somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

ক্ষুদ্রঋণ নিয়ে কয়েকটি কথা

২৭ শে মার্চ, ২০১১ সকাল ১০:৫৯
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

ব্লগসহ বিভিন্ন মিডিয়ায় ইদানিং ডঃ ইউনুস এর বিরুদ্ধে নেয়া সরকারী সিদ্ধান্ত নিয়ে প্রচুর কথাবার্তা হচ্ছে। সিদ্ধান্তের পক্ষে যুক্তি অনেক আছে, তার গ্রহনযোগ্যতা নিয়ে কথা বলা আমার উদ্দেশ্য না।আমাকে যেটা অবাক করে সেটা হচ্ছে, সিদ্ধান্তের বিপক্ষে প্রধান যুক্তি হিসাবে উপস্থাপন করা হয়, ডঃ ইউনুস বহির্বিশ্বে বাংলাদেশের জন্য কতটা সুনাম বয়ে এনেছেন।এটা যে সত্য এবং অনেক বড় অর্জন এ ব্যাপারে আমার কোন দ্বিমত নাই। অনেক বিদেশী বন্ধুকেই দেখি বাংলাদেশকে চিনে শুধু প্রাকৃতিক দুর্যোগ আর গ্রামীন ব্যাঙ্ক এর কারনে। গ্রামীন ব্যাঙ্ক এবং ডঃ ইউনুস নোবেল না পেলে হয়তো শুধু প্রাকৃতিক দুর্যোগের দেশ হিসেবেই বিদেশীরা বাংলাদেশকে চিনত।

আমার প্রশ্ন হচ্ছে নোবেল বিজয় ই কি ডঃ ইউনুস এর একমাত্র অর্জন? নোবেল বিজয়ের পেছনের কারনটা কি আসলেই মূল্যহীন? ক্লিনটন এর সাথে সুসম্পর্ক, ক্ষুদ্রঋণ এর উচ্চ সুদের হার আর ক্ষুদ্রঋণের জালে আবদ্ধ হয়ে নিঃশেষ হয়ে যাওয়া দু’একজনের গল্প ই কি যথেষ্ট এটা বলার জন্য যে পুরো ব্যাপারটা আসলে দারিদ্র্য নিয়ে ব্যাবসা? আমার মনে হয়, ক্ষুদ্রঋণ এর বিরুদ্ধে অনেকগুলো অভিযোগ ই কিছু ভুল ধারনার উপর প্রতিষ্ঠিত।

১। গরীবের জন্য ঋণের সুদের হার কেন ধনীর চেয়ে বেশী?

খুবই সহজ কারন। গরীবরা ঋণের বিপরীতে জামানত রাখেনা। আপনি যখন ব্যাঙ্ক থেকে ঋণ নেন, আপনি সেটা নেন আপনার চাকুরির বেতন, অথবা কোন স্থাবর সম্পত্তির বিপরীতে। আপনি যদি খেলাপী হন, ব্যাঙ্ক আপনার জামানতকৃত সম্পত্তি বিক্রি করে পাওনা টাকা আদায় করতে পারে। সুতরাং আপনাকে ঋণ দিতে ব্যাঙ্কের ঝুঁকি কম।তাই তাদের খরচ ও কম।যার জামানত রাখার মত কিছু নাই, তাকে যদি ঋণ দেয়া হয়, সেক্ষেত্রে খেলাপী ঋণের সম্ভাবনা অনেক বেশী থাকে। আর ঋণ খেলাপী হলে সেটা আদায় করার কোন উপায় থাকে না। এজন্য প্রচলিত ব্যাংকিং ব্যবস্থায় গরীবদের ঋণ পাওয়ার কোন সুযোগ নেই। ঋণের যোগান কম থাকার কারনে মানুষ জরুরী প্রয়োজনের সময় গ্রামের মহাজনদের কাছ থেকে চড়া সুদে ঋণ নিতে বাধ্য হয়।প্রশ্ন হচ্ছে, এত লাভজনক ঋণ দেয়ার ব্যবসায় সবাই কেন এগিয়ে আসে না, তাহলেই তো ঋণের যোগান বেড়ে যেত। সমস্যা হচ্ছে, সবার ঋণ আদায় করার ক্ষমতা নাই। প্রভাবশালীরা, যারা জানে ঋণ আদায় করতে পারবে, তারাই শুধু ঋণ দেয়। আবার মহাজনী ব্যবসা সামাজিকভাবে খুব ভাল চোখে দেখা হয়না, ধর্মীয়ভাবে তো নয়ই। সুতরাং, খুব অল্প সংখ্যক মানুষই এ ব্যবসায় জড়ায়, লাভের হারটাও স্বাভাবিকভাবেই বেশী থাকে।

ক্ষুদ্রঋণ ব্যবস্থা একটি চমৎকার প্রক্রিয়ায় গরীব মানুষের জন্য ঋণের প্রাপ্যতা নিশ্চিত করে। যেহেতু জামানত নেয়া সম্ভব নয়, তাই ঋণ আদায় করার জন্য অনেক বেশী পর্যবেক্ষন (monitoring) করা হয় প্রচলিত ব্যাংকিং এর তুলনায়। গ্রামে গ্রামে কেন্দ্র আর ব্যাঙ্কের এত কর্মী থাকার কারণ এটাই।এটা করতে গিয়ে ঋণ আদায় হয় ঠিকই, কিন্তু ব্যাংকের খরচ বেড়ে যায়। তাই কোন আর্থিক প্রতিষ্ঠান যদি দীর্ঘমেয়াদে ঋণদান করে যেতে চায়, তাহলে কোন লাভ না করতে চাইলেও তাদের প্রচলিত ব্যাংকিং এর চেয়ে বেশী সুদ নিতে হবে। ব্যাপারটাকে এভাবে দেখুন, আপনি যত হাজার বা লাখ টাকা বা ডলার ঋণ নিচ্ছেন, সেটার পেছনে আপনার ব্যাংকের কত কর্মঘন্টা খরচ হচ্ছে আর সেই পরিমান টাকা ঋন দিয়ে আদায় করতে একটি ক্ষুদ্রঋন প্রদানকারী প্রতিষ্ঠানের কত কর্মঘন্টা খরচ হয়।

অবশ্যই ক্ষুদ্রঋণ প্রদানের অতিরিক্ত খরচ বিবেচনা করার পরেও বাংলাদেশে প্রচলিত ক্ষুদ্রঋণের সুদের হার খুব বেশী কিনা সেটা খতিয়ে দেখা উচিত। কিন্তু আপনাকে ১৫% সুদে ব্যাংক ঋণ দেয় অথচ আপনার গ্রামের ভূমিহীন কৃষকটিকে গ্রামীন ব্যাংক থেকে ২৫% সুদে ঋন নিতে হয় এই অভিযোগে ক্ষুদ্রঋন ব্যবস্থার সমালোচনা করা বোকামী।

২। ক্ষুদ্রঋণ দারিদ্র্য কমাতে পারছে কি?

আমি জানি না। কিন্তু আপনার আশেপাশে এখনো অনেক দরিদ্র মানুষ দেখছেন এর মানে এই না যে ক্ষুদ্রঋণ পুরোপুরি ব্যর্থ।ক্ষুদ্রঋণ একা কখনোই দারিদ্র দূর করতে পারবে না, কিন্তু এটা দারিদ্রের বিরুদ্ধে লড়াই করতে সাহায্য করে। সেটা ঠিকমত করতে পেরেছে কিনা বুঝতে হলে আপনাকে তুলনা করতে হবে ক্ষুদ্রঋণ না থাকলে কি হত সেই অবস্থার সাথে। যেহেতু আমরা সময়ে পেছনে যেতে পারিনা, তাই গবেষনার ক্ষেত্রে এটা একটা বড় চ্যালেঞ্জ।

সাধারনত ক্ষুদ্রঋণ এর দুর্বলতার কথা বলতে গিয়ে কয়েকজনের দুর্দশার উদাহরন দেয়া হয়। কিন্তু উপকৃত মানুষের সুংখ্যা কি দুর্দশাগ্রস্থ মানুষের চেয়ে কম? আমাদের দেখতে হবে গড়ে সমাজের উপকার বেশী হয়েছে নাকি ক্ষতি বেশী হয়েছে।এমনকী একজনের অবস্থা আগের চেয়ে খারাপ হওয়ার মানে এই নয় যে তার জন্য ঋন না নেয়া ভাল ছিল। মনে করুন, এক কৃষক, তার একটা গরু ছিল, চাষবাস করে খেত। হঠাত তার বউ অসুস্থ হয়ে গেল, কয়েক হাজার টাকা খরচ করলে সে বাচবে। সেই কৃষক এনজিও থেকে ঋণ নিয়ে বউয়ের চিকিতসা করালো। পরবর্তিতে কিস্তির টাকা দিতে গিয়ে তাকে গরু বিক্রি করে দিতে হলো। এখন সে দিনমজুর। আপনি তার সাথে কথা বলতে যান, বলবে হ্যা ভাই, ঋণ নিয়ে আজ আমার এই অবস্থা। কিন্তু ভাবুন, ঋণ না নিলে কি হত?

আমার অভিজ্ঞতায় বাংলাদেশের মানুষ শখের বশে ঋণ নেয় না। আপনি যেমন ঋণ নেন মায়ের ভাল চিকিতসার জন্য, বিয়ে করার জন্য কিংবা ভাল একটা বিনিয়োগের সম্ভাবনায়, আপনার গ্রামের দরিদ্র মানুষটিও তাই। একটা গরু বা মুদি দোকান হয়তো তার ভাগ্য বদলে দিতে পারে, কিংবা টাকার অভাবে তার ছেলেটি এসএসসি পরীক্ষার ফি দিতে পারছে না। ব্যবধানটা হচ্ছে, আপনার বিনিয়োগ সফল না হলে ঋণ পরিশোধ করতে গিয়ে আপনি নিঃস্ব হয়ে যাবেন না কিন্তু আমাদের রাহেলার মা হয়তো হবে। কিন্তু সেজন্য কি আমরা তাদের কিছু করতে দেবনা? তাহলে যে, আরো পাঁচটা সফল বিনিয়োগ হবেনা, অনেকে পরীক্ষা দিতে পারবে না, অনেকে মারা যাবে বিনা চিকিতসায়।সবচেয়ে ভাল হত, আমরা যদি সবাইকে প্রয়োজনের সময় সাহায্য করতে পারতাম, ফেরত পাওয়ার আশা না করে। কিন্তু আমাদের তো এত সম্পদ নেই। তাই আমাদের ঝুঁকি নিতে হবে, সফলতার ভাগ বেশী থাকলেই আমরা একসময় দারিদ্রমুক্ত হতে পারব। কিন্তু কয়েকজনের ব্যর্থতার করুন কাহিনী দেখে পুরো ব্যবস্থাটাকে উপড়ে ফেলতে চাওয়ার কোন কারন নেই। অবশ্যই এই ব্যবস্থাকে দারিদ্র বিমোচনে কিভাবে আরো কার্যকর করা যায় সেটা চিন্তা করা উচিত।
সর্বশেষ এডিট : ২৮ শে মার্চ, ২০১১ ভোর ৬:৪২
৩টি মন্তব্য ২টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

ব্লগার'স ইন্টারভিউঃ আজকের অতিথি ব্লগার শায়মা

লিখেছেন অপু তানভীর, ০৪ ঠা মে, ২০২৪ রাত ১১:০৫



সামুতে ব্লগারদের ইন্টারভিউ নেওয়াটা নতুন না । অনেক ব্লগারই সিরিজ আকারে এই ধরণের পোস্ট করেছেন । যদিও সেগুলো বেশ আগের ঘটনা । ইন্টারভিউ মূলক পোস্ট অনেক দিন... ...বাকিটুকু পড়ুন

...এবং উচ্চতায় তুমি কখনই পর্বত প্রমাণ হতে পারবে না

লিখেছেন নতুন নকিব, ০৫ ই মে, ২০২৪ সকাল ৮:৫৬

...এবং উচ্চতায় তুমি কখনই পর্বত প্রমাণ হতে পারবে না

ছবি কৃতজ্ঞতাঃ অন্তর্জাল।

ছোটবেলায় মুরব্বিদের মুখে শোনা গুরুত্বপূর্ণ অনেক ছড়া কবিতার মত নিচের এই লাইন দুইটাকে আজও অনেক প্রাসঙ্গিক বলে মনে হয়।... ...বাকিটুকু পড়ুন

লালনের বাংলাদেশ থেকে শফি হুজুরের বাংলাদেশ : কোথায় যাচ্ছি আমরা?

লিখেছেন কাল্পনিক সত্ত্বা, ০৫ ই মে, ২০২৪ দুপুর ১:১৪



মেটাল গান আমার নিত্যসঙ্গী। সস্তা, ভ্যাপিড পপ মিউজিক কখনোই আমার কাপ অফ টি না। ক্রিয়েটর, ক্যানিবল কর্পস, ব্লাডবাথ, ডাইং ফিটাস, ভাইটাল রিমেইনস, ইনফ্যান্ট এনাইহিলেটর এর গানে তারা মৃত্যু, রাজনীতি,... ...বাকিটুকু পড়ুন

আমেরিকার গ্র্যান্ড কেনিয়ন পৃথিবীর বুকে এক বিস্ময়

লিখেছেন কাছের-মানুষ, ০৫ ই মে, ২০২৪ দুপুর ১:৪১


প্রচলিত কিংবদন্তি অনুসারে হাতে গাছের ডাল আর পরনে সাধা পোশাক পরিহিত এক মহিলার ভাটাকতে হুয়ে আতমা গ্র্যান্ড কেনিয়নের নীচে ঘুরে বেড়ায়। লোকমুখে প্রচলিত এই কেনিয়নের গভীরেই মহিলাটি তার... ...বাকিটুকু পড়ুন

চুরি! চুরি! সুপারি চুরি। স্মৃতি থেকে(১০)

লিখেছেন নূর আলম হিরণ, ০৫ ই মে, ২০২৪ দুপুর ২:৩৪


সে অনেকদিন আগের কথা, আমি তখন প্রাইমারি স্কুলে পড়ি। স্কুলে যাওয়ার সময় আব্বা ৩ টাকা দিতো। আসলে দিতো ৫ টাকা, আমরা ভাই বোন দুইজনে মিলে স্কুলে যেতাম। আপা আব্বার... ...বাকিটুকু পড়ুন

×