somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

গল্পঃ সময়ের আবর্তনে

২৮ শে এপ্রিল, ২০১৪ রাত ১১:১৪
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

ক্রমাগত ফোনের রিং এর শব্দে সাব্বিরের ঘুমটা ভেঙ্গে গেল।চোখ বন্ধ রেখেই সে ফোন রিসিভ করে।গ্রামের বাড়ি থেকে বাবা ফোন দিয়েছে।কথা শেষ করে,চোখ বন্ধ রেখে সে পাশ ফিরে জুলিকে জড়িয়ে ধরতে যায় কিন্ত হাতটা খালি বিছানাতে হাতড়ে বেড়ায় কিন্ত সে জুলিকে খুঁজ়ে পায় না।এবার তার ঘুমটা পুরোপুরি ভেঙ্গে যায়।সে তাকিয়ে দেখে বাথরুমের দরজা খোলা,কিচেন থেকেও কারো সাড়াশব্দ পাওয়া যাচ্ছেনা।হঠাতই সাব্বিরের মনে পড়ে যায় জুলি ফ্লাটে নেই।গত রাতে প্রায় দুইটার দিকে ঝগড়ার পর রাগ করে সে বাসা থেকে বের হয়ে গেছে।বলে গেছে আর ফিরে আসবে না।উফ! মেয়ে মানুষ আসলেই একটা ঝামেলা!যায় যাক গিয়ে,আমার কি?এই ভেবে সাব্বির আবার পাশ ফিরে শোয়।ভাবে আর একটু ঘুমিয়ে নেবে আরাম করে কিন্ত অনেকক্ষন চোখ বন্ধ করে শুয়ে থাকার পরও তার আর ঘুম আসেনা।প্রায় সাতটা বাজে।আরো অন্তত এক ঘন্টা আরাম করে ঘুমানো যেত।হটাত তার বাবার উপর রাগ উঠে যায়।কি দরকার এই সাত সকালে ফোন দেয়ার?বাবা সবসময় এমন অসময়ে ফোন দেয়।নিজেরা সেই অজ পাড়াগাঁয়ে কাকডাকা ভোরে ঘুম থেকে ওঠে বলে ভাবে সকলেই এমন ভোরে উঠবে।তাদের তো আর সকালে উঠে অফিস যেতে হয় না,রাত জেগে কাজ করতে হয় না কিন্ত তাই বলে কি বুঝবে না সাব্বির কত রকমের ঝামেলায় থাকে?



কিছুক্ষন অলসভাবে গড়াগড়ি করে সাব্বির উঠে পড়ে।মাথাটা হালকা ব্যাথা করছে।কফির পানি চাপিয়ে সে বাথরুম থেকে ফ্রেশ হয়ে নেয়।ফ্রিজ় থেকে গত রাতের বেঁচে যাওয়া পিজ্জার টুকরা বের করে একটা কামড় দিয়ে সে কফির কাপ নিয়ে সোফায় বসে।নিশাত চলে যাওয়ার পর বাসায় সে আর রান্নাবান্নার ঝামেলা খুব একটা করে না।সকালের নাস্তা আর দুপুরের লাঞ্চ অফিসেই সেরে ফেলে,রাতে কোনোদিন বাইরে খেয়ে আসে আবার যখন জুলি আসে তখন বাইরে থেকে খাবার আনিয়ে নেয়।ছুটির দিনে দুই একবার রান্না করার চেষ্টা করেছে তবে খুব বেশি সুবিধা করে উঠতে পারেনি বলে সে চেষ্টা বাদ দিয়েছে।বিয়ের প্রথম দিকে সে আর নিশাত মিলে মাঝে মাঝে রান্না করত।তখন অবশ্য ঝামেলা মনে হতনা কারন নিশাতই সব রেডি করে রাখত আর হাতে ধরে সব শিখিয়ে দিত।ভালই ছিল সময়টা সাব্বির মনে মনে ভাবে।কফির কাপে চুমুক দিয়ে সে রিমোট টিপে টিভি চালু করে।সে একের পর এক চ্যানেল বদলাতে থাকে কিন্ত দেখার মত কিছু খুঁজে পায়না।শেষে একটা চ্যানেলে খবর দেখার চেষ্টা করে।সেখানে খবর পাঠিকা বলে চলেছে,দুই সন্তানসহ বিষপানে আত্মহত্যা করেছে এক গৃহবধু।মৃতদের ছবি দেখানো শুরু করতেই সাব্বির চ্যানেল পালটে ফেলে।সেখানে দেখাচ্ছে এক অগ্নিদগ্ধ ধবংসস্তুপ থেকে আহত নিহত মানুষকে সরিয়ে নেয়া হচ্ছে,মানুষের আর্তনাদে চারিদিক ভারি হয়ে উঠেছে।কি ভয়ানক্ দৃশ্য! নিশ্চয় আবার কোনো পোশাক কারখানায় আগুন লেগেছে।সাব্বির বিরক্ত হয়ে টিভি অফ করে দেয়।সকালবেলা উঠে যদি মানুষ এমন সব দুঃসংবাদ শুনে দিন শুরু করে তাহলে তার দিন কিভাবে ভাল যাবে?


কফি শেষ করে সে ঝটপট গোসল সেরে নেয়।অফিসের জন্য রেডি হতে হতে তার চোখ যায় দেয়ালে ঝুলানো ক্যালেন্ডারের দিকে।আজ এপ্রিল মাসের আঠাশ তারিখ,দুইহাজার চৌদ্দ সাল।মাত্র পাঁচ বছর আগে সে ছিল ছাত্র,তখন তার কিছুই ছিল না কিন্ত এখন সে একটা মাল্টিন্যাশনাল কোম্পানির কর্মকর্তা।এখন তাই নিজস্ব ফ্লাট আছে,ব্যাংকে যথেষ্ট টাকা আছে সেই সাথে আছে সন্মান আর খ্যাতি।সাব্বির আয়নাতে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে নিজেকে দেখে।পাঁচবছর আগের সাব্বিরের ছাপ সে নিজের মাঝে খুঁজে পায় না।সময়ের সাথে সাথে সবকিছুই বদলায়।মানুষকেও তাই বদলাতে হয়।আর যারা বদলাতে পারেনা,তারা জীবনে বড়কিছু করতেও পারেনা।এই যে যেমন নিশাত সেই আগের মত স্বপ্ন বিলাসীই রয়ে গেছে।মাত্র দুবছর হলো বিয়ে হয়েছে এর মাঝেই তার একটা সন্তানের বায়না।একটা বাচ্চা কি মুখের কথা নাকি?একবার জন্ম দিয়ে ফেললে তো আর ফিরিয়ে দেয়া যাবে না।একটা বাচ্চার দায়ীত্ব নেয়া,তার সবকিছুর দিকে খেয়াল রাখা এইসব করতে গেলে তো নিজের জীবনটা ঠিক্মত উপভোগই করা যাবেনা।জীবনের সবকিছুই তখন একটা ভয়ানক শেকলে আঁটকে পড়বে।জীবন তো সবে শুরু হলো,পাঁচ সাত বছর জীবনটা উপভোগ কর তারপর নাহয় ওসব ঝামেলার কথা ভাবা যাবে।এসব কথা সাব্বির অনেক বুঝিয়েছে নিশাতকে কিন্ত তার সেই একই কথা এদিকে সাব্বিরও কোনো মতেই নিজের সিদ্ধান্ত থেকে সরে আসবে না।এসব নিয়েই দুজনের সম্পর্কের অবনতি শুরু হলো যার ফলশ্রুতিতে একদিন সে নিশাতের গায়ে হাত তুলে ফেলে।সেই যে নিশাত বাড়ি ছেড়ে বের হয়ে গেল তারপর থেকে আজ প্রায় ছয়মাস তারা আলাদা থাকছে।কাগজে কলমে ডিভোর্স হয়নি এখনও কিন্ত যেকোনোদিন সেটাও হয়ে যাবে।


বাসা থেকে বাইরে বের হতেই কটকটে রোদ দেখে সাব্বিরের মাথায় রক্ত চড়ে যায়।গাড়ি নিয়ে বের হয়ে কিছুদূর গিয়েই সে জ্যামে পড়্ল।জ্যামটা ছোটই ছিল কিন্ত কিভাবে যেন ছুটে না গিয়ে আরো বড় হতে লাগল।সকাল সাড়ে নয়টা মত বাজে কিন্ত এর মধ্যেই রাস্তাঘাট রোদে তেঁতে উঠেছে।গাড়ি মধ্যে বসে বসে সাব্বির ঘামতে থাকে।এসিটা গত সপ্তাহ থেকে কাজ করছেনা,ব্যাস্ততার কারনে সেও ঠিক করার সময় পাচ্ছে না।জ্যাম ছেড়ে যাওয়ার কোনো লক্ষনই নেই এদিকে সাব্বির গাড়ি্র ভেতরে অস্থির হয়ে ওঠে।আজ বসের সাথে মিটিং আছে লেট করে পৌঁছালে আর রক্ষা থাকবে না।সাব্বির মনে মনে বলতে থাকে,নরক নরক,নরকে বাস করছি আমি।অবশেষে যখন সে অফিসে গিয়ে পৌঁছাল ততক্ষনে প্রায় আধা ঘন্টা হয়েছে মিটিং শুরু হয়েছে।সে দিন রাত খেটে যে প্রেজেন্টেশন তৈরী করেছে সেটা মিটিং বোর্ডে প্রেজেন্ট করতে শুরু করেছে তার কলিগ সুজন। সে ঘরে ঢুক্তেই বস তার দিকে একটি অগ্নিদৃষ্টি বর্ষন করলেন।সাব্বির মনে মনে ভাবল আজ আমার সত্যিই খবর আছে।


প্রেজেন্টেশন শেষে সকলে যখন সুজনের প্রশংসা করতে লাগল তখন সাব্বিরের গা জ্বলছে রাগে।এই সবকিছুই তো তার প্রাপ্য ছিল সুজনের না।বিশেষ করে বস যেন সুজনকে বেশি বেশিই প্রাধান্য দিলেন আজকে অথচ তিনি জানেন এই প্রজেক্টের পেছনে সাব্বিরের চেয়ে বেশি কেও খাটেনি।মিটিং শেষে তার প্রতি বসে উদাসীনতা আর নির্লীপ্ততা দেখে সাব্বির বেশ ভয় পেয়ে গেল।তারচেয়ে বরং অপমান আর বকাবকি শুনলেই ভাল ছিল।এবারের প্রোমোশনটা হয়ত সুজনের ভাগ্যেই জুটতে যাচ্ছে যদিও এটা তার পাওয়ার কথা।আর কেনই বা সুজন পাবেনা?তারমত করে সাব্বির তো আর বউকে স্বচ্ছ শিফন শাড়ি পড়িয়ে নিয়ে অফিসের পার্টিতে আসেনা কিংবা বউকে সাথে নিয়ে বসের বাড়িতে বেড়াতে যায় না।সুজনের মত বউ বা কার ভাগ্যে জোটে,যে অমন হেসে হেসে বসের গায়ে গড়িয়ে পড়বে,ন্যকা ন্যাকা স্বরে কথা বলবে?

মিটিং থেকে বের হয়ে সাব্বির দেখে ৫টা কল এসেছে মোবাইলে।বড়আপা ফোন দিয়েছে।হঠাতই অপরাধবোধে ছেয়ে যায় সাব্বিরের মন,তার সাহস হয়না পালটা ফোন দেয়ার।এক্সিডেন্টের পর কয়েক সপ্তাহ ধরে বড় আপা হাসপাতালে রয়েছে।সাব্বির সেই যে প্রথম দিন গিয়েছে তারপরে আর তাকে দেখতে যায়নি।বড় আপা খুব মন খারাপ করেছে,তাকে ফোন করে ডেকেছে কিন্ত আজ যাই কাল যাই করে সাব্বিরের আর যাওয়া হয়নি।সে বুঝতে পারে খুব অন্যায় হয়ে গেছে না যাওয়াটা।অথচ এই বড় আপার কাছেই সে বলতে গেলে মানুষ হয়েছে।নিজের মাও ছোটবেলা্য তার এত খেয়াল রাখেনি যতটা বড় আপা রেখেছে।বাবাকে বলে এই শহরে তার পড়ালেখার ব্যবস্থাও বড় আপাই করেছে।ছাত্র জীবনে টাকা ফুরিয়ে গেলে একবার আপার বাসায় পৌঁছাতে পারলে আর চিন্তা থাকত না,নিজের জমানো টাকা থেকে হলেও তিনি তাকে টাকা দিতেন।সাব্বির ঠিক করে আজ সন্ধ্যায় যে করেই হোক সে বড় আপাকে দেখে আসবে।সে তখনি ফোন করে বন্ধুদের জানিয়ে দেয় আজ আর সে ক্লাবে যাচ্ছেনা।সিদ্ধান্তটা নিতে পেরে তার মনটা একটু ভাল হয়।সে নিজের রুমে গিয়ে ফাইলগুলোর হিসাব মেলাতে থাকে দ্রুততার সাথে।

দুপুরে ক্যান্টিনে গিয়ে নুডুলস আর জুসের অর্ডার দিয়ে সে জানালার ধারে একটা চেয়ারে বসে।হঠাত সে দেখে জুলি একটা ট্রে হাতে তার দিকে আসছে কিন্ত তাকে অবাক এবং হতাশ করে দিয়ে সে সাব্বিরের পেছনের টেবিলে গিয়ে বসে।বাপরে,রাগ দেখছি এখনো আছে।সমস্যা নেই দামী একটা গিফট দিলেই এই রাগ নিমেষের মধ্যে উধাও হয়ে যাবে,এই কথা ভেবে সাব্বির মনে মনে হাসে।খাওয়া শেষে কফির কাপ হাতে সাব্বির দেখে ক্যান্টিন প্রায় ফাঁকা কিন্ত জুলি এখনো বসে আছে।সাব্বির পায়ে পায়ে এগিয়ে জুলির টেবিলে বসে।টেবিলের উপর থাকা জুলির হাতটা ধরে একটা চাপ দিয়ে বলে,এখনো রাগ করে আছ?জবাবে সাব্বিরকে হতবাক করে দিয়ে জুলি উঠে দাঁড়ায় তারপর গটগট করে হেঁটে ক্যান্টিন ত্যাগ করে।এইবার সাব্বির ভীষন ক্ষুব্ধ হয়ে ওঠে।এই মেয়েগুলি পেয়েছে কি?যখন যা অসম্ভব আবদার করবে তাকে তাই রাখতে হবে?দুদিন মেলামেশা করেই বিয়ের দাবী?তাই কি কখনো হয়?সে কেন এমন একজনকে হুট করে বিয়ে করতে যাবে যে অফিসে সামান্য টাইপ করার কাজ করে?হতে পারে সে সুন্দরী কিন্ত দুদিনের সম্পর্কের জের ধরে নিশ্চয় বিয়ে করা যায়না্।সাব্বিরের মনেহয় এই মেয়েকে বেশি বেশ লাই দেয়াই তার ভুল হয়েছে।অফিসে ফ্লাটিং করত এই পর্যন্তই ঠিক ছিল কিন্ত তাকে বাড়িতে নেয়া মোটেও উচিত হয়নি।কিন্ত নিশাত চলে যাওয়ার পর বাসাটা খালি খালি লাগত তাই একদিন ঝোঁকের বসে তাকে বাড়িতে নিয়ে গিয়েছিল।এখন তো সব দোষ সাব্বিরের হবে কিন্ত এই মেয়েও তো শুরু থেকে নির্লজ্জের মত তার সাথে ঘেষাঘেষি করেছে,বলামাত্রই তার বাসায় যেতে রাজি হয়ে গিয়েছে।উফ!কি তেজটাই না দেখিয়ে গেল কিন্ত সাব্বির তাকে কত কিছুই না কিনে দিয়েছে,কত ভাল ভাল জায়গাতেই না ডিনার করিয়েছে।সাব্বির ভীষন অপমানিত বোধ করে এবং ঠিক করে এই মেয়েকে আর পাত্তা দেবে না।


তিক্ত মন নিয়ে সাব্বির অফিসের বাকি সময়টা কাটায়।অফিস শেষে কিছু ফল আর টুকটাক জিনিস কিনে নিয়ে সাব্বির বড়আপাকে দেখতে যায়।সাদা বেডে শোয়া বড়আপার চেহারা দেখে সাব্বির চমকে ওঠে।কেমন যেন মলিন আর নিস্প্রভ দেখাচ্ছে তার চেহারা।সাব্বিরকে দেখে তার চোখদুটি খুশিতে চিকচিক করে ওঠে।নিঃসন্তান এই নারী সাব্বিরকেই সন্তানের স্নেহ দিয়ে মানুষ করেছেন,সাব্বির তার চোখের মনি।বিছানার পাশে টুলে বসে সাব্বির আপার মাথায় হাত বুলিয়ে দেয়,সঙ্গে আনা খাবার খাইয়ে দেয় পরম মমতায়।কথা বলতে বলতে কখন যে রাত হয়ে যায় তা সাব্বিরের খেয়াল থাকেনা।হাসপাতাল থেকে বের হয়ে বাসায় ফেরার পথে সে রাতের খাবার খেয়ে নেয়।এত রাত হয়েছে তবুও রাস্তাঘাটে মানুষ আর গাড়ির কমতি নেই।গাড়ির শব্দ,প্যাঁ প্যোঁ হর্নের শব্দ,মানুষের শব্দ সবমিলিয়ে কেমন যেন অসহ্য একটা পরিবেশ।শুধু রাতের অন্ধকার শহরের কুতসিত চেহারাটা ঢেকে দিয়েছে আর নিওন আলো সাজিয়ে তুলেছে রাস্তাগুলো।সাব্বিরের কাছে শহরটা কেন যেন অসহ্য লাগতে থাকে।তবুও সে গাড়ির এসি ঠিক করার জন্য সেটাকে গ্যারেজে পৌঁছে দেয়।এরপর যখন সে বাড়ি ফিরতে চায় তখন সে কোনো বাহন পায় না।কোনোটাই যাবে না,ভাড়া বেশি দিলেও না।অগত্যা সে হেটেই ফিরতে থাকে।উঁচুনিচু রাস্তায় হোঁচট খেয়ে খেয়ে হাঁটার সময় ড্রেন থেকে উপচে পড়া নোংরা কাদায় তার পা জড়িয়ে যায়,যেখানে সেখানে স্তুপ করে রাখা আবর্জনার গন্ধে তার বমি এসে যায়।সাব্বিরের মন একটুখানি শান্তির জন্য আকুল হয় ওঠে।


বাসায় পৌঁছে সাব্বিরের কেমন যেন লাগতে থাকে।গোসল শেষ করে বিছানায় শুতেই তার মনে পড়ে আগামী কাল গ্রাম থেকে বাবা-মা আসতে চেয়েছে।সে বোঝেনা কেন তাদের এতদুর আসতে হবে যখন জেলা শহরেই ভাল চিকিতসা করা যায়।সাব্বির তো আর টাকা পয়সা কম দেয় না তাদের।ঝামেলাটুকু অন্যের ঘাড়ে দেয়ার জন্য সে ছোট আপাকে ফোন দেয়।ছোট আপা বাবামাকে নিজের দায়িত্বে রাখবে কথা দেয় কিন্ত সাব্বির যে কতবড় দায়িত্বজ্ঞানহীন কুলাঙ্গার সেটাও শুনিয়ে দিতে ছাড়েনা।সাব্বির বোনের কাছ থেকে এক নতুন তথ্য জানতে পারে।তার বড়আপার জামাই নাকি আপার অসুস্থতার অযুহাত দিয়ে আবার বিয়ে করার চিন্তা ভাবনা করছে।রাগে সাব্বিরের গা জ্বলতে থাকে।তার দোষেই আপা এখনো মা হতে পারলো না কিন্ত সে নিজের দোষ স্বীকার না করে আপার ঘাড়ে দোষ চাপিয়ে দিব্বি ঘুরে বেড়াচ্ছে ।আর এখন আপাকে দীর্ঘদিন বেড রেস্ট নিতে হবে এই অযুহাতে আবার বিয়ে করতে চাইছে।আপার মুখটা এই জন্যই বুঝি এত মলিন ছিল।সাব্বিরের মনটা তিতা হয়ে যায়।তার ভীষন কান্না পায়।ইচ্ছা হয় মমতাময়ী কারো কোলে মাথা রেখে কিছুক্ষন কাঁদতে।


হঠাত সাব্বিরের নিশাতের কথা ভীষন মনে পড়ে।সাব্বির কখনো নিশাতকে ফিরিয়ে আনার চেষ্টা করেনি কারন সাব্বির মনেকরে সবকিছুরই বিকল্প আছে।নিশাতের সাথে না মিললে অন্য কারো সাথে মত মিলবে।সাব্বির সামনে এগিয়ে যেতে চায়,অনেক উঁচুতে ঐ শিখর ছুঁতে চায় তাই সে নিশাতকে পিছু ডাকেনি। কারন সে পায়ে বেড়ী পরে থাকতে চায়নি।আজ প্রায় ছয় মাস পর সে নিশাতের নাম্বারে ফোন দেয়।ফোন ধরে গম্ভির কন্ঠে নিশাত জানায় সে ডিভোর্স পেপার সাইন করে পাঠিয়ে দিয়েছে।স্তম্ভিত সাব্বির কিছু বলে উঠার আগেই একটা পুরুষকন্ঠ ফোনে বলে ওঠে,দোস্ত আমি আর নিশাত বিয়ে করবো বলে ঠিক করেছি।তুই আর দেরী না করে ঝামেলাটা মিটিয়ে ফেল।সাব্বির চিনতে পারে এই কন্ঠের অধিকারিকে।তারই ছাত্র জীবনের বন্ধু মামুন,যে সাব্বিরকে অনেক বিশ্বাস করে তার হাতে চাকরির আবেদনপত্র জমা দিতে দিয়েছিল কিন্ত সাব্বির তারটা জমা না দিয়ে বরং নিজের চাকরিটা নিশ্চিত করেছিল।একদিন সে মামুনের চাকরি ছিনিয়ে নিয়েছে আজ মামুন তার বউ ছিনিয়ে নিল।কিন্ত সে ছিনিয়ে নিয়েছে এই দোষই বা কিভাবে দেবে?সে নিজেই তো নিশাতকে দূরে ঠেলে দিয়েছে।
সাব্বিরের ভেতরটা কেমন যেন জ্বলতে থাকে।তার বুকের ভেতরে কেমন খালি খালি লাগে। আজ কেন যেন তার মনে হতে থাকে জীবনটা তেমন সুখের কিছু নয়।অনেকগুলো সিগারেট পুড়িয়ে সে ক্লান্ত হয়ে একসময় ঘুমিয়ে পড়ে।তার সামনে অপেক্ষা করছে এমনি নিরস আরেকটা কিংবা কে জানে হয়ত অনেকগুলো দিন।



দুঃস্বপ্ন দেখে ঘুম ভেঙ্গে ধড়মড় করে উঠে বসল সে।এক ধরনের চাপা আতঙ্কে তার বুকটা ধড়ফড় করছে।গুহার প্রবেশমুখে চাপা দেয়া পাথরের ফাঁক দিয়ে কেমন একটা ফ্যাকাসে আভা দেখা যাচ্ছে।তারমানে বাইরে এখন সকাল হচ্ছে।সেই প্রথম ভোরের আলোয় সে আধো অন্ধকারে ঘুমন্ত সঙ্গিনির দিকে তাকায়।তাদের গত শীতে জন্মানো সন্তানটিকে বুকে জড়িয়ে সে গভির ঘুমে অচেতন।তারপাশে তাদের দুই কন্যা একেঅপরকে জড়িয়ে ধরে ঘুমাচ্ছে।গুহার আরো ভেতরের দিকে ঘুমিয়ে আছে তার বাবা মা।সে জানে গুহার শেষ মাথায় যেখানে গাঢ় অন্ধকার জমাট বেধে রয়েছে সেখান ঘুমিয়ে রয়েছে তার দুই সহদরা আর তাদের দুজনকে আঁকড়ে ধরে ঘুমিয়ে আছে প্রাচীনমানবের কিশোর ছেলে সন্তান।প্রাচীনমানবের তরুন ভাইটি দেয়ালের গায়ে বর্শার ফলা ঘষে ঘষে ধারাল করতে করতে সেখানেই ঘুমিয়ে গেছে।সকলের দিকে চোখ বুলিয়ে প্রাচীনমানব তার বুকের মধ্য সবার জন্য টনটনে ব্যাথার মত মমতা বোধ করে।


শক্তিশালী দুহাতে প্রবেশমুখের পাথর সরিয়ে সে বাইরে এসে একখন্ড পাথরের উপর বসে।অন্ধকার কেটে গিয়ে আকাশ হয়েছে ফ্যাকাসে সাদা বর্নের।গুহার সামনে জ্বলানো অগ্নিকুন্ডের আগুন নিভে গেছে তবে ধুসর ছাইয়ের নিচে তার কমলা আভা এখনো বোঝা যাচ্ছে।সামনের প্রান্তরে শক্ত মাটিতে মাথা তুলেছে নরম সবুজ ঘাস।গাসে ঢাকা প্রান্তর শেষে রয়েছে টলটলে স্বচ্ছ পানির লেক। এইত মাত্র ত্রিশ সূর্য আগেও সব কিছু সাদা বরফে ঢাকা ছিল।লেক আর প্রান্তর আলাদা করে চেনা যেত না কিন্ত এখন সেখানে আকাশের ছায়া পড়ে,বাতাসের দোলায় ছোট ছোট চঞ্চল ঢেউ জাগে।ঘাসের প্রান্তরে আর বনের আনাচেকানাচে এরই মাঝে উজ্জ্বল রঙের ফুল ফুটতে শুরু করেছে।গুহার চারপাশের লতানো গাছে পাপড়ি মেলেছে কমলা,লাল আর বেগুনি রঙের ফুল।মৃদু বাতাস তার অপূর্ব সৌরভ ভাসিয়ে নিয়ে আসছে তার নাকে।প্রাচীনমানুষ অবাক হয়ে ভাবে গত শীতের আগে ধ্বস নেমে তাদের পুরোনো আবাস ভেঙ্গে গেলে তারা প্রায় বিশ সুর্য হেটে এই নতুন আবাসের সন্ধান পেয়েছিল।তখন এই লেকের উপর দিয়ে হেটেই তারা এখানে এসেছিল কিন্ত এখন সেখানে তরল পানি যা একটা ছোট পাথরের টুকরাকেও ভাসিয়ে রাখতে পারেনা।লেকের ওপাড়ে পাহাড়ের পেছনে কমলা আভা জেগে উঠতে থাকে।প্রাচীনমানব জানে একটু পরেই পাহাড়ের গর্ভ থেকে জন্ম নেবে সূর্য।


হু হু বাতাসে ঘাসের প্রান্তর দুলতে থাকে,সে বাতাসে প্রাচীনমানবের লম্বা চুল উড়তে থাকে হঠাত তার মনে পড়ে যায় ভোররাতের দুঃস্বপ্নের কথা।প্রাচীনমানব প্রায়ই নানা ধরনের স্বপ্ন দেখে,স্বপ্নে বিচিত্র সব জিনিস দেখে কিন্ত এমন অদ্ভুত স্বপ্ন সে আগে কখনো দেখেনি।কি অদ্ভুত সেই জগত,কি বিচিত্র সেখানের মানুষগুলো!!!স্বপ্নের যুবকটি কত নিঃসঙ্গ!তার মনটা কেমন অনুভুতিহীন,কেমন মমতাহীন।প্রাচীনমানবের মনেহয় স্বপ্নে সে যেন যুবকটির জীবন অনুভব করে এসেছে। সেই জীবন্ত নিসঙ্গ অনুভুতির অনুভব হওয়ামাত্র সে আবার শিউরে ওঠে,যেমন শিউরে উঠেছিল সে স্বপ্ন দেখার সময়।স্বপ্নে দেখা পুরুষটির জন্য তার মনে মমতা জেগে ওঠে,তার জীবনের কথা মনে করে প্রাচীনমানবের করুনা হয়।


সে পাথরের উপর বসে বসে সূর্য ওঠা দেখতে থাকে।কাঁধে সঙ্গিনির হাতের স্পর্শ পেয়ে সে পেছন ফিরে তাকায়।তার সঙ্গিনি নতুন শিশুটিকে তার হাতে ধরিয়ে দেয়।প্রাচীনমানব তাকে কোলে নিয়ে একটু দোলা দিতেই সে খিলখিল করে হেসে ওঠে।তার হাসি দেখে বাবামা দুজনের মুখেও হাসি ফুটে ওঠে।প্রাচীনমানবের মাথা থেকে দুঃস্বপ্নের রেশ একেবারে কেটে যায়।সামনে পড়ে রয়েছে সোনালী দিন।আজ তারা সবাই মিলে খাবার সংগ্রহে যাবে।দক্ষিনের জঙ্গলে গতকাল তার বোনেরা সবুজ রঙের থোকা থোকা রসাল মিষ্টি ফল খুঁজে পেয়েছে।মেয়েদের নিয়ে তারা যাবে সেই ফল সংগ্রহে।তার নিজের পিতা বৃদ্ধ হয়েছে তাই সে তার কিশোর ছেলেটির সাথে লেকের ওপারে যাবে মাছ ধরতে।প্রাচীনমানব তার তরুন ভাইয়ের সাথে উত্তরের গহিন বনে যাবে বন্য হরিনের সন্ধানে। কেবল তার সঙ্গিনি আর বৃদ্ধা মা থাকবে গুহা পাহারা দেয়ার জন্য।প্রাচীনমানবের মনে অনেক খুশি।এবারের আবাস তাদের আগের সব আবাসের চেয়ে ভাল হয়েছে।এখন তাদের আর গত শীতের মত খাবারের কষ্টও করতে হবেনা।


দিন বাড়ার সাথে সাথে সকলের সাথে সে শিকারে যাওয়ার জন্য প্রস্তত হয়।নিঃসঙ্গ যুবকের কথা নিছক দুঃস্বপ্নের মতই তার মন থেকে হারিয়ে যেতে থাকে।তেজী ভাইটির সাথে বনের মাঝে বন্য হরিনের পেছনে ছুটতে ছুটতে প্রাচীনমানবের মনে হতে থাকে আহা!জীবন কত সুন্দর!বেঁচে থাকা কত আনন্দের!
৩টি মন্তব্য ৩টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

গণতন্ত্র আর বাক-স্বাধীনতার আলাপসালাপ

লিখেছেন অনিকেত বৈরাগী তূর্য্য , ২৭ শে মার্চ, ২০২৪ বিকাল ৪:২৩


একাত্তর সালে আওয়ামী লীগের লোকজন আর হিন্দু ধর্মাবলম্বীরা ছিল পাকবাহিনীর প্রধান টার্গেট। যদিও সর্বস্তরের মানুষের ওপর নিপীড়ন অব্যাহত ছিল। গ্রামের পর গ্রাম জ্বালিয়ে দেওয়া হয়েছিল। মুক্তিযোদ্ধা আর তাদের পরিবারের... ...বাকিটুকু পড়ুন

কাফের কুফফারদের দেশে বাস করা হারাম।

লিখেছেন মঞ্জুর চৌধুরী, ২৭ শে মার্চ, ২০২৪ রাত ৯:১৩

ফেসবুকে বাঙালিদের মধ্যে ইদানিং নতুন এক ফতোয়া চালু হয়েছে, এবং তা হচ্ছে "দাওয়াতের নিয়্যত ছাড়া কাফের কুফফারদের দেশে বাস করা হারাম।"
সমস্যা হচ্ছে বাঙালি ফতোয়া শুনেই লাফাতে শুরু করে, এবং কোন... ...বাকিটুকু পড়ুন

স্বাধীনতা দিবসের অনুষ্ঠানে মুক্তিযোদ্ধাদের মুমিনী চেহারা ও পোশাক দেখে শান্তি পেলাম

লিখেছেন মহাজাগতিক চিন্তা, ২৭ শে মার্চ, ২০২৪ রাত ৯:৫৮



স্বাধীনতা দিবসের অনুষ্ঠানে স্টেজে উঠেছেন বত্রিশ মুক্তিযোদ্ধা তাঁদের চব্বিশ জনের দাঁড়ি, টুপি ও পাজামা-পাঞ্জাবী ছিলো। এমন দৃশ্য দেখে আত্মায় খুব শান্তি পেলাম। মনে হলো আমাদের মুক্তিযোদ্ধা আমাদের মুমিনদের... ...বাকিটুকু পড়ুন

দু'টো মানচিত্র এঁকে, দু'টো দেশের মাঝে বিঁধে আছে অনুভূতিগুলোর ব্যবচ্ছেদ

লিখেছেন মোহাম্মদ গোফরান, ২৮ শে মার্চ, ২০২৪ রাত ১২:৩৪


মিস ইউনিভার্স একটি আন্তর্জাতিক সুন্দরী প্রতিযোগিতার নাম। এই প্রতিযোগিতায় বিশ্বের বিভিন্ন দেশের সুন্দরীরা অংশগ্রহণ করলেও কখনোই সৌদি কোন নারী অংশ গ্রহন করেন নি। তবে এবার রেকর্ড ভঙ্গ করলেন সৌদি... ...বাকিটুকু পড়ুন

আমাদের দুই টাকার জ্ঞানী বনাম তিনশো মিলিয়নের জ্ঞানী!

লিখেছেন সাহাদাত উদরাজী, ২৮ শে মার্চ, ২০২৪ রাত ২:৫৯

বিশ্বের নামীদামী অমুসলিমদের মুসলিম হয়ে যাওয়াটা আমার কাছে তেমন কোন বিষয় মনে হত না বা বলা চলে এদের নিয়ে আমার কোন আগ্রহ ছিল না। কিন্তু আজ অষ্ট্রেলিয়ার বিখ্যাত ডিজাইনার মিঃ... ...বাকিটুকু পড়ুন

×