হেলুসিনেশন অথবা স্মৃতিদের গল্প
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
Tweet
“কুত্তার বাচ্চাটা দান মেরে দিলো!!”
কর্কশ গলায় চেঁচিয়ে বলে উঠলো জমির মিয়া। রাস্তার মানুষেরা তাঁর দিকে জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। জমির মিয়া নিজের ভুল বুঝতে পেরে মাথা নিচু করে বাসার দিকে পা বাড়ালো। কটকটে রোদ আর ভ্যাবসা গরমে পাতলা কাপরের সাদা ধবধবে পাঞ্জাবীটা শরীরের সাথে লেপ্টে গেছে। বাসায় এসে খাটের উপর ধুপ করে আছড়ে পড়ে জমির মিয়ার বিশাল দেহটা। জমির মিয়ার চোখের সামনে তাঁর পাহারের মতো উঁচু পেটটা হালকা নড়াচড়ায় মৃদু দোল খায়। কিছুক্ষণ পর পাশের হোটেলের পিচ্চি টিংকু গরম চায়ের কাপ হাতে রুমে ঢুকে। জমির মিয়া প্রত্যেকদিন দুপুরে যখন অফিস থেকে বাসায় ফেরে, তারপর পাঁচ থেকে সাত মিনিটের মধ্যেই টিংকু চা নিয়ে জমির মিয়ার রুমে হাজির হয়ে যায়। এইটা এখন তাঁর নিয়মিত রুটিন এবং অভ্যাসে পরিণত হয়ে গেছে। জমির মিয়ার মাথার পাশে রাখা টি-টেবিলের ওপর চায়ের কাপটা নামিয়ে রাখে। কাপ রাখার সময় টুং-টাং শব্দ হয়। জমির মিয়া বিরক্ত হয়ে টিংকুকে বলে, “খানকির ছেলে! আওয়াজ হইলো ক্যান!” অন্য কোনো দিন হলে কোমর সই করে একটা লাথি মারা যেত। আজকে কেমন যেন আলসেমী লাগছে তাই লাথিটা মারা হলোনা। টিংকু রুম থেকে বের হয়ে যাবার সময় দরজা লাগানোর আওয়াজ হয়- করররররর!!!
জমির মিয়া আবারো চেচিয়ে ওঠেন,
“শুয়োরের বাচ্চা!!!”
গরমের দিন এলেই জমির মিয়ার আলসেমীর অভ্যাসটা বাড়তে থাকে। দুপুর বেলা কেমন একটা ঘুম ঘুম, ঘোর ঘোর ভাব হয়। যেমন, এখন চায়ের কাপটা হাত দিয়ে তুলতে মন চাচ্ছে না। জমির মিয়া চায়ের কাপ থেকে বের হওয়া হালকা ছাই রঙের ধোয়ার দিকে তাকিয়ে থাকে। জমির মিয়া ভাবে, ইদানিং আলসেমীর ভাবটা কি একটু অতিরিক্ত হয়ে যাচ্ছেনা? যেমন, এখন হাত দিয়ে চায়ের কাপটা তুলতে মন চাচ্ছে না। কতক্ষণ আগে, রিক্সাওয়ালাকে দশ টাকার জায়গায় একশ টাকা দিয়ে আসলো। নাহ। রিক্সাওয়ালার ব্যাপারটা হয়তো একটু বেশিই আলসেমী অথবা ঘোরের ভাবে হয়ে গেছে। জমির মিয়া স্পষ্ট দেখছে, দশ টাকার জায়গায় একশ টাকার নোটটা রিক্সাওয়ালার দিকে বাড়িয়ে দিচ্ছে। জমির মিয়ার মন বলছে ব্যাপারটা ভুল হচ্ছে, তারপরেও জমির মিয়া হাতটা থামাতে পারলেন না। রিক্সাওয়ালা যুবক, টাকার নোটটা হাতে নিয়ে ঘামে ভেজা বুক পকেটে ঢুকিয়ে দিলো। কাঁধে রাখা গামছাটা দিয়ে মুখ আর ঘাড়ের ঘাম মুছে, রিক্সা নিয়ে মিলিয়ে যায় দূরের রাস্তায়। যাবার আগে জমির মিয়ার দিকে একবার অসহায় দৃষ্টিতে তাকায়।
পাশে রাখা টি-টেবিলের ওপর রাখা চায়ের কাপ থেকে হালকা ছাই রঙের ধোয়া বের হতেই থাকে।
ধোয়ার দিকে তাকিয়ে হঠাত জমির মিয়া কিছু একটা দেখতে পায়, খুব আবছা ভাবে। অনেক বছর আগে, তাঁর বৌকে সে জবাই করছে বাড়ির উঠোনের সামনের হাসনাহেনা গাছটার নিচে। গাছে তখন সাদা সাদা ফুলগুলো ঘ্রাণ ছড়ায়। গাছের তলায় পড়ে থাকা সাদা সাদা হাসনাহেনারা তাঁর গলাকাটা বৌয়ের রক্তে টকটকে লাল হয়। সারা বাড়ি, রক্তের গন্ধে নয়, হাসনাহেনার গন্ধে ছেয়ে যায়। জমির মিয়া তৃপ্তির হাসি হাসে। পেছন ফিরে তাকিয়ে দেখে তাঁর দশ বছর বয়সী ছেলে ঘরের চৌকাঠে দাঁড়িয়ে তাঁর দিকে হা করে তাকিয়ে আছে। সম্ভবত ছেলেটা মায়ের গলাকাটা দেহ দেখে ভরকে গেছে, এবং খুব বেশি ভয় পেয়ে গেছে। জমির মিয়া যেই বটি দিয়ে বৌএর গলা কেটেছে, সেই বটি হাতেই ছেলের উদ্দেশ্যে এগিয়ে গেল। ছেলে কোনোদিকে না তাকিয়ে এক দৌড়ে পালিয়ে গেল।
জমির মিয়া হঠাত জেগে ওঠে হেলুসিনেশন অথবা নিছক পুরোনো স্মৃতির রাজ্য থেকে। জমির মিয়া ভয় পেয়ে যায়। এবং খুব বেশি ভয় পেয়ে যায়, যখন দেখে তাঁর ঘর হাসনাহেনার গন্ধে ভরে গেছে। ভয় পেয়ে যায়, যখন হোটেল বয় টিংকুর সাথে তাঁর দশ বছর আগেকার ছেলের চেহারার মিল খুঁজে পায়। জমির মিয়া দৌড়ে হোটেলে যায়। হোটেলে গিয়ে জমির মিয়া যা শুনে, তা শোনার জন্য তিনি মোটেও প্রস্তত ছিলনা। জমির মিয়া শুনে, এই হোটেলে কোনো পিচ্চি থাকেনা। এবং টিংকু নামের কাওকে তাঁরা চেনেই না। জমির মিয়া ভয়ে কাঁপতে কাঁপতে তাঁর ঘরের দিকে পা বাড়ায়। ঘরের দরজার সামনে এসে জমির মিয়া থমকে দাঁড়ায়। দেখে দরজার সামনে একটা গামছা, সাথে নয়টা দশ টাকার নোট। জমির মিয়ার মনে পরে যায়, গামছাটা সেই রিক্সাওয়ালার কাঁধে দেখেছিলো। এবং তারপর জমির মিয়া প্রচন্ড ভয় পেয়ে যায়, যখন জমির মিয়ার চোখে রিক্সাওয়ালার চেহারাটা ভেসে ওঠে। এ তো হুবুহু তাঁর ছেলেরই চেহারা!
জমির মিয়া ঘরে ঢুকে ধুপ করে দরজাটা বন্ধ করে দেয়। ঘুমুতে চেষ্টা করে। জমির মিয়া খুব ভালো ভাবে বুঝতে পারে, এইভাবে অদ্ভূত চিন্তারা তাঁর মাথায় আর আধাঘন্টা ঘোরাফেরা করলে সে নিশ্চিত মরে যাবে।
জমির মিয়া খুব বেশি চেষ্টা করে, ঘুমিয়ে যাবার।
হাসনাহেনার গন্ধে জমির মিয়ার ঘুম হয়না।
১২টি মন্তব্য ১২টি উত্তর
আলোচিত ব্লগ
শাহ সাহেবের ডায়রি ।। আমের খাট্টা
তাতানো গরমে কাল দুপুরে কাচা আমের খাট্টা দেখে ব্যাপারটা স্বর্গীয় মনে হল । আহা কি স্বাদ তার । অন্যান্য জিনিসের মত কাচা আমের দাম বাড়াতে ভুল করেনি... ...বাকিটুকু পড়ুন
ডাক্তার ডেথঃ হ্যারল্ড শিপম্যান
উপরওয়ালার পরে আমরা আমাদের জীবনের ডাক্তারদের উপর ভরশা করি । যারা অবিশ্বাসী তারা তো এক নম্বরেই ডাক্তারের ভরশা করে । এটা ছাড়া অবশ্য আমাদের আর কোন উপায়ই থাকে না... ...বাকিটুকু পড়ুন
আমার ইতং বিতং কিচ্ছার একটা দিন!!!
এলার্ম এর যন্ত্রণায় প্রতিদিন সকালে ঘুম ভাঙ্গে আমার। পুরাপুরি সজাগ হওয়ার আগেই আমার প্রথম কাজ হয় মোবাইলের এলার্ম বন্ধ করা, আর স্ক্রীণে এক ঝলক ব্লগের চেহারা দেখা। পরে কিছু মনে... ...বাকিটুকু পড়ুন
বিসিএস শুধু দেশের রাজধানী মুখস্ত করার পরীক্ষা নয়।
"আমার বিসিএস এক্সামের সিট পরেছিলো ঢাকা পলিটেকনিক ইনস্টিটিউট এ, প্রিপারেশন তো ভালোনা, পড়াশুনাও করিনাই, ৭০০ টাকা খরচ করে এপ্লাই করেছি এই ভেবে এক্সাম দিতে যাওয়া। আমার সামনের সিটেই এক মেয়ে,... ...বাকিটুকু পড়ুন
কে কাকে বিশ্বাস করবে?
করোনার সময় এক লোক ৯৯৯ এ ফোন করে সাহায্য চেয়েছিল। খবরটা স্থানীয় চেয়ারম্যানের কানে গেলে ওনি লোকটাকে ধরে এনে পিটিয়েছিলেন। কারণ, ৯৯৯ এ ফোন দেওয়ায় তার সম্মানহানি হয়েছে।
সমাজে এমন... ...বাকিটুকু পড়ুন