আমিনের লাশটা জানাজার জন্য নিয়ে যাবার আয়োজন চলছে । বাদ আসর তার নামাজে জানাজা হবে । গ্রামের লোকজন ;তা আছেই, আশপাশ থেকেও প্রচুর লোক জমা হয়েছে মসজিদে । হাজার হোক গ্রামের ছেলে। ছেলেটা ছিল অমায়িক, সাধ্যমত সবার উপকার করতো ।
নিজ গ্রাম ছাড়াও আশেপাশে সবাই এক নামে চিনতো তাকে । কোথায় কার অসুখ, হাসপাতালে নিতে হবে, রোগীর সাথে হাসপাতালে থাকতে হবে, খবর পেলেই আমিন হাজির । কারো বাড়িতে বিয়ের বা অন্য কোন আয়োজনে সামাল দেবার দ্বায়িত্ব নেওয়ার জন্য হাজির থাকে আমিন । তাকে যে কোন কাজ দিয়ে নিভর্র করা যায় । সবার সাথেই তার আন্তরিকতা ।
সবার আজ প্রশ্ন ছেলেটা আত্মহত্যা করলো কেন ?
সবেমাত্র ইণ্টার পাশ করেছে, পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্ত্তির প্রস্তুতি নিচ্ছে ।
সেই ছেলে হঠাৎ করে এমন কাজ- করবে কেন?
তার বন্ধুদের কাছেও এর কোন জবাব নেই ।
বিধাব মায়ের একমাত্র অবলম্বন এই ছেলে । বাবা সামান্য রোগে ভুগে গত হয়েছে বছর পাঁচেক আগে, সেই থেকে বিধবা মায়ের অন্ধের যষ্টি ।
লেখাপড়ায় বেশ ভালো, সবার আশা জীবনে অনেক দূর এগিয়ে যাবে সে। তার বয়সি উঠতি ছেলেদের মধ্যে আদর্শ ছেলেহিসাবে ধরা হতো তাকে । অনেক পিতামাতা তার ছেলেদের আমিনের উদাহরন দিতো ভাল হবার জন্য ।
এহেন ছেলে কেন যে হঠৎ আত্মহত্যা করে বসলো তা সবাইকে ভাবিয়ে তুলেছে ।
আত্মহত্যার আলামত হিসাবে পুলিশ জব্দ করেছে তার ঘর থেকে পাওয়া একটা খালি বোতল। ধারণা করা হচ্ছে বোতলটাতে ছিল বিয । পুলিশ, ময়না তদন্ত ইত্যাদি পর্ব শেষ করে আজ বাদ আসর তার জানাজার প্রস্তুতি চলছে ।
আস্তে করে দু একজন অবশ্য বলছে, আত্মহত্যা করলে তার জানাজা পড়া উচিত কি না ?
তবে তা জোর দিয়ে বলার মত সাহস হচ্ছে না তাদের ।
কিন্তু একজন ইতিমধ্যে ইমাম সাহেবের কাছে এ ব্যাপারে আওয়াজ দিলো, তিনি জহির সাহেব , গ্রামের সব বিষয়ে তিনি মাথা গলাবেনই । তার কাজ সহজ বিষয়টি যতটা পারা যায় জটিল করে তোলা ।
ইমাম সাহেব পাল্টা জানতে চাইলো , আত্মহত্যা যে করেছে তা আপনি নিশ্চিত কি ?
অবস্থা দেখে তাই তো মনে হচ্ছে । জহির সাহেবের জবাব ।
ইমাম সাহেব বলল্লো পুলিশ কিন্তু এখনো কনর্ফাম করেনি । তা ছাড়া আমি শুনেছি আপনার ছেলে শরীফ তার সাথে সে রাতে ছিল । আপনার ছেলে কিন্তু কিছু বলেনি পুলিশকে ।
লোকটা আর কথা না বাড়িয়ে কেটে পড়লো, অবশ্য বলে গেলো, সে কোন অধর্মের সাথে নেই।
কি জানি কোথা থেকে কি হয়ে যায় ।
আমিনের মায়ের আর্তনাদ সবাইকে অশ্রুশিক্ত করছে, গ্রামের সব মহিলারা তাকে শান্তনা দিচ্ছে । তাতে কি ।
বিধবার কান্না হাহাকার থামছে না । আজ দু দিন ধরে এ মাতম চলছে । সে খালি চিৎকার করছে , আমার ছেলে কখনো এ কাজ করতে পারে না । সে কখনো আত্মহত্যার মত পাপ কাজ করবে না । আমার বাজান কে কেউ মেরে ফেলেছে । আল্লাহ বিচার করবে । আমার বুকের ধন যে কেড়ে নিলো হে আল্লাহ তাকে তুমি কেড়ে নাও ।
নানান কথায় তার আর্তনাদে পরিবেশ ভারী হয়ে উঠছে ।
মসজিদের পাশেই কবরস্থান ।
জানাজা শেষ হয়ে গেছে ।
জহির সাহেব রাস্তার পাশের চায়ের দোকানের লম্বা বেম্চিতে সিগারেট ফুকতে ফুকতে তাচ্ছিল ভাবে জানাজা দেখলেন।
ছেলে শরীফকে জানাজায় অংশ নিতে মানা করা সর্ত্তেও সে জানাজা পড়েছে ।
উপচে পড়া ভীড় দাড়িয়ে আছে কবরগাঁর পাশে ।
সব কিছু ছাপিয়ে আমিনের মার আর্তনাদ শোনা যাচ্ছে ।
বাবা আমার । তুই আমাকে কেন ছেড়ে চলে গেলি । আমি কি নিয়ে থাকবো । কাকে নিয়ে স্বপ্ন দেখবো । বাবা আমিন । আমিন । ্আমিন । আমি জানি বাবা তুই নিজেকে মারিস নি । তোকে কেউ না কেউ খুন করেছে । বাবা প্রতিশোধ নে । প্রতিশোধ নে বাবা ।
তার কণ্ঠস্বর কেমন যেন বদলে যেতে শুরু করলো ।
অভিসম্পাত দিতে দিতে সমস্ত পরিবেশকে ভয়ার্ত করে তোলে । তার কণ্ঠস্বরশুনে মনে হতে লাগলো অন্য কেউ কথা বলছে । কবরগাঁর বাইরে মাটিতে বসে সমানে চিৎকার করে কাঁদছে আর অভিসম্পাত করে চলেছে ।
কবরে মাটি চাপা দেওয়া হয়ে গেছে। কবরের উপরে একটা খেজুর পাতাও যত্ন করে লাগিয়ে দেওয়া হয়েছে ।
বন্ধুদের কজন কবরের মাটিগুলো ঠিক করে দিলো ।
ইমাম সাহেব মুনাজাতের জন্য হাত তুললো । উপস্থিত সবাই হাত তুললো । ইমাম সাহেব বলছে, হে আল্লাহ এ ছোট ছেলেটার সব গুনাহ মাফ করে দাও , সে না বুঝে অপরাধ করেছে হয়তো, তুমি পরওয়াদেগার , তুমি ক্ষমাশীল মহান, তুমি মাফ করে দাও আমাদের এ ছোট ছেলেকে । আমাদের সবার জন্য সে কাজ করতো, তুমি নিজেই দেখেছো , সে যদি অপরাধ করে থাকে তাকে মাফ করে দিও, তাকে বেহেস্ত দিও , ।
তার পর আবারো ইমাম সাহেব যোগ করলেন , আর তাকে যদি কেউ হত্যা করে থাকে, অথবা কারো কথায় সে কষ্ট পেয়ে আত্মহত্যা করে থাকে, তবে তাকে শাস্তি দিও, সে অপরাধীকে আমাদের চিনিয়ে দিও । ইত্যাদি, ইত্যাদি ।
ইমাম সাহের মুনাজাত ছাপিয়ে হঠাৎ তার মায়ের কণ্ঠস্বর শোনা যেতে লাগলো, বাবা প্রতিশোধ নে বাবা, প্রতিশোধ নে বাবা, ছেড়ে দিস নে, ছেড়ে দিস নে ।
ইতিমধ্যে ইমাম সাহেব মুনাজাত শেষ করলেন ।
লোকজন আস্তে আস্তে কবরস্থান ছাড়তে শুরু করলো ।
আমিনের বন্ধুরা কবরটার উপর একটা ফুলের চাদর বিছানোর আয়োজন করছে, অল্প কিছু লোক তখনো দাড়িয়ে আছে । তারাও দেখছে ।
ওদিকে আমিনের মা তখন ও আর্তনাদ করে চলেছে, বাবা প্রতিশোধ নে বাবা, প্রতিশোধ নে বাবা, ছেড়ে দিস নে, ছেড়ে দিস নে । । তাকে ও তোর সাথে নিয়ে যা বাপ । তাকেও তোর সাথে নিয়ে যা ।
আস্তে আস্তে তার কণ্ঠস্বর কেমন যেন ভর্য়া ত হয়ে যাচ্ছে ।
উপস্থিত সবার মধ্যে কেমন ভয় ভয় ভাব দেখা যাচ্ছে ।
জহির সাহেব সেই লম্বা বেঞ্চিতে আয়েশ করে পা তুলে বসতে বসতে হালকা হাসির সাথে মন্তব্য করলো শুকুনের বদদোয়ায় কি কখনো গরু মরে ।
হঠাৎকরে কবরস্থানের ভেতরে থাকা লোক জনের ভীষণ চেচামেচি, শোরগোল শোনা গেলো ।
যারা ফিরছিলো , তারাও থমকে দাড়িয়ে গেলো ।
আমিনের মার আর্তনাদ তখন ও থেমে থেমে চলছিল ।সেও হঠাৎ থেমে গেছে, সে ও অবাক হয়ে তাকিয়ে আছে ।
কবরস্থানের ভেতর থেকে আমিনের এক বন্ধু বেরিয়ে এলো ভর্য়াত চেহারায় ।
তার কাছে জানা গেল, কবরের উপর ফুলের চাদর বিছানোর সময় কবরের ভেতর থেকে একটা হাত বেড়িয়ে এসে, শরীফকে কবরের ভেতর টেনে নিয়ে গেছে ।
অনেকে ভয়ে ভয়ে কবরের কাছে ফিরে গেলো, দেখা গেলো , কবরের নরম মাটিতে শরীফ মুখ থুবড়ে পড়ে আছে, একটা হাত কবরের ভেতর ঢুকে আছে । সাহস করে করে একজন একেবারে কবরের উপর নেতিয়ে থাকা শরীফের দেহটা কবরের উপর থেকে টেনে তুললো ।
নিয়ে যাওয়া হলো বাজারে ডাক্তারের চেম্বারে , দেখে শুনে ডাক্তার সাহেব জানালো, সব শেষ ।
শরীফ মারা গেছে ।
তা হলে কি প্রতিশোধ নেওয়া হলো । মায়ের আর্তনাদে আমিন কি প্রতিশোধ নিলো ।
তবে কি সে আত্মহত্যা করে নি।
শরীফই তাকে খুন করেছে ।
ধর্মেও বিধিবিধানের প্রতি শরীফের বাপের অবঙ্গা ।
অবশ্য কেউ কেউ বল্লো অন্য কথা, আমিনের মায়ের আর্তনাদ আর অভিসম্পাত সবার মনে একটা ভয় ঢুকে গেছিলো ।
শোকার্ত অবস্থায় আর্তনাদ করলে তার কণ্ঠস্বর অদ্ভুদ রকম বদলে যায়্ , অচেনা মনে হয়।
উপস্থিত অনেকের মধ্যে তার প্রভাব ফেলে । সে রকমই হয়তো শরীফের উপর প্রভাব ফেলেছে ।
ফুলের চাদর দিতে গিয়ে কোন ভাবে হয়তো , হাত ফস্কে কবরের নরম মাটিতে গেথে গেছে আর আগে থেকে প্রভাবের কারণে, সাথে সাথে প্রচণ্ড ভয়ে হার্ট এর্টাক করে মারা গেছে ।
অন্যজন যুক্তি দিলো, কিছু না করে ও ভয় পাবে কেন ।
যত লোক তত মত ।
তবে আমিনের মাকে এরপর কেউ কাঁদতে দেখিনি ।
শরীফের বাপকেও কেউ হাসতে ও দেখিনি ।
হত্যার আলামত হিসাবে পুলিশ জব্দ করেছে তার ঘর থেকে পাওয়া একটা খালি বোতল ।
ধারণা করা হচ্ছে বোতলটাতে ছিল বিয ।