১১ ফেব্রুয়ারী, ২০২২,
রাত ১১ঃ০০ টা।
দূর থেকে ভেসে আসা বাঁশীর সুরে কেমন যেন মোহাবিষ্ট লাগছে। কি যেন একটা চেনা সুর বাজছে লোকটার বাঁশী তে। কিন্তু কিছুতেই ধরতে পারছি না। অথচ এই মূহুর্তে ওই বাঁশীর সুর ছাড়া আর কিছুই যেন নেই। চেনা, অথচ ধরতে না পারা সুরটা ভেসে যাচ্ছে দূর থেকে বহুদূরে। দূরের কোনো পাহাড়ে ধাক্কা খেয়ে ফিরে আসতে আসতেই লোক টা আবার নতুন সুর ছুড়ে দিচ্ছে শূন্যে।
দুধারে চা বাগান ঘেরা একটা ছোট্ট বাংলোয় আজ সন্ধ্যায় উঠেছি। এলাকা টা অপরিচিত নয়। কিন্তু এই জায়গাটায় আগে কখনো আসি নি। শহর বা রিসোর্ট এলাকা থেকে অনেক টা দূরে। রাতের নির্জনতা এখানে ভয়ঙ্কর। ঝিঝি পোকার ডাক, মাঝে মাঝে কুকুরের ঘেউ ঘেউ আওয়াজ আবার কখনো দূর থেকে ভেসে আসছে শেয়ালের হুক্কাহুয়া। বাংলোর একদম গা ঘেষে চায়ের বাগান। পেছনের বারান্দায় বসলে অন্ধকারে কালো কাপড়ে ঢাকা যে অদ্ভুত বস্তু গুলো মনে হচ্ছে তা আসলে এক একটা ঝোপালো চায়ের গাছ। দূরে মন্দিরের ঘন্টাধ্বনি শোনা যাচ্ছে। ঢং ঢং করে কেন যে এত রাতে ঘন্টা বাজছে কে জানে!
এই জায়গাটার একটা অদ্ভুত সোদা গন্ধ আছে, আছে একটা মাটির টান। আজ আমরা দুজন আর বাংলোর কেয়ারটেকার ছাড়া আর কেউ নেই এখানে। আর আছে এনাদের কয়েক টা পোষা কুকুর। আমাদের প্রথম বার দেখে খুব ডাকাডাকি করেছে বটে, কিন্তু এখন বেশ সামনের উঠোনে বসে লেজ নাড়ছে।
এটাকে ঠিক বাংলো না বলে ভ্যাকেশন হোম বলাই ভালো। কারণ টিপিক্যাল বাংলো বা রিসোর্ট এর মতো এটা না। একটা দু কামরার ঘর আর একটা ডর্মেটরি সাথে একটা কিচেন। সামনে বেশ খানিক টা খোলা জায়গা। তার পাশে একটু খানি জায়গা খালি রেখে একটা ছোট পুকুর। আর দুপাশে দিগন্তজোড়া বিস্তীর্ণ চা বাগান। অন্য যেকোন গাছের বাগান থেকে চা বাগান ব্যাপার টা আমার কাছে ভালো লাগার মূল কারণ প্রতিটা গাছ খুব যত্ন করে একই রকম সাইজে ছেটে কেটে রাখা হয়। কেন যেন মনে হয় সেনাবাহিনীর ক্যাডেট রা প্যারেড শেষে সারিবদ্ধভাবে দাঁড়িয়ে আছে।
এখানে শীতের প্রকোপ বেশ ভালোই। মোজা, জুতা, হুডি পরে ও পার পাওয়া যাচ্ছে না। অথচ অবাক হয়ে একটু আগেই খেয়াল করলাম তাপমাত্রা ১৭ ডিগ্রী সেলসিয়াস এবং সেটার ফিল ১৬। এ রকম টেম্পারেচারে এত ঠান্ডা ফিল হওয়া খানিক টা অবাক করার মতো বিষয়ই বটে।
এখানে আসার পরেই খেয়াল করলাম ছোট বেলার সেই শীতের সকালের মতো কথা বলতে গেলেই মুখ দিয়ে ধোয়ার মতো বাষ্প বের হচ্ছে। ছোট বেলায় শীত কাল এলেই রাস্তায় খড়কুটো দিয়ে জ্বালানো আগুনের পাশে বসে কথা বলার সময় মুখ দিয়ে এমন ধোঁয়া বের হতো। খেজুরের তাজা রস নামিয়ে নিয়ে ওই আগুনের পাশে করা অস্থায়ী চুলায় চলতো গুড় বানানোর কাজ। স্কুল ছুটির দিন হলে বেশ অনেক টা সময় বসে কাটিয়ে দিতাম আর মুখ দিয়ে একটু পর পর বাষ্প গুলো শূন্যে ভাসাতাম। আজ মুখ দিয়ে এই ধোঁয়া বের হওয়ার ব্যাপার টা আমাদের দুজনকেই বেশ নস্টালজিক করে তুলেছে।
লোকটা এখন ও একটানা বাঁশী বাজিয়েই যাচ্ছে। বাংলোর সব লাইট নিভিয়ে দেওয়া হয়েছে। কেয়ারটেকার খেয়েদেয়ে লেপ মুড়ি দিয়ে ঝাপ দিয়েছেন নিদ্রাদেবীর কোলে। আমি একা বারান্দায় একটা চেয়ারে বসে আছি। সামনের খোলা জায়গাটায় বারান্দার ঠিক নীচে বসে কুকুর গুলো কেমন একটা কৌতুহলী চোখে আমাকে দেখছে আর লেজ নাড়ছে সাথে মুখ দিয়ে একটা অদ্ভুত শব্দ করছে, যেটা রাগ বা অবাক হওয়ার নয় বরং আনুগত্যের শব্দ। অন্ধকারে ওর চোখ দুটো জ্বলজ্বল করছে। কিন্তু আমার চোখ কাছের দৃষ্টি ছাপিয়ে পাড়ি জমিয়েছে দূরের চা বাগানের চা গাছের সুন্দর করে ছাটা ঝোপ গুলোর দিকে। আর মন মজেছে বাঁশীর সুরে।
আমার জায়গায় বুদ্ধদেব গুহ থাকলে হয়তো একটা গোটা উপন্যাসের গোড়া পত্তন করে ফেলতেন, কিন্তু যেহেতু এখানে এখন আমি আছি তাই আপাতত বরং ওনার লেখা "শালডুংরী" তেই ডুবে যাই।
সর্বশেষ এডিট : ১৩ ই জুন, ২০২৪ বিকাল ৫:৩১