somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

দেহজ (গল্প-প্রথম খন্ড)।

২৩ শে জুন, ২০০৯ রাত ২:২৫
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

শাঁইইইইইই শাঁইইইইইই একটা শব্দ পুবান বাতাসে ভেসে চলে। এ শব্দ বাতাস আর বৃক্ষের মিলিত সঙ্গীত। শেষ জৈষ্ঠ্যের রাত কালো করা অন্ধকারে আকাশ হয়ে যায় অন্ধ, বিশাল সব পালে গতর ভাসিয়ে আসা কৃষ্ণ মেঘদৈত্যের আজ একি রুপ। ক্ষণে ক্ষণে তার রুদ্র রোষের চাহনিতে চকিতে জ্বলে ওঠা অগ্নি স্ফুলিঙ্গের আজ এতো ঠা ঠা হাসি কেন। গুড়ু গুড়ু শব্দ তুলে সেই দৈত্য পেটে তার ধ্বংসের ঢাক বাজাচ্ছে-প্রবল এক ক্ষুধা তার হাহাকারের বাতাসে। সেই হাহাকার-ই শাঁই শাঁই হয়ে বাজে। বাঁশঝাড়ের এতক্ষণ ধরে নিথর হেলে থাকা মাথাখান বাতাসে অমন দোলায়ে ওঠে ক্যান। একি তবে সেই মা মনসা, জেগে উঠছেন তার বিষাসনে থেকে। শরীরের আঁইশে যে বিষ জমায়া রাখছে তার সবই কি ওগলায়া দিবো এই রাইতে। তাই-কি সে বাঁশ ঝাড়ের রুপে আজ সাজনিছে। একটু পরেই বেরিয়ে আসবে আসল চেহারায়, মেলে দিবে মুক্তা ঝিকানো ফনাখানা আকাশে, আর তার তীক্ষ্ণ দাঁত বেয়ে বেয়ে, আক্রোশে লকলকিয়ে ওঠা জিহ্বাখানা থেকে ফোঁটায় ফোঁটায় বিষবৃষ্টি আসবে। মরে যাবে সে, বেঁচে উঠবে না কাল সকালে, দেখা হবে না সুখির সাথে।

আমিনুলের আইজ বহুত কাম। চৌধূরী বাড়িত যাইতে অইবো, আম গাছের গুড়ি গুলা ভ্যানে তুইলা তায় আবার নাগের বাজার দিয়া আসো। তা নাগের বাজার কি আর খালি ভ্যানের শক্তিতে যাওয়া যায়, চড়াই আসলে তহন গতরের হেটমও লাগে, ওই সোমে কান্ধে তুইলা ভ্যান ঠেলতে অয়। তাছাড়া রাতে তার ঘুমও হয়নি। ঘন হয়ে আসা রাত যে এতো ভয়ের কেটেছে তার কারণ আর কিছু না, সুখীকে দেখার উত্তেজনা। এই উত্তেজনায় প্রেম নাই তা যেমন মিছা কথা তেমনি মিছা কথা যে ওই প্রেমে শরীর নাই। কারণ সুখীর বিয়ে হয়ে গেছে। এখন প্রেমের প্রকাশে আর দায়িত্ব নাই, প্রাত্যহিকতা নাই, অভিমান নেই। তা কেবলই ক্ষণিকের আবেগ তীব্রতা হয়ে ওঠা। সেই আবেগকে প্রচন্ড করে তুলতে পারে কেবল শরীর, এক মুহূর্তের জন্য, প্রাপ্তির কোন আশা না করে। সমাজ-সংস্কার ভীতি সমস্তকে ভুলে থাকায় যায় শরীরের শিহরণেই কেবল। যারা পরিশীলিত জীবন চান, তারা বলবেন এ ঠিক নয়। কেবল শরীরে প্রেম হয় না। হয়তো তা-ই। কেবল শরীরকে কখনোই প্রেম বলা যায় না। কিন্তু যে প্রেমের সংসার হয় না সে কোথায় গিয়ে নিজের প্রকাশ ঘটায়। সবার ক্ষেত্রে শরীর নাও হতে পারতো, আমিনুলের ক্ষেত্রে তা-ই হয়েছে। এ কোন প্রাপ্তি বা শাস্তির বিবেচনা না করেই। প্রবল এক ক্ষুধায় সে যখন ওই আম গাছের গুঁড়ি বাজারে দিয়ে ফিরে আসবে-তখন তার মনে হয়েছিল মানুষ মরে গেলে তার আর কোন দাম থাকে না। সে একটা কলা গাছও না যে তাকে কাজে লাগাবে। তখন খালি মাটির চাদর গায়ে দিয়া তুমি চীরকাল ঘুমাওগা। তোমারে কেউ দেখতেও আইবো না, ভ্যান গাড়ি টানতেও কইবো না। 'সব চোকের ভুল-দুইন্যাইডার মাইদ্যে খালি চোকের বুল আর জিহ্বার স্বাদ আর কিচ্ছু না।' সে একবার মোক্তারকে বলেছিল। আসলেই-তো তাই। সে যখন সুখীরে বিয়ে করতে পালো না। তখন কি ওর খারাপ লাগেনি। লেগেছে, সে খবর কেউ জানে না। কয়েক রাত তার ঘুম, কয়েক বেলা তার খাওয়া সম্তই এলোমেলো। আর এরপর যখন সুখী এলো বোনের বাড়ি, তখন দেখা হয়েছিলো তাদের, সর্বশেষ। সন্ধ্যার অন্ধকারে, তখন ওই নিরালায় সুখী তাকে জড়িয়ে ধরেছিল- তারপর কাল আবার তাদের দেখা হবে। এবং সে জন্যে সূর্য্যকে উঠে আসতে হবে তাদের গ্রামের আকাশে, তো সেই সুর্য্য যদি আর না ওঠে। এই ভয়ই যখন সে পায় তখন ওই জৈষ্ঠ্যের হঠাৎ ঝড়কে সে ভয় পেতেই পারে। ঝড় বেশি হলে সুখী যদি না আসে। ওইদিন জড়িয়ে ধরার পর সুখীর গায়ের গন্ধ, বুকের নরোম ওম -সমস্তই যে সে গায়ে হাতে মেখেছে, সেই গন্ধ আর পরম নির্ভরতাই যখন তাকে ডাকছে তখন শরীর-তো থাকবেই। কেন দোষ দিবেন তার।

আমিনুলের গতরখানা দেখার মতো। উদিলা গয়ে তার বরণ পাকাভোগির মতো। বুকের চওড়া জমিনে বাতাস আঙ্গুল বুলায়, কাঁধে তার ভীষণ শক্তি। আর তার চেহারা ছোট বেলায় দেখা যাত্রার নবকুমারের মতো। চোখ দুটো বড়ো বড়ো, হাসে কোন শরম ছাড়াই। কখনোই মুখের দিকে তাকায় না। খালি ঘুর ঘুর করতো। সেই আমিনুলের সাথে সুখীর বিয়ে হয়নি-তাতে সুখীর আফসোস নেই। যে মরদ মুখ ফুইটা কিছু কইতে পারে না, সে আবার মরদ নাকি। তারতো মরদ চাই, আমিনুলের মতো খালি গতরে শক্তি থাকলে চলবে না। বেশরমও অইতে অইবো। মিনমিন করা পুরুষ তার পছন্দ না। সুখীর ধারণা এই স্বভাবের পুরুষের বৌরা সুখী হয় না। তাই যখন পুবের বাজারে তার বিয়ে হলো তখন সে ভাবেইনি আমিনুলের কথা। কিন্তু এখন যখন তার স্বামী খুনের আসামী হয়েছে, এক বছর তার কোন হদিস নাই। খালি বুড়া শ্বশুর আর দেবরের সংসার দেখা ছাড়া তার জীবনে কোন কাজ নাই। তখন বোনের বাড়ি গিয়ে সেই আমিনুলকে আবার দেখলো। দু'জনে পরিকল্পনা করে শহিদুলদের বাড়ির বাঁশঝাঁড়ের জঙ্গলে দেখা করলো। আমিনুলের প্রতি তার প্রেম, না-কি পুরুষ বঞ্চিত থাকার যন্ত্রণা-অথবা একঘেয়ে জীবনের কষ্টগুলো সব গুমরে উঠলে কিংবা এমনও হতে পারে আমিনুলের চেহারায় যে মায়া ভাসে সেই মায়ার টানে আর নইলে আমিনুলের ঘামের গন্ধ তাকে নিরুপায় করে তুললে সে আমিনুলকে জাপটে জড়িয়ে ধরে। অবশ্য তার আগে আমিনুল জিজ্ঞেস করেছিলো সুখী কেমন আছে। যদিও এই প্রশ্ন শুনে সুখী হাউমাউ করে কেঁদে ওঠেনি। কেবল আমিনুলের বুকে মুখ আর ঠোঁট ঘষেছিলো।

তবে শরীর নিয়ে সুখীর কখনোই কোনো চিন্তি ছিল না। বয়েস সন্ধিকালীন শারীরিক যাতনাগুলোকে সে আড়ালই করেছে। কারণ সে জেনেছে এসব আড়ালেরই বিষয়। কিন্তু বিয়ের পর জামাল যখন প্রথম পুরুষ হিসেবে শরীর স্পর্শ করলো, তখন সে এর আবেশে মুগ্ধ হয়েছে, আবেগে ভেসেছে, শিহরণে অবগাহিত হয়েছে, স্ফূরণে কেঁপে কেঁপে উঠেছে, কাছে পাওয়ার কামনায় জড়িয়ে ধরেছে, তীব্রতায় জ্বলে জ্বলে উঠেছে। তারপর চৈত্রের দাবদাহে বৃষ্টি হয়ে ঝরেছে, বিলের জলে খলবল করে ছুটে চলা খোলশে মাছ হয়েছে, ফিঙ্গের লেজে নেচে উঠেছে, আকাশবিহারী হয়েছে। নব অংকুরের কামনায় শিৎকারে উঠেছিলো বারবার। কিন্তু সেই জামাল তার জীবনে আর কখনো আসবে কি-না সেই নিশ্চয়তা নেই। আবার জামাল এসব ঝামেলায় জড়িয়েছে তাকে না জানিয়েই-এ অভিমান তার ছিলো। আর নিশ্চয় একাকীত্ব তাকে অসহায় করেছে। সেই সমুদ্রে কুলহীন সুখী আমিনুলেই কি নব অংকুরের জমিন খুঁজে পেয়েছিলো। নইলে প্রকৃতির রহস্যময়তা আছর করছিলো তাকে সেই সন্ধ্যায়। যার ফলে সে আমিনুলের সাথে ওই কান্ডটি করে থাকতে পারে। কারণ তখন বাতাসে খড়ের ওম ওম গন্ধ ভেসে যাচ্ছিল। একটা মুখ ভাঙ্গা চাঁদ আকাশে বসে বসে রাত দেখছিলো-একা একা। সেই চাঁদের আলোয় আমিনুল তার না পাওয়া জামাল হয়ে ওঠেনি, এটা কে বলবে।

জামাইর বাড়ি ফিরে গিয়েও সুখী ভাবতে চেয়েছে। কিন্তু পারেনি। আমিনুলের গায়ের গন্ধ এখনো তার নাকে। মাতাল করা সে গন্ধ। ছাতিমের অমন গন্ধ হয়। আর নইলে স্বর্ণচাঁপায় এই গন্ধ আছে। যা গন্ধেরও অধিক হয়ে ওঠে। হয়ে ওঠে ভালোবাসা, হয়ে ওঠে ভয়হীন রোমাঞ্চ। এক দুর্নিবার টান আছে সেই গন্ধে। আমিনুলের বুকের গন্ধেই বিভোর হয়ে সুখি মাতোয়ারা রাত কাটায়, বোনের বাড়ি আমলাবো যাওয়ার আগের রাতে।


চলবে............................
সর্বশেষ এডিট : ২৩ শে জুন, ২০০৯ সন্ধ্যা ৭:২৩
২৭টি মন্তব্য ২৪টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

মিশন: কাঁসার থালা–বাটি

লিখেছেন কলিমুদ্দি দফাদার, ০৪ ঠা ডিসেম্বর, ২০২৫ রাত ৯:২৭

বড় ভাই–ভাবীর ম্যারেজ ডে। কিছু একটা উপহার দেওয়া দরকার। কিন্তু সমস্যা হলো—ভাই আমার পোশাক–আশাক বা লাইফস্টাইল নিয়ে খুবই উদাসীন। এসব কিনে দেওয়া মানে পুরো টাকা জ্বলে ঠালা! আগের দেওয়া অনেক... ...বাকিটুকু পড়ুন

আওয়ামী লীগের পাশাপাশি জামায়াতে ইসলামীকেও নিষিদ্ধ করা যেতে পারে ।

লিখেছেন সৈয়দ কুতুব, ০৫ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ রাত ১২:৪৫


বাংলাদেশে আসলে দুইটা পক্ষের লোকজনই মূলত রাজনীতিটা নিয়ন্ত্রণ করে। একটা হলো স্বাধীনতার পক্ষের শক্তি এবং অন্যটি হলো স্বাধীনতার বিপক্ষ শক্তি। এর মাঝে আধা পক্ষ-বিপক্ষ শক্তি হিসেবে একটা রাজনৈতিক দল... ...বাকিটুকু পড়ুন

J K and Our liberation war১৯৭১

লিখেছেন ক্লোন রাফা, ০৫ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ সকাল ৯:০৯



জ্যাঁ ক্যুয়ে ছিলেন একজন ফরাসি মানবতাবাদী যিনি ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সময় পাকিস্তান ইন্টারন্যাশনাল এয়ারলাইন্সের একটি বিমান হাইজ্যাক করেছিলেন। তিনি ৩ ডিসেম্বর, ১৯৭১ তারিখে প্যারিসের অরলি... ...বাকিটুকু পড়ুন

এবার ইউনুসের ২১শে অগাষ্ঠ ২০০৪ এর গ্রেনেড হামলার তদন্ত করা উচিৎ

লিখেছেন এ আর ১৫, ০৫ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ সকাল ৯:৪০



এবার ইউনুসের ২১শে অগাষ্ঠ ২০০৪ এর গ্রেনেড হামলার তদন্ত করা উচিৎ


২০০৪ সালের ২১ শে অগাষ্ঠে গ্রেনেড হামলার কারন হিসাবে বলা হয়েছিল , হাসিনা নাকি ভ্যানেটি ব্যাগে... ...বাকিটুকু পড়ুন

বাংলাদেশের রাজনীতিতে নতুন ছায়াযুদ্ধ: R থেকে MIT—কুয়াশার ভেতর নতুন ক্ষমতার সমীকরণ

লিখেছেন এস.এম. আজাদ রহমান, ০৫ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ দুপুর ১২:৪৪



বাংলাদেশের রাজনীতিতে নতুন ছায়াযুদ্ধ: R থেকে MIT—কুয়াশার ভেতর নতুন ক্ষমতার সমীকরণ

কেন বিএনপি–জামায়াত–তুরস্ক প্রসঙ্গ এখন এত তপ্ত?
বাংলাদেশের রাজনীতিতে দীর্ঘদিন ধরে একটি পরিচিত ভয়–সংস্কৃতি কাজ করেছে—
“র”—ভারতের গোয়েন্দা সংস্থা নিয়ে রাজনীতিতে গুজব,... ...বাকিটুকু পড়ুন

×