দুটো ঘটনার বর্ণনা দিয়ে লিখা শুরু করি,
এক আত্মীয়ার গ্রামের বাড়ি গিয়েছি ঘুরতে। বারান্দায় সবাই মিলে বসে আছি।এমন সময় রাস্তা দিয়ে জীর্ণশীর্ণ দেহের একজন লোক মাথায় একটা বস্তা নিয়ে যাচ্ছিলেন। পেছনে খুব সম্ভবত তার স্ত্রী এবং মেয়ে। রোজার ইদের কিছুদিন আগে তাই স্বভাবতই মনে হচ্ছিল, খেটেখাওয়া মানুষটি তার সামান্য পুঁজি দিয়ে হয়তো আপনজনদের মুখে একটু -আধটু হাসি ফোটানোর চেষ্টা করেছে। কিন্তু খানিকের মধ্যেই আমার ধারণা ভুল প্রমাণ করে উপস্থিত একজন আফসোসের সাথে বলে উঠলেন, '' কন্যাসন্তান জন্মের দায় এতটাই যে আজীবন তা বয়ে বেড়াতে হয়। সামনে ইদ, তাই মেয়ের শ্বশুরবাড়ির মন জোগানোর জন্য বাবা-মা সাধ্যের বাইরে গিয়ে হলেও উপঢৌকন আনার চেষ্টা করেছেন।'' এও জানতে পারি যে, মনমতো কিছু না পেলে শ্বাশুড়ি তার ছেলের বৌকে কথা শুনিয়ে থাকে, সেইসাথে পাড়া প্রতিবেশীদের সাথে কানাঘুঁষা করে। রোগাটে টাইপের দুর্বল মানুষটি ভারে নুহ্য হয়ে পড়েছে, ঠিকমতো হাঁটতে পাচ্ছেনা, এমনটি দেখলে যে কারুর কষ্ট লাগবে। তাই হয়তো সম্বলহীন বাবার মলিন মুখটি আমার নৈতিকতার কপাটে চপোটাঘাত করতে থাকে। আমি ওই অসহায় মানুষের মুখটা ভুলতে পারিনা।
এবার আসি দ্বিতীয় ঘটনায়, আমার একজন পরিচিত ছেলে ছাত্রাবস্থায় বিয়ে করেছে। তার ভাষ্যমতে, মেয়ের পরিবার পছন্দসই ছেলে পেয়ে তার পরিবারকে না জানিয়ে কৌশলে বিয়ে দিয়েছে। ছেলেটি এই সম্পর্ক নিয়ে খুব অসুখী সেটা তার চোখ মুখেই ফুটে উঠেছে। নিজেদের মধ্যে সমঝোতা করে সম্পর্ক ঠিক করছেনা কেন তা জানতে চাইলাম। উত্তরে বললো, কোনোভাবেই নাকি বনিবনা হচ্ছেনা, সম্পর্ক নরমাল করা যাচ্ছেনা এবং দিনদিন তা তিক্ততার রূপ নিয়েছে। আক্ষেপের সাথে আরো জানালো, বিয়ের দেনমোহর ধার্য করেছিল বিশ লাখ টাকা যেটা পরিশোধ করা তার সাধ্যাতীত। অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলাম, একজন ছাত্র কীভাবে তার বিয়ের দেনমোহর বিশ লাখ টাকা করতে সম্মতি দিতে পারে ! পুরোটাই নাকি অল্প বয়সের ভুল আবেগ ছিল যা সে সময় গড়িয়ে যাবার সাথে সাথে অনুধাবন করতে পেরেছে। কাগজে কলমে তারা সঙ্গী হলেও, মানসিক কোনো টান যে বিদ্যমান নেই, তা সহজেই অনুমেয়।
দুটো ঘটনাই আমার কাছে ভয়ংকর লেগেছে। বিয়েটা তো একটা নির্মল বন্ধন যেখানে দুইজন নারী-পুরুষ একে অন্যকে সামাজিকভাবে স্বামী-স্ত্রী হিসেবে স্বীকৃতি দেয়। দুজন মানুষ গাঁটছড়া বাধে পরস্পরের সুখ -দুঃখের চিরসাথী হবার প্রত্যয়ে। এত সুন্দর একটি বন্ধন শুরুতেই কলুষিত হয় যৌতুক আর দেনমোহরের কঠিন দরকষাকষিতে। শুরু হয় লাভ-লোকসানের হিসাব। বরপক্ষ অতিরিক্ত দেনমোহর দিতে অসম্মতি জানালে কনেপক্ষ মন খারাপ করে জানতে চায়, তাদের মেয়ের মূল্য কী এতই কম !! কেউ কেউ ভাবেন, বেশি মোহরানা ধার্য করা না হলে মেয়েটিকে তার হাসব্যান্ড যেকোনো সময় ছেড়ে চলে যেতে পারে। তারমানে সম্পর্ক টিকিয়ে রাখার জন্য একধরণের বাইন্ডিং দিয়ে দেয়া হয়।
ওদিকে, বরপক্ষের মুখ কালো হয়ে যায় যদি মেয়ের সাথে সন্তুষ্টি পরিমাণে উপঢৌকন না আসে। এই সন্তুষ্টির পরিমাণ/লিমিট যে ঠিক কতটুকু, সেটা বুঝা মুশকিল। তবে এখনকার যুগের ছেলের বাবারা ভদ্র হয়ে গেছে। সরাসরি যৌতুক চায়না। তাদের প্রেস্টিজে লাগে। কিন্তু মেয়ের নতুন সংসার গুছিয়ে দেবার দায় তো মেয়ের বাবা মায়ের কোনোভাবেই এড়ানো উচিত না, এমন কলুষিত ভাবনা থেকে তারা বের হয়ে আসতে পারেনা। তাইতো মেয়ের সাথে আশানুরূপ উপহার না পেলে কড়া সুরেই হোক আর হাসি হাসি মুখে হালকা পিঞ্চ কেটেই হোক, একগাদা কথা শুনিয়ে দেয়। নতুন বউটিকে শুনিয়ে শুনিয়ে আক্ষেপ করতে থাকে, অমুক ছেলে বিয়েতে তার শ্বশুরবাড়ি থেকে হাতি, ঘোড়া, উড়োজাহাজ ইত্যাদি অনেককিছু পেয়েছে। তার ছেলেটার ভাগ্য এতটাই খারাপ যে কিছুই পেলোনা। এই আফসোসে তাদের রীতিমতো ঘুম হারাম হয়ে যায়। এও ভাবতে থাকে যে তমুকের মেয়ের সাথে বিয়েটা দিলে কত কী পাওয়া যেতো !! সেইসাথে তো আশেপাশের লোকজনের জিজ্ঞাসা আছেই, ''ছেলে বিয়েতে কী পেলো!'' এসব লোভী ভাবনা একটি মেয়ের মনে নতুন পরিবারটি নিয়ে নেতিবাচক ধারণার জন্ম দেয়।
ভিন্ন দুটো পরিবারের মানুষদের মানসিকতা একদম একই থাকবেনা, সেটা খুব স্বাভাবিক। দুইপক্ষ যদি এমনভাবে লাভ-ক্ষতির হিসেব কষতে থাকে, তাইলে আত্মার বন্ধনটা কখনোই তৈরী হয়না। আর সেটা নব-দম্পত্তিদের জন্য কঠিন অভিশাপ হয়ে দাঁড়ায়। 'ছেলের বিয়েতে আয় হয় আর মেয়ের বিয়েতে দিতে হয়’ এই টাইপ চিন্তা -চেতনা থেকে যতদিন না আমরা বের হয়ে আসতে পারবো, ততদিন আধুনিক যৌতুকের ঘানি আমাদের টেনে যেতেই হবে।
যেহেতু আমরা মেয়েরা পুরুষের সাথে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে সমানতালে এগিয়ে চলেছি, তাই হাজার বছরের এই অভিশাপ মোচনের ঢের সময় এসে গেছে। মোহরানা কখনো আমাদের নিরাপদ জীবনের /সম্পর্কের নিশ্চিন্ত অবলম্বন হতে পারেনা, এতটুকু বুঝার মতো ম্যাচিউরড মানসিকতা গড়ে তুলতে হবে। সেইসাথে অতিরিক্ত পরিমাণে দেনমোহর নেবার প্রথা ঘৃণাভরে প্রত্যাখ্যান করে সমাজটাকে বুঝিয়ে দেবার সুযোগ হয়েছে যে, আমাদের সম্মান আমরা নিজস্ব মেধা-মননের দ্বারা প্রতিষ্ঠা করতে পারি।
আর, আমাদের তরুণদেরও সমস্বরে যৌতুক প্রথাকে 'না' বলে সমাজ থেকে তা ঝেঁটিয়ে বিদায় করা উচিত। একজন বাবার কলিজার টুকরা, আদুরে কন্যাকে পাওয়ার থেকে বড় আর কোনো উপহার হতে পারেনা। সঙ্গীনি সবসময় তার পাশে শক্তি হয়ে, সাহস হয়ে, প্রেরণা হয়ে থাকবে, তার জীবনটাকে সুন্দর করে গুছিয়ে রাখবে এর চেয়ে শ্রেষ্ঠ পাওয়া আর কী ই বা হতে পারে !
আধুনিকতার যুগ পেরিয়ে এখন আমরা অত্যাধুনিক সময়ে বসবাস করছি। তাই, নিজস্ব স্বকীয়তা দিয়ে নিজের আত্মমর্যাদা বৃদ্ধি করবার মতো উদার মানসিকতা তৈরী করতে হবে। বিয়ে মানে হোক, একটা সুন্দর সম্পর্ক যেখানে থাকবে বিশ্বাস, সবসময় পাশে থাকবার প্রতিশ্রুতি আর অফুরন্ত ভালোবাসার অপূর্ব মেলবন্ধন।
গুগল থেকে সংগৃহীত ফটো
সর্বশেষ এডিট : ২০ শে জানুয়ারি, ২০২০ সন্ধ্যা ৬:২৯