ব্লগের অত্যন্ত প্রিয়মুখ এবং সুপরিচিত ব্লগার রুবাইদা গুলশান (নীল মনি) এর গল্পগ্রন্থ "সেফটিপিন" বইটি কিছুদিন আগে আমার পড়ার সৌভাগ্য হয়েছে। তাঁর লেখা এ বইটি পড়ে নিজস্ব উপলব্ধির ব্যাপারে আলোকপাত করার উদ্দেশ্যেই এই ক্ষুদ্র প্রয়াস। রিভিউ বলতে আসলে যা বোঝায় এই লেখাটা ঠিক তা নয়। তবুও কেউ যদি এটাকে রিভিউ হিসেবে ধরে নেন তাহলে তাঁকে বলব- এটা আমার জীবনের তথাকথিত প্রথম বুক রিভিউ। তাই সকল ত্রুটি-বিচ্যুতির দায় একান্তই আমার নিজস্ব।
ছোট এবং মাঝারি মিলিয়ে সর্বমোট আটাশটি জীবনঘনিষ্ঠ বিভিন্নরকম গল্প নিয়ে সেফটিপিন। লেখিকা তুলনামূলক নবীন হলেও তাঁর লেখায় পরিপক্কতার ছাপ সুস্পষ্ট। পাঠকের মনোযোগ ধরে রাখার ব্যাপারে তিনি পুরোপুরি সফল। জীবনের নানা ঘাত-প্রতিঘাত, চড়াই-উৎরাই আর টানাপোড়েনের চিত্রগুলো অসাধারণ মুন্সিয়ানায় ফুটিয়ে তুলেছেন! সমাজের বিভিন্ন ছোটখাট অসঙ্গতিও উঠে এসেছে তাঁর অসাধারণ লেখনিতে। তিনি নিজস্ব স্বকীয়তাকে উদ্ভাসিত করে ভাবনার গভীরতায় ডুবে গিয়ে প্রতিটি গল্প সযত্নে দাঁড় করিয়েছেন! মানবিক গুণাবলীর ব্যাপারে তাঁর উপলব্ধিও অসাধারণ! এ ব্যাপারটাকে তিনি প্রায় সব স্থানেই সর্বোচ্চ প্রাধান্য দিয়েছেন।
বইয়ের প্রায় প্রতিটি গল্প মূলত নারীদেরকে ঘিরে আবর্তিত হয়েছে। বইটি একবার পড়া শুরু করলে পুরো শেষ না করা পর্যন্ত মনোসংযোগ কিছুতেই বাধাগ্রস্ত হবে না; অমোঘ আকর্ষণে শেষ পর্যন্ত বেঁধে রাখবে পাঠককে। পড়া শেষ হওয়ার পরও গল্পগুলোর অন্তর্নিহিত আবেদন, জীবনের নানা অক্ষমতা আর অপূর্ণতার সহজসরল চিত্রায়ন এবং সর্বোপরি ছোটখাট পূর্ণতা আর তৃপ্তিকর অভিজ্ঞতাগুলো অনেকদিন ধরে পাঠককে বিমোহিত করে রাখবে। গল্পগুলোতে আমাদের নিজেদেরই জীবনের নানা প্রতিচ্ছবি উঠে এসেছে। তিনি যেমন নারীদের জীবনের বিভিন্ন সময়কে শক্তিশালী লেখনির মাধ্যমে প্রকাশ করেছেন তেমনি তিনি প্রেম-ভালোবাসাকেও সযত্নে পরিচর্যার চেষ্টা করেছেন। জীবনের এদিকটাকে মোটেও পাশ কাটিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করেননি; বরং প্রেম আর ভালোবাসাকে বিভিন্ন রূপ আর আঙ্গিকে তুলে ধরেছেন!
সেফটিপিন গল্পগ্রন্থের প্রথম ছোটগল্প। এ নামেই বইটির নামকরণ করা হয়েছে। সমাজের সুযোগসন্ধানী পুরুষ নামক দানবের লোলুপ কলুষতা থেকে একটি কিশোরীর আত্মরক্ষার খুবই কার্যকরী অস্ত্র হিসেবে সেফটিপিন ব্যবহার করার ধারণা এককথায় খুবই চমকপ্রদ! তেমনি দ্বিতীয় গল্পটিতেও মৌনতা নামের আরেকজন মেয়ের ঘুণেধরা সমাজের হিংস্র থাবা থেকে আত্মরক্ষার অধিকারের বিষয়ে লেখিকা খুবই হৃদয়গ্রাহী বর্ণনা দিয়েছেন!
বাঁশ গল্পটি পাঠককে অস্ত্বিত্ব ধরে ঝাঁকি দিয়ে যাবে। পাঠক ধাক্কা খেয়ে অনেকক্ষণ নিজেকে ভাবনার জগতে হারিয়ে ফেলবেন; নিজের ভেতরের অক্ষমতায় লজ্জিত হয়ে নিজেকে শাণিয়ে নিতে অন্যরকম শক্তির অস্ত্বিত্ব অনুভব করবেন!
চোখ গল্পটিতে সমাজের চরম দুর্নীতিগ্রস্ত একটি শ্রেণির লোকদের ব্যাপারে খুবই শক্তিশালী মেসেজ দেয়া হয়েছে। আমাদের সমাজে প্রতিনিয়ত যেসব দুর্নীতি আর অবক্ষয়ের বিস্তার ঘটে চলেছে চোখ গল্পটি তার জাজ্জ্বল্যমান প্রমাণ।
দূরত্বের শেষ প্রহরে বইটির সর্বশেষ গল্প। এক কিশোরীর প্রথম প্রেমের প্রস্ফূটিত পাঁপড়ি অকালেই ঝরে যাওয়া আর প্রেমিকের সকরুণ পরিণতির এক মর্মন্তুদ আখ্যান! পাঠককে জোর করে এক অভাবনীয় ভাবনার জগতে প্রবিষ্ট করবে।
এমনিভাবে প্রতিটি গল্প শেষে পাঠক গল্পের পরিধির একেবারে ভেতরে ঢুকে গিয়ে প্রত্যেক ঘটনার সাথে বারংবার নিজেকে মূল চরিত্র হিসেবে আবিষ্কার করবেন! পাঠকের মনে হবে- আরে! এ যে আমার নিজের জীবনেরই গল্প!
লেখিকার আরও দুটি বই প্রকাশিত হয়েছে। একটি কাব্যগ্রন্থ আর একটি উপন্যাস। সে হিসেবে লেখিকাকে একেবারে নবীন বলা যাবে না। তাই তাঁর গল্পগ্রন্থ পড়তে গিয়ে পাঠককে আচমকা হোঁচট খেতে হবে না এ কথা নির্দ্বিধায় বলা যায়। তিনি লেখায় নিজস্ব লিখনশৈলীর যথোপযুক্ত প্রয়োগের প্রয়াস পেয়েছেন। তিনি পাঠককে টানতে পারবেন তাঁর নিজের ভাবনা আর বোধের সাথে; আর পাঠকও লেখিকার নিজস্ব জগতের সাথে একাত্ম হয়ে মোহাবিষ্ট হতে পারবেন- একজন পাঠক হিসেবে এ কথা বললে মোটেও অত্যুক্তি হবে না।
সবশেষে লেখিকার লেখার হাত আরও অনেক অনেক শক্তিশালী হোক এবং তাঁর সুন্দর ভবিষ্যত আরও সাফল্যমণ্ডিত হোক এই কামনা করে এখানেই সমাপ্তি টানলাম। সবাইকে ধন্যবাদ!
সর্বশেষ এডিট : ১৭ ই জুলাই, ২০১৮ বিকাল ৩:৪১