ভিসার জন্য যুদ্ধ
প্রচলিত আছে (কোথায় লেখা আছে জানি না), পায়ে তিল থাকলে নাকি বিদেশ ভ্রমন নিশ্চিত। আমার পায়ের তিল দেখে আমি ভাবতাম কবে সেই সুযোগ আসবে আর কবেই বা বিদেশ যেতে পারবো। বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির পর ভ্রমন নামক জিনিসটা আমার মধ্যে মাথাচাড়া দিয়ে উঠলো। টাকা জমাতাম আর সেমিষ্টার শেষ হলেই ভ্রমন এ বের হবার প্রস্তুতি নিতাম। টাকা আর সঙ্গীর অভাব হলে আমি আর আমার সমবয়সী চাচাতো ভাই নাহিদ মিলে চলে যেতাম গাজীপুর আমার নানা বাড়ি। সেখানে দুদিন কাটিয়ে শহরের একঘেয়েমি দূর করার চেষ্টা করতাম। এভাবেই পার করলাম বিশ্ববিদ্যালয়ের তিনটি বছর। থার্ড ইয়ারের শেষে প্ল্যান করলাম ভারত যাবার। বন্ধুবান্ধবদের বলার পর সবাই রাজি। শুরু করলাম পয়সাপাতি জোগাড় করা।
২০০৮ এর সেপ্টেম্বরে পাসপোর্ট করে ফেললাম। ঠিক হল ২০০৯ এর জানুয়ারী তে সেমিষ্টার ফাইনাল পরীক্ষার পর আমরা ভারত ভ্রমন এ বের হব। দিন যতই যাচ্ছে সঙ্গীর সংখ্যা ও তত কমছে। এর মধ্যে আমার ও বন্ধু সায়েমের যাওয়া নিশ্চিত। ঠিক হল কেউ না গেলে দুইজন ই সই। তারপর ও বন্ধুদের তেল দিতে কার্পণ্য করলাম না। আরেক বন্ধু প্রবালের ও পাসপোর্ট করা হয়ে গেছে কিন্তু সে যাবার নিশ্চয়তা দিতে পারছে না। দেখতে দেখতে ডিসেম্বর চলে এল। ফাইনাল পরীক্ষার রুটিন ও পেয়ে গেলাম। নির্বাচনের কারণে দুইবার রুটিন পরিবর্তন হল। জানুয়ারীর মাঝামাঝি সময়ে পরীক্ষা শেষ হবে এবং শেষ হবার সাথে সাথেই আমরা ভিসার জন্য আবেদন করব। কিন্তু ভারতের কোথায় যাওয়া যায়? দিল্লি, আগ্রা, আজমীর না কোলকাতা? ফেসবুকে এক বন্ধুর ভারতের দার্জিলিং ভ্রমণের ছবি দেখে ঠিক করে ফেললাম কোলকাতা ও দার্জিলিং যাব। বন্ধুদের ও দার্জিলিং এর ছবিগুলো দেখালাম। সবাই সায় দিলো। অবশেষে চূড়ান্ত হল আমি, সায়েম ও প্রবাল এই সফরের পার্টনার।
দেখতে দেখতে সেমিষ্টার ১৯শে জানুয়ারী ফাইনাল পরীক্ষা ও শেষ হয়ে গেল। শেষ পরীক্ষা দিয়ে দুপুর দেড়টার দিকে গেলাম ভিসার জন্য আবেদন করতে। গিয়ে দেখলাম ভিসার জন্য আবেদন ফর্ম জমা নেবার শেষ সময় দুপুর বারোটা। তাছাড়া আগে ডলার এন্ডোর্স করতে হবে (নূন্যতম ১৫০ ডলার) তারপর এন্ডোর্স এর কাগজ সহ ভিসার ফর্ম জমা দিতে হবে। ভারতীয় ভিসা প্রসেসিং এর কাজ করে থাকে স্টেট ব্যাংক অব ইন্ডিয়া। ব্যাংকের সামনে গিয়ে প্রয়োজনীয় তথ্যগুলো সংগ্রহ করে নিলাম। ঠিক হল পরদিন ডলার এন্ডোর্স করিয়ে অন্যান্য কাগজপত্র জোগাড় করে তারপর দিন ভোর রাতে ভিসার জন্য লাইনে দাঁড়াবো (উল্লেখ্য এর মধ্যেই জেনে গিয়েছিলাম যে ভারতীয় ভিসার জন্য লাইনে দাঁড়াতে হয় ভোর রাতে)। আরো জানলাম দালালেরা তাদের লাইন এর জায়গা ৫০০ থেকে ১০০০ টাকায় বিক্রি করে থাকে। ভোর রাতে ই গিয়ে লাইনে দাঁড়াবো, আর যাই হোক শ্রদ্ধেয় দালাল ভাইদের টাকা দিবো না।
পরদিন ২০ তারিখ ডলার এন্ডোর্স করালাম, নেট থেকে আবেদন ফর্ম সংগ্রহ করলাম, অন্যান্য কাগজপত্র ও ঠিকঠাক করে রাখলাম। রাতে খাবার পর আমি ও প্রবাল চলে গেলাম আমার মামা কাম বন্ধু মঈন এর খিলগাঁয়ের বাসায়। সেখানে রাত তিনটা পর্যন্ত কার্ড খেললাম, আড্ডা দিলাম। রাত তিনটায় আমি, মঈন আর প্রবাল গুলশান এর উদ্দেশ্যে রওয়ানা দিলাম, পথিমধ্যে মালিবাগ থেকে সায়েম কে তুলে নিলাম। আমাদের মধ্যে একটা দুষ্ট বুদ্ধি ও খেলে গেল। মঈন ও আমাদের সাথে লাইনে দাঁড়াবে, কিন্তু শেষ মূহুর্তে তার লাইনের জায়গাটুকু বিক্রি করে দিলেই ১০০০ টাকা ইনকাম। পরে অবশ্য বিবেকের তাড়নায় এই কর্মসূচী বাদ দিতে হলো। ২১ তারিখ ভোর ৪ টার দিকে গুলশান শুটিং ক্লাবের কাছাকাছি গিয়ে দেখলাম অন্তত ৫০০ মানুষের লাইন। কি আর করা লাইনে দাঁড়ালাম। আমাদের সামনে দাঁড়ানো ভাই এর কাছে শুনলাম তিনি গত তিনদিন ধরে ভিসার লাইনে দাঁড়াচ্ছেন কিন্তু ফর্ম জমা দিতে ব্যর্থ হয়েছেন। যাই হোক, শুরু হলো অপেক্ষার পালা। ভিসার ফর্ম জমা নেয়া শুরু হবে সকাল ৮ টা থেকে। ভোর ৬টার দিকে পুলিশ এসে লাইনটিকে নিয়ে যাবে এম্বেসির কাছাকাছি। শীতের রাত, তার উপর এক জায়গায় দাঁড়িয়ে অপেক্ষার প্রহর গোনা ছাড়া আর কোন উপায় নেই। ব্যাগে তাসের প্যাকেট আছে কিন্তু রাস্তার ধূলায় বসে তাস খেলার ইচ্ছা হলো না। আমার সাথের বাকী তিনজন ধুমসে একটার পর একটা সিগারেট খেয়ে নিজেদের গরম রাখার প্রয়াস চালাচ্ছে, কিন্তু আমি আবার অধুমপায়ী হওয়াতে তাদের এই আনন্দ থেকে বঞ্চিত। সকাল ৭টার দিকে একদল পুলিশ এসে আমাদের লাইন ধরিয়ে ভিসা অফিসের সামনে নিয়ে যেতে লাগলো। মনে পড়ে গেল স্কুল এ থাকতে এসেম্বলির পর এইরকম লাইন ধরে ক্লাসে যেতাম। যাই হোক লাইন এগিয়ে চলেছে, গন্তব্য ভারতীয় ভিসা অফিস। লাইনটা সবে শুটিং ক্লাবের সামনে এসে পৌছেছে আর হঠাৎ দেখি সামনের কয়েকজন দিলো দৌড়। আর সেই দৌড়েই লাইন ছিন্ন-বিচ্ছিন্ন। দেখলাম লাইনের মাঝে কিছু সুবিধাবাদী ঢুকে গেছেন। আমাদের সামনে যেই ভাই ছিলেন উনি দেখি আমাদের ৫০-৬০ জনের আগে চলে গেছেন। ৮টার সময় ভিসা অফিসে ফর্ম জমা নেয়া শুরু হলো। একসাথে ১৫-২০ জন করে ভিতরে যেতে পারছে। ৩০ মিনিট পর পর লাইন মনে হয় ৫-১০ কদম এগিয়ে যায়। এভাবে ১১টা পার, লাইনের সামনে আরো ১৫০ জনের মত আছে। বুঝলাম আজকে আর ফর্ম জমা দিতে পারবোনা। এতক্ষনে বুঝলাম আমার সামনে দাড়াঁনো ভাই কেন ৩ দিন ধরে লাইনে দাঁড়িয়ে ও ফর্ম জমা দিতে পারেন নি। যাই হোক ইতোমধ্যে ঐ ভাই দালালের মাধ্যমে লাইন কিনে ফর্ম জমা ও দিয়ে এসেছেন। আমরা সিদ্ধান্ত নিলাম যার যার বাসায় চলে যাবার, এবং রাত ১২টার দিকে এসে পরেরদিনের (২২শে জানুয়ারী) লাইন ধরার। বাসায় গিয়ে দিলাম ঘুম। সন্ধ্যায় প্রস্তুতি নিলাম আবার যুদ্ধে যাবার। ১২ টার সময় পৌঁছে গেলাম লাইন ধরতে। আমরা তো ভাবছি আমরাই বুঝি সবার আগে হাজির হচ্ছি, শালা গিয়ে দেখি আমাদের আগে আরো ১৯৮ জন দাঁড়িয়ে। আগের দিন যারা ফর্ম জমা দিতে পারেনি তাদের মধ্যে ৫০ জন নাকি দুপুর থেকেই লাইনে দাঁড়িয়ে আছে। লাইনে দাঁড়িয়েই সামনে দাঁড়ানো ভদ্রলোকের কাছে শুনলাম সামনে কেউ একজন নাম লিখছেন এবং সিরিয়াল নং দিচ্ছেন। আমরা ও নাম লেখালাম, আমাদের সিরিয়াল নং ছিল ১৯৯, ২০০ এবং ২০১। ৩০-৪৫ মিনিট পর পর একবার করে সিরিয়াল নং ঠিক আছে কিনা তা দেখা হচ্ছে। লাইনে দাঁড়ানো দুই তিন জন এখানে নেতার ভূমিকায় অবতীর্ণ। ওনারাই একটু পরপর সিরিয়াল ঠিক রাখার দায়িত্ব পালন করছেন। আবার শুরু হল অপেক্ষার পালা, এবার সময়টা আরো বেশী, সাথে শীতটা ও। ৩টা -৪টার দিকে কাগজ, কঞ্চি একত্রিত করে আগুন ধরানো হলো, আমরা গিয়ে আগুন পোহালাম। কিন্তু সময় যেন কাটে না। ভোরের আলো ফোটার পর ৭ টার দিকে আবার ও পুলিশ ভাইদের আগমন। এবার আমরা লাইনে দাঁড়ানো সবাই যার যার সামনের জনের কাঁধে হাত রেখে চলা শুরু করলাম আর সবাই একসাথে চিৎকার করতে লাগলাম “ ভাই কেউ হাত ছাইরেন না, ভাই কেউ হাত ছাইরেন না”। যাক আগের দিনের চেয়ে অনেক সুশৃংখলভাবে লাইন এগিয়ে চললো, কোন দৌড়াদৌড়ি ও হলো না। আমার আবারো স্কুলের এসেম্বলির কথা মনে পড়ে গেল। লাইন এক জায়গায় দাঁড়ানোর পর আমাদের নেতা গোছের ভাই রা আবার সামনে থেকে সিরিয়াল গুনতে লাগলেন। কিন্তু একি! আমদের সিরিয়াল এরমধ্যেই ২০০ থেকে ২৫০ এ উর্ত্তীর্ণ হয়েছে। কোথা থেকে ৫০ জনের আবির্ভাব ঘটলো সামনের কেউই বলতে পারলো না। আগের দিনের মতই লাইন একটু একটু করে এগিয়ে যায়, আর আমরাও আশান্বিত হই। অবশেষে বেলা ১১টা ৩০ মিনিটের দিকে আমরা ভিসা অফিসের ভিতরে প্রবেশ করতে সক্ষম হই। বেলা ১টা ৩০ মিনিটে যখন আমরা ফর্ম জমা দিয়ে বের হই তখন মনে হলো আমরা যুদ্ধ জয় করে বের হয়েছি। প্রবাল আর সায়েম যার যার বাসায় চলে গেলো। আর আমি (আমার শরীরে অতিরিক্ত তেল তো তাই) গেলাম বাণিজ্যমেলায়।
পাসপোর্ট ফেরত দেয়ার তারিখ ছিল ২৭শে জানুয়ারী। ২৭ তারিখ বিকালে আমরা আবারো হাজির হলাম গুলশানে ভারতীয় স্টেট ব্যাংক এর সামনে এবার আমাদের সঙ্গী আরেক বন্ধু ইমন। ইমনকে বাইরে রেখেই ৪টায় আমরা প্রবেশ করলাম ভিতরে। ৭টা ৩০ মিনিটে যখন ভিসা নিয়ে বের হলাম বেচারা ইমন তখন ও বাইরে আমাদের জন্য অপেক্ষমাণ। বেচারার জন্য কষ্ট ই লাগছিলো। যাই হোক, ভিসা নিয়ে বের হবার পর মনে হলো একটি যুদ্ধের সফল পরিসমাপ্তি হলো, টানা তিনদিনের কষ্ট সার্থক।
(চলবে...............)
সর্বশেষ এডিট : ১৩ ই নভেম্বর, ২০০৯ রাত ১২:০৩

অনুগ্রহ করে অপেক্ষা করুন। ছবি আটো ইন্সার্ট হবে।



