১ মিনিট। হ্যাঁ, ১ মিনিটই সব ধ্বংস করে দেবার জন্য যথেষ্ট আবার এই ১ মিনিটই মুছে দিতে পারে সব যন্ত্রণা। ১ মিনিটের জন্য ট্রেন টা মিস হয়ে যেতে পারে আবার এই ১ মিনিটেই মিলে যেতে পারে সেই অংকের সমাধান যার জন্য করা হয়েছে দীর্ঘকাল অপেক্ষা।
এয়ারপোর্ট থেকে আমি সরাসরি হোটেল টুইলাইটে গিয়ে ঠাই নিলাম। আগের থেকেই ১২৩ নম্বর রুমটা বুকিং দিয়ে রেখেছিলাম। ১২৩ নম্বর রুম আমার অবসেশন, যেকোন হোটেল রুম বুকিং এর ক্ষেত্রে ১২৩ নম্বর রুমটাই আমার অগ্রাধিকার পায়।
আমি একজন গোস্ট রাইটার। হ্যাঁ আমার লেখা বই অন্যেরা নিজেদের নাম দিয়ে চালায়। আমি এনোনিমাস হয়ে থেকে গেলেও অর্থের পরিমাণ যেটা পাই তা দিয়ে বেশ ভালোই চলে যায় আমার । তাই আফসোস একেবারে করিনা বললেই চলে। এবার আমি সিদ্ধান্ত নিয়েছি একটা বই লিখবো, না গোস্ট রাইটার হয়ে নয়। এমন একটা বই লিখবো যে বইয়ের কভারেই বড় করে আমার নাম লেখা থাকবে। হয়তোবা টাইটেলের চেয়েও বড় , অনেক বড় । এই হোটেলে আগেও আমি এসেছি তখন ১২৪ নম্বর রুমখানা আমার ভাগ্যে জুটেছিল । ১২৩ নম্বর রুমে যে ভদ্রলোক তখন থেকেছিলেন উনি গত মাসে হার্ট এটাকে মারা গেছেন। উনার সাথে আমার এই হোটেল রুমেই পরিচয় হয়েছিল এবং দৈনিক যোগাযোগও হতো। মৃত্যুর তিন দিন আগেও উনি আমাকে ফোন করেছিলেন আর আমি পরবর্তিতে যেদিন উনাকে ফোন করেছিলাম সেদিন ফোন অন্য কেউ ধরেছিল।
চার কাপ কফি শেষ করেও আমি গল্পের প্রথম শব্দটা খুঁজে পেলাম না। খুব স্ট্রাগ্লিং সিচুয়েশান এটা। যাদের লেখার কিংবা গান বাঁধার অথবা ঘর গোছানোর অভ্যাস আছে তারা বেশ ভালো করেই ব্যাপারটা বুঝবেন। না আজ আর হচ্ছে না, মনে হয় না আর হবে। এর থেকে ঘুমিয়ে যাই। একটা ভালো ঘুম দিতে পারে একটা ভালো কন্সেপ্ট , গ্রহণযোগ্য আইডিয়া। কিন্তু অতিরিক্ত কফির প্রভাবে ঘুমটার একেবারে ১২ টা বেজে গেছে। রাত ২ টা বেজে ১৩ মিনিট, তাও ঘুম এলো না। তাই হোটেলের বারান্দায় কিছুক্ষণ খালি পায়ে হাঁটার সিদ্ধান্ত নিলাম। স্বভাবতই সবাই ঘুমে। চারিদিক বেশ নীরব, শোনা যাচ্ছে শুধু থেকে থেকে প্যাঁচার বিহ্বল করা শব্দ আর কুকুরের ঘেউ ঘেউ । এই সেই ভুতুড়ে পরিবেশ যা আমি সবসময় খুঁজি, কোলাহলে তা পাওয়া অসম্ভব।
বেশ কিছুক্ষণ অতিক্রান্ত হলেও এ ধরণের ভূতুড়ে পরিবেশ আমায় একটা শব্দ সন্ধানে সাহায্য করতে পারলো না। হঠাৎ সিঁড়িতে বেশ ভারী একজোড়া বুটের শব্দ শোনা গেল। হ্যাঁ নিঃসন্দেহে কেউ সিঁড়ি বেয়ে এদিকে উঠে আসছে। কেন জানি মনে হচ্ছিল স্বর্গের কোন দূত আমার সাহায্যার্থে এগিয়ে আসছেন। দৃশ্যমান হল একজন বেটে গড়নের লোক, বেশ বেটে। স্বর্গের দূত যে বেঁটে হবে না এমন তো কোন কথাও নেই । আমার সামনে এসে দাঁড়ালেন আর ডান হাতটা হস্তকম্পনের জন্য এগিয়ে দিয়ে নিজের পরিচয় দিলেন
-হাই, আমি ডাঃ নিতিশ রঞ্জন।
– অঞ্জন, অঞ্জন চৌধুরী। নাইস টু মিট ইউ।
– ১২৩?
– হ্যাঁ!! কি করে বুঝলেন?
– দরজাটা এখনো খোলা, আমি ১২৪।
-এতো রাতে?
-হ্যাঁ ঐ পাশের আদিবাসি পাড়ায় গিয়েছিলাম। আজ পূর্নিমার রাত। প্রতি পূর্নিমার রাতে ওরা উৎসব করে এখানে। পাশাপাশি একটা পানীয় তৈরী করে যার মাদকতা সত্যিই খুব অদ্ভুত, খুব চমৎকার। একবার চেখে দেখবেন নাকি?
– অবশ্যই দেখা যেত যদি আমার মদ্য পানের অভ্যাস থাকতো।
– হাহাহা, কি মানের ডাক্তার আমি বুঝেছেন তো? আপনাকে মদের স্বাদ নেবার জন্য প্ররোচিত করছি।
– আরে তেমন কিছুই করেননি আপনি। পুরোটাই আমার ইচ্ছের ব্যাপার। এখন নিশ্চই ঘুমোতে যাবেন?
– এইতো মিনিট ১৫ বিথোভেন শুনতে শুনতে স্নান করবো তারপর সুগন্ধি আতর মেখে স্বপ্নের প্রস্তুতি নেব। লোকটা আমি বুড়ো আর খাটো হলেও আমার চাহিদা খুব বেশি। এখনো আমার ভেতর সেই ১৮ বছরের যুবকটিই বাস করছে।
– হ্যাঁ বেশ প্রাণ আছে আপনাতে। এখনো বেশ চঞ্চল প্রকৃতির রয়ে গেছেন দেখে বোঝা যাচ্ছে।
একটা হাঁসি দিয়ে আমায় শুভরাত্রি জানালেন তারপর বিথোভেনের ফার এলিসের সুরে শিস বাজিয়ে নিজের ঘরে প্রবেশ করে গেলেন। আমি আমার হাঁটা আমি অব্যাহত রাখলাম।
শব্দ না খুঁজে পেয়ে আমি ঘরে প্রবেশ করে আবারো একটু ঘুমাবার চেষ্টা করলাম। মিনিট পাঁচেক পর হঠাৎ রুমের ইন্টারকম টা বেজে উঠলো। এখন রাত ৩;১২, এতো রাতে ফোন আসার কারণটা স্বাভাবিক হবে না তা আগেই বুঝতে পারলাম। ওপার থেকে ফোনে একজন মহিলার কন্ঠ শোনা যাচ্ছে।
-স্যার আপনার পাশের রুম থেকে কমপ্লেইন এসেছে। আপনি দয়া করে দেয়ালে পেরেক ঠোকা বন্ধ করুন। এখন রাত প্রায় সোয়া তিনটা।
আমি একটু হতচকিয়ে উঠলাম।
-পেরেক?? কিসের পেরেক?? কে পেরেক ঠুকছে?
– স্যার এটা কি ১২৩ নম্বর রুম নয়?
-হ্যাঁ , ১২৩ নম্বর রুম।
– হ্যাঁ স্যার দয়া করে পেরেক ঠোকা বন্ধ করুন।
– আপনি কি বুঝতে পারছেন না যে আমি দেয়ালে কোন পেরেক ঠুকছি না?
– স্যার আপনার পাশের রুম থেকে বারবার অভিযোগ দেয়া হচ্ছে। দয়া করে পেরেক ঠোকা বন্ধ করুন।
আমি ব্যাপারটায় বেশ তাজ্জব হলাম। ফোনটা রাখার ১ মিনিট পর আমার দরজায় টোকার আওয়াজ শুনতে পেলাম । দরজা খুলে দেখি সেই বেটে ভদ্রলোকটা ।
-সরি মিস্টার চৌধুরী একদমই ঘুমোতে পারছিলাম না তাই একটা অভিনব কৌশলে আপনার ঘুম ভাঙ্গানোর চেষ্টা করলাম আরকি।
-না আমি ঘুমাচ্ছিলাম না তবে আপনি এমনিতেই আমার দরজায় টোকা দিতে পারতেন খামখা বানোয়াট অভিযোগ করার কোন প্রয়োজন ছিল না।
-হ্যাঁ হ্যাঁ আমি জানি। আমি দুঃখিত , রাগ করবেন না দয়া করে। আমি কি ভেতরে আসতে পারি?
-হ্যাঁ হ্যাঁ আসুন না।
-এটা একটি ইজি চেয়ার নয় কি? বেশ আরামদায়ক এক বিশেষ ধরণের কেদারা এটা। চিন্তায় , নস্টালজিয়া উপভোগে কিংবা এ ধরণের একটা ইজি চেয়ারে বসেই হতে পারে একটা নিখুঁত খুনের পরিকল্পনা।
-আপনার শব্দগুলো শুনেই বোঝা যাচ্ছে যে আপনি একজন সাইকিএট্রিস্ট নয়তোবা একজন অটোপ্সি স্পেশালিস্ট।
-ভুল ধরলেন। আমি একজন হৃদরোগ বিশেষজ্ঞ তবে এটা নিঃসন্দেহে বলতে পারি যে আমি রহস্য ঘেরা কথা বলতে খুব পছন্দ করি।
নিজের ছোট দেহটা ঐ বিশাল একটা চেয়ারে খুব অনায়াসেই এটে গেল ভদ্রলোকের। তারপর চোখ বন্ধ করে ইজি চেয়ারটা নিয়ে খেলতে শুরু করলেন। একবার উবু হয়ে চেয়ারটাকে হেলাচ্ছেন তো আরেকবার সিলিং এর দিকে মাথা তুলে। তবে চোখ তার দু ধরণের কসরতেই বন্ধ অবস্থায় আছে। হঠাতই থেমে গেলেন। আর আমার দিকে বড় বড় চোখ করে তাকিয়ে চেঁচিয়ে উঠলেন
Stop all the clocks, cut off the telephone,
Prevent the dog from barking with a juicy bone,
Silence the pianos and with muffled drum
Bring out the coffin, let the mourners come.
বেশ রাগান্বিত কন্ঠে কয়েকটা শব্দ বলেই পরমূহুর্তে হেসে উঠলেন উনি। জানেন এটা কার কবিতা?
-ডাব্লিউ এইচ অউডেন?? ফিউনারেল ব্লুজ?
-হাহাহা।। বন্ধু খুশি করে দিলে এই প্রভাতে তুমি আমায় । একদম ঠিক বলেছ। তোমার আমার জমবে ভালো। হয়ে যাবে নাকি এক এক পেগ?
-না আমি…
-ও হ্যাঁ আপনি তো আবার মদ্য পানে অভ্যস্ত নন।
-একদম তাই। ধন্যবাদ।
-আচ্ছা আপনার কি মনে হয়?? আলেকজান্ডার কে বিষ প্রয়োগে মারা হয়েছিল নাকি ম্যালেরিয়ায় ধুকেই উনে মরেছিলেন?
-সে যাই হোক হয়তোবাঁ সেলুকাসের সিংহাসনে আরোহনের পন্থাই ছিল ওটা। একজনের মৃত্যু আরেকজনের অর্জন।
-‘কন্সিকুয়েন্সেস’। খুব ভালো বলেছ বন্ধু আমার । মৃত্যুটা আর ২ বছর পরে হলে হয়তো সেলুকাস সিংহাসনে আরোহনের অভিজ্ঞতা অর্জন করতে পারতো না। জানো বন্ধু আমাদের এই আলাপচারিতারও একটা কন্সিকিউন্স আছে।
-কি সেটা?
-কে জানে?? তবে আছে এটা নিশ্চত। তাই নয় কি?
-থাকতেই হবে, এটাই নিয়ম।
-সময় এই কন্সিকুয়েন্সগুলো তৈরী করছে নিজের অস্তিত্ত্ব টিকিয়ে রাখতে। ঘটনার সমাপ্তি মানে সময়েরো সমাপ্তি। তাই নয় কি?
-হ্যাঁ তাই, হয়তোবা তাই।
-গতকাল স্বপ্নে কি দেখলে? তোমার তিলোত্তমার শাড়ির রঙ কি ছিল?
-সেটা তো আমার মনে নেই।
-আমার তিলোত্তমার শাড়ির রঙ সোনালী ছিল । কিন্তু কি অদ্ভুত ব্যাপার জানো?
-কি?
-তিলোত্তমাকে আমি এখন পর্যন্ত না ঠিক চিনে উঠতে পারিনি। তবে তিলোত্তমার গাঁয়ের রঙ কালো ছিল। সেটা আমি বুঝতে পেরেছি। নিঃসন্দেহে সেটা আমার স্ত্রী ছিলো না এটাই আমার প্রশান্তির কারণ আর তাই আমি ব্যাপারটা বেশ আনন্দ নিয়েই তোমাকে বলছি।
-কেন স্ত্রী হলে কি হত? উনি কি বেশ কড়া মেজাজের??
-আরে ধ্যাত। নিতান্তই ঠান্ডা মাথার মহিলা আর ঐ একজন ললনার চেহারাই তো সবচেয়ে বেশি দেখা হয় । স্বপ্নেও তাকে নিয়ে যেতে বলছো?
-হা হা হা। বেশ বলেছেন।
-আচ্ছা নামটা ছাড়া আপনার সম্পর্কে কিছু জানা হয় নি। (বেশ আগ্রহ ভরে জিজ্ঞেস করলেন উনি আমায় প্রশ্নটা)
-তুমিই তো শুনতে ভালো লাগছিল।
-হ্যাঁ ঐ দেখ পুরো তুমি আপনি মিলিয়েই চালিয়ে দিচ্ছিলাম। আসলে তুমি আমার চেয়ে বয়সে অনেকটা ছোটই হবে মনে হয়। অর্থের জন্য কি কর?? স্বপ্ন আলাদা নাকি জীবিকার জন্য স্বপ্ন দেখার মত কোন কাজ ?
-হ্যাঁ জীবিকার জন্য স্বপ্ন দেখার মত কোন কাজের চেষ্টাতেই আছি কিন্তু স্বপ্নই তো আসে না। বেঁচে থাকাই তো দুষ্কর হয়ে যাবে ডাঃ সাহেব।
-লেখক নাকি?
-হ্যাঁ। কি করে বুঝলেন?
-ঐ আর কি হবে বল। গেস করলাম আরকি। তা কোন ধরণের লেখক তুমি?? যে সমাজের সব কিছুর সাথে খাপ খাইয়ে মানুষকে বিনোদন দিয়ে চলে সেরকম লেখক নাকি যে লেখক সোশাল লুপহোল খোঁজায় ব্যাস্ত থেকে নিজেকে বিদ্রোহী বলে দাবী করে তেমন লেখক?
-সবকিছু মিলিয়েই তো একজন লেখক তাই নয় কি ডাঃনিতিশ?
-আরে রাখো ওসব কথা, দিন শেষে সবাই ঐ নামযশ আর প্রতিপত্তির জন্যই কাজ করে। সাহিত্য শিল্প ব্যাপারটাই তো হারিয়ে যাবে একদিন। নব্য সাহিত্য ধরণের নাম হবে ‘কর্পোরেট লিটারেচার’।
-আর যদি ব্যাপারটা কেউ বেনামে করে?? এনোনিমাসলি করে??
-অর্থের ব্যাপারটা তো থেকেই যাচ্ছে। তবে এনোনিমাস লেখকরা যদি নিজেদের শেষ কাজ অব্দি আড়ালে রেখে যাবার চেষ্টা করে তবে আমি তাকে একজন প্রকৃত সাহিত্যিকই বলবো। আর সত্যি বলতে অর্থ ব্যাপারটা তো আবশ্যকই।
লোকটা নিঃসন্দেহে একটা উচ্চমানের চিন্তাবিদ এবং ওভারথিঙ্কিং যে ব্যাটার মাথার ১২ টা বাজিয়ে দিয়েছে তাতে আমার কোন সন্দেহ রইল না। ঘন্টাখানেকের ভেতর সূর্যোদয় হবে। একে বিমান ভ্রমণ তারপর আবার না ঘুমিয়ে একদম কাবু হয়ে আছি। শরীরটা ঘুমোতে চাইছে কিন্তু কি যেন একটা ঘুমোতে দিচ্ছে না। আমি এক পর্যায়ে ডাঃনিতিশকে বলতে বাধ্য হলাম ঘর খানা ত্যাগ করে আমাকে একটু বিশ্রামের সুযোগ করে দিতে। নিতান্ত ভদ্রলোকের মত তিনিও ঘরখানা ত্যাগ করলেন। আর আমি একটা স্বস্তির ঘুম দেবার চেষ্টা করলাম।
দরজায় ধাক্কার শব্দে ঘুমটা ভেঙ্গে গেল। হাতঘড়িটা বালিশের পাশ থেকে তুলে চেয়ে দেখলাম প্রায় ১২ টা বাজে। বেশ ৬/৭ ঘন্টার একটা ভাল ঘুমই হয়েছে। উঠে দরজা খুলে দেখলাম রুম সার্ভিস। একজন সুন্দরী মহিলা হাঁতে একটি ট্রে নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। ওতে নাস্তা ঢাকা অবস্থায় আছে। সেই ভদ্রমহিলার পা অনুসরন করে রুমে যথারীতি ডাঃ নিতিশের আগমন ঘটলো এবং রুম সার্ভিসের মহিলা আমাকে আরো কিছু লাগলে ফোন করে জানাতে বলে রুম থেকে বেরিয়ে গেল। কিন্তু ডাঃ নিতিশ ঐ ইজি চেয়ারটায় বেশ ভালোই মজা পেয়েছে। ওতে বসে আমাকে দরজা খানা ভিজিয়ে দেবার নির্দেশ দিলেন। আমিও দরজা খানা ভিজিয়ে দিয়ে বাথ্রুমের দিকে গেলাম ফ্রেশ হতে। খানিকক্ষণ পর বেরিয়ে দেখলাম ডাঃ নিতিশ ঠিক ওখানেই বসে আছে এবং এমনভাবে মাথা নিচু করে বসে আছে যেন উনি কিছু একটা খুব মনোযোগ দিয়ে শুনছেন। আমি আমার টাওয়েল্টা দিয়ে মুখখানা মুছতে মুছতে কিছু জিজ্ঞেস না করে উনার দিকে চেয়ে রইলাম। প্রায় মিনিট তিনেক পর উনি আমার দিকে মুখ তুলে চাইলেন। বেশ একটু ভ্রু কুচকে চাইলেন। এটা বিরক্তির ভ্রুকুঞ্চন নয়। এটা অতীতের কোন যন্ত্রণার স্মৃতির কোণ দ্বারা সৃষ্ট অভিব্যক্তি বিশেষ। আমি কোন কথা বলছি না। উনিও কোন কথা বলছেন না। এভাবে কেটে গেল বেশ কিছুক্ষণ। হঠাত মুখের অভিব্যাক্তি পুরো পালটে দিলেন। যেন ঘোর অমানিশা এক নিমেষে পূর্নিমায় পরিণত হয়েছে। এ ধরণের ব্যক্তিদের আমার খুব অসহ্য লাগে যারা নিজেদের দুঃখ কষ্ট অনুভূতি চাপিয়ে রাখতে পারে। নিজের ভেতর দুঃখের অনুভূতি গুটিয়ে রেখে দিয়ে যায় অমলিন হাঁসি , হাঁসিয়ে যায় অন্যদের। এদের আমার সত্যিই অসহ্য লাগে। কারণ আমি নিজেও একজন এনোনিমাস লেখক। নিজেকে গুটিয়ে রাখার কষ্ট আমার বেশ জানা। এ ধরণের মানুষদের পেট কাটলে হয়তোবা বের হবে হাজারটন সুখ-দুখের স্মৃতি । হঠাতই নীরবতা কাটিয়ে চেঁচিয়ে বলে উঠলেন উনি
“The deepest craving of human nature is the need to be appreciated.”
-কার কথা মিস্টার অঞ্জন??
– উইলিয়াম জেমস।
-উইলিয়াম জেমস অর সিগ্মুন্ড ফ্রয়েড?
– আর বলবেন না। এসব বলে লাভ নেই। কাল থেকে আজ অব্দি চেষ্টা করে একটা শব্দও খুঁজে পাচ্ছি না লেখার জন্য আর আপনি আছেন উইলিয়াম জেমস আর সিগ্মুন্ড ফ্রয়েড নিয়ে।
-আপনি কি কোন কালজ্ব্য়ী কিছু লেখার প্রস্তুতি নিচ্ছেন নাকি??
-হাহাহাহা। না না তা নয়। তবে কিছু একটা। যাকে অন্তত খারাপ বলা যাবে না।
আমি মনের অজান্তেই উনার কাছে সাহায্য চেয়েছিলাম। এটা উনিও বুঝতে পারছিলেন এবং আমার সত্যিই মনে হয়েছিল সাহায্য চাওয়ার জন্য উনি একদম উপযুক্ত একজন ব্যক্তি।
-চলুন তৈরী হয়ে নিন । বের হব আমরা আজ।
-কোথায় যাব আমরা মিস্টার নিতিশ?
-লেখক কি হারাতে চায় না?
-তাইতো এখানে আসা।
-তাহলে আবার প্রশ্ন কেন!!!
আমি চট জলদি নাস্তা টা সেরে প্যান্ট শার্ট আর আমার ওভারকোট টা পড়েই উনার সাথে বেরিয়ে পড়লাম । আমরা সবুজ ঘাসের উপর দিয়ে হাঁটছি। রোদ এখনো পুরোপুরি শুকিয়ে দিতে পারেনি ঘাসের উপরের শিশির গুলোকে। বেশ দেরী পর্যন্ত কুয়াশা জর্জরিত ছিল চারিদিক। একটা ছোট্ট ছেলে হঠাত দৌড়ে এসে আমার কাছে টাকা চেয়ে বসলো, পকেট থেকে খুচরো গুলো বের করে দিতেই নিজের ধুলোমাখা ন্যাংটা শরীর নিয়ে দৌড়ে চলে গেল সে।
-একটা জিনিস খেয়াল করেছ অঞ্জন ?
-না। কোনটা?
-ঐ ল্যাংটা বাচ্চা টা একবারের জন্যও আমার কাছে টাকা চায়নি।
-হ্যাঁ চায়নি। আমার কাছে চেয়েছে টাকা পেয়েছে তো চলে গেছে।
-হয়তো। আমি তোমাকে হোটেলের বাইরে কেন নিয়ে এসেছি জানো অঞ্জন?
-কেন ডাঃ নিতিশ??
-এতে তোমার লেখায় সাহায্য হবে। এখন না হলেও রাতে হবে।
-হ্যাঁ সে চিন্তায় আমিও এসে গেলাম বাইরে।
-আচ্ছা বল অঞ্জন ছোট বেলায় তোমার কি হবার ইচ্ছে ছিল?? আচ্ছা তার আগে চল ঐ বট গাছটার নিচে একটু বসা যাক।
-চলুন।
দুজনে একটা সদ্য যৌবনে পা রাখা বট গাছের নিচে গিয়ে বসলাম। একবার বটগাছের গোঁড়া থেকে ডগা অব্দি দেখে নিলেন ডাঃ নিতিশ । তারপর বলে উঠলেন
-হ্যাঁ বল কি হবার ইচ্ছে ছিল ছোট বেলায়?
– সবাই ডাক্তার হতে বলতো। তাই আমিও একসময় মেনে নিলাম আমি একজন ডাক্তারই হবো।
– ডাক্তার হলে না কেন?
– অত ভালো ছাত্র ছিলাম না। পড়াশোনায় মন বসতো না। আর এসব প্রোফেশানাল ওয়ার্ল্ড এর ভেতরো এলিট প্রোফেশন। আমি সবসময়ই খুব সাধারন থাকতে চেয়েছি। তাই হয়তোবা ডাক্তার ইঞ্জিনিয়ার হবার জন্য যে পদ্ধতির ভেতর দিয়ে যেতে হয় তা আমাকে খুব একটা আকর্ষন করেনি। তাই এই লেখক প্রোফেশানই আমার খুব পছন্দের। সত্যিই খুব পছন্দের।
– বেশ ভালো। স্বপ্ন, ভালোলাগা এসব নিয়ে কাজ কারবারের মজাই আলাদা। কিন্তু আমার প্যাশন কি ছিল জান?
– মানুষের হৃদয় কে কেটে ছুঁড়ে আবার জোড়া লাগানো?
-হাহাহাহা ।। তা যা বলেছ। একদম সঠিক। ঐ ধমনী শিরা নিয়ে খেলা করাই আমার প্যাশন ছিল। লাবডুব , লাবডুব … আহাহা কি প্রশান্তির শব্দ যে ওটা। ওটা মানেই একটা অস্তিত্ব এখনো পৃথিবীতে আছে। আশা এখনো রয়ে গেছে। আবার অনেক সময় এমনো হত যে হঠাতই থেমে গেছে লাবডুব তারপর আবার সবাইকে চমকে দিয়ে হঠাতই মেশিন রিস্টার্ট । আহাহাহাহা সেই অভিব্যক্তি আমি বলে বোঝাতে পারবো না।
– এখন আর অপারেশন করেন না??
-অপারেশন নয় বলো প্যাশন। ওটা আমার প্যাশন । আমি যদি বেঁচে থাকতাম তবে সত্যিই কাজটা এখনো করে যেতাম।
– বেঁচে থাকতেন মানে?
– আমি বাধ্যতামূলক অবসরে আছি। আমাকে আদালতে পাগল সাব্যস্ত করে এ কাজ থেকে অব্যাহতি দেয়া হয়েছে। তাই এখন সব বাদ দিয়ে দিকে দিকে ঘুরি। আমি সত্যিই আদালতের ঐ রায়ের পর থেকে মরে গেছি। মানুষকে মানুষের ‘প্যাশন’ থেকে দূরে রাখার মানে হচ্ছে তাকে গলাটিপে হত্যা করা।
-কিছু মনে করবেন না। কিন্তু কেন??? কেন আপনাকে পাগল সাব্যস্ত করা হল?
-আরে বলোনা। ঐ প্রোফেশনে কম্পিটিটরের চাল। বাদ দাও। ভালোই হয়েছে এখন আর কাজ করি না। আজ নয়তো কাল অবসরে তো যেতেই হতো।
-হ্যাঁ তা ঠিকই বলেছেন।
‘তোমার ঐ ১২৩ নাম্বার রুমে আজ থেকে তিন বছর আগে একজন বুড়ো থাকতেন। নাম ছিল কেদার চক্রবর্তী। ঊনার হার্টের ডাক্তার ছিলাম আমি’- খানিকক্ষণ নীরব থেকে হঠাতই আউড়ে উঠলেন উনি।
-(আমি একটু চমকে গিয়ে ) কেদার চক্রবর্তি কে তো আমি বেশ করেই চিনি। এই হোটেলেই উনার সাথে আমার সাক্ষাত হয়েছিল। তখন ১২৩ নম্বর রুমে উনি থেকেছিলেন আর আমি ১২৪ এ।ব্যাপারটা কি একটু খুলে বলা যাবে ডক্টর বাবু?
উনি আমার আগ্রহ ভরা প্রশ্নটা এড়িয়ে গিয়ে বললেন
-আচ্ছা অঞ্জন ধরো আমি তুমি দুজনই মৃত, এটা একটা স্বর্গ এবং এই গাছটা একটা কল্পতরু। ব্যাপারটা দারুণ হবে না??
-আমিও উনার কথায় মেতে গিয়ে বলে উঠলাম আর ঐ কলসীকাকে যাওয়া মেয়েটি হচ্ছে উর্বসী।
-হাহাহাহা।। মরে গেছ কিন্তু কাম গেল না।
– আমরা কি মৃত্যু বিষয়টাকে এখন বন্ধ রাখতে পারি না?? কল্পতরু কিন্তু ইচ্ছে পূরণ করে দেবে। তাই আর মৃত্যু নিয়ে কথা বলা ঠিক হবে না ।
– বোধয়। মৃত্যু তো অমোঘ সত্য। এড়িয়ে যেতে পারবে না। চিরন্তন সত্য নিয়ে কথা বলতে অবশ্য খুব একটা উৎসাহ থাকেনা ।
——————
‘কেদার চক্রবর্তী’- একজন দারুণ ব্যক্তিত্ববান সুপুরুষ ছিলেন। সত্তোরোর্ধ্য বয়সেও তার কথা বলার ভঙ্গীমায় অনেক যুবতী লাস্যময়ীও কাবু হয়ে যেতে পারতো। বেশ গম্ভীরস্বরে কথা বলতেন। আর আমাকে বেশ পছন্দ করতেন। যেদিন এই হোটেলে প্রথম দেখা হয়েছিল উনার সাথে সেদিন আমাকে জড়িয়ে ধরে বলেছিলেন “আমি ছোটদের এভাবেই আশির্বাদ করি। তোমায় দেখেই আমার আশির্বাদ করতে ইচ্ছে হল। তাই করে ফেললাম।’ – কথাগুলো আমার কানে এখনো স্পষ্ট বেজে চলে। কেদার চক্রবর্তী আমার কোন আত্মীয় নন। কিন্তু তাকে আমার সর্বদাই খুব কাছের মানুষ বলে মনে হতো। হয়তোবা উনিও আমাকেও খুব কাছের কেউ ই ভাবতেন। আমাদের কথা হত প্রায়শই আর একটা প্রশ্ন উনি আমায় প্রত্যেকবার কথা বলার সময়ই বলতেন “ আমার আশির্বাদ কাজে লেগেছে কি অঞ্জন?” আমি হ্যাঁ না কিছুই বলতে পারতাম না। উনিও ব্যাপারটা এড়িয়ে যেতেন।
কিন্তু আজ উনার আশির্বাদ আমার সত্যিই কাজে লাগলো। যখন ডাঃ নিতিশ উনার বাদামী রঙের কোটের গোপন পকেট থেকে একটা চিঠি বের করে দিলেন আর বললেন এটা পড়তে। “এটা কেদার চক্রবর্তীর তরফ থেকে তোমার জন্য উপহার। হয়তো ভালবাসা’- আমি ডাঃ নিতিশের দিকে হা করে চেয়ে রইলাম। উনি বললেন ‘হ্যাঁ আমি এখানে কেবল তোমার খোঁজে এসেছি এই চিঠিটা তোমায় দিতে। ডাঃ কেদার মারা যাবার আগে আমার হাতেই চিঠিটা পুরে দিয়ে বলে উঠলেন’।
“আর কেউ নয়। কেবল এডঃচ্যাটার্জী তুমি ও সে” -উনার কমিটমেন্ট পূরনে আজ আমি এখানে।
-চিঠিখানা পড়ে লাভ নেই ওতে তেমন কিছুই লিখা নেই। শুধু এডঃ চ্যাটার্জীর সাথে যোগাযোগের জন্য উনি তোমাকে অনুরোধ করে গেছেন। জীবদ্দশায় উনি অঢেল সম্পদের মালিক হয়েছিলেন। অবশ্যই বৈধ উপায়ে। কিন্তু সন্তান গুলোর ৩ টেই মারা গেল একটা কার এক্সিডেন্টে। কাছের বলতে থেকে গেলাম আমি উনার ব্যক্তিগত চিকিৎসক, এডঃ বিজয় চ্যাটার্জী আর উনার এসিস্ট্যান্ট লিন্ডা এর বাইরেও আরেকজন যে ছিল ওটা আমার জানা ছিলোনা। মৃত্যুর কদিন আগেই আমি বুঝতে পারছিলাম যে উনার শারীরিক অবস্থা খারাপ যাচ্ছে। উনিও তা নিজ থেকেই বুঝে নিলেন। আমাকে আর এডঃচ্যাটার্জী কে জরুরি তলবে ডেকে পাঠালেন। একটা উইল করতে। যে উইলের উনার সম্পদের পরবর্তী মালিক আমাকে করতে চাইলেন। কিন্ত আমি তো পাগল মানুষ। আদালতে তা প্রমাণিত। এই অভিযোগ নিয়ে সম্পদ রক্ষে করা কঠিন হয়ে যাবে। তাই পরবর্তি অপশন ছিলে তুমি। হ্যাঁ তুমি
আশির্বাদটা বেশ ভাল মতই করে গেছেন উনি। একটা সলিড আশির্বাদ। লেখার শব্দ আগামী ক’দিন খুঁজে না পেলেও চলবে। ডাঃ নিতিশের গত ১ মিনিট কি আমার জীবন পালটে দিল? নাকি আমি যেমন ছিলাম তেমনই থাকবো? দেখা যাক কি হয়! সময়ই হয়তো বলে দেবে। এই একটা ঘটনা হয়তো জন্ম দেবে আরো অনেক ঘটনার। ঘটনা ঘটতে ঘটতে এক সময় আমিও মারা যাবো। আচ্ছা সত্যিই যদি আমি এই সম্পদের মালিক হয়েই মারা যাই তবে এই সম্পদের পরবর্তী মালিক কে হবে?? আমার তো কোন ওয়ারিশ কিংবা কোন বংশধর নেই। আর বংশধর থাকলেই কি?? কেউই বা কোন কিছুই তো আর চিরস্থায়ী নয়।
-“ডাঃ নিতিশ?”
– জি বলুন!!
-চিঠিটা না হয় আমি পড়ে নেব। কিন্তু সম্পদ দিয়ে আমি কি করবো বলুন? আমি তো একা মানুষ। অত অর্থ সম্পদের খুব কি একটা প্র্য়োজন আছে আমার?
-বলো কি?? ১৫০ একর জায়গা। বিশাল অট্টালিকা। দু-তিনশো কোটি টাকার মালিক হয়ে গেছ তুমি। এ সুযোগ হাতছাড়া করবে?
– হ্যাঁ সত্যিই ভীষণ ব্যাপার এটা। অনেক সম্পত্তি। কিন্তু ভয় হয় যে?
-ভয়? কিসের ভয়?
– যত বড় ঘটনা তত বড় ফলাফল। তা যদি ভালোর দিকে যায় তবে বেশ। কিন্তু খারাপ ফলাফলের ধাক্কা আমি সামলানোর মত মানসিক জোড় নিয়ে জন্মাইনি। আপনি হয়তো জানেন না ডাক্তার বাবু , আমি যে শহরে জন্মেছি সে শহরে এখনো সবচেয়ে ধনী ব্যক্তিটি আমার পিতা। আমি সব ছেঁড়ে ঘুরে বেড়াই। এটাই আমি। আমি এমন থাকতেই পছন্দ করি। ওসব ল্যাভিশ জীবন আমার জন্য নয়।
– ‘ব্রাভো মাই বয়’ তুমি সত্যিই অনেক ভাল একজন মানুষ। কিন্তু আরেকবার ভেবে দেখতে পারো কিন্তু।
-অস্থায়ী জিনিস নিয়ে ভেবে লাভ নেই ডাঃ। আমি মৃত্যুর পরোয়ানা অনেক বেশি করি। তাই মৃত্যু পরবর্তী যে জিনিস সঙ্গে করে নিয়ে যেতে পারবো আমাকে নাহয় ওটা নিয়েই থাকতে দিন।
– তবে থাকো তুমি তোমার চেতনা নিয়েই বাছা। কিন্তু ভেবে দেখেছো কি যে গত ১ মিনিটই পালটে দিতে পারতো তোমার জীবন?
-পারতো না ,সত্যিই পালটে দিয়েছে আমার জীবন।
-কিন্তু কিভাবে?? তুমি তো ওগুলো নিলে না।
-ঐযে! আত্মবিশ্বাস, লোভ সংবরণ, সততা। এগুলো তো আমার ব্যক্তিত্ত্ব আর চেতনাকে আরো বেশি সমৃদ্ধ করলো। তাই নয় কি?? দেখবেন এখন লিখতে বসলে এক নিঃশ্বাসে লিখে ফেলেছি অনেক কিছু। সত্যিই ডাঃ নিতিশ ‘একমাত্র মৃত্যুটাই অমোঘ সত্য বাকি সবই আনুষঙ্গিক খেলা’।
– সত্যিই অঞ্জন
‘একমাত্র মৃত্যুটাই অমোঘ সত্য বাকি সব আনুষঙ্গিক খেলা মাত্র’।
সর্বশেষ এডিট : ১৮ ই মে, ২০১৭ রাত ৮:৩৬