somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

বাদশাহ গানদার

৩০ শে ডিসেম্বর, ২০১২ সন্ধ্যা ৭:৪০
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :




ও কারিগর, দয়ার সাগর, ওগো দয়াময়
চান্নিপসর রাইতে যেন আমার মরণ হয়...


নিজের মৃত্যুর আকাঙ্খা এতোটা নির্মোহভাবে কয়জন বলতে পারে!হুমায়ুন আহমেদ পেরেছিলেন।লেখক, চলচিত্রকার হুমায়ুন আহমেদকে নিয়ে অনেক কথা বলা হয়।কিন্তু তার গানপাগল রূপটি যেন বরাবরই আড়ালে রয়ে গেলো।তার যে কোনো সৃষ্টির সাথে জড়িয়ে ছিলো গান।তার নাটকে গান, তার চলচিত্রে গানে, এমনকি তার বইগুলোতেও গানের স্পর্শ থাকতো।গল্পের মাঝে না হোক নিদেনপক্ষে বইয়ের ফ্ল্যাপে তার পছন্দের কোনো গানের উল্লেখ থাকতো।হুমায়ূন আহমেদ শুধু বাংলাদেশের সাহিত্যকেই সমৃদ্ধ করেননি, বাংলা গানের জগতেও যুক্ত করেছেন ধুলি-মলিন কিছু মানিককে।আর সবটাই করেছেন তার নিজস্ব হুমায়ুনীয় স্টাইলে।


তবে একলা চলো রে...

̃শ্মশ্রুমন্ডিত এক ভদ্রলোক বিশাল এক গাছের নীচে বসে আছেন।আকাশ থেকে অঝোর ধারায় বৃষ্টি নামছে।ব্যাকগ্রাউন্ডে বাজছে, "যদি তোর ডাক শুনে কেউ না আসে..."।কাউকে বলে দিতে হবে না, এটা কার নাটক।পরিচিত এই দৃশ্যটা, সর্বদা এতোটা চেনা ছিলোনা।মিডিয়া জগতে একটা সময় (অ)স্বাভাবিক রীতি ছিলো, রবীন্দ্রনাথের গান শুধু মাত্র রবি ঠাকুরের গল্পকেন্দ্রীক নাটকেই ব্যবহৃত হবে।পরিচালকদের চাপে পড়ে বেচারা রবি বাবু পর্যন্ত "টাইপ-কাস্টেড" হয়ে পড়েছিলেন।এই অবস্থার পরিবর্তন ঘটান হুমায়ূন।কারো ডাকের অপেক্ষায় না থেকে, একের পর এক নাটকে বহুমাত্রিকভাবে ব্যবহার করেছেন রবীন্দ্রসঙ্গীত।একটা সময় তার নাটকের ট্রেডমার্ক হয়ে দাঁড়ালো গানগুলো।হুমায়ূন আহমেদ'র নাটকের সমাপ্তি মানেই রবীন্দ্রনাথের গান। তথৈব

চলচিত্রের অবস্থাও ছিলো তথৈবচ।সেখানে তো রবীন্দ্রনাথ আজও অপাঙ্ক্তেয়।ব্যতিক্রম-আগুনের পরশমণি!১৯৭১ এর আগুন ঝরা সময়ে এক মুক্তিযোদ্ধা বসে বসে চাঁদের বাঁধ ভাঙা হাসি শুনছে, এমন প্যারা-রোম্যান্টিক দৃশ্যকল্প তৈরী করা শুধুমাত্র হুমায়ূনের পক্ষেই সম্ভব ছিলো (হুমায়ূন কিন্তু চলচিত্রটির নামও রেখেছিলেন রবীন্দ্রনাথের একটি গান থেকে)।


হুমায়ূন বাদশাহরে বাউলা কে বানাইলো রে !

এরপর হুমায়ূন আহমেদ হঠাৎ করেই লোকসঙ্গীতের দিকে ঝুঁকে পড়েন।খুঁজে বের করলেন একের পর এক রত্ন।সিলেট বিভাগের একটা অনুষ্ঠান গিয়ে তিনি প্রথম হাসন রাজার গান শুনেন।শুরুটা হয়েছিলো "অচিন বৃক্ষ" নাটকে হাসন রাজা'র "নিশা লাগিলো রে" গানটার মাধ্যমে।যা পরবর্তীতে পূর্ণতা পায় "আজ রবিবার" ধারাবাহিকে এসে।ব্যবহার করেন, "বাউলা কে বানাইলো রে, কানাই তুমি, কান্দে হাসন রাজার মন, লোকে বলেরে ঘর-বাড়ি ভালা না আমার, আমি যাইমু আল্লাহর সনে" সহ অনেক গান।গানগুলোতে কন্ঠ দিয়েছিলেন হুমায়ূন আহমেদরই আবিষ্কার সেলিম চৌধুরী।প্রসঙ্গত, এখানে উল্লেখ্য যে, সেলিম চৌধুরী'র উথ্থান ঘটেছিলো হুমায়ূন আহমেদর খন্ড নাটক "উইজা বোর্ড"-এ ব্যবহৃত "আজ পাশা খেলবোরে শ্যাম" গানটির মাধ্যমে।এই একটি গানের কল্যাণে রাতারাতি তারকা বনে যান সেলিম।গানটি লিখেছেন সৈয়দ আব্দুন নূর হোসাইনি চিশতি, তিনি দীনহীন ছদ্মনামে লিখতেন।

এছাড়াও তার নাটকগুলোতে "আমার যমুনার জল দেখতে কালো", সৈয়দ শাহ নূর'র "আমার শ্যাম যদি হইতো মাথার কেশ", রাধারমন দত্ত’র "আমি রবনা রবনা গৃহে" গানগুলো বেশ কয়েকবার ব্যবহার করেছেন।

বিটিভি'র জন্য তিনি আনন্দমেলা ও জলসাঘর নামে দুটি অনুষ্ঠান তৈরী করেছিলেন।জলসাঘর এর মাধ্যমে দেশবাসী প্রথমবারের মতো জানলো বাউল শাহ আব্দুল করিম নামে এক সুরের যাদুকরের কথা।পরবর্তীতে "উড়ে যায় বকপক্ষী" নাটকে তিনি আব্দুল করিম'র "আমি কূলহারা কলংকিনী" সহ বেশ কয়েকটি গান ব্যবহার করেন।আনন্দমেলায় প্রচারিত উকিল মুন্সী'র "আমার গায়ে যত দুঃখ সয়" গানটি।

তবে, উকিল মুন্সীর গান হুমায়ূন আহমেদ সবচে বেশি ব্যবহার করেছেন "শ্রাবণ মেঘের দিন" চলচিত্রে।উপরোল্লিখিত গানটি ছাড়াও "শোয়া চাঁন পাখি" ও "পূবালি বাতাসে" শিরোনামে আরো দু'টি ছিলো সেখানে।এই চলচিত্রে মাধ্যমে গায়ক হিসেবে আত্নপ্রকাশ করেন বারী সিদ্দিকী।তার সর্বশেষ চলচিত্র "ঘেটু পুত্র কমলা"-তেও শীতালং শাহ-এর লেখা "শুয়া উড়িলো" গানটি গেয়েছেন বারী সিদ্দিকী (গানটির সুরকার কানাই লাল দাস)।ফ্লুটিস্ট এর চেয়ে গায়ক হিসেবে আজ তার পরিচিতি বেশি।


এই গান গান না, আরো গান আছে

হুমায়ূন আহমেদ শুধু গান খুঁজেই থেমে থাকেননি।লিখেছেন অসম্ভব জনপ্রিয় কিছু গান এবং বরাবরের মতো নিজস্ব ধারা বজায় রেখে।গানগুলোতে জোছনা ও বৃষ্টির সরব উপস্হিতি থেকেই সেটা বোঝা যায়।দুই দুয়ারীতে আগুন'র কন্ঠে "মাথায় পড়েছি সাদা ক্যাপ" গানটি সবার মুখে ফিরতো।এই চলচিত্রের "বর্ষার প্রথম দিনে" গানটির জন্য জাতীয় চলচিত্র পুরষ্কার পান সাবিনা ইয়াসমিন।তবে, গীতিকার হিসেবে তাকে ব্যাপক পরিচিতি এনে দেয় "শ্রাবণ মেঘের দিন"।সুবীর নন্দী'র "একটা ছিলো সোনার কন্যা" বাংলাদেশী গানের জগতে প্রবাদপ্রতিম একটি স্থান দখল করে আছে।গানটি সুবীর নন্দীর ক্যারিয়ারেও নতুন একটি মাত্রা যোগ করে।এছাড়া ছিলো সাবিনা ইয়াসমিন'র কন্ঠে "আমার ভাঙা ঘরে" শীর্ষক অদ্ভুত সুন্দর একটি গান।হুমায়ূন আহমেদ আগুনের পরশমণি চলচিত্রের জন্যও গান লিখেছিলেন।কিন্তু রবীন্দ্রনাথ আর হাসন রাজার পাশে গীতিকার হিসেবে নিজের নাম দেখতে ভালো না লাগায়, শেষ পর্যন্ত গানটি আর ব্যবহার করেননি।

চন্দ্রকথা চলচিত্রে হুমায়ূন আহমেদের লেখা দুটো গান লোকপ্রিয়তা পায়।গানদুটো হলো সুবীর নন্দীর "উড়ালপঙ্খী" ও সেলিম চৌধুরীর "চাদনী পসরে কে আমারে স্মরণ করে"।নয় নম্বর বিপদ সংকেত চলচিত্রে ব্যবহার করেন একটি কাওয়ালী গান।"লটারি" বাদে অন্য কোনো দেশীয় চলচিত্রে কাওয়ালি'র ব্যবহার নেই বললেই চলে।তার সব মৌলিক গানের সুরকার ছিলেন মকসুদ জামিল মিন্টু।অসাধারণ মেলোডিয়াস কিছু গান উপহার দিয়েছেন এই ভদ্রলোক।আরও অনেক অনেক বছর যে গানগুলো মাণুষ গুন গুন করে গাইবে।মকসুদ জামিল মিন্টু ছাড়াও হাবিব ওয়াহিদ ও এস.আই.টুটুলও তার কিছু মৌলিক গানের সুর করেছেন।হুমায়ুন আহমেদের লেখা গান নিয়ে একটি পূর্ণাঙ্গ অ্যালবামও বের হয়েছিলো।"যে থাকে আঁখি পল্লবে" নামক সেই অ্যালবামের গানগুলোর সুর করেছেন টুটুল।এই অ্যালবামের "যদি মন কাঁদে" গানটি ব্যাপক জনপ্রিয়তা পেয়েছিলো।

তবে হুমায়ূন আহমেদের লেখা যে গানটি সর্বপ্রথম ব্যাপক পরিচিতি পেয়েছিলো, সেটি হলো বিটিভিতে প্রচারিত "এই দিন দিন না, আরো দিন আছে..."।গানটি গেয়েছিলেন হুমায়ূন আহমেদের আরেক আবিষ্কার আব্দুল কুদ্দুস বয়াতি।তিনি হুমায়ূন আহমেদের সাথে প্রথম কাজ করেন "খাদক" নাটকে।


শুয়া উড়িলো রে...

গিয়াস উদ্দিন এর লেখা "মরিলে কান্দিস না" গানটিকে হুমায়ুন আহমেদ নাম দিয়েছিলেন 'মৃত্যু সংগীত' (গানটির সুরকার বিদিত লাল দাস)।তার প্রতিটি গানের আসর শেষ হতো এই মৃত্যু সংগীতের মাধ্যমে।তার বিভিন্ন লেখাতে বারবার ঘুরে-ফিরে এসেছে গানটি।যেন এই গানের মাধ্যমে লেখক খুব করে অনুরোধ করেছেন, তার জন্য কেউ অশ্রু বিসর্জন না দেয়।কারণ, তিনি তো তার জীবনটা উপভোগ করে গিয়েছেন পুরোমাত্রায়।

ক্ষমা করবেন স্যার, আপনার অনুরোধটা রাখতে পারিনি।একটু না হয় কাঁদলামই আপনার জন্য, বাদশাহ গানদার !
সর্বশেষ এডিট : ৩১ শে ডিসেম্বর, ২০১২ বিকাল ৪:৪৬
১৫টি মন্তব্য ১৪টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

নারী একা কেন হবে চরিত্রহীন।পুরুষ তুমি কেন নিবি না এই বোজার ঋন।

লিখেছেন সেলিনা জাহান প্রিয়া, ০৪ ঠা মে, ২০২৪ রাত ১২:৫৪



আমাদের সমাজে সারাজীবন ধরে মেয়েদেরকেই কেনও ভালো মেয়ে হিসাবে প্রমান করতে হবে! মেয়ে বোলে কি ? নাকি মেয়েরা এই সমাজে অন্য কোন গ্রহ থেকে ভাড়া এসেছে । সব... ...বাকিটুকু পড়ুন

মুসলিম কি সাহাবায়ে কেরামের (রা.) অনুরূপ মতভেদে লিপ্ত হয়ে পরস্পর যুদ্ধ করবে?

লিখেছেন মহাজাগতিক চিন্তা, ০৪ ঠা মে, ২০২৪ সকাল ৯:৪৯




সূরাঃ ৩ আলে-ইমরান, ১০৫ নং আয়াতের অনুবাদ-
১০৫। তোমরা তাদের মত হবে না যারা তাদের নিকট সুস্পষ্ট প্রমাণ আসার পর বিচ্ছিন্ন হয়েছে ও নিজেদের মাঝে মতভেদ সৃষ্টি করেছে।... ...বাকিটুকু পড়ুন

মসজিদে মসজিদে মোল্লা,ও কমিটি নতুন আইনে চালাচ্ছে সমাজ.

লিখেছেন এম ডি মুসা, ০৪ ঠা মে, ২০২৪ সকাল ১০:২৩

গত সপ্তাহে ভোলার জাহানপুর ইউনিয়নের চরফ্যাশন ওমরাবাজ গ্রামের এক ব্যক্তির মৃত্যু হয়েছে। লোকটি নিয়মিত মসজিদে যেত না, মসজিদে গিয়ে নামাজ পড়েনি, জানা গেল সে আল্লাহর প্রতি বিশ্বাসী ছিল, স্বীকারোক্তিতে সে... ...বাকিটুকু পড়ুন

=সকল বিষাদ পিছনে রেখে হাঁটো পথ=

লিখেছেন কাজী ফাতেমা ছবি, ০৪ ঠা মে, ২০২৪ সকাল ১১:৩৮



©কাজী ফাতেমা ছবি

বিতৃষ্ণায় যদি মন ছেয়ে যায় তোমার কখনো
অথবা রোদ্দুর পুড়া সময়ের আক্রমণে তুমি নাজেহাল
বিষাদ মনে পুষো কখনো অথবা,
বাস্তবতার পেরেশানী মাথায় নিয়ে কখনো পথ চলো,
কিংবা বিরহ ব্যথায় কাতর তুমি, চুপসে... ...বাকিটুকু পড়ুন

ব্লগে বিরোধী মতের কাউকে নীতি মালায় নিলে কি সত্যি আনন্দ পাওয়া যায়।

লিখেছেন লেখার খাতা, ০৪ ঠা মে, ২০২৪ সন্ধ্যা ৬:১৮

ব্লগ এমন এক স্থান, যেখানে মতের অমিলের কারণে, চকলেটের কারণে, ভিন্ন রাজনৈতিক মতাদর্শের কারণে অনেক তর্কাতর্কি বিতর্ক কাটা কাটি মারামারি মন্তব্যে প্রতিমন্তব্যে আঘাত এগুলো যেনো নিত্য নৈমিত্তিক বিষয়। ব্লগটি... ...বাকিটুকু পড়ুন

×