিয়েছিল, স্বপ্ন জাগিয়েছিল, জাগিয়েছিল স্বাধীনতার স্পৃহা তা আমার মত এক অতিসাধারণ তরুণের পক্ষে উপলব্ধি করা সম্ভব হতো না কোনদিনই যদি আমানুল হকের ছবিতে গাদা ফুলের গাছ উপড়ানো লাঠি তিনি নিজে না চিনিয়ে দিতেন।
এই হচ্ছে তাঁর ভেতরটা। পরম যতেœ যেখানে তার দেশ, দেশের মানুষ। তাঁর তোলা স্থির চিত্র, চিত্র নয়, এই বাংলার বাঙ্ময় ইতিহাস!
০টি মন্তব্য ০টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

ইন্টেরিম সরকারের শেষদিন : গঠিত হতে যাচ্ছে বিপ্লবী সরকার ?

লিখেছেন সৈয়দ কুতুব, ২০ শে ডিসেম্বর, ২০২৫ রাত ১২:২২


ইরাক, লিবিয়া ও সিরিয়াকে ব্যর্থ রাষ্ট্রে পরিণত করার আন্তঃদেশীয় প্রকল্পটা সফল হতে অনেক দিন লেগে গিয়েছিল। বাংলাদেশে সে তুলনায় সংশ্লিষ্ট শক্তিসমূহের সফলতা স্বল্প সময়ে অনেক ভালো। এটা বিস্ময়কর ব্যাপার, ‘রাষ্ট্র’... ...বাকিটুকু পড়ুন

বিচার চাই? না ভাই, আমরা "উল্লাস" চাই

লিখেছেন মাথা পাগলা, ২০ শে ডিসেম্বর, ২০২৫ রাত ১:৩৭





দীপু চন্দ্র দাস একটি পোশাক শিল্প কারখানায় চাকরি করতো। সম্প্রতি দীপু দাস তার যোগ্যতা বলে সুপার ভাইজার পদে প্রমোশন পেয়েছিলো।

জানা যায়, সুপারভাইজার পজিশনটির জন্য আরও তিনজন প্রতিদ্বন্দ্বী ছিলো... ...বাকিটুকু পড়ুন

মব সন্ত্রাস, আগুন ও ব্লাসফেমি: হেরে যাচ্ছে বাংলাদেশ?

লিখেছেন শ্রাবণধারা, ২০ শে ডিসেম্বর, ২০২৫ রাত ৩:৫২


ময়মনসিংহে হিন্দু সম্প্রদায়ের একজন মানুষকে ধর্মীয় কটূক্তির অভিযোগে পুড়িয়ে মারা হয়েছে। মধ্যযুগীয় এই ঘটনা এই বার্তা দেয় যে, জঙ্গিরা মবতন্ত্রের মাধ্যমে ব্লাসফেমি ও শরিয়া কার্যকর করে ফেলেছে। এখন তারই... ...বাকিটুকু পড়ুন

তৌহিদি জনতার নামে মব সন্ত্রাস

লিখেছেন কিরকুট, ২০ শে ডিসেম্বর, ২০২৫ সকাল ১১:৫৪




ছবিঃ অনলাইন থেকে সংগৃহীত।


দেশের বিভিন্ন স্থানে সাম্প্রতিক সময়ে ধর্মের নাম ব্যবহার করে সংঘটিত দলবদ্ধ সহিংসতার ঘটনা নতুন করে উদ্বেগ সৃষ্টি করেছে। বিশেষ করে তৌহিদি জনতা পরিচয়ে সংঘবদ্ধ হয়ে... ...বাকিটুকু পড়ুন

মুখ গুজে রাখা সুশীল সমাজের তরে ,,,,,,,,

লিখেছেন ডঃ এম এ আলী, ২০ শে ডিসেম্বর, ২০২৫ বিকাল ৪:০৫


দুর্যোগ যখন নামে আকাশে বাতাশে আগুনের ধোঁয়া জমে
রাস্তা জুড়ে কখনো নীরবতা কখনো উত্তাল প্রতিবাদের ঢেউ
এই শহরের শিক্ষিত হৃদয়গুলো কি তখনও নিশ্চুপ থাকে
নাকি জ্বলে ওঠে তাদের চোখের ভেতর নাগরিক বজ্র
কেউ কেও... ...বাকিটুকু পড়ুন

×