১। পত্রিকার পাতায় দুদিন পরপর তেলের মূল্য বৃদ্ধির রিপোর্ট পড়ে কি আপনার মন ও মেজাজ খারাপ হয়ে যায়?
২। অফিস যাবার সময়, কিংবা ছুটির সময় অথবা একটু বৃষ্টি হলেই রিক্সাওয়ালা এবং সিএনজিওয়ালাদের নবাবী আচরণে বিরক্ত?
৩। ১০টায় অফিস অথচ জ্যামের কথা মাথায় রেখে প্রতিদিন ৭টায় ঘর থেকে বের হতে হয়?
উপরের উত্তর যদি হ্যাঁ হয় তাহলে এর খুব সহজ সমাধান হচ্ছে-----সাইকেল
পূর্বের কথাঃ
ছোটকালে সাইকেলের শখ ছিল না এমন ব্যাক্তি খুঁজ়ে পাওয়া মুশকিল। একটি ব্যক্তিগত সাইকেলের শখ আমার বহুদিনের। আমার খেলার সাথীদের অনেকেরই সাইকেল ছিল। বাবা-মা’র কাছে যখনই সাইকেলের জন্য আবদার করতাম ‘সাইকেলে এক্সিডেন্ট হবে’ এই উছিলায় প্রত্যেকবারই প্রত্যাখাত হতাম। ৯০ দশকের শুরুর দিকে আমার স্কুল জীবনের যখন শুরু তখন বন্ধুদের সাইকেল দিয়েই সাইকেল চালানো শিখে ফেললাম। আমাদের এলাকায় সেই সময় ৫ টাকার বিনিময়ে ৩০ মিনিটের জন্য সাইকেল ভাড়া পাওয়া যেত, সেই ভাড়ার সাইকেলও চালাতাম। খুব খারাপ লাগতো যখন বিকেল বেলা বন্ধুরা সবাই নিজ নিজ সাইকেল নিয়ে ঘুরতো। স্কুল জীবনের শেষ দিকে এসেও বাবা-মা’র কাছে সাইকেলের জন্য আবদার চলতে লাগলো এবং প্রত্যেকবারই ব্যর্থ হতাম। তখন মনে হতো “ইশ!!! আমার কাছে যদি টাকা থাকতো……”
আমার দ্বি-চক্রযানকথনঃ
এভাবে স্কুল, কলেজ জীবন শেষ করে বিশ্ববিদ্যালয়ের স্নাতক পাশ করে ফেললাম। তখন হাতে টাকা ছিল, চাইলেই একটা সাইকেল কিনে ফেলতে পারতাম। কিন্তু নিজের টাকায় সাইকেল কিনার ইচ্ছাটা কেমন জানি মরে গেল। ২০১০ সালে স্নাতকোত্তর পর্যায়ে ভর্তি হলাম। ততদিনে বাস ভাড়া বাড়ছে দুদিন পরপর। রিক্সাওয়ালারা পারলে প্রতিদিনই ভাড়া বাড়ায়। ট্রাফিক জ্যামের কথা না হয় বাদই দিলাম। ২০১১ সালে সিদ্ধান্ত নিলাম সাইকেল কিনার। অবশেষে ২০১১ সালের ফেব্রুয়ারী মাসে বাবা-মাকে রাজি করিয়ে একটি সাইকেল কিনে ফেললাম। আমি যখন সাইকেল কিনার জন্য বাসা থেকে বের হচ্ছি তখন শুনি আমার মা বাবাকে বলছে “ওর এতদিনের সাইকেলের শখ ও আজ পূরন করছে’’। ২০০০ সালের পর আবার সাইকেলে চড়ে খুবই উত্তেজিত ছিলাম। বংশাল থেকে সাইকেল কিনে ভয়ে ভয়ে(ব্যস্ত রাস্তায় প্রথম) নিজেই চালিয়ে নিয়ে আসলাম। শুরু হল একটি নতুন অধ্যায়। দিন রাত যেখানেই যাই, সাইকেলটিকে সাথে নিয়েই যাই। নিয়মিত বিশ্ববিদ্যালয়ে যাই মাত্র ৩০-৩৫ মিনিটে যেখানে আগে লাগতো ২-৩ ঘন্টা। এভাবেই সবকিছু চলছিল। কিন্তু ২ মাস পর হঠাৎ একদিন আমার শখের সাইকেলটি চুরি হয়ে যায়।
এভাবে সাইকেল ছাড়া কেটে গেল ৪ মাস। যখনই গাড়িতে চড়ি তখনই সাইকেলটাকে খুব মিস করি। সাইকেল ছাড়া রাস্তাঘাটে চলা খুবই মুশকিল হয়ে দাঁড়িয়েছিল। সিদ্ধান্ত নিলাম আবারো একটি সাইকেল কিনার।
একটি সাইকেল পাগল গ্রুপের সন্ধানলাভঃ
সেপ্টেম্বর মাসে যখন সিদ্ধান্ত নিলাম আবারো একটি সাইকেল কিনবো তখনি ফেসবুকে বিডিসাইক্লিস্ট নামে একটি গ্রুপের সন্ধান পাই। এই গ্রুপটিতে জয়েন করার পর সাইকেল সম্পর্কে অজানা অনেক কিছুই জানতে শুরু করি। যদিও এই গ্রুপটির সাথে আমি নিয়মিত রাইডে অংশগ্রহণ করিনা, এই গ্রুপের কারো সাথেই (দু-একজন বাদে) সেভাবে পরিচয় নেই। তারপরও এই গ্রুপ থেকে আমি প্রতিনিয়তই কিছু না কিছু শিখছি। এই গ্রুপের মাধ্যমে আমি শিখেছি কিভাবে নিরাপদে সাইকেল চালাতে হয়, কিভাবে সাইকেল রক্ষণাবেক্ষণ করতে হয়। এই গ্রুপের মাধ্যমে জানতে পেরেছি যে একটি সাইকেলের দামও যে লাখ টাকা ছাড়াতে পারে। এই গ্রুপের অনেক মানুষই নিয়মিত সাইকেলে চড়ে অফিসে যাতায়াত করে থাকেন যা আমার মত অনেকের জন্যই অনুপ্রেরণাদায়ক। এই গ্রুপের কিছু উদ্যমী মানুষ ঢাকাকে সাইকেলের নগরী বানানোর স্বপ্নপূরনের লক্ষ্যে নিয়মিত কাজ করে যাচ্ছেন। এই গ্রুপে নিয়মিত রাইডার না হলেও আমি এখন ঢাকা শহরের যেখানেই যাই না কেন সাইকেলে চড়ে যাই। আমার সাইকেলের ছোটখাট সমস্যার জন্য মেকানিকের কাছে না গিয়ে নিজেই সারাই।
সর্বশেষে কিছু কথাঃ
আমাদের সমাজে কিছু প্রচলিত ধারণার মধ্যে একটি হচ্ছে ‘যাদের পয়সা কম সাইকেল হচ্ছে তাদের বাহন’। আমরাতো নবাবের বংশধর তাই সাইকেলে নিত্যদিনের কাজ সারলে আমাদের মান-ইজ্জত যায়। আমাদের মত গরীব দেশে প্রতি বছর জ্বালানী তেলের জন্য আমরা বিপুল পরিমানে ভর্তুকি দেই। তার চেয়ে আমরা যদি সাইকেলের ব্যবহার বাড়াতে পারতাম তাতে আমাদের জ্বালানী তেলের ব্যবহার কমার সাথে সাথে ভর্তুকির পরিমাণও কমতো যা কিনা অন্য কোন উন্নয়নমূলক কাজে ব্যবহার করা যেত। মূল্যস্ফীতির চাপে জর্জরিত আমরা যদি সাইকেল চালাই তাহলে নিজেরাও অর্থনৈতিকভাবে লাভবান হবো। পরিবেশবান্ধব এই যানটির মাধ্যমে আপনি পরিবেশ রক্ষায়ও ভুমিকা রাখতে পারেন। তাই প্রচলিত সব ধারণাকে ভেংগে আসুন আমাদের ঢাকা শহরটাকে সাইকেল-বান্ধব নগরী গড়ে তুলি। বর্তমান ঢাকা শহরে চলাচলের জন্য সাইকেল হতে পারে আপনার নিত্যদিনের সঙ্গী, বন্ধু। পরিচিত কারো কাছে সাইকেল থাকলে তা নিয়ে কয়দিন যাতায়াত করে দেখতে পারেন। বিশ্বাস করুন, এই যানটিতে অভ্যস্থ হয়ে গেলে অন্য সব যানবাহন আপনার কাছে অস্বস্তিকর মনে হবে। তেলের মূল্য বৃদ্ধি কিংবা মাঝে মাঝে রিক্সাওয়ালাকে ৫ টাকার ভাড়া ১০ টাকা দিতেও গায়ে লাগবে না।
আর যদি প্রচলিত ধারার বাইরে আসতে না পারেন তাহলে আপনার জন্য আমার সমবেদনা রইল। আর আপনার মুখতো উম্মুক্তই রইল; পরিবহণ ব্যবস্থা, ট্রাফিক সিস্টেমকে গালাগালি দিন যত খুশি তত।

অনুগ্রহ করে অপেক্ষা করুন। ছবি আটো ইন্সার্ট হবে।



