একটা সত্যি ঘটনা শেয়ার করি।
আমাদের দেশের বাড়িতে নতুন একটা রাস্তা তৈরি হয়েছে।তো সেই রাস্তা দেখতে অনেকেই আসে।সেখানে সকালে মানুষ হাটাহাটি করে, বিকেলে ঘুরতে যায়।তখন রাস্তাটি কেবল চালু হয়েছে,এক ভোরে আটচল্লিশ বছর বয়স্ক এক নারী প্রতিদিনের মত মর্নিং ওয়াকে গিয়েছেন।কোনো কারনে রাস্তায় তখন তিনি একাই ছিলেন।ফাঁকা রাস্তায় চলমান একটি ট্রাক হঠাৎ তার পাশে থেমে যায়।দুই তিনটি লোক নেমে দ্রুত হাত পা ধরে তাকে ট্রাকে তুলে নেয়ার চেষ্টা করে।তিনি প্রাণপণে বাধা দিতে চান এবং চিৎকার করতে থাকেন।বাইপাস রাস্তা।চারিদিকে ফাঁকা মাঠ।গ্রামের বাড়িঘর অনেক দূরে দূরে।কে বাঁচাবে তাকে?আল্লাহ সহায় ছিলেন তাই অত ভোরে দুই কি তিনজন কৃষক তাদের ফসলের ক্ষেত তদারকি করতে গিয়েছিলেন।তারা চিৎকার শুনে ঘটনা দেখতে পেয়ে কাস্তে কোদাল হাতে ছুটে আসেন।লোকগুলো মহিলাকে প্রায় ট্রাকে তুলেই ফেলেছিল তবে কৃষকরা চলে আসায় তাকে ফেলে তারা পালিয়ে যায়!একথা বলা বাহুল্য যে নারীটিকে তারা দেবীর আসনে বসিয়ে পূজা করার ইচ্ছায় তুলে নিয়ে যাচ্ছিল না।
এখন আসুন ভদ্রমহিলার চরিত্র ব্যবচ্ছেদ করি।বয়স তো আগেই বলেছি আটচল্লিশ থেকে পঞ্চাশের মধ্যে হবে।তিনি বোরকা পড়ে মাথায় ওড়না পেঁচিয়ে হাটতে বের হন।এত ভোরে হাটতে আসার কারন- ডায়াবেটিস।
একাকি আসার কারন - বাসায় সাথে আসার মত কেউ নেই।
নির্জন জায়গায় আসার কারন- রাস্তাটি নির্জন থাকেনা।তার গ্রাম তো বটেই আসেপাশের গ্রামের অনেক বয়স্ক নারী পুরুষ ভোর বেলা সেখানে হাটতে আসে।আর এই প্র্যাক্টিস নতুন নয়।রাস্তা চালু হওয়ারও অনেক আগে থেকে এটা চলে আসছে
সেদিন দূর্ভাগ্যবশত তিনি একা পড়ে গিয়েছিলেন!
এতখানি বয়েসে নিজ এলাকায় বা আশেপাশে প্রকাশ্যে ধর্ষণ বা ধর্ষণ চেষ্টার কথা শুনিনি।তার মানে কি আমার এলাকা খুব ভাল?তা নয়।এলাকা দেশের আর সব এলাকার মতই ভালমন্দে মেশানো। রাতের আঁধারে,গোপনে কোথায় কি অত্যাচার অনাচার হয়ে যাচ্ছে তার খবর পাওয়া তো সম্ভব নয় যদি তা বাইরে না আসে।তাই ঘটনাটি নতুন আর চাঞ্চল্যকর। মায়ের মুখে কথাটি শুনে ধাক্কার মত লাগলো। মায়ের মুখের দিকে আরও ভাল করে তাকিয়ে দেখলাম।
মধ্যবয়স পেরিয়ে পৌঢ়ত্বের দরজায় দাঁড়ানো আমার মা হয়ত সেই ভদ্রমহিলার চেয়ে কয়েক বছরের বড় হবেন।ধাক্কা লাগার বড় কারন মহিলাটি আমার স্কুল জীবনের বন্ধুর মা।তাদের বাসায় গিয়ে কয়েক বার উনার হাতে বানানো পিঠা খেয়েছি।
ইশ! এই ঘটনাতে না জানি তিনি কত আঘাত পেয়েছেন।আঘাতের চেয়ে বেশি পেয়েছেন লজ্জা আর অপমান।গ্রামের মানুষ, পরিবার বা তার ছেলে কেউ কি তার পাশে দাঁড়িয়েছে?কে জানে!সাধারণত
কেউ দাঁড়ায় না।বেশিরভাগই ভুক্তভোগীকে দায়ী করে।ছেলে বিয়ে দিয়েছেন আগেই।এধরণের ঘটনা জানাজানি হলে ছেলের শ্বশুরবাড়িতেও মুখ দেখানো কষ্টকর।চুড়ান্ত বিপদ থেকে হয়ত তিনি বেঁচেছেন কিন্ত সামাজিক লজ্জা আর অপমান থেকে বোধহয় বাঁচতে পারেন নি।
নারীর প্রতি যৌন নিপীড়ন আর ধর্ষণের ক্ষেত্রে সমাজের এই এক আজব নিয়ম।খুন করলে লোকে খুনির দোষ দেয় কিন্ত ধর্ষণ করলে দেয় ধর্ষিতার দোষ।দারুণ সুবিচার!
আগে স্ত্রী, কন্যা বা বোনকে নিয়ে দুশ্চিন্তা করতে হতো।এখন দুশ্চিন্তা করতে হয় আমাদের নিজের মা কে নিয়েও!একদিনে তো সমাজটা এত পচে যায়নি।পচে যাওয়ার জন্য নানারকম উপাদান সবত্র ছড়িয়ে আছে।উত্তেজক ঔষধ, ড্রাগস, মদ,পর্নোগ্রাফি কোন জিনিসটার সহজলভ্যতা নেই এদেশে?
কেউ কেউ সাম্প্রতিক ঘটনাগুলোকে Pavlov এর Dog and the bell experiment এর ফলাফলের সাথে তুলনা করেছেন।এক্সপেরিমেন্ট এর লিংক নিচে দিয়ে দিচ্ছি।
লিংক এখানে
যদি বিষয়টির মধ্যে সত্যতা থেকে থাকে তাহলে সমস্যা দুইটি। এক -নারীর পোশাককে অপরাধের জন্য দায়ী করার কালচার বন্ধ হবে না।দুই - নারী ব্যাতিত সমাজ কল্পনা করা যেহেতু সম্ভব নয় সেহেতু এটা মেনে নিতে হবে যে নারীর প্রতি যৌন নির্যাতন এবং ধর্ষণ চলতে থাকবে।এরা আজ রাস্তা থেকে মেয়ে তুলে নেয়ার সাহস করছে কাল ঘরে ঢুকে তুলে নিয়ে যাবে।
একটা জিনিসের পার্থক্য আমাদের সবার বোঝা দরকার আর সেটা হচ্ছে অনাচার এবং অপরাধের মধ্যে পার্থক্য। দেশ কাল পাত্র আর ধর্মীয় বিশ্বাস ভেদে এক ক্ষেত্রে যা কালচার অন্যক্ষেত্রে তা অনাচার।তবে অপরাধ সবক্ষেত্রেই অপরাধ।
অন্য বিষয় নাহয় বাদ দিলাম প্রেমের বিষয়ে এদেশে অনেক ট্যাবু রয়েছে।আমাদের দাদু-নানুর যৌবনকালীন সময়ে প্রেমের নামও হয়ত নেয়া যেতনা কিন্ত বাবা মায়ের সময়ে প্রেমের বিয়ে অনেক হয়েছে।আর আমাদের সময়ে প্রেম ও অতিঘনিষ্ঠতা খুব কমন বিষয়।বিয়ে ছাড়া একসাথে থাকার ঘটনাও দেখা যায় অনেকসময়।আমাদের সন্তানদের সময় এদেশে হয়ত লিভ টুগেদার হয়ে যাবে কমন।বয়ফ্রেন্ড বা গার্লফ্রেন্ড নিয়ে এসে বাড়িতেই রাত্রিযাপনের ব্যাপারটাও হয়ত চালু হবে পুরোপুরি। এ তো গেল এদেশের কথা।ইউরোপ আমেরিকা সহ এশিয়ার অনেক দেশেই এমন কালচার চলে আসছে অনেক আগে থেকেই।সেসব জায়গাতে যার যার চয়েস বা অধিকারকে অনেক মূল্য দেয়া হয়।
আমাদের কাছে ব্যাপার গুলো খারাপ লাগুক বা ভাল লাগুক সময়ের পরিবর্তন আটকানো যাবে না।একটি মেয়ে যদি বয়ফ্রেন্ডের সাথে নিজ ইচ্ছায় সময় কাটায় তবে সেটি তার ব্যাপার।যদি বয়ফ্রেন্ড তাকে জোর করে বা বাধ্য করে তবে সেটি ধর্ষণ এবং ধর্ষণ একটি অপরাধ।এখানে প্রাপ্তবয়স্ক মানুষের ইচ্ছা বা মতামতের গুরুত্ব অনেক।অপ্রাপ্তবয়স্ক হলে যেভাবেই তা হোক সেটা ধর্ষণ বলে গন্য হবে।
ভেবে দেখুন আপনার ছোট্ট মেয়েটিকে হয়ত কোনোভাবে ভুলিয়ে কাছের কেউ যৌন নিপীড়ন করছে। বেশি ছোট বলে সে হয়ত বুঝতেও পারছে না তার সাথে কি ঘটছে।কিশোরী একটি মেয়েকে প্রেম বা বিয়ের কথা বলে ভুলিয়ে ভালিয়ে তার সুযোগ নেয়াটাও তাই ধর্ষণ। সেখানে মেয়েটির সম্মতি যতই থাক। একজন নাবালিকা নিজের ভালমন্দ বুঝবে না এটাই স্বাভাবিক তাই দায়টা সাবালক পুরুষের উপরে এসে পড়ে।
মানুষের মোরালিটি নষ্ট হলে সমাজে অনাচার বৃদ্ধি পায়।অবৈধ সম্পর্ক, পরকিয়া,একইসাথে একাধিক প্রেম,নগ্নতা,অশ্লীলতা , নেশা, জুয়া,প্রতারণা এইসব বাজে বিষয়ের প্র্যাক্টিস চলতে থাকে।তবে ধর্ষণের মত ঘটনা মহামারী রুপ নিচে আরও বড় কিছু দরকার হয় আর সেটা হচ্ছে আইনের অনুশাসন না থাকা এবং অপরাধী বিনা বিচারে ছাড়া পেয়ে যাওয়া। মেয়েদের দেখলেই কিছু পুরুষের Pavlov's experiment এর কুকুরের মত লালা ঝড়তে থাকে।তাদের ভেতরে কুবাসনা জেগে ওঠে।পর্ণগ্রাফিতে সুঠাম নগ্ন নারীদেহ দেখতে দেখতে রিকশাওয়ালার ও বাসনা জাগে তার ধরাছোঁয়ার বাইরে থাকা ভদ্রলোকের স্কুলে যাওয়া ফুটফুটে কিশোরীকে ছুঁয়ে দেখার।
কিন্ত ইচ্ছা করলেই হবে?ভয় নেই?ভয় অবশ্যই আছে।
কিন্ত যখন অনেকগুলো ধর্ষনের ঘটনা অমীমাংশিত রয়ে যায় তখন এই রিকশাচালকও একদিন তার ভয়কে জয় করে ঘৃণ্য অপরাধটি ঘটিয়ে ফেলে।দেখাদেখি ঘটনাগুলো বাড়তে থাকে।একটা বাজে কন্সেপ্ট তৈরি হয়ে গেলে তা জোর করে না থামানো পর্যন্ত থামেনা।ভারতে বাসে নির্ভয়া ধর্ষণকান্ড ঘটেছে একবার,আর সেই ঘটনার দেখাদেখি এদেশে অনুরূপ ঘটনা কত ঘটেছে তা বলে শেষ করা যাবেনা।
ভাবতে অবাক লাগে আইনশৃঙ্খলার কতটা অবনতি হলে কুবাসনা চরিতার্থ করতে কু জায়গায় যাওয়ার সহজ পথের চেয়েও চলতি পথে যেকোনো নারীকে ট্রাকে উঠিয়ে নেয়া সহজ বলে মনে হয়।এসব নরপশুদের কথা বাদ দিয়ে যদি সেসব লোকের কথায় আসি যারা ধর্ষণের খবরের নিচে ধর্ষণ সমর্থন করে মন্তব্য করেন।আবার অনেকে মন্তব্য মুখে প্রকাশ না করলেও মনে মনে পুষতে থাকেন।এই লোকগুলোর সমস্যাটা অনেক গভীরে প্রোথিত। এদের সমস্যাটা মানসিকতার, নারীর প্রতি নিচু দৃষ্টিভঙ্গির।
এদের কাছে মনে হয় নারীকে কাপড়ে আবৃত করে ঘরে বন্দী রাখলেই সব সমস্যার সমাধান।এরা মনে রাখতে চায়না মর্গে তরুনী নারীর লাশও নিগৃহীত হয়,ধর্ষণের জন্য কবর থেকে লাশ তোলার নজিরও আছে। ঘরের চার দেয়ালের মাঝে কাছের মানুষের লালসার দ্বারা নারীদের নির্যাতিত হওয়ার ঘটনা এত বেশি রয়েছে যে বলে শেষ করা যাবে না।
মূল সমস্যা হচ্ছে নারীদের এরা আলাদা মানুষ বা আলাদা সত্তা বলে মানতে চায়না।শিক্ষালয়ে,কর্মক্ষেত্রে বা সমাজে নারীর ভূমিকা না থাকলে তার শুধু একটা ভূমিকাই থাকে তা হলো জন্মদান ও মনোরঞ্জন।তারা মনে করে এটাই হওয়া উচিত নারীদের একমাত্র কাজ।তাদের মতে নারী হবে কৃতদাসের মত।তার বুদ্ধি অর্থ বা ক্ষমতা থাকবে না।এর ব্যতিক্রম দেখলেই এধরনের মানুষ ক্ষেপে ওঠে।কটু মন্তব্য করে ধর্ষণের মত অপরাধকে সমর্থন করে।
আমাদের দেশে এইসব নোংরা ধারণা পাকাপোক্ত করার কাজে সাহায্য করে বেশিরভাগ ধর্মীয় শিক্ষক।তাদের প্রজ্ঞা নারীর নির্লজ্জতা এবং নারীর পর্দার আসেপাশেই ঘুরপাক খায়।এসব কথা বলে বলে পুরুষদের তারা অবচেতনে খেপিয়ে রাখে।অথচ তারা যদি পুরুষের সঠিক কর্তব্য,সংযত আচরণ এবং মদ,জুয়া,নেশা পর্ণগ্রাফি,ইভটিজিং, অযাচার ও ধর্ষণের কুফল সম্পর্কে শিক্ষা দিতেন তবে সমাজটা এত সহজে পচে যেত না।নৈতিকতা শিক্ষার একটা বড় অংশ ধর্মীয় শিক্ষক তথা হুজুর বা ইমামদের কাছ থেকে আসতে পারে।কিন্ত তাদের বেশিরভাগই নারীকে শায়েস্তা করার উপায় শেখাতেই ব্যস্ত থাকে।অথচ ধর্মে কোথাও বলা নেই বেপর্দা নারীকে ধর্ষণ করা জায়েজ।পুরুষের এধরণের চিন্তা পরিবর্তন না হলে কোনো আইনই নিপীড়ন রোধ করতে পারবে না।সেই সাথে খুবই জরুরী জিনিস হচ্ছে পারিবারিক অনুশাসন। সাধারনত অতি আদরের আর অতি অনাদরের ছেলে সন্তানগুলো অপরাধের দিকে পা বাড়ায়।পরিবারের সঠিক গাইডলাইন নিয়ে বড় হওয়া কেউ এধরনের অপরাধ করে ফেলার সাহস করে না।
তাই ধর্ষণরোধে পরিবর্তন আনতে হবে মানসিকতায় ও নারীর প্রতি দৃষ্টিভঙ্গিতে।ছেলে সন্তানগুলোকে নারীর প্রভু নয় বরং বন্ধু ও সহযোগী হিসাবে বড় করতে হবে।এই জঘন্য অপরাধের যথাযথ সাজাও নিশ্চিত করতে হবে। Pavlov's experiment এর সাথে আমার দ্বিমত এখানেই যে আমরা কুকুর নই বরং মানুষ।মানুষের বিবেকটুকুকে হারিয়ে যেতে দেয়া যাবে না কোনোভাবেই।
ছবি- ইন্টারনেট থেকে নেয়া
সর্বশেষ এডিট : ১৬ ই অক্টোবর, ২০২০ সন্ধ্যা ৭:৫১