যাপিত জীবনে অহরহ আমাদের মনে ভয়ের উদ্রেক হয়। ভয় ব্যাপারটা অনেকটাই মনস্তাত্বিক। ভবিষ্যতে খারাপ কিছু ঘটতে যাচ্ছে যা আমাদের বেদনার কারণ হতে পারে এমন শঙ্কা থেকে মানুষের মনোজগতে যে মানসিক চাপ তৈরী হয় তাকে ভয় বলে অভিহিত করা হয়েছে। ছোটকাল থেকেই আমাদের মধ্যে ভয় পাবার প্রবণতা দেখা দেয়। শিশুরা অপরিচিত মানুষকে দেখলে কান্নাকাটি করে, তাদের আদর গ্রহণ করতে অনীহা প্রকাশ করে। এসব শিশুর কোমল মনে ভীতির বহি:প্রকাশ। এমনকি প্রত্যেক প্রাণী ই ভয় পায়।
ব্যাপারটা মনোজগতের বিষয় হলেও অনেকে বলে থাকেন, একজন মানুষ ধীরে ধীরে তার পরিবেশ থেকে ভয় পেতে শেখে। যেমন, শিশুরা কোনোকিছু খেতে না চাইলে, ঘুমাতে না চাইলে, বড়দের কথা শুনতে না চাইলে তখন বিভিন্ন পোকামাকড়, পুলিশের ভয় অথবা ভুতের ভয় ইত্যাদি দেখানো হয়। বড়োরা শারীরিক অঙ্গভঙ্গি অথবা কথাবার্তার মাধ্যমে ভয় দেখিয়ে ছোটদের নিয়ন্ত্রণ করতে চায়। তাই, ভয় ব্যাপারটা মনস্তাত্বিক হলেও অধিকাংশ ক্ষেত্রে সামাজিক অনেক কার্যকলাপ প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে যুক্ত থাকে বললে অত্যুক্তি হবেনা।
বিবিধ রকমের ভয়:
কিছু ধরণের ভয় আছে যেগুলো খুব স্বাভাবিক যেমন অন্ধকারকে ভয়, ভুতের ভয়, পরীক্ষার সম্ভাব্য ফলাফল নিয়ে ভয়, মানুষের সামনে কথা বলতে ভয় ইত্যাদি। আবার, এটি যখন কিছুটা তীব্র আকার ধারণ করে যা মানব মনে অস্বস্তিকর অনুভূতির উদ্রেক করে তাকে 'ফোবিয়া' বলা হয়। উইকিপিডিয়াতে বিভিন্ন প্রকার ফোবিয়ার কথা উল্লেখ রয়েছে। কোনো কিছু হারানোর ভয়কে ডিসপোসোফোবিয়া (Disposophobia) , নিজেকে নিয়ে হাসাহাসি বা হেয় করার ভয়কে গেলোটোফোবিয়া (Gelotophobi), সিদ্ধান্ত নেবার ভয়কে ডেসিডোফোবিয়া (Decidophobia), টেলিফোনে কথা বলার ভয়কে টেলিফোন ফোবিয়া (Telephone phobia), আঘাতপ্রাপ্ত হবার ভয়কে ট্রামাটোফোবিয়া (Traumatophobia) বলা হয়। অবাক করা বিষয় হলেও সত্য যে, মানুষের ফুলের প্রতিও ভীতি রয়েছে। আর তাকে বলা হয় এনথোফোবিয়া (Anthophobia)। এছাড়াও, আরো বহু ধরণের ফোবিয়া রয়েছে যেগুলো সম্বন্ধে জানতে চাইলে 'ভয়সমূহের তালিকা' শিরোনামের উইকি পাড়া (উইকিপিডিয়ার ওয়েবসাইটটি) তে ঢু মারতে পারেন।
ভয় পাবার সম্ভাব্য কারণ:
বার্ট্রান্ড রাসেলের মতে, ''ভয় হচ্ছে কুসংস্কারের জনক, কুসংস্কারের সাথে জন্ম নেয় নিষ্ঠুরতা। যদি ভয়কে জয় করতে পারেন তবেই আপনি এগোতে পারবেন প্রজ্ঞার পথে।'' তাই ভয় পাবার যথাযথ কারণ অনুসন্ধান করা অত্যাবশ্যকীয়। শুরুতেই উল্লেখ করা হয়েছে যে, ভয় খানিকটা মানসিক ব্যাপার। কিন্তু তা অনেকখানি নির্ভর করে আমাদের চারপাশের পরিস্থিতি ও মানুষের আচরণের উপর। এছাড়াও একধরণের নৈরাশ্যবাদী মনোভাব থেকে ভয়ের সৃষ্টি হয়। কোনোকিছু করতে গেলে তার নেতিবাচক ফলাফল পাবার সম্ভাব্যতা মানব মনে উদ্বেগের কারণ হতে পারে।
মানুষ স্বভাবতই প্রত্যাখ্যাত হতে চায়না। যখন ভাবতে থাকে যে বসের কাছে কোনোকিছু আবদার করলে অথবা প্রস্তাব পেশ করলে তা ফিরিয়ে দেবার সম্ভাবনা রয়েছে, তখন সে ভয় পায়। যার দরুণ অনেকটা সময় ধরে অজানা আশংকায় ভুগতে থাকে। এসব বাদেও, অতীত অভিজ্ঞতা মানুষের মধ্যে ভয়ের উদ্রেক করে। গ্রাম্য একটি প্রবাদ প্রচলিত আছে, 'চুনে মুখ পোড়ে যার, দইয়েও ভয় হয় তার।' অর্থ্যাৎ অতীতে কাজ করে ব্যর্থ হবার পরে পুনরায় কোনো কাজ শুরু করতে গেলে মানুষের মধ্যে পূর্বের ফলাফল পুনরাবৃত্তি হবার শঙ্কায় একধরনের ভীতিকর মনোভাবের সৃষ্টি হয়।
লক্ষণসমূহ:.
ভয় পেলে মানুষের মধ্যে বিভিন্ন প্রকার শারীরিক ও মানসিক অস্বাভাবিকতা দেখা দেয়। যেমন:
১) হার্টবিট বেড়ে যাওয়া (খাঁটি বাংলায় আমরা বলি, বুক ধুকধুক করছে);
২) শরীরে প্রচন্ড ঘামের সৃষ্টি হওয়া (শীতের সময়ও মানুষের গা দরদর করে ঘাম বেয়ে পড়তে পারে);
৩) মাথা ঘোরা ও বমিবমি ভাব হওয়া (অনেকে অতিরিক্ত নার্ভাস হয়ে বমি করে ফেলেন);
৪) শ্বাস -প্রশ্বাসে অস্বাভাবিকতা (দম বন্ধ হয়ে আসছে এমন মনে হতে পারে);
৫) ক্ষুধামন্দা আবার অনেকের ক্ষেত্রে অতিরিক্ত ক্ষুধাভাব তৈরী হওয়া;
৬) বুকে ব্যাথা অনুভব করা এবং অজ্ঞান হয়ে যাওয়া;
৭) আত্মবিশ্বাস কমে যাওয়া যা ভুক্তভোগীর মধ্যে হতাশা তৈরী করে;
৮) জনসমাগম এড়িয়ে চলবার প্রবণতা ইত্যাদি।
ভয়কে জয় করবার কৌশল:
ভয় মানুষের স্বাভাবিক প্রবণতা হলেও তা যখন অতিরিক্ত পর্যায়ে চলে যায় তখন সেটিকে একধরণের মানসিক রোগ বলা হয়ে থাকে। কোনো উদ্ভুত পরিস্থিতি ভয়ের সঞ্চার করলে আমাদের তা নিয়ন্ত্রণ করবার চেষ্টা করা উচিত। কীভাবে ভয়কে (বিশেষ করে দীর্ঘমেয়াদী ভয়) জয় করা যেতে পারে তা নিয়ে বিশেজ্ঞরা বিভিন্ন পরামর্শ দিয়েছেন। নিম্নে কিছু কৌশল সম্পর্কে আলোকপাত করা হল:
কোন বিষয়ে ভয় হয় তা বের করুন: যেহেতু ভয়টা আপনার নিজের মধ্যে থেকেই আসছে তাই সর্বপ্রথম আপনাকে খুঁজে বের করতে হবে ঠিক কোন সব কারণে আপনি ভয় পান। সম্ভব হলে তা কাগজে লিখে ফেলুন। তারপর এর যৌক্তিকতা ও সম্ভাব্য ফলাফল নিয়ে পর্যালোচনা করুন। পারলে, সেগুলো ছোট্ট করে লিখে রাখতে পারেন।
স্বাভাবিক ঘটনা হিসেবে ভাবুন: কোনো একটা পরিবেশে আপনি হয়তো ভয় পাচ্ছেন এবং ভাবছেন আপনার স্বাভাবিক কার্যকম ব্যাহত হতে চলেছে। এমন ভাবনা আপনাকে আরো অপ্রস্তুত করে দেবে। সেক্ষেত্রে, এটিকে খুব স্বাভাবিক একটি প্রক্রিয়া হিসেবে ভাবুন এবং যথাসম্ভব পাত্তা না দিয়ে চলুন।
নিজেকে ভালো করে প্রস্তুত করুন: কোথাও প্রেজেন্টেশন অথবা সভা -সেমিনারে বক্তৃতা করতে গেলে কিংবা কারো সাথে সাক্ষাতের পূর্বে ঘরে নিজেকে ভালোভাবে প্রস্তুত করুন। কী কী বিষয়ে আলোকপাত করতে চান সেগুলো গুছিয়ে ফেলুন। হালকা নোট করে ফেলুন। প্রয়োজনবোধ করলে আয়নার সামনে অনুশীলন করুন। ভালো প্রস্তুতি আপনার মধ্যে আত্ত্ববিশ্বাস বাড়াবে। ফলশ্রুতিতে, আপনার ভয় পাবার সম্ভাবনা কম থাকবে।
ভয়কে চ্যালেঞ্জ হিসেবে গ্রহণ করুন: আমরা চাই, সবকিছু সুন্দরমত খুব সহজে হয়ে যাক। কোনো চ্যালেঞ্জ নেয়াও যে একধরণের আর্ট, তা আমরা উপলব্ধি করতে পারিনা। এর প্রকৃত সৌন্দর্য তখনই উদ্ভাসিত হবে যখন আমরা চ্যালেঞ্জটি নেব এবং জয় করার নিমিত্তে সামনে আগাবো। তাই, ভয়কে চ্যালেঞ্জ হিসেবে নিয়ে জয় করবার চেষ্টা করুন।
ভয়ের বিষয়টা শেয়ার করুন: আপনি কেন ভয় পাচ্ছেন, তার ফলে কী ধরণের সমস্যা তৈরী হচ্ছে তা বিশ্বস্ত কারো সাথে শেয়ার করে নিজেকে হালকা করুন। যখন দেখবেন, কঠিন সংগ্রামের সময় আপনি একা নন, আপনার পাশে আরো শুভাকাঙ্খী রয়েছে; তখন আপনি কিছুটা হলেও আশ্বস্ত হবেন। সেইসাথে তাদের অভিজ্ঞতা থেকে প্রাপ্ত পরামর্শও আপনার কাজে লাগতে পারে।
স্বাস্থসম্মত খাবার: অনিয়ন্ত্রিত জীবনযাপন ও খাদ্যাভ্যাস মানুষকে হতাশ করে, তার কর্মক্ষমতা হ্রাস করে যা থেকে পরাজিত হবার ভয় তৈরী হয়। পুষ্টিসমৃদ্ধ খাবার মানুষের শরীর সুস্থ রাখে ও মন সতেজ করে। তাই, যথাসম্ভব পুষ্টিকর খাবার দিয়ে খাদ্যতালিকা সমৃদ্ধ করুন।
ভ্রান্ত ধারণা পরিহার করুন: কোনোকিছু করবার আগেই তার ফলাফল নিয়ে সন্দিহান হবেন না। আমি পারবোনা, আমাকে দিয়ে হবেনা এমনসব ভ্রান্তধারণা পরিহার করুন। ভবিষ্যৎ সম্পর্কে যেহেতু আপনি সম্পূর্ণ অবগত নন, তাই তা সময়ের উপরই ছেড়ে দেয়া উত্তম। আপনার অবচেতন মনে ইতিবাচক ব্লু-প্রিন্ট তৈরীর চেষ্টা করুন। কেননা, আমাদের বাস্তবজগতের উপর মনোজগতের বেশ তীব্র প্রভাব রয়েছে।
আনন্দের উপকরণ তৈরী করুন: যে কাজগুলোকে আপনাকে আনন্দ দেয়, অবসরে সেসব কাজ করুন। খানিকটা সময় খেলাধুলা, ব্যায়াম অথবা মেডিটেশন করার চেষ্টা করুন। ভালো গান শোনা, সিনেমা দেখা, সৃষ্টিশীল কোনো কাজ (উদাহরণস্বরূপ, আঁকিবুকি, গান গাওয়া, আবৃত্তি, লেখালেখি করা, হ্যান্ডিক্রাফট বানানো ইত্যাদি) এ নিজেকে ব্যস্ত রাখুন। সুযোগ পেলে প্রিয়জনদের সাথে আড্ডা দিন, একসাথে সুন্দর মুহূর্ত স্মৃতিবন্দী করতে চেষ্টা করুন।
হিসেব-নিকেশ করুন: আপনি যে কাজ করতে চাচ্ছেন সেটি করলে কী হবে আর না করলে কী হতে পারে তা নিজে নিজে উপলব্ধি করবার চেষ্টা করুন। সেক্ষেত্রে, বিকল্প কোনো পন্থা (প্ল্যান-বি) ও ভেবে বের করার চেষ্টা করুন। কাজটা করার ফলে যে নেতিবাচক ফলাফলের শঙ্কা করছেন, সেটা ঘটলে তা থেকে উত্তরণের সম্ভাব্য উপায় খুঁজে বের করুন।
আমরা সাধারণত সমস্যার মোকাবেলা করতে ভয় পাই। যে জিনিসটাতে ভয় হচ্ছে, বারবার সেই জিনিসটা করার চেষ্টা করুন। নিজেকে যথাসম্ভব গুছিয়ে রাখুন। এটিকে জিইয়ে না রেখে শান্ত ও ধীরস্থিরভাবে মোকাবেলার চেষ্টা করুন। ভয় কাটিয়ে উঠবার জন্য যেটি প্রয়োজন, সেটি হলো আত্মবিশ্বাস।নিজের সক্ষমতার দিকে সজাগ দৃষ্টিপাত করুন। অতীত সাফল্য ও অর্জন নিয়ে ভাবুন। মনে রাখবেন, সমস্যার অবশ্যই সমাধান আছে। তাই, ভয় পাবেন না।
সময় হয়তো কখনো কখনো আমাদের সাময়িক চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি ফেলে দেয়। কিন্তু তা থেকে আমরা যথেষ্ট পরিমান মানসিক পরিপক্কতা ও অভিজ্ঞতা অর্জন করতে পারি। আছাড় খেলে পড়ে গেছেন না ভেবে ভাবুন, আপনি মাটিকে আঘাত করতে পেরেছেন। নিজের প্রতি একনিষ্ঠ থাকুন। সম্ভাব্য সকল পথে চেষ্টা করুন এবং প্রাপ্ত ফলাফলকে মেনে নিতে শিখুন। সাহসিকতার সাথে উঁচুনিচু পথ মাড়িয়ে, সকল বাধা ডিঙিয়ে সামনের দিকে দুর্বার গতিতে এগিয়ে যাবার প্রত্যয় গ্রহণ করুন। নেলসন ম্যান্ডেলার একটি উক্তি মনে রাখবেন -
''সাহস মানে ভয়ের অনুপস্থিতি নয়, বরং ভয়কে জয় করা। সে সাহসী নয়, যে ভীতি অনুভব করে না, বরং সেই সাহসী যে ভীতিকে জয় করে।''
সাহসী হতে শিখুন। দৃঢ় মনোবল একদিন না একদিন বিজয় আপনার হাতের মুঠোয় এনে দেবেই।
তথ্যসূত্র: উইকিপিডিয়া ও গুগল।
ইন্টারনেট থেকে সংগৃহিত ফটো।
সর্বশেষ এডিট : ২১ শে মে, ২০২০ রাত ২:৪৩