গেল ২৯ জুলাই ছিল আন্তর্জাতিক বাঘ দিবস। নানান আয়োজনের মধ্য দিয়ে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের মত বাংলাদেশেও এবার আন্তর্জাতিক বাঘ দিবস উদযাপিত হয়েছে। এবারের দিবস পালনের শ্লোগান ছিল ‘‘বাঘের আবাসস্থল সুন্দরবন বাঁচান’’। দিবসটি পালনের ক্ষেত্রে শ্লোগানটি খুবই গুরুত্বপূর্ণ ও তাৎপর্যপূর্ণ।
পৃথিবীর ভয়ংকর সুন্দর প্রাণী হিসেবে পরিচিত বাঘ। দিনদিন আশংকাজনক হারে কমে যাচ্ছে এই প্রাণীটি। সে কারণে অনেকের দৃষ্টি এখন বাঘের দিকে, কিভাবে রক্ষা করা যায় এই প্রাণীটিকে। বাঘ রক্ষার দাবি উঠেছে পৃথিবীর নানা প্রান্ত থেকে। বর্তমানে সারা পৃথিবীতে বাঘের সংখ্যা তিন হাজার দুইশ’টি, যার মধ্যে পৃথিবীর একক বৃহৎ ম্যানগ্রোভ ফরেষ্ট সুন্দরবনে আছে ৪৪০টি। সুন্দরবন এখন বিশ্ব ঐতিহ্য। বাংলাদেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলে বঙ্গোপসাগরের কোল ঘেসে অবস্থিত পৃথিবীর একক বৃহত্তম ম্যানগ্রোভ ফরেষ্ট ও প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের অপরুপ লীলাভুমি সুন্দরবন।
উল্লেখ্য পৃথিবীর ১৩টি দেশে এখন বাঘের সংখ্যা ৩২০০টি। এর মধ্যে আমাদের সুন্দরবনেই আছে ৪৪০টি। বাংলাদেশের বাঘের হিসেব বিগত বাঘ শুমারি অনুযায়ী। এ হিসেব অনুযায়ী সুন্দরবনে পুরুষ বাঘ ১২১টি, নারী বাঘ ২৯৮টি এবং শিশু বাঘ ২১টি। অথচ গত শতাব্দীর শুরুতেও বাঘের সংখ্যা ছিল প্রায় এক লাখ। বেআইনিভাবে বাঘ শিকার আর নির্বিচারে বন ধ্বংস-এই দুই কারণেই বিশ্বে বাঘের সংখ্যা এত কমে গেছে বলে মনে করেন ইন্দোনেশিয়ার পররাষ্ট্রমন্ত্রী জুলকিফলি হাসান। বাঘ বাঁচাতে ইন্দোনেশিয়ার বালিতে গত সপ্তাহে অনুষ্ঠিত তিন দিনব্যাপী সম্মেলনের উদ্বোধনীতে তিনি এসব কথা বলেন। তিনি আরও বলেন, বাণিজ্যিক ভাবে বাঘের চামড়া বেশ লাভজনক হওয়ায় অনেক ব্যবসায়ীর কাছেই এটা একটা ভাল ব্যবসা। আর এতে তাদের উৎসাহ যোগাচ্ছে বিদ্যমান আইনের সঠিক ব্যবহার না হওয়া। তিনি আরও বলেন, বিশ্বে আগে নয় জাতের বাঘের দেখা পাওয়া যেত কিন্তু এখন সেখানে আছে মাত্র ছয়টি। বাঘ রয়েছে এমন ১৩টি দেশর অংশগ্রহণকারীরা যেমন বাংলাদেশ, ইন্দোনেশিয়া, ভারত, চীন, ভূটান, নেপাল, মিয়ানমার, থাইল্যান্ড, মালেশিয়া, কম্বোডিয়া, লাওস, ভিয়েতনাম ও রাশিয়া এই সম্মেলনে অংমগ্রহণ করে। মূলত দুটি বিষয় আলোচিত হয় সম্মেলনে, কিভাবে বাঘের সংখ্যা আরো বাড়ানো যায় এবং যে বাঘগুলো এখনো বেঁচে আছে তাদের কিভাবে শিকারীদের হাত থেকে রক্ষা করা যায়। এছাড়া এই সম্মেলনে ঠিক করা হয় ১১ বছরে অর্থাৎ ২০২২ সালে বাঘের সংখ্যা দ্বিগুন করতে হবে।
এদিকে সর্বশেষ তথ্য অনুযায়ী ২০০৪ সালে সর্বশেষ বাঘ শুমারী মতে সুন্দরবনে বাঘের সংখ্যা ৪৪০টি। ১৯৭১ সাল থেকে এ পর্যন্ত ছয়বার বাঘ শুমারী হয়েছে। ছয়টি বাঘ শুমারীর মধ্যে ১৯৭১ সালে বাঘের সংখ্যা ছিল ৩২০টি, ১৯৭৫ সালে বাঘের সংখ্যা ছিল ৩৫০টি, ১৯৮০ সালে বাঘের সংখ্যা ছিল ৪৩০ থেকে ৪৫০টি, ১৯৯২ সালে ৩৫৯টি এবং ১৯৯৩ সালে ৩৬২টি। সুন্দরবনের বাঘ রক্ষায় বাংলাদেশকে সহায়তা করবে বিশ্বব্যাংক। সুন্দরবনের ঐতিহ্যবাহী প্রাণী ‘রয়েল বেঙ্গল টাইগার’ সুরক্ষায় বিশ্বব্যাংকের উদ্যোগে বাংলাদেশ ও ভারত যৌথভাবে একটি প্রকল্প বাস্তবায়ন করবে। বাঘ রক্ষায় বিশ্বব্যাংকের সহায়তায় বর্তমানে বিশ্বের ১৩টি দেশে এ ধরনের প্রকল্প বাস্তবায়ন হচ্ছে।
সুন্দরবন এক ভয়ঙ্কর জঙ্গলের নাম। গবেষণাধর্মী লেখক সতীসচন্দ্র মিত্র তাঁর এক লেখনীতে লিখেছেন “ সুবি¯তৃত এবং তরঙ্গ সঙ্কুল অসংখ্য নদী, নিবিড় দুর্ভেদ্য জঙ্গল, ভীষণ হিংস্র জন্তুসমূহের অত্যাচার, প্রতিনিয়ত জল প্লাবনে কর্দমাক্ত ভূ-পৃষ্ঠ, আবাস, আশ্রয় ও ভ্রমণ চিহ্নিত পথের অভাব এবং আরও শত শত উৎপাত সুন্দরবনকে মনুষ্যের পক্ষে অগম্য করিয়া রাখিয়াছে”। সুন্দরবনের চির সবুজ সুদৃশ্য গহীন বনানীর পার্শ্বে সাগরের মাঝে সূর্যোদয় ও সূর্যাস্তের দৃশ্য সত্যিই মনোমুগ্ধকর।
হাজার হাজার বছর আগে এ অঞ্চল ছিলো সমূদ্র গর্ভে। ষষ্ঠ শতকের আগে গঙ্গা নদীর মূল প্রবাহ ভৈরব ও পদ্মা প্রবাহিত হয়ে সাগরে মিলতো ভগীরথী নদীর মোহনায়। উত্তর থেকে এই পানি প্রবাহের সাথে মিশে আসা পলি সুমুদ্রে পড়ে। যার ফলে মোহনায় চরের সৃষ্টি হয়। সময়ের পরিবর্তনে গঙ্গা নদী তার চলার পথ পরিবর্তন করে মেঘনার সঙ্গে মেলে। এতে পূর্বেকার চর গুলো বড় হতে হতে ব-দ্বীপের সৃষ্ঠি হয় এবং এই দ্বীপের উপর লবন ও পানি সহনশীল বিভিন্ন প্রজাতির গাছ জন্মাতে লাগলো। জোয়ারের পানির সঙ্গে আসা মাটি জমা হতে হতে বনভূমি গড়ে ওঠার মত আস্তে আস্তে পরিবেশ সৃষ্টি হতে লাগেলো। জোয়ারের পরে ভাটার টানে পানি যখন পুনরায় নামতে শুরু করে তখন নরম কাঁদার উপর দিয়ে চলতে গিয়ে স্থায়ী পানি নিষ্কাশনের জন্য ধীরে ধীরে সৃষ্টি হতে লাগলো অসংখ্য খাল ও নালা। এভাবেই হয়তবা সৃষ্টি হলো সুন্দরবন এবং সুন্দরবনের মধ্যেকার নদী ও নালা।
এই বনের নাম কিভাবে সুন্দরবন হলো তা নিয়ে রয়েছে নানান ব্যাখ্যা। প্রথম ব্যাখ্যাটি বনটি দেখতে খুবই সুন্দর তাই এই বনের নাম সুন্দরবন। দ্বিতীয় ব্যাখ্যাটি এই বনে রয়েছে প্রচুর পরিমানে সুন্দরী নামক এক প্রকার বৃক্ষ। এর কাষ্ঠ দেখতে লাল বর্ণ, আর লাল দেখায় বলে একে সুন্দরী অথবা সুন্দর বৃক্ষ বলে। হয়তোবা এই বৃক্ষের জন্যই এই বনের নাম হয়েছে সুন্দরীবন বা সুন্দরবন। কারো কারো মতে সম্ভবতঃ ইহা সুমুদ্রবন শব্দের পরিবর্তিত শব্দ। কারণ সাধারণ মানুষ সুমুদ্রকে সুমুদ্দুর বলে থাকে। মহাপন্ডিত বিভারিজ সাহেব বলতে চেয়েছেন বরিশাল জেলার সুন্ধা নদী হতে সুন্দরবন নামের উৎপত্তি। কেননা বরিশারে সুগন্ধা নামে একটি প্রবল নদী ছিল। এই সুগন্ধা নদীকেই মানুষ সুন্ধা বলতো এবং এই নদীর নাম অনুসারে প্রথম এই নদীর নিকটবর্তী বনের নাম এবং পরবর্তিতে সমস্ত বনের নামই সুন্ধারবন বা সুন্দরবন হয়েছে। কেউ কেউ আরও মন্তব্য করেছেন পূর্বে বাকেরগঞ্জ অঞ্চল চন্দ্রদ্বীপরাজ্যের অর্ন্তগত ছিল। তখন চন্দ্রদ্বীপের বনভাগকে চন্দ্রদ্বীপবন বলতো। সেই চন্দ্রবন থেকেই হয়তোবা সুন্দরবন হয়েছে। কথিত আছে ইংরেজ আমলের বহু পুর্বে বিদেশী পর্যটকেরা সুন্দরবন দেখতে এলে একে ’’Jungal of Sundry tress” নামে অবিহিত করতেন। তবে সকল ব্যাখ্যার মধ্যে দ্বিতীয় ব্যাখ্যাটি সকলের কাছে গ্রহণযোগ্য যে, “ সমস্ত বন জুড়ে পৃথিবীর দূর্লভ এই সুন্দরী গাছ থাকার কারনে এই বনের নাম হয়েছে সুন্দরবন।’’
বাংলাদেশের ৫টি জেলার মধ্যে রয়েছে ১৭টি উপজেলা এবং যার মধ্যে প্রায় ২০০টি ইউনিয়ন। তবে উল্লেখ্য ৫টি জেলার ভিতর উত্তরে সাতক্ষীরা, খুলনা ও বাগেরহাট এই তিনটিতে বনের বি¯তৃতি অনেক বেশী। যার উপজেলা গুলো হচ্ছে সাতক্ষীরা জেলার শ্যামনগর, কালীগঞ্জ ও আশাশুনি, খুলনার কয়রা, পাইকগাছা ও দাকোপ এবং বাগেরহাট জেলার মোংলা, মোড়েলগঞ্জ ও শরণখোলা। পূর্বে পিরোজপুর জেলার মাঠবাড়িয়া, ইন্দুরকানী এবং বরগুনা জেলার পাথরঘাটা উপজেলা। সুন্দরবনের দক্ষিণে কোন জন বসতি নেই। আছে শুধু অগাধ জলরাশির বঙ্গোপসাগর এবং পশ্চিমে ভারতের পশ্চিম বঙ্গের ২৪ পরগনা জেলা। বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যের সুন্দরবনকে বিভক্ত করেছে হরিণভাঙ্গা ও রায়মঙ্গল নদী। অর্থাৎ পূর্বে বলেশ্বর নদী এবং পশ্চিমে হরিণঘাটা ও রায়মঙ্গল নদীর মধ্যেবর্তী সুন্দরবনটুকুই বাংলাদেশের মধ্যকার সুন্দরবন।
সুন্দরবনের মোট আয়তন প্রায় ৫ লাখ ৭৭ হাজার ২৮৫ হেক্টর বা প্রায় ১০ হাজার বর্গ কিলোমিটার। অবশ্য বর্তমানে সঠিক জরিপ করলে সামান্য পরিমানে কম বেশী হতে পারে। মোট আয়তনের বাংলাদেশের মধ্যে রয়েছে ৫ হাজার ৮০০ বর্গ কিলোমিটার। অর্থাৎ বাংলাদেশে ও ভারতের আনুপাতিক হার দাড়ায প্রায় ৬ ঃ ৪। সুন্দরবনের বন এলাকা হচ্ছে ৪ লাখ ১ হাজার ৬০০ হেক্টর এবং জলাভূমী বা নদী-খাল ১ লাখ ৭৫ হাজার ৬৮৫ হেক্টর। সুন্দরবনের যতটা এলাকা জুড়ে বনভূমি রয়েছে তার মধ্যে ৩ লাখ ৮০ হাজার ৩৪০ হেক্টর উন্নত বনভূমি এবং ২৬ হাজার ৮০৭ হেক্টর অপ্রধান বনভূমি।
প্রকৃতির বিস্ময় সম্পদের ভান্ডার বিশ্ববিখ্যাত এই বন শুধু বাংলাদেশ ও ভারতের নয় এটি বিশ্বেরও সম্পদ। কেননা জাতিসংঘের শিক্ষা, বিজ্ঞান, ও সাংস্কৃতিক বিষয়ক সংস্থা (ইউনেস্কো) ১৯৯৭ সালের ৬ই ডিসেম্বর ওয়ার্ল্ড হ্যারিটেজ কমিটির ২১তম অধিবেশনে সুন্দরবনকে “হ্যারিটেজ সাইট” বা বিশ্ব সম্পদ হিসেবে ঘোষণা করা হয়েছে। এই ঘোষণার মধ্যে দিয়ে প্রথিবীর ৫২২টি বিশ্ব ঐতিহ্যের মধ্যে সুন্দরবনের নাম অর্ন্তভূক্ত হয়েছে। ফলে ঠিক যেমন বেড়েছে এবনের মর্যাদা ঠিক তেমন বেড়েছে আমাদের দায়িত্ব। সুন্দরবন পৃথিবীর একক বৃহত্তম ম্যানগ্রোভ বন। প্রায় ১০ লক্ষ মানুষ প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ ভাবে এই বনের উপর নির্ভরশীল। ১৮৭৯ সালে ব্রিটিশ সরকার বন বিভাগকে সুন্দরবনের দায়িত্ব দেন বন রক্ষা করার জন্য এবং প্রথম বিভাগীয় বন কর্মকর্তার দায়িত্ব পালন করেন এমইউ গ্রিন (১৮৮৬ সালে)। বর্তমান বন প্রসাশন খুলনাস্থ বিভাগীয় বন অফিস থেকে সুন্দরবন পূর্ব বন বিভাগ ও সুন্দরবন পশ্চিম বন বিভাগের মাধ্যমে এটি নিয়ন্ত্রণ করে। ব্যবস্থাপনার সুবিধার্থে শরণখোলা রেঞ্জ, চাঁদপাই রেঞ্জ, খুলনা রেঞ্জ ও সাতক্ষীরা রেঞ্জ এই ৪টি রেঞ্জে ভাগ করেছে। ইতিমধ্যে সরকার ৩২,৩৮৬ হেক্টর এলাকাকে সুন্দরবন ইস্ট, সুন্দরবন ওয়েস্ট, সুন্দরবন সাউথ নামে তিনটি অভয়ারণ্যে সৃষ্টি করেছে। যেখানে বিধি মোতাবেক কোনরকম অনুপ্রবেশ নিষিদ্ধ। কাজেই এই সুন্দরবন রক্ষা করার দায়িত্ব আপনার, আমার এবং আমাদের সকলের। এছাড়া সুন্দরবন এখন বিশ্ব প্রাকৃতিক সপ্তাশ্চর্য নির্বাচনে চুড়ান্ত পর্বে প্রতিযোগিতা করছে। তাই আসুন সুন্দরবনের বাঘ রক্ষা করি, সুন্দরবনকে রক্ষা করি এবং ইন্টারনেটে অথবা মোবাইলে সুন্দরবনকে ভোট দিয়ে প্রাকৃতিক সপ্তাশ্চর্যের তালিকায় সৃন্দরবনের নাম অন্তর্ভূক্ত করি।
মূল প্রতিবেদন.......
সর্বশেষ এডিট : ০২ রা আগস্ট, ২০১২ দুপুর ১:৫২

অনুগ্রহ করে অপেক্ষা করুন। ছবি আটো ইন্সার্ট হবে।




