
‘প্যাটে ক্ষিদে, বারিতে খাওয়া পাই না, খাওয়ার নাই তাই এই চাহার (চা) দোহানে কাম কত্তে আইচি। সহাল সাত তায় আসি আর বারি যাই রাত্তিরি সাত তায়। এর লগে হামারে (আমারে) দেয় ৩০ টাহা (টাকা)। ওই দিয়া কিছু খাওয়ার কিনে বারি যাই, অসুস্থ বাবারে খাতে দিই”
এভাবে কথাগুলো বলছিল সারু নামের এক শিশু শ্রমিক। বয়স আনুমানিক ৭/৮ বছর হবে। পিতা রুশ মোহাম্মদ মারাত্মক রোগে আক্রান্ত (শিশুর ভাষ্যমতে গায়ে ব্যাথা, পেট-ব্যথা)। তিনি কর্মাক্ষম। গ্রামের বাড়ি রাজশাহী’র মতিহার উপজেলার চর শ্যামপুরে। সে কাজ করে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসের গোল্ড চত্বরের এক চায়ের দোকানে।
একই বয়সের আরেক শিশুশ্রমিক কান্না জড়িত কণ্ঠে বলতে লাগলো ‘বাবা কাম করতি পারে না, তাই আমি কাম করি প্যাটের ক্ষুদা মেটানোর জন্যি। বাবা ভিÑষ-ন অসুস্থ। কাম করতি পারে না। সকাল আট টায় আসি আর যাই রাত নয় টায়। এক সন্ধ্যার খাওয়া আর নব্বই টাকা দেয় হোটেলের বিটা (মালিক)। আমার খালা এহানে কাম ঠিক কর্যা দিছে। শিশুটির নাম রনি। পিতার নাম ইনা। গ্রামের বাড়ি সাতক্ষীরা জেলার কলারোয়া উপজেলার দয়াড়ায়।
যে বয়সে হাসি আর খেলা-ধুলার মধ্য দিয়ে স্কুল মাঠ মাতানো আর পিতা-মাতা আদরে বড় হওয়ার কথা ছিল সেই বয়সে সারু অথবা রনি’র মতো এসব শিশুরা কোন হোটেল অথবা চা-বিস্কুটের দোকানে। দেশের আইন অনুযায়ি ১৮ বছরের নিচের শিশুদের দিয়ে ভারি বা কষ্টের কোন কাজ না করানোর নিষেধাজ্ঞা থাকলেও দেশের সর্বোচ্চ বিদ্যাপীঠ রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে সারু আর রনি’র মতো অবলা শিশুদের দিয়ে অবাধে চলছে শিশু শ্রম। দিনদিন শিশু শ্রমিকের সংখ্যা বাড়ছে বিরামহীনভাবে। বিভিন্ন ক্যান্টিন, হোটেল, চায়ের দোকান, ফটোকপির দোকানে, মাঝে মাঝে রিক্সচালক হিসেবে। আরও অবাক লাগে দেশের আইন-শৃংখলা বাহিনীর সদস্যদের যেই বিষয়টি দমন করার কথা সেখানে ক্ষোদ কর্মরত পুলিশ সদস্যদের বিভিন্ন এলাকায় দৈনন্দিন খাবার বহনের কাজেও পুলিশের গাড়িতে শিশুশ্রমিকদেরকে ব্যবহার করা হচ্ছে।
সরেজমিনে প্রদক্ষিন করে দেখা গেছে, রাবি ক্যাম্পাসে প্রায় এক শতাধিক শিশুশ্রমিক ও অর্ধশতাধিক পথশিশু রয়েছে। এদের বয়স সাত থেকে তেরোর বা সর্বোচ্চ চৌদ্দর মধ্যে। অধিকাংশ ক্ষেত্রে দেখা গেছে হয় তাদের মা নেই বা বাবা নেই। কিংবা বাবা মারত্মক দুরারোগ্য রোগে আক্রান্ত। কাজ করতে পারে না। অথবা মা তালাকপ্রাপ্ত। পারিবারিক ও আর্থিক দুরাবস্থার কারনে তারা অর্থোপর্জনের পথে অগ্রসর হয়েছে। কেউ এক শ্রেণী বা দু’শ্রেণী পর্যন্ত লেখাপড়া হয়েছে। আবার কারোরবা কখনো শিক্ষা আলো স্পর্শ করেনি।
আর বিশেষ করে এ পথশিশুদেরকে দেখ যায় বিভিন্ন সময়ে আবাসিক হলগুলো আশেপাশে থাকতে। অভাবের তাড়ানায় তারা বিভ্ন্নি অবৈধ পেশায় লিপ্ত হচ্ছে বলে জানা যায়। মাঝে মাঝে তারা ছিচড়া চুরি করে। আবার এদেরকে মাদকসেবীরা তাদের মাদকদ্রব্য বহনের কাজে লিপ্ত করে। ক্যাম্পাসের পার্শবর্তী মেহেরচন্ডীতে মাদক জাতীয় দ্রব্য বহন ও অসামাজিক কার্যকলাপে এদেরকে নিয়োগ করে থাকে। অনেক ক্ষেত্রে এসব শিশুরা বয়সে অপেক্ষাকৃত বড়দের দ্বারা নির্যাতিত হয়। শুধু পেটের দায়ে আজ তারা এমন কাজ করতে বাধ্য হচ্ছে।
যে বয়সে হাতে থাকার কথা ছিল বই, চোখে স্বপ্ন, বুকে দেশগড়ার শপথ, পায়ের দুরন্তপনা, মায়ের স্নেহ, বাবার ভালবাসা, পরিবারের সহযোগিতা এবং সমাজ- রাষ্ট্রের মানবাধিকার পাওয়ার কথা। সে বয়সে পাচ্ছে হাতে চায়ের কেটলি, চোখে ধোয়া, বুকে হতাশা আর সন্ত্রাসী-মাদকসেবীদের হাতছানি। এদের পারিবারিক বন্ধন বলতে কিছূ নেই। বাবা মায়ের স্নেহ-মততা তাদের কপালে হয়তো কোনদিন স্পর্শ করেনি। জীবন নামের তরীর মাঝি সে নিজে। এভাবে হয়তো একদিন সে তার তরী ভিড়ে কোন মাদকসম্রাট, মানবপাচারী বা গডফাদারের ঘাটে। কিছু দিন পর প্রতিদিন নেশা করবে। সেই নেশার টাকা সংগ্রহে চুরি, ডাকাতি, ছিনতাই। নিজেকে বাঁচাতে খুঁজবে রাজনৈতিক আশ্রয়। নেতারা তাকে ব্যবহার করবে যাবতীয় অপকর্মে। যার হাক-ডাক আর তান্ডবে সুশীল সমাজের ঘুম হবে হারাম। একদিন এসেছিল দুমুঠো খাবারের জন্য, আজ আমাদের সভ্য সমাজ (!) তাকে বানিয়ে দিচ্ছে গডফাদার বা সন্ত্রাসী। তরী চলে যায় অতল গহবরে। যে জগত থেকে আর ফিরে আসা যায় না। না ফেরার দেশে.......
সংবিধানে আইন, কত নীতি বাক্য! কত শত সুবচন! ১৮ বছরের কম বয়সী হলো শিশু!
সার্বক্ষনিক কর্মী, অসামাজিক বা অমর্যাদাকর ও ঝুঁকিপূর্ন কাজে নিয়োজিত করা যাবে না! শিশু আইন-১৯৭৪ অনুযায়ী, কোন শিশূর কাছে উপযুক্ত চিকিৎসকের পরামর্শ ছাড়া নেশা হয়- এমন কোন পানীয় বা ওষুধ বিক্রি করা যাবে না। এমনকি যেসব স্থানে নেশাদ্রব্য বিক্রি হয়, সেখানে শিশুদের নিয়ে যাওয়া ও শাস্তিযোগ্য অপরাধ। আইন আছে কিন্তু তার প্রয়োগ নেই।
এত কিছুর পরও আমরা আশায় বুক বাধি হয়ত একদিন বন্ধ হবে এ শিশু শ্রম। হয়ত এদেরও হাতে উঠবে বই। সোনার বাংলাদেশ গড়ার কাজে এ পথ-শিশুদেরও থাকবে অবদান।
মূল নিবন্ধ..

অনুগ্রহ করে অপেক্ষা করুন। ছবি আটো ইন্সার্ট হবে।




