বাংলাদেশের ভৌগোলিক বাস্তবতা অন্যান্য মুসলিম দেশ থেকে ভিন্ন। মায়ানমারের সাথে সামান্য কয়েক মাইলের সীমান্ত ছাড়া তিন দিকেই ভারত। পার্শ্বে বা নিকটে কোনো মুসলিম দেশ নেই। ভারতের বিশাল ভূগোলের মাঝে ক্ষুদ্র বাংলাদেশের অবস্খান সে দেশের স্কুল ছাত্রদের কাছে উপস্খাপিত হয় এক বিরক্তিকর ও প্রশ্নবহ বিষয় রূপে। তাদের প্রশ্ন, কেমন করে তাদের অভ্যন্তরে বাংলাদেশ অস্তিত্ব পেল? এর উত্তর খুঁজতে গিয়ে ভারতীয় ছাত্রদের জানানো হচ্ছে সম্পূর্ণ ভিন্ন ও বিকৃত ইতিহাস, যার সাথে সত্যের কোনো সংশ্রব নেই।
বাংলাদেশ পাকিস্তানেরই রাজনৈতিক উত্তরাধিকার। পাকিস্তানের জন্মই হয়েছিল ভারতের মুসলমানরা আজ যেভাবে নির্যাতনের শিকার হচ্ছে তা থেকে বাঁচবার তাগিদে। অথচ পাকিস্তানকে চিত্রিত করা হচ্ছে বৃটিশ ষড়যন্ত্রের ফলরূপে। পাঠ্যবই, সিনেমা, টিভি সিরিয়াল, উপন্যাস ইত্যাদির মাধ্যমে এ বিকৃত ভাষ্যকে ইতিহাস বলে প্রতিষ্ঠিত করা হচ্ছে। ফলে শুধু পাকিস্তানেরই নয়, বাংলাদেশের প্রতিষ্ঠাকেই অতি প্রশ্নবহ করে তুলেছে নতুন প্রজন্মের কাছে।
পারস্পরিক সমতা, ভ্রাতৃত্ব ও ভালোবাসা প্রাধান্য পেলে বাংলাদেশের প্রতি ভারতের রাজনীতি কখনই এতটা প্রতারণামূলক হতো না। ভারতের আচরণ বুঝবার জন্য নিম্নের কয়েকটি দৃষ্টান্তই যথেষ্ট। এক) একাত্তরের পর পাকিস্তানীদের ফেলে যাওয়া সকল সামরিক যানবাহন, অস্ত্র, গোলাবারুদ, নৌযান ভারত কর্তৃক লুণ্ঠিত হয়। বাংলাদেশের জন্য রেখে যায়নি কিছুই। দুই) দ্বিপাক্ষিক চুক্তি মোতাবেক ১৯৭৪-এ বেরুবাড়ী ভারতকে দিয়ে দেয়া হয় কিন্তু বাংলাদেশের পাওনা তিনবিঘা এখনও দেয়া হয়নি। তিন) মুজিব আমলে ভারত বাংলাদেশের কারেন্সি নোট ছাপানোর দায়িত্ব নেয়। কয়েকগুণ নোট ছাপিয়ে কালো বাজারে ছেড়ে বাংলাদেশের অর্থনীতিকে সম্পূর্ণ পঙ্গু করে দেয়। চার) ১৯৭৫-এ মাত্র ৪১ দিনের জন্য ফারাক্কা বাঁধে গঙ্গা থেকে সর্বোচ্চ ১৬ হাজার কিউসেক পানি উত্তোলনের চুক্তি হয়। চুক্তি নবায়ন না করে ভারত অবিরাম পানি সরিয়ে নিয়েছে। ফলে বাংলাদেশের ক্ষতি হয়েছে হাজার হাজার কোটি টাকা।
ভারতে বুদ্ধিজীবী, রাজনীতিক ও মিডিয়ার সম্মিলিত প্রচেষ্টায় গড়ে উঠেছে এমনই এক মানসিকতা যার ফলশ্রুতিতে প্রায় প্রতিটি শিক্ষিতই সাতচল্লিশের পাক-ভারত বিভক্তিকে নিজেদের জন্য অভিশাপ ভাবে। কাশ্মীরে ভারতীয় জবরদখল, দলননীতি ও যুদ্ধের নামে ব্যাপক গণহত্যার যৌক্তিক ভিত্তি পেয়েছে এমনই এক চিন্তা-চেতনা থেকে। মানচিত্রে সর্বোচ্চ অবস্খানের কারণে কাশ্মীরকে ভারতীয়রা নিজ দেশের মুকুট মনে করে। কাশ্মীর ছাড়া ভারতের মানচিত্র পূর্ণাঙ্গ নয়, এমনি এক ভাবনা এমনকি স্কুল ছাত্রদের। বাংলাদেশকে ভাবে পেটের মধ্যে বিষফোঁড়া। পূর্বাংশের ৭টি রাজ্যের সাথে সংযোগে বাংলাদেশই সবচেয়ে বড় বাধা! বড় বাধা পূর্ব এশিয়ার পথে পা বাড়ানোতেও! এভাবে সচেতনভাবে গড়া হচ্ছে বাংলাদেশের বিরুদ্ধে এক বিষাক্ত বৈরী মনোভাব। বাংলাদেশে স্বাধীনতার ভবিষ্যৎ ভাবতে হবে ভারতের মতো বৈরী প্রতিবেশীর এমনি এক মানসিক প্রেক্ষাপটকে সামনে রেখেই।
প্রতিটি দেশের কাছেই তার স্বাধীন অস্তিত্বের প্রশ্ন অতি গুরুত্বপূর্ণ। বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ কি? স্বাধীনতার শত্রু-মিত্র কারা? স্বাধীনতার গ্যারান্টি বা রক্ষাকবচই বা কি? এসব প্রশ্ন আমাদের স্বাধীন অস্তিত্বের সাথে সম্পৃক্ত। বাংলাদেশ স্বাধীনভাবে টিকে থাকবে কি থাকবে না তা নির্ভর করবে এসব প্রশ্নের উত্তর কিভাবে খোঁজা হবে এবং তা থেকে কিভাবে শিক্ষা নেয়া হবে তার উপর। বাংলাদেশ চিরদিন টিকে থাকবে, এটুকু বললেই এর আয়ু দীর্ঘায়িত হবে না। শুধু আবেগ দিয়ে দেশের স্খায়িত্ব বাড়ে না। স্বাধীনতা নিয়ন্ত্রিত হয় জনগণের চিন্তা-চেতনা, ত্যাগের প্রেরণা, রাজনীতির তাগিদ ও অর্থনৈতিক প্রয়োজনে। এগুলোর তারতম্যে পরিবর্তিত হয় দেশের ভৌগোলিক মানচিত্রও। শুধু ভাষা একটি দেশের স্বাধীনতার একমাত্র উপাদান নয়। তাহলে বাংলাদেশের স্বাধীন অস্তিত্বের তেমন যৌক্তিক ভিত্তি থাকে না। পশ্চিমবঙ্গের সাথে মিলে এক অখণ্ড ভারতে লীন হওয়ার বিপক্ষেও তখন তেমন কিছু বলার থাকে না।
বিভিন্ন জাতির চিন্তা-চেতনা, আশা-আকাáক্ষা যেমন এক ও অভিন্ন নয়, তেমনি অভিন্ন নয় সেসব দেশের রাজনীতিও। এক ও অভিন্ন নয় তাই ভারত ও বাংলাদেশের রাজনীতি। প্রতি ফুলের যেমন নিজস্ব রং ও গন্ধ আছে, তেমনি প্রতি জনগোষ্ঠীর নিজস্ব কিছু বৈশিষ্ট্যও আছে। এ বৈশিষ্ট্যগুলোকে আরো বিশিষ্টময় করার জন্যই প্রয়োজন পড়ে ভিন্ন ভিন্ন রাষ্ট্রের। নইলে ভারতের বুকে একটাই রাষ্ট্র হতো এবং বিশ্বেও এতো রাষ্ট্র হতো না। এ দেশের মানুষ এককালে পাকিস্তান গড়েছিল এ কারণেই। আজকের বাংলাদেশ তারই ধারাবাহিকতা। ফলে জন্মসূত্রেই এটা বিশিষ্টময়।
স্বাধীনতার চেতনা খুঁজতে হলে অতীতে যেতে হবে। বাংলাদেশের নব্বই ভাগ মানুষ মুসলমান এবং অধিকাংশই ধর্মপ্রাণ। ফলে এ দেশের রাজনীতিতে ধর্মের প্রভাব থাকবে সেটা স্বাভাবিক। যারা ধর্মপ্রাণ তারা ধর্ম নিয়ে শুধু মসজিদেই যায় না বরং যেখানে যায় সেখানেই সঙ্গে নিয়ে যায়। ধর্ম লেবাস নয় যে ক্ষণে ক্ষণে খুলবে এবং প্রয়োজনে আবার পরিধান করবে। এটি ব্যক্তির অস্তিত্বের অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ। যেমন ফুল থেকে তার রূপ, রং আর গন্ধকে পৃথক করা যায় না, তেমনি ব্যক্তি থেকে তার ধর্মকেও। কি রাজনীতি, কি ব্যবসা-বাণিজ্য, কি শিল্প, কি সাহিত্য যেখানেই তার বিচরণ সে ঈমানের প্রতিফলন ঘটায়। প্রকৃত মুসলমানের কাছে নামায-রোযা, হজ্ব-যাকাতই শুধু গুরুত্বের নয়, গুরুত্বপূর্ণ রাজনীতিতে সক্রিয় অংশগ্রহণও। ইসলামের নবী রাজনীতির ময়দানে যতটা সময় ব্যয় করেছেন অন্য কাজে ততোটা করেননি।
শুধু দান-খয়রাত আর তাবলীগের ওপর নির্ভর করে আর যাই হোক সমাজের ইসলামীকরণ সম্ভব নয়। তাহলে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা রক্ষার কাজে নবীজী (সা ও তাঁর সাহাবাগণ যুদ্ধ করতেন না। এটুকু এতই মোদ্দাকথা যে, বুঝবার জন্য আলেম বা ইসলামে পণ্ডিত হওয়ার প্রয়োজন নেই। রাষ্ট্রের সংস্কারে অমনোযোগী হলে ইসলামের সত্যিকার অনুসরণ হয় না। ইসলামে জঞ্জাল সরানোর এ কাজটা হলো জিহাদ। প্রায় ষাট ভাগ সাহাবা একাজে শুধু অর্থই দেননি, জীবনও দিয়েছেন। তাদের রক্তের বরকতেই আমাদের মতো গাফেলরাও আজ জন্মসূত্রে মুসলমান।
মুসলমানরা যেখানে ঘর বাঁধে সেখানে স্বাধীন রাষ্ট্রও গড়ে। আল্লামা ইকবাল এ লক্ষ্যেই এ উপমহাদেশে একটি মুসলিম রাষ্ট্রের স্বপ্ন দেখেছিলেন। অথচ যারা সেক্যুলার রাজনীতিতে বিশ্বাসী তাদের কাছে এ রাষ্ট্রের যুক্তি কখনোই বোধগম্য হয়নি। এমনকি বিষয়টি বুঝেনি সেসব আলেমও যারা মসজিদের চার দেয়ালের মাঝে ইসলামকে বন্দী রাখতে চায়। ঘর বাঁধলে যেমন তার দেয়ালটাও জরুরি, তেমন জাতির জন্য জরুরি নিরাপদ সীমান্ত রেখা। এ জন্যই প্রয়োজন স্বাধীন রাষ্ট্র।
মুসলমানদের শক্তি বৃদ্ধিকে যারা নিজেদের বিপদ মনে করে তাদের কাছে বাংলাদেশের স্বাধীনতা অসহ্য বৈ নয়। বাংলাদেশের স্বাধীনতার শত্রু-মিত্র নির্ণয়ে এ বাস্তবতাকে অবশ্যই ধর্তব্যের মধ্যে আনতে হবে। ইসলামে যারা আত্মনিষ্ঠ, বাংলাদেশের স্বাধীনতায় তাদের নিষ্ঠা প্রশ্নাতীত। বাংলাদেশের স্বাধীনতাকে তারা নেয়ামত মনে করে। স্বাধীনতার বিপরীতে যা ঘটতে পারে তা হলো পরাধীনতা তথা ভারত ভুক্তি। পরাধীনতার অর্থই অন্যের অধীনতা, এখানে অন্য বলতে ভারত ভিন্ন আর কে হতে পারে? ভারত ভুক্তিতে এ দেশের ধর্মহীন বা ধর্মের অঙ্গীকারহীনদের হারানোর কিছু নেই। বরং অখণ্ড ভারতে ইসলামে আপোসহীনদের নিধনে তারা সাম্প্রদায়িক উগ্র হিন্দুদেরও সর্বাত্মক সহযোগিতা পাবে। বাংলাদেশে এদের একার পক্ষে এ কাজটা দুরূহ। ইসলামের জোয়ার যেভাবে বেগবান হচ্ছে তাতে তাদের নিজেদের রাজনৈতিক আয়ু যথেষ্ট সংকটাপন্ন। নিজেদের অস্তিত্বের স্বার্থে তারা বিদেশী শত্রুকেও আহ্বান করতে পারে। ফলে স্বাধীনতার পক্ষের শক্তিরূপে যাদের বড়ই অহঙ্কার, ধর্মের প্রতি অঙ্গিকারহীন হওয়ার কারণে স্বাধীনতার বিপক্ষে যাওয়াও তাদের জন্য বিচিত্র নয়। স্বাধীনতার শত্রু-মিত্র নির্ণয়ে তাই সমগ্র বিষয়টাকে দেখতে হবে এক বিস্তৃত প্রেক্ষাপটে। শুধু একাত্তরের ভূমিকাকে ধর্তব্যে আনলে অনেক ভারতীয় এজেন্টও স্বাধীনতার মিত্র মনে হবে। এমন সংকীর্ণ মূল্যায়নে স্বাধীনতা নয় পরাধীনতার পথই উন্মুক্ত হতে পারে।