somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

রাতের আগন্তুক

০৩ রা এপ্রিল, ২০১৮ রাত ৮:০৪
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :



(নতুন পাঠকদের জন্য তিনটি পর্ব একসাথে দিলাম। তাতে কষ্ট করে আর আগের পর্বের লিংক খুঁজে বের করার ঝামেলায় যেতে হবে না। আর যারা আগের পর্বগুলো পড়েছেন স্ক্রল করে সোজা নিচে গিয়ে তৃতীয় পর্ব পড়তে থাকুন।)

ঝিরিঝিরি বৃষ্টির মধ্যে একটি ল্যাম্পপোস্টে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে আছি প্রায় বিশ মিনিট ধরে। লম্বা রেইনকোট আর চওড়া কার্নিসের হ্যাট পরা থাকায় ভিজে চুপচুপে হওয়ার হাত থেকে রেহাই পেলেও শরীরের পুরোটা শুকনো নেই। ফাঁকফোকর দিয়ে এক-দু'ফোঁটা পানি চুঁইয়ে চুঁইয়ে ভেতরে ঢুকে অস্বস্তির সৃষ্টি করছে।

আরও কিছুক্ষণ অপেক্ষা করতে চাই। একঘন্টার লোডশেডিংয়ের সময় প্রায় হয়ে এসেছে। যদিও লোডশেডিং হলেও এলাকাটায় একেবারে ঘুটঘুটে অন্ধকার হবে না। সিটি কর্পোরেশনের ল্যাম্পপোস্টের বাতিগুলো জ্বলতেই থাকবে; তবে আমার কাজের জন্য কিছুটা সুবিধা অবশ্যই পাব। পকেটে হাত দিয়ে ছোট্ট লেদারব্যাগটার স্পর্শ নিলাম। এই ছোট্ট ব্যাগে কিছু প্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতি আছে যা আমার পেশায় খুবই দরকারি জিনিস।

রাত ঠিক একটায় বিদ্যুৎ চলে গেল। মনে মনে নিজেকে প্রস্তুত করে নিয়ে এগিয়ে গেলাম বাড়িটার দিকে। এই আবাসিক এলাকাটা এখনও তেমন ঘিঞ্জি হয়ে ওঠেনি। ছড়িয়ে-ছিটিয়ে বাড়িঘর উঠছে। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই দুটি বাড়ির মাঝামাঝি জায়গা ফাঁকা রয়ে গেছে। আমার জন্য এটাও একটা সুবিধা। অবশ্য আমাকে এ কাজের জন্য ভাড়া করা লোকটা মোটামুটি আরও কিছু সুবিধার কথা আগেই জানিয়ে দিয়েছে।

গেট ভেতর থেকে বন্ধ। বাড়ির পেছনে চলে এলাম। দেয়ালের সামনে দাঁড়িয়ে একটু আন্দাজ করার চেষ্টা করলাম কতটুকু উঁচু। ফুট সাতেক হতে পারে। সাত ফুট উঁচু দেয়াল টপকানো আমার জন্য কোন ব্যাপারই নয়। হাতে শক্ত আর মোটা চামড়ার গ্লাভস পরে নিয়ে ছোট্ট একটা লাফ দিলাম। উপরে কাচ গাঁথা থাকলেও হাতে তেমন কিছু অনুভব করলাম না। দোল খেয়ে দেয়ালের উপর উঠে আবছা অন্ধকারেই চারিদিকে একবার চোখ বুলিয়ে নিলাম।

কেউ থাকার কথা নয়, তারপরও অভ্যাসবশত তীক্ষ্ণ চোখে এদিকওদিক চেয়ে নিশ্চিত হয়ে নিলাম। এ পেশায় সাবধানতার মার নেই। এতদিন ধরে সাবধানে কাজ করার কারণেই পুলিশ আমার টিকিটিও ছুঁতে পারেনি।

মাটিতে নেমে নিঃশব্দ পায়ে পুরো বাড়িটা চক্কর দিলাম। তারপর আস্তে আস্তে কিচেনের দরজার সামনে গিয়ে দাঁড়ালাম। জানি এটায় তালা দেয়া নেই, শুধু ছিটকিনি মারা। এ ব্যাপারটা বাড়ির মালিকই আমাকে জানিয়ে রেখেছে।

ছোট্ট লেদার ব্যাগটা থেকে অত্যন্ত খাটো একটা শাবল বের করে ছিটকিনির পাশের ফ্রেম এবং দরজার সরু ফাঁকে স্থাপন করলাম। ফাঁকটা খুবই সরু, শাবলের মাথা ঢুকতে চাইছে না। গায়ের জোরে চেপে ঢুকিয়ে দিলাম মাথাটা। তারপর গায়ের সর্বশক্তি দিয়ে চাপ দিলাম।

একসময় ছিটকিনি থেকে আলগা হয়ে খুলে এল দরজাটা। নিঃশব্দে ঢুকে পড়লাম কিচেনের ভেতর। দরজা ভেজিয়ে দিয়ে কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থেকে চোখে অন্ধকার সইয়ে নিলাম। রেইনকোট আর জুতো জোড়া খুলে নিয়ে রেইনকোটটা একটা হুকে আটকে তারপর আস্তে আস্তে পা বাড়ালাম। বেডরুম বাদ দিয়ে গোটা বাড়িটা সার্চ করলাম নিঃশব্দ পায়ে। তারপর বেডরুমের দরজায় কান পাতলাম। কোন শব্দ পাওয়া যাচ্ছে না। আস্তে করে হাতলে মোচড় দিলাম। ভেতর থেকে তালা লাগানো। অবশ্য এমনই থাকার কথা।

ব্যাগের পকেট থেকে সরু একটা তামার তারের টুকরো বের করে তালায় ঢুকিয়ে দিলাম। আস্তে আস্তে অনেকক্ষণ কসরত করার পর মৃদু ক্লিক শব্দ করে খুলে গেল লক। ধীরে ধীরে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললাম। আলতো মোচড় দিতেই খুলে গেল দরজা। নিঃশব্দে ভেতরে প্রবেশ করে দরজা ভেজিয়ে দিলাম।

আবছা অন্ধকারে বিছানাটা দেখা যাচ্ছে। কেউ শুয়ে আছে ওদিকে পাশ ফিরে। আরেকটু কাছে গিয়ে নিশ্চিত হতে চাইলাম। এগিয়ে গিয়ে ঠাহর করার চেষ্টা করলাম। লম্বা চুল বালিশের উপর এলোমেলোভাবে ছড়িয়ে থাকতে দেখে শিওর হলাম, আমার টার্গেট এই মেয়েটিই। আমাকে দেয়া বর্ণনার সাথে সবকিছু খাপেখাপে মিলে যাচ্ছে। মেয়েটা প্রতিদিন স্লিপিং পিল খেয়ে ঘুমায় এটা আমাকে আগেই জানানো হয়েছে।

কাজ সারার আমার নিজস্ব দুটো পদ্ধতি আছে। একটা হচ্ছে চামড়ার চওড়া বেল্ট গলায় এঁটে দিয়ে যতক্ষণ পর্যন্ত ভিকটিম নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে গিয়ে স্থির না হচ্ছে ততক্ষণ দুপাশ থেকে চেপে ধরে রাখা, আরেকটা হচ্ছে নাকেমুখে বালিশ চাপা দিয়ে নিঃশ্বাস বন্ধ করে দিয়ে পরপারে পাঠিয়ে দেয়া। এটাকে শেষ করতে আমি আজ দ্বিতীয় পদ্ধতিটা ব্যবহার করব।

পাশ থেকে একটা বালিশ টেনে নিয়ে আস্তে করে মেয়েটার নাকেমুখে চেপে ধরলাম। কিছুক্ষণের মধ্যেই মেয়েটা ছটফট করে উঠে দুহাত দিয়ে নাকমুখ থেকে বালিশ সরানোর জন্য জোরাজুরি করতে লাগল। আমি আরো শক্ত করে বালিশটা চেপে রাখলাম। হাত-পা নাড়িয়ে কিছুক্ষণ চেষ্টা করার পর মেয়েটা নেতিয়ে পড়ল। নিশ্চিত হওয়ার জন্য প্রায় মিনিট পাঁচেক আমি বালিশটা চেপে ধরে রাখলাম। তারপর বালিশটা আস্তে আস্তে সরিয়ে নিলাম। ব্যস, আমার কাজ শেষ।

এতক্ষণ শক্তি খাটানোর ফলে কিছুটা হাঁপিয়ে গেছি। পাশেই একটা সোফা দেখে ধপ করে বসে পড়লাম। সিগারেটের তেষ্টা পেয়ে গেছে। পকেট থেকে সিগারেট আর লাইটার বের করলাম। সিগারেট ঠোঁটে চেপে ফস করে লাইটার জ্বাললাম। মুখটা সামনে লাইটারের দিকে এগিয়ে নিতে গিয়ে হঠাৎই চোখ চলে গেল মেয়েটার স্থির নিষ্কম্প মুখের দিকে।

বিদ্যুৎপৃষ্টের মত কেঁপে উঠে স্থির হয়ে গেলাম। কড়কড় করে কোথাও বাজ পড়ল। হাত আর মুখ থেকে লাইটার-সিগারেট খসে পড়ল আমার। সারা শরীর যেন এক নিমিষে অবশ হয়ে গেল। বিস্ফারিত চোখে অন্ধকারেই চেয়ে রইলাম অনেকক্ষণ।

স্থাণুর মত নিশ্চুপ হয়ে কতক্ষণ বসে ছিলাম জানি না। হঠাৎ টেলিফোনের শব্দে সম্বিত ফিরে পেলাম। কোথাও ফোন বাজছে। টলতে টলতে ঘর থেকে বেরিয়ে এলাম।

ড্রইংরূমে টেলিফোনটা যেন আর্তনাদ করে চলেছে। টেবিলের কাছে গিয়ে ছোঁ মেরে রিসিভারটা তুলে নিয়ে কানে ঠেকালাম। কিছু শব্দজটের পর অপরপ্রান্ত থেকে ভেসে এল সেই লোকটার গলা-
"কাজ শেষ করেছ?"

"ইউ বাস্টার্ড" আমি দাঁতে দাঁত ঘষে উচ্চারণ করলাম।

হা হা হা করে অট্টহাসিতে ফেটে পড়ল লোকটা। "সারপ্রাইজটা কেমন হল মিঃ প্রেমিক?"

"হু আর ইউ অ্যান্ড হোয়াই?"

"এখনও বুঝতে পারনি?" চিবিয়ে চিবিয়ে উচ্চারণ করল ও। "আমি তোমার এককালের বেঁচে থাকার অবলম্বন, তোমার ধ্যান-জ্ঞান, জানের জান, তোমার প্রাণপ্রিয় প্রেয়সীর আদি ও অকৃত্রিম স্বামীপ্রবর।"

"কিন্তু কেন, আর আমাকে দিয়েই কেন?"

"সে অনেক লম্বা কাহিনী। তোমার শোনার ধৈর্য্য হবে না" কৌতুকের সুরে বলল লোকটা।

"আমি শুনতে চাই" দাঁতে দাঁত চেপে বললাম আমি।

"ঠিক আছে। তাহলে শোনো" বলে শুরু করল লোকটা-

"ওকে প্রথমবার দেখেই আমি ওর রূপে পাগল হয়ে যাই। দেখেছিলাম তোমাদের এলাকাতেই। আমি তখন নতুন নতুন ঠিকাদারি শুরু করেছি। তোমাদের এলাকার একটি রাস্তার কাজ করতে গিয়ে একদিন ওকে দেখি। সম্ভবত কলেজে যাচ্ছিল। কী বলব? মেয়েটার রূপে যেন সম্মোহনী শক্তি ছিল। দেখামাত্রই আমি ওকে পাবার জন্য পাগল হয়ে গেলাম। আমি সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেললাম- এই মেয়েটাকে যেভাবেই হোক আমাকে পেতেই হবে। তারপর খোঁজখবর করা শুরু করলাম। আমার জন্য সোনায়-সোহাগা হল যখন শুনলাম মেয়েটার বাবা সামান্য একজন প্রাইমারি স্কুলমাস্টার। আমার এক কাছের লোককে দিয়ে বিয়ের প্রস্তাব পাঠালাম। বাবা রাজি হলেও মেয়েটা প্রথমে কিছুতেই রাজি হয়নি। কিন্তু ওর বাবা সাংঘাতিক চাপ প্রয়োগ করে ওকে বিয়েতে রাজি করায়। তারপর ওকে বিয়ে করে নিয়ে চলে আসি ঢাকায়। কেমন লাগছে মিঃ ব্যর্থ প্রেমিক?"

"বলে যাও" বিড়বিড় করে বললাম আমি।

"বিয়ের রাতেই জানতে পারলাম আমি একটি জীবন্ত লাশকে ঘরে এনেছি। সে আমাকে স্বামী হিসেবে মনপ্রাণ দিয়ে কোনদিনও গ্রহণ করতে পারবে না। ওর বাবা আত্মহত্যার ভয় দেখিয়ে ওকে বিয়েতে রাজি করায়। ও তোমার ব্যাপারে সবকিছুই ওর বাবাকে খুলে বলে। তুমি মেধাবি ছাত্র, বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ছ, তোমার জন্য ও অপেক্ষা করার অঙ্গীকার করেছে ইত্যাদি শোনার পরও ওর বাবা কোনভাবেই আমার মত ছেলেকে হাতছাড়া করতে রাজি হয়নি। অসম্ভব সুন্দরী মেয়ের বিয়ের চিন্তায় নাকি ওর বাবার রাতের ঘুম হারাম হয়ে গিয়েছিল। অত সুন্দরী মেয়ে কখন কী ঘটে যায় এ চিন্তায় আর বিয়ের ব্যাপারে দেরী করার পক্ষপাতি ছিল না।
তোমার ব্যাপারে আমাকেও সবকিছু খুলে বলে ও। ওর কাছে তোমার ছবিও দেখতে পাই। তখনই আমি মনে মনে প্রতিজ্ঞা করি আমি এর এমন প্রতিশোধ নেব যেন তোমাদের দু'জনেরই জীবন নরকের চেয়েও ভয়ানক যন্ত্রণাময় হয়ে যায়। তারপর আমি ওকে আর ছুঁয়ে দেখিনি।"

"তারপর শুরু হল আমার প্রতিশোধের পালা। তোমাকে খুঁজে বের করার জন্য আমি বিভিন্ন দিকে লোক লাগিয়ে দিলাম। এদিকে এক রাতে তোমার প্রেমিকাকে খাবারের সাথে নেশাদ্রব্য খাইয়ে আমার এক রাজনৈতিক বসের মনোরঞ্জনের ব্যবস্থা করে দিলাম। পুরো ঘটনা ভিডিও করে রাখলাম যাতে পরে ওকে ব্ল্যাকমেইল করতে পারি" বলে আবারও অট্টহাসি দিল লোকটা।

আমি রিসিভারের মাউথপিসটা মুখের কাছে নিয়ে লোকটাকে অশ্রাব্য ভাষায় কয়েকটা গালি দিলাম।


তৃতীয় পর্বঃ


গালি শুনে থমকে গেল লোকটা। কিছুক্ষণ নিরব থেকে তারপর যেন কিছুই হয়নি এমনভাবে আবার বলতে শুরু করল-
"তারপর থেকে প্রায় প্রতিদিনই আমার ফ্ল্যাটে বিভিন্ন নেতা, বড় বড় সরকারি কর্মকর্তাদের পদধুলি পড়তে শুরু করল। আর আমিও এই সুযোগে বিভিন্ন সরকারি কাজের টেন্ডার বাগিয়ে নিতে লাগলাম। তোমার মনে প্রশ্ন জাগতে পারে যে, মেয়েটা এত অত্যাচার সহ্য করার চেয়ে আত্মহত্যা করল না কেন, তা করলেই তো বেঁচে যেত?
আত্মহত্যা না করার দুটো কারণ ছিল। প্রথমতঃ ওর বাবা বেঁচে ছিল। ওর ভিডিওক্লিপ বাবার চোখে পড়লে বেচারা হয়ত হার্টফেলই করত। বাবার এভাবে মৃত্যু দেখতে চায়নি ও। তাই বাবার মুখের দিকে চেয়ে সবকিছু মেনে নিয়েছিল। দ্বিতীয় এবং প্রধান কারণটা ছিলে তুমি। তোমার সাথে দেখা না করে ও মরতে চায়নি। কোন একসময় নাকি ও প্রতিজ্ঞা করেছিল- মৃত্যু পর্যন্ত তোমার জন্য প্রতীক্ষা করবে। প্রেমের সস্তা আবেগ যাকে বলে আর কি" তাচ্ছিল্য ঝরে পড়ল লোকটার কন্ঠে। তারপর আবার বলতে শুরু করল-

"তোমাকে খোঁজার জন্য যে লোকগুলোকে লাগিয়েছিলাম তাদের মধ্যে একজন একদিন খবর নিয়ে এল। আমার জন্য এটাও ছিল আরেকটা সুসংবাদ। জেনে গেলাম তুমি এখন এক দুর্ধর্ষ কিলার। করাপ্টেড পলিটিশিয়ানদের পথের কাঁটা সরানোর এক মোক্ষম হাতিয়ার। রাজনৈতিক বিভিন্ন প্রতিদ্বন্দ্বীদের এবং নিজেদের প্রমোদ ভবনে পুরনো হয়ে যাওয়া এবং ক্যারিয়ারের জন্য সিকিউরিটি রিস্ক হিসেবে পরিণত হওয়া রক্ষিতাদেরকে দুনিয়া থেকে সরিয়ে দেয়ার জন্য তারা তোমার শরণাপন্ন হয়ে থাকেন। তখনই আমি আমার পরিকল্পনা সাজাতে শুরু করি। এক ঢিলে দুটি পাখি মারার সুযোগ দেখতে পাই। মেয়েটার প্রয়োজনীয়তা প্রায় ফুরিয়ে এসেছিল। নেতারা নতুন নতুন জিনিস চায়। পুরনো জিনিসের প্রতি অনীহা চলে এসেছিল। তাই ওকে শেষ করে দেয়ার সিদ্ধান্ত নিই। এতে আমার প্রতিশোধের কিছুটা পূরণ হবে। যদিও কিছুটা খারাপ লাগছিল। কারণ, হাজার হোক সে আমার বিয়ে করা বউ এবং আমাকে অনেক সুযোগ-সুবিধে পাইয়ে দিয়েছিল। আর তোমাকে দিয়ে যদি কাজটা করাতে পারি তাহলে প্রতিশোধের ষোলকলা পূর্ণ হয়। তাই অনেক ভেবেচিন্তে প্ল্যানটা করে ফেলি।

তোমার প্রেয়সীকে অপেক্ষাকৃত নির্জন আর নতুন এই এলাকায় একটি ভাড়া বাড়িতে এনে তুলি। তোমাকে ভাড়া করা হয় ওকে পৃথিবী থেকে সরিয়ে দেয়ার জন্য। তারপর আজ আমাকে দেশের বাইরে যেতে হবে বলে বাড়িতে জানিয়ে সন্ধ্যায় দেশ ছেড়ে চলে আসি। মেয়েটা কোন সন্দেহ করেনি, কারণ প্রায়ই আমি হুটহাট করে দেশের বাইরে চলে যাই। আর তারপরেরটুকু তো তোমার জানাই আছে। নতুন করে বলতে হবে কি?

"কিন্তু তুমি নিজের বিয়ে করা বউকে খুন করিয়ে পুলিশের হাত থেকে বাঁচবে কী করে? ওরা কি তোমাকে এর সাথে জড়াবে না? আর এই টেলিফোন কলের ব্যাপারটা? পুলিশ এই ফোনকলের ব্যাপারে খোঁজখবর করবে আর আমাকে ভাড়া করতে যে লোকটাকে পাঠিয়েছিলে সে তো সাক্ষ্য দেবে।"

"না। পুলিশ আমাকে কোনভাবেই এর সাথে জড়াতে পারবে না। তুমিই ভেবে দেখ, আমি আমার স্ত্রীকে একা একটি বাড়িতে রেখে ব্যবসার কাজে দেশের বাইরে চলে আসি। তারপর ঝড়বৃষ্টির রাতে খালি বাড়ি পেয়ে ডাকাতির উদ্দেশ্যে তুমি সেখানে ঢুকে পড়। তারপর মেয়েটাকে খুন করে ডাকাতি শেষে চলে যাও। ডাকাতির উদ্দেশ্যটা পুলিশের কাছে বিশ্বাসযোগ্য করার জন্য আমার ঘরের কাবার্ড আর ড্রয়ারগুলোর তালা আগেই সেভাবে ভেঙ্গে রাখা হয়েছে।
মেয়েটাকে তুমি কেন খুন করেছ তার মোটিভ পুলিশ বের করতে পারবে বলে মনে হয় না। আর মোটিভ বের করতে পারলেও আমার কোন সমস্যা নেই। তারা এটাকে ডাকাতি হিসেবেই দেখবে এবং ডাকাতিতে বাধা পেয়ে তুমি মেয়েটাকে খুন করেছ বলে ভাববে। আমি যে এর সাথে কোনভাবে জড়িত আছি তা তারা কোনভাবেই প্রমাণ করতে পারবে না। আর যদি শেষমেশ প্রমাণ করতেও পারে তবুও কোন সমস্যা দেখি না। আমার টাকা আছে, আর ওদেশে টাকা দিয়ে দিনকে রাত করা যায়। সর্বোপরি পলিটিশিয়ান নেতাদের কথা ভুলে গেলে? তারা আছে কী করতে?
আর এই টেলিফোন কলের ব্যাপারটা নিয়ে বেশি খুশি হয়ো না। ওখানকার টেলিফোনের সিস্টেমটা তো তুমি জানোই; এই ২০০০ সালে এসেও মান্ধাতা আমলের সিস্টেমে চলছে সরকারি এই প্রতিষ্ঠানটি। ঠিক কয়টায় কলটা করা হয়েছিল এবং কতক্ষণ ধরে কলটা চালু ছিল শুধু এতটুকুই রেকর্ডে থাকবে। কী কথা হয়েছিল সেটা ওরা বের করতে পারবে না। কারণ, টেলিফোন বোর্ডে সব কল রেকর্ড করার সিস্টেম নেই।
তারপর রইল ওই লোকটা, যার হাতে তোমাকে দেয়ার জন্য একটা মোটাসোটা খাম পাঠানো হয়েছিল। যার মধ্যে একটা টাইপ করা কাগজ আর তোমার কাজের ফি হিসেবে নগদ টাকা ছিল। ওই কাগজেই সবকিছু লিখে তোমাকে ভাড়া করা হয়েছিল। আসলে লোকটা ছিল ওনলি একজন মেসেঞ্জার বা বাহক, সে এসবের ব্যাপারে কিছুই জানে না। তাকে শুধু খামটা পৌঁছে দেয়ার দায়িত্ব দেয়া হয়েছিল। আর যে তাকে এই দায়িত্বটা দেয় মেসেঞ্জার লোকটা তাকে চিনতেই পারবে না। বুঝতে পারলে না? এই লোকটা ছদ্মবেশে ছিল। সুতরাং কোনভাবেই তুমি আমার নাগাল পাবে না।"

আমি স্পষ্ট বুঝতে পারলাম লোকটা আমাকে একেবারে পথের শেষ প্রান্তে এমনভাবে এনে দাঁড় করিয়েছে যে আমার আর কোনদিকে যাওয়ার রাস্তা নেই। আমার বেঁচে থাকার একমাত্র অবলম্বন, আমার জীবনের চেয়েও যাকে বেশি চেয়েছি সেই প্রেয়সীকে আমাকে দিয়েই খুন করিয়ে নিজে আত্মতৃপ্তির অট্টহাসি হাসছে। ঘৃণা আর রাগে আমার সর্বশরীর থরথর করে কেঁপে উঠল।

আবার লোকটার কন্ঠ ভেসে এল-
"শোনো, যদি বাঁচতে চাও তাহলে এখনই বাড়ি থেকে বের হয়ে গা ঢাকা দাও। কোন অজ্ঞাতনামার ফোন পেয়ে পুলিশ যে কোন সময় পৌঁছে যেতে পারে। আমার প্রতিশোধ পূর্ণ হয়েছে সুতরাং তোমার ব্যাপারে আমার আর কোনপ্রকার মাথাব্যাথা নেই। নিজের ভাল চাইলে চিরতরে দেশ ছেড়ে পালিয়ে যাও। আর আমার ব্যাপারে ভুলেও খোঁজখবর করার চেষ্টা কোরো না, তাহলে কখন পটল তুলবে তা টেরটিও পাবে না।"

আর কিছু না বলে লোকটা লাইন কেটে দিল। আমি তারপরও বোকার মত কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে রইলাম। রিসিভার ক্রেডলে রেখে আরও কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থেকে আস্তে আস্তে বেডরুমে এসে ঢুকলাম। ততক্ষণে কারেন্ট চলে এসেছে। রুমে ঢুকে বেডসাইড ল্যাম্পটা জ্বালিয়ে দিয়ে ওর শিয়রের পাশে বসলাম। চিরদিনের জন্য স্থির হয়ে যাওয়া করুণ আর বেদনার্ত নিষ্পাপ মুখটার দিকে নির্নিমেষ তাকিয়ে রইলাম। চোখ থেকে টপটপ করে পানি পড়ে পড়ে বুকের কাছে শার্ট ভিজতে লাগল। যে আমি গত ছয়টি বছর নিজেকে দয়ামায়াহীন একটি পাষণ্ডে পরিণত করেছিলাম, একের পর এক মেয়ের জীবনপ্রদীপ নিভিয়ে দেয়ার পরও যার চোখ থেকে একফোঁটা পানি বের হয়নি সেই আমি এই মুহূর্তে হু হু করে ডুকরে কেঁদে উঠলাম। ও আমার জন্য জীবনের শেষ ক্ষণটি পর্যন্ত অপেক্ষা করতে চেয়েছিল। আর সে প্রতিজ্ঞা সে ভাঙ্গেনি। তার প্রতিজ্ঞা সে রেখেছে। জীবনের শেষ দিনে হলেও আমার সামনে এসেছে। এ কথা মনে হতেই আমার দুচোখ দিয়ে বাঁধভাঙ্গা স্রোতের মত একনাগাড়ে পানি বেরিয়ে এসে বুক-পেট ভিজিয়ে দিতে লাগল।

ছোটবেলাতেই মা-বাবা মারা যাওয়ায় চাচার বাড়িতে থেকে লেখাপড়া করে মানুষ হওয়ার চেষ্টা করছিলাম। বাবার বেশকিছু জমিজমা ছিল আর চাচাও আমাকে নানারকম সাহায্য-সহযোগিতা করতেন। তাই আমাকে লেখাপড়ার খরচের ব্যাপারে চিন্তা করতে হয়নি। বিশ্ববিদ্যালয়ের ছুটিতে বাড়িতে গিয়ে যেদিন ওর বিয়ের খবর শুনি তারপর থেকে আমার পুরো পৃথিবীটাই যেন ওলটপালট হয়ে যায়। ও আমার সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করায় সমস্ত মেয়েদের প্রতি তীব্র ঘৃণা নিয়ে হোস্টেলে ফিরে আসি। লেখাপড়া থেকে মন উঠে যায়। আস্তে আস্তে ক্ষমতাসীন পার্টির ছেলেদের সাথে বন্ধুত্ব হয়। নিজেকে ধ্বংস করার নেশায় মেতে উঠি। বখাটে ছেলেদের সাথে ওঠাবসা আর ছোটখাট অপরাধের সাথে সখ্যতা শুরু হয়। বিভিন্ন ছাত্রকে মারধর, হল দখল, মিছিলে ছোটখাট বোমাবাজি ইত্যাদি অপরাধের সাথে জড়িয়ে পড়ি। কিছুদিন পর রাজনৈতিক নেতাদের চোখ আমার উপর পড়তে শুরু করে। তারপর অপরাধজগতে আমি একেবারে যাকে বলে অপ্রতিদ্বন্দ্বী হয়ে উঠি। বিভিন্ন কাজে নেতারা আমার সাহায্য নিতে শুরু করেন। ক্রমে আরও ভয়ঙ্কর অপরাধে নিজেকে আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে ফেলি। ভাড়াটে খুনির খাতায় নিজের নাম লেখাই। অনেক বড় বড় নেতা আমার সাহায্যে প্রতিদ্বন্দ্বী নেতাকে চিরতরে দুনিয়া থেকে সরিয়ে দিতে সক্ষম হয়। পুলিশের খাতায় আমার নাম উঠে যায়। কিন্তু পুলিশ এখনও আমাকে কোন অপরাধেই হাতেনাতে ধরতে পারেনি। হয়ত রাজনৈতিক ছত্রছায়ায় থাকার কারণে পুলিশ আমাকে সমঝে চলে, সেজন্য আমাকে ধরার ব্যাপারে ওদের তৎপরতা কম।

এখন আমাকে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নিতে হবে। আমি কী করব? যেহেতু আমার বেঁচে থাকার আর কোন অর্থ নেই তাই পুলিশের কাছে ধরা দিয়ে অতীত-বর্তমানের সব অপরাধের কথা স্বীকার করে নেব, নাকি ওই লোকটাকে খুঁজে বের করে প্রতিশোধ নেব? অবশ্য আমি ধরা দিলে অনেক নেতার গোমর ফাঁস হয়ে যাবে। সবচেয়ে বড় কথা এই নেতাদের চাপেই পুলিশ আমাকে বেশিদিন বাঁচিয়ে রাখবে না। কোনদিন খবরের কাগজের হেডলাইন হব আমি। সেখানে লেখা থাকবে- "আসামীকে নিয়ে অস্ত্র উদ্ধার করতে গেলে তার সহযোগীদের সাথে পুলিশের বন্দুকযুদ্ধ হয় আর এতে ক্রসফায়ারে পড়ে বিভিন্ন মামলার মোস্ট ওয়ান্টেড আসামী দুর্ধর্ষ খুনী সায়েম নিহত হয়।"

এটা ঠিক আমি যদি বেঁচে থাকি তাহলে আমার বাঁচার একমাত্র উদ্দেশ্য হবে লোকটাকে খুঁজে বের করে তার পাপের কর্মফল কড়ায়গন্ডায় বুঝিয়ে দেয়া। ওকে খুঁজে বের করা আমার জন্য তেমন কঠিন হবে না। ও মনে করেছে ওর চেয়ে চালাক আর কেউ নেই? ও যদি চলে ডালে ডালে তাহলে আমি চলি পাতায় পাতায়।

মনস্থির করে কোন সিদ্ধান্তে পৌঁছুবার আগেই হঠাৎ পুলিশের গাড়ির সাইরেনের শব্দ শুনতে পেলাম।
সর্বশেষ এডিট : ০৪ ঠা এপ্রিল, ২০১৮ দুপুর ১:২৩
২২টি মন্তব্য ২২টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

ছি , অবৈধ দখলদার॥ আজকের প্রতিটি অন‍্যায়ের বিচার হবে একদিন।

লিখেছেন ক্লোন রাফা, ০৪ ঠা ডিসেম্বর, ২০২৫ দুপুর ১২:১০



ধিক ‼️বর্তমান অবৈধভাবে দখলদার বর্তমান নরাধমদের। মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে স্বাধীন বাংলাদেশে । বীর মুক্তিযোদ্ধাদের ক্ষমা চাইতে হলো ! রাজাকার তাজুলের অবৈধ আদালতে। এর চাইতে অবমাননা আর কিছুই হোতে পারেনা।... ...বাকিটুকু পড়ুন

আম্লিগকে স্থায়ীভাবে নিষিদ্ধে আর কোন বাধা নেই

লিখেছেন সৈয়দ মশিউর রহমান, ০৪ ঠা ডিসেম্বর, ২০২৫ দুপুর ১২:২২


মঈন উদ্দিন ফখর উদ্দিনের ওয়ান-ইলেভেনে সরকারের ২০০৮ সালের ডিসেম্বরে ভারতের সহায়তায় পাতানো নির্বাচনে হাসিনা ক্ষমতায় বসে। এরপরই পরিকল্পিত উপায়ে মাত্র দুই মাসের মধ্যে দেশপ্রেমিক সেনা অফিসারদের পর্যায়ক্রমে বিডিআরে পদায়ন... ...বাকিটুকু পড়ুন

মিশন: কাঁসার থালা–বাটি

লিখেছেন কলিমুদ্দি দফাদার, ০৪ ঠা ডিসেম্বর, ২০২৫ রাত ৯:২৭

বড় ভাই–ভাবীর ম্যারেজ ডে। কিছু একটা উপহার দেওয়া দরকার। কিন্তু সমস্যা হলো—ভাই আমার পোশাক–আশাক বা লাইফস্টাইল নিয়ে খুবই উদাসীন। এসব কিনে দেওয়া মানে পুরো টাকা জ্বলে ঠালা! আগের দেওয়া অনেক... ...বাকিটুকু পড়ুন

আওয়ামী লীগের পাশাপাশি জামায়াতে ইসলামীকেও নিষিদ্ধ করা যেতে পারে ।

লিখেছেন সৈয়দ কুতুব, ০৫ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ রাত ১২:৪৫


বাংলাদেশে আসলে দুইটা পক্ষের লোকজনই মূলত রাজনীতিটা নিয়ন্ত্রণ করে। একটা হলো স্বাধীনতার পক্ষের শক্তি এবং অন্যটি হলো স্বাধীনতার বিপক্ষ শক্তি। এর মাঝে আধা পক্ষ-বিপক্ষ শক্তি হিসেবে একটা রাজনৈতিক দল... ...বাকিটুকু পড়ুন

J K and Our liberation war১৯৭১

লিখেছেন ক্লোন রাফা, ০৫ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ সকাল ৯:০৯



জ্যাঁ ক্যুয়ে ছিলেন একজন ফরাসি মানবতাবাদী যিনি ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সময় পাকিস্তান ইন্টারন্যাশনাল এয়ারলাইন্সের একটি বিমান হাইজ্যাক করেছিলেন। তিনি ৩ ডিসেম্বর, ১৯৭১ তারিখে প্যারিসের অরলি... ...বাকিটুকু পড়ুন

×