১. মনে করুন ১০ জন ছাত্রের মধ্যে একটা প্রতিযোগিতা হচ্ছে। প্রত্যেককে ০ থেকে ১০০ এর মধ্যে যেকোন সংখ্যা খাতায় লিখতে হবে। সবার লিখা হয়ে গেলে, সবগুলো সংখ্যার গড় নেয়া হবে। মনে করি গড় হলো ‘ক’। এখন যার সংখ্যা গড়ের অর্ধেকের সবচেয়ে কাছাকাছি হবে, অর্থাৎ ‘ক/২’ এর সবচেয়ে কাছাকাছি হবে, সে বিজয়ী হবে। আপনি প্রতিযোগীর একজন হলে কোন সংখ্যাটি লিখতেন, সেটা একটু চট করে ভেবে নিন বাকিটুকু পড়ার আগে। চাইলে মন্তব্যের ঘরে লিখেও দিতে পারেন আপনার উত্তর।
এবার প্রতিযোগিতার বাইরে থেকে সমস্যাটি নিয়ে একটু মাথা ঘামানো যাক। প্রথমেই বলে নেই, আমি একজন প্রতিযোগী হলে কখনোই ৫০ এর চেয়ে বড় কোন সংখ্যা লিখতাম না। কারন, কেউ যেহেতু ১০০ এর চেয়ে বড় কোন সংখ্যা লিখতে পারবে না, গড় সবসময়ই ১০০ এর চেয়ে কম হবে, তাই গড়ের অর্ধেক কখনোই ৫০ এর চেয়ে বেশী হবে না। এ তো সোজা হিসাব, তাহলে অন্য সবাই ও নিশ্চয় আমার মত করে চিন্তা করছে। তাই যদি হয়, তাহলে আমার মত অন্যরাও কেউ ৫০ এর বেশী লিখবে না। কেউ যদি ৫০ এর বেশী না লিখে তাহলেতো গড় ও ৫০ এর বেশী হবে না। তার মানে গড়ের অর্ধেক কখনোই ২৫ এর বেশী হবে না। তাহলে আমি ২৫ এর বেশী লিখব না। সমস্যা হলো আবারো অন্যরাও নিশ্চয় আমার মত করে চিন্তা করছে। তাই তারাও যদি ২৫ এর বেশী না লিখে তাহলে গড় ১২.৫ এর বেশী হবে না। এভাবে যদি চিন্তা করতে থাকি, তাহলে প্রতিবার দুই দিয়ে ভাগ করতে করতে একসময় শূন্যর খুব কাছাকাছি পৌঁছে যাব। তার মানে, সবাই যদি আমার মত করে চিন্তা করে, তাহলে সবার লিখা উচিত ‘শূন্য’। আর সবাই এমন করে চিন্তা করবে নাই বা কেন, যুক্তি দিয়ে চিন্তা করলে সবার তো এই জায়গায়ই আসা উচিত।
এখন মিলিয়ে দেখুন আপনার আগের উত্তরের সাথে এখনকার হিসাব মিলছে কিনা। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই হয়তো মিলবে না। আর আমি এই প্রতিযোগিতায় অংশ নিলে খুব সম্ভবত কখনোই শূন্য লিখতাম না। মনে করুন আমি পুরো হিসাব করে কে কি করবে চিন্তা করে লিখলাম ‘শূন্য’। কিন্তু অন্য প্রতিযোগীরা অতদূর চিন্তা করল না। অধিকাংশ প্রতিযোগী হয়তো একধাপ চিন্তা করে বের করল ৫০ এর চেয়ে বেশী লেখার কোন মানে নেই। তারপর ৫০ এর কাছাকাছি একটা সংখ্যা লিখে দিল। সেক্ষেত্রে কেউ যদি সেই অধিকাংশের চেয়ে একধাপ বেশী চিন্তা করে ২৫ এর কাছাকাছি কিছু একটা লিখে দেয়, সে কিন্তু জিতে যাবে। আমি অনেক বেশী ধাপ চিন্তা করেও হেরে যাব। সুতরাং আমি কত ধাপ চিন্তা করতে চাই সেটা নির্ভর করছে অন্যরা কত ধাপ চিন্তা করছে বলে আমি মনে করি তার উপর, সেটা আবার নির্ভর করছে অন্যরা আমিসহ অন্যরা কত ধাপ চিন্তা করছি বলে মনে করছে তার উপর.........এই চিন্তা যেহেতু কখনো শেষ হবে না, তাই এখানেই বরং থেমে পরের গল্পে চলে যাই।
২. এবার আর সংখ্যা নির্বাচন নয়, সরাসরি সুন্দরী নির্বাচন। আমাদের ১০ ছাত্র প্রতিযোগী এবার সুন্দরী প্রতিযোগিতার বিচারক। ছয় সুন্দরীর মধ্য থেকে একজনকে বেছে নিতে হবে। তবে প্রতিযোগিতা আছে বিচারকদের মধ্যেও। আপনি যে সুন্দরীকে বাছাই করেছেন সে যদি বিচারকদের সর্বোচ্চ ভোট পেয়ে সেরা সুন্দরী নির্বাচিত হয় তাহলে পুরষ্কার রয়েছে আপনার জন্যও।
মনে করুন আপনি সেই বিচারকদের একজন। আপনি কি আপনার দৃষ্টিতে যাকে সবচেয়ে সুন্দরী মনে হবে তাকেই নির্বাচন করবেন? আমি হলে কিন্তু দু’বার ভাবব। কারন আমি যাকে সুন্দরী মনে করছি, তাকে যদি অন্যরাও সুন্দরী মনে করে তাহলেই শুধু আমি পুরষ্কার পাব। সুতরাং আমি ভাবার চেষ্টা করব অন্যরা কাকে সুন্দরী মনে করতে পারে। কিন্তু অন্যরা ও নিশ্চয় আমার মত করে ভাবছে এবং চেষ্টা করছে সবাই সবার পছন্দ সম্পর্কে কি ভাবছে সেটা বের করার। আগের গল্পের মত এখানেও আপনাকে সিদ্ধান্ত নিতে হচ্ছে কত ধাপ পর্যন্ত আপনি চিন্তা করবেন। মজার ব্যাপার হচ্ছে, বিচারকদের পুরষ্কারপ্রাপ্তির লোভের কারনে কিন্তু এখানে সুন্দরীদের ভাগ্য ঝুলে যেতে পারে।
মনে করুন ছয় সুন্দরীর মধ্যে পাঁচজন খুবই সুন্দরী। সব বিচারেই তারা এত কাছাকাছি যে একজন থেকে আরেকজনকে ভাল বলা কঠিন। বা বললেও বুঝাই যাচ্ছে একেকজনের একেক মত থাকবে। কিন্তু ষষ্ঠ সুন্দরীর পারফর্মেন্স অন্যদের চেয়ে যথেষ্ট খারাপ ছিল, এটা মোটামুটি সবাই স্বীকার করবে। আমি বিচারকদের একজন হলে খুব সম্ভব এই ষষ্ঠ সুন্দরীকেই নির্বাচন করতাম। কেন, কারন পাঁচজনের একজনকে নির্বাচন করলে আমার সাথে অন্যদের পছন্দ মিলার সম্ভাবনা যে কম সেটা আমি যেমন জানি অন্যরাও জানে। তাই সবাই মিলে সবচেয়ে কম যোগ্যতাসম্পন্ন প্রার্থীর মাথায় বিজয়মুকুট তুলে দেয়া খুব একটা অস্বাভাবিক নয়।
৩. এবার চলে আসি শেয়ার বাজারে। মনে করুন আমি শেয়ার কিনতে চাই, উদ্দেশ্য শেয়ার কেনাবেচা করে কিছু লাভের মুখ দেখা। কম দামে ভাল শেয়ার পেলে আমি কিনব। কারন আমি আশা করি ভাল শেয়ারের দাম বাড়বে, তখন আমি বিক্রী করে কিছু লাভ করতে পারব। এখন ভাল শেয়ার কোনগুলো, বা কোন শেয়ারের দাম বাড়বে? ভাল মৌল ভিত্তির শেয়ার? না, ভাল শেয়ার সেগুলোই যেগুলোকে অন্যরা ভাল মনে করে। সুতরাং যদি কোন শেয়ার থাকে যেটাকে এখন সবাই খুব একটা ভাল মনে করেনা কিন্তু কিছুদিন পর সবাই ভাল মনে করবে তাহলে আপনি সেই শেয়ার আজকে কিনে ভবিষ্যতে লাভ করতে পারবেন। এখানেও আবার আপনাকে সেই মাইন্ড গেম খেলতে হবে। সবাই যদি আপনার মত মনে করে আজকেই শেয়ার কিনতে চায়, তাহলে সেটা আজকের জন্য ভাল শেয়ার হয়ে গেল, আর আপনাকে বেশী দামে কিনতে হবে। মোটকথা হচ্ছে, সুন্দরী প্রতিযোগিতার মত শেয়ার বাজারেও বিচারকদের মধ্যকার মাইন্ড গেম শেয়ার ভাল-খারাপের হিসাব উল্টে দিতে পারে। শেয়ারের টেকনিক্যাল অ্যানালাইসিস যাই হোক না কেন, ক্রেতা-বিক্রেতা কি ভাবছে সেটা সব টেকনিক্যাল অ্যানালাইসিস এর হিসাব পালটে দিতে পারে।
সবাই নিশ্চয় এতক্ষনে বুঝে গেছেন, জন মেনার্ড কেইনস এর মতে শেয়ার বাজারের উঠানামা সুন্দরী প্রতিযোগিতার গল্পের সুন্দরী নির্বাচনের মত। শেয়ারের প্রকৃত মূল্য, মৌল ভিত্তি বা টেকনিক্যাল অ্যানালাইসিস এর ভূমিকা তাতে খুব একটা না ও থাকতে পারে।
সর্বশেষ এডিট : ১২ ই নভেম্বর, ২০১২ সকাল ১০:৩৩