ভালবাসা সার্বজনীন; সত্যিকারের প্রেম জাতি, ধর্ম, বর্ণের উরধে। অন্ধ ভালবাসা সবসময় সোজা পথে চলে না; প্রায়ই ধর্মের বানানো গন্ডি ভেঙে ছুটে চলে শুধু মাত্র ‘মানুষ’ পরিচয়ে।
সাধারনতঃ কিশোর বয়সেই অধিকাংশ ভাই বোনেরা এরকম সম্পর্কে জড়িয়ে পরে। এরকমই একটা গল্প শুনাবো আপনাদেরঃ
সবসময় বাঁধন ভাঙার একটা প্রবৃত্তি কাজ করতো আমার মনে। সবাই যে ভাবে করবে, আমি সেভাবে করব না; সবাই যে পথে হাটবে আমি সেই পথে হাঁটবো না। অল্প বিস্তর জানাশোনা হয়েছে যেসব বান্ধবীদের সাথে, তারা প্রথম দিকে একটা ড্যাম কেয়ার ভাব দেখালেও, একটা পর্যায়ে বিয়ের জন্য প্রেসার ক্রিয়েট করে। ভালো লাগতো না বিষয় টা। এ জাতীয় ইগো’র কারনে সিরিয়াসলি কারো সাথে সম্পর্কে জড়িয়ে পরা হয়ে উঠেনি; যেটা হয়েছে সেটাকে এক কথায় বলা যায় ‘ধরি মাছ, না ছুই পানি’!
একবার ঢাকা আসার পথে আরিচা থেকে ৩০ কিলমিটার দূরে বাস নষ্ট হয়ে যায়। বৃষ্টি পরছিল মুষলধারে। সন্ধ্যা নামছে। আরিচা থেকে কয়েকটি মাইক্রোবাস এসেছিল, যাত্রীদের সংখ্যার তুলনাম অপ্রতুল। সবাই পড়ি মড়ি করে উঠতে লাগলো। আমার তাড়াহুড়া নেই। ছোট্ট একটা ট্র্যাভেল ব্যাগ নিয়ে খুপরি দোকানে সিগারেট ধরালাম। যাত্রীরা সবাই চলে গেছে মাইক্রোবাসে করে। হটাৎ দেখি বাসের পাশে বিশাল একটা লাগেজ নিয়ে একটা মেয়ে দাড়িয়ে দাড়িয়ে ভিজছে। লাগেজ টা এতো বড় আর ভারী যে তার পক্ষে বয়ে নিয়ে কোন নিরাপদ দুরত্তে যাওয়া সম্ভব না তার পক্ষে। একে বৃষ্টি, তার উপরে নস্ট বাসটার হেল্পার- ড্রাইভার এর টিজ এ মেয়েটা যারপরনাই অপ্রস্তুত। সিগারেট শেষ করে রাস্তায় দাঁড়ালাম। অন্য কিছু না পেয়ে একটা রিকসা ঠিক করলাম আরিচা পর্যন্ত। মেয়েটার কাছে এসে আড়ষ্ট হয়ে জিজ্ঞেস করলাম আমার সাথে যেতে ইচ্ছুক কিনা। একটু আড়ষ্ট ভাব থাকলেও পারিপার্শ্বিক অবস্থা বিবেচনা করে রাজি হয়ে গেল। একদম অপরিচিত একটা মেয়ে, ধাউস সাইজের এক ব্যাগ। তুমুল বৃষ্টির মধ্যে পাশাপাশি বসে ৩০ কিলো পথ মনে হচ্ছিল ৩০০ কিলোমিটার! আরিচায় পৌছতে রাত ৯ টা বেজে গেল। লঞ্চে এপার এসে বাসে উঠলাম। বলা বাহুল্য ভদ্রতার খাতিরে ব্যাগটা আমাকেই নিতে হয়েছিল এ পথটুকু। গাবতলি এসে যখন নামি তখন রাত ১ টা বেজে ৩০ মিনিট। বিদায় নিলাম। মেয়েটা শুকিয়ে কাঠ। অবশেষে তাকে উত্তরা নামিয়ে দিয়ে আমি লালবাগ আসি সি এন জি তে। নামার আগে কন্ট্রাক্ট নম্বর চাইলো। তখন আমার সেলফোন ছিল না। বাসার টি এন্ড টি নম্বর দিলাম। বাসায় এসে কান ধরলাম; জীবনে যেচে পরে কাউকে আর সাহায্য করতে যাবো না...
হয়তো ভুলেই যেতাম যদি মেয়েটা মাস ছয়েক পরে ফোন না দিত! বাসায় দাওয়াত দিল। ওদের বাসায় গিয়ে শুনলাম ও খুলনা ভার্সিটিতে পরে। এবার বাসায় এসেই প্রথমে আমাকে ফোন দিয়েছে; দেখলাম ঐদিনের ঘটনা ওদের বাসার সবার মুখস্থ একপ্রকার। ওদের বাসার সবাই আমার ভক্ত হয়ে গেল।
শুরু হল আমাদের বন্ধুত্ব। ওর সাথে রাসেল নামে একটা ছেলের রিলেসন ছিল। দেখতে কালো বলে রাসেলের ফ্যামিলি রাজি হয়নি দেখে রাসেল সরে গিয়েছে। প্রায়ই দুঃখ করতো। আস্তে আস্তে আমাদের ডিপেন্ডেন্সি বাড়তে লাগলো। অবস্থা এমন যে একটা চকলেট কিনতে গেলেও ফোন করে জিজ্ঞেস করতো কোনটা কিনবে! কখন যে বন্ধুত্ব প্রণয়ে রুপ নিলো দুজনের কেউ ই টের পেলাম না!
ধীরে ধীরে আমরা আমাদের ভবিষ্যৎ নিয়ে চিন্তা করা শুরু করলাম। আমি না পারবো আমার ধর্মকে ছোট করতে, না পারবো ওর ধর্মকে ছোট করে ওর মনে কস্ট দিতে। ঠিক হল বিয়ের পর যে যার ধর্ম পালন করবো। ও পুরোপুরি ঢাকা চলে এল পড়াশুনা শেষ করে। আমি এক উকিল বন্ধুর সাথে পরামর্শ করতে গেলাম ধর্ম আলাদা হলে কিভাবে বিয়ে করা যায় এ নিয়ে। বন্ধুটি বলল যে কোন এক জনকে ধর্ম চেঞ্জ করতে হবে। যেহেতু এটা বাংলাদেশ, মনে হয় হিন্দু কেই কনভারট হতে হবে! আকাশ থেকে পরলাম। ধর্ম চেঞ্জ করবো, আমার এতো দিনের বিশ্বাস, আচার, শিক্ষা... মা’র মুখটা মনে পড়ল। সম্ভব না... মনে মনে বললাম। আমার ভালবাসার চেয়ে আমার ধর্ম আর ফ্যামিলি অনেক বড়।
ওকে কিছুই বললাম না। অদ্ভুত ব্যাপার ছিল আমরা একজন অন্য জনকে খুব সুন্দর ভাবে পড়তে পারতাম। বুঝতে পেরেছিল ও সম্ভবতঃ
প্রথম আলোতে একটা আর্টিকেল বের হয়েছিল। দুজনার ধর্ম ভিন্ন হলে, কোন ধর্মই ত্যাগ না করে বিয়ে করা যায় ‘ব্রাহ্ম সমাজ’ মতে। ঐ কাগজটা ছিরে মানিব্যাগে রেখেছিলাম সযত্নে।পুজোর ছুটিতে গ্রামের বাড়ি যাবো। ধরে বসলো, আমার সাথে যাবে। গ্রামের পরিবেশ, কালচার কি মনে করবে ভেবে না করলাম; শুনল না। অবাক ব্যাপার বাড়ির সবাই ওকে খুব আপন করে নিলো! এমনকি বাবু একটা লাল রঙের একটা কাতানের শাড়িও কিনে দিল ওকে। গ্রামে কানাঘুসা চলতে লাগলো আমি মুসলমান বিয়ে করে নিয়ে এসেছি। সবাই আমাদের বাড়ি আসতে লাগলো। বিশ্রী একটা ব্যাপার। আমার অসম্ভব বুদ্ধিমতী ঠাকুরমা সব সামাল দিলেন।
ছোটবোনের সাথে মেলায় যাবে টাকা চাইলো। হাসতে হাসতে জিজ্জেস করলাম কি এমন কিনবে, এখানে তো কিছুই পাওয়া যায় না। হাসতে হাসতেই রিপ্লাই দিলো ‘এখানে যা পাওয়া যায়, তা আর কোথাও পাওয়া যায় না’...
ওর পোস্টিং হল মংলায়। প্রতিবার যাবার সময় আমি দিয়ে আসতাম, আসার সময় ও আমি গিয়ে নিয়ে আসতাম। আমার প্রচুর কষ্ট হত, কিন্তু কখনো অনুভব করিনি। এতো দূরে না এসে মাঝে মাঝে ও একাই আমাদের বাড়িতে গিয়ে ছুটি কাটাতো।
একবার মংলা থেকে আসার সময় রাত হয়ে গেল। ও বলল আজ বাসায় গিয়ে কাজ নেই; পূর্ণিমা রাত চল আজকে তোমার বাসায় থাকি। সারারাত ছাঁদে বসে চাঁদ দেখবো। সাত পাচ না ভেবে রাজি হয়ে গেলাম। আমি ওদের বাসায় থাকি, ও আমাদের বাড়িতে থাকে অসুবিধা কি! ও ই তো আমার পৃথিবী; প্রদীপের নিচের অন্ধকার দেখার মতো বয়স আর মানসিকতা কোনটাই আমার ছিল না। লালবাগ মেসে থাকতাম অনেকদিন ধরে। অল্প বিস্তর রাজনীতি করতাম। খেলাধুলায় ও নাম ছিল মোটামুটি। ব্যান্ড এ গাইতাম, লিড বাজাতাম। যথেষ্ট দাপট এবং পরিচিতি ছিল এলাকায়। ওকে নিয়ে মেসে আসলাম। এর আগেও ও অনেকবার এসেছে এখানে। সবাই ওকে চেনে। ওকে রেখে বাইরে গেলাম খাবার আনতে।
এসে দেখি বাসার সামনে জটলা। এলাকার ১৫/২০ টা পোলাপানের সাথে মাসুম, সুমন আর সোয়েব কথা বলছে। কি ব্যাপার, এগিয়ে গেলাম।
:‘কি রে কি করস তোরা?’
আমার এতো দিনের পরিচিত বন্ধু সুমন আর সয়েবের চেহারা কেমন যেন অপরিচিত লাগছে। ওরা কোন কথা বলল না। ক্রুব্ধ দৃষ্টিতে তাকাল আমার দিকে। টুকটাক ঝামেলা আমিও করছি আগে, এ দৃষ্টি আমার অপরিচিত না। কিন্তু আমার সাথে... ??
মাসুম এক পাশে ডাক দিয়ে নিলো। বলল, ‘মেসে দোলা কে আনসস, পোলাপাইন জানছে, ঝামেলা হইতে পারে তুই ওদের কয়টা টাকা দিয়া দে।’
‘মানে কি? আমারে খোট ধরছে... তাও তোরা, যাদের সাথে আমি এতো দিন চলছি, নিজে না খাইয়া খাওয়াইছি... বাইন... ’
‘দোস্ত করার কিছু নাই; বুজতাসস না ক্যন তুই হিন্দু... মাইয়াডা মুসলিম। একটা হিন্দু মাইয়া আনলে তোরে কইতে পারতোনা কিছু... কাজী রে আইনা ঝামেলা করতে পারে ওরা... বুঝতাসস না ...? ’
চোখের সামনে পৃথিবীটা ঘুরতে লাগলো। এই প্রথম একজন হিন্দু হিসেবে বাংলাদেশে নিজের আসল অবস্থান বুঝতে পারলাম। এও বুঝতে পারলাম, এই মুহুরতে, এই অবস্থায়, আমি এলাকার কোন বড় ভাইর সাহায্য পাবো না... মারাত্মক একটা ক্যাচাল এ জড়িয়ে পরতে যাচ্ছি। কিন্তু একই সাথে প্রচন্ড জেদ চাপলো মাথায়। ওদেরকে আমি একটা পয়সাও দেবো না, আমার যা হয় হোক। প্রব্লেম, দোলার সেফটি...
বাসায় ঢুকলাম। বাইরের গেঞ্জাম শুনে ও যা বোঝার বুঝে নিয়েছে। চোখের জল লুকোতে চেস্থা করে বলল আমাকে বাসায় দিয়ে এসো। কিন্তু এতো রাতে ওর বাসায় এভাবে যাওয়া যাবে না। গীতা দি তখন লালবাগে থাকতো; দিদিকে ফোন দিলাম, সংক্ষেপে বললাম এবং তখনই ওকে দিদির বাসায় রেখে আসলাম। যখন ওকে নিয়ে গেট থেকে বেরুচ্ছি লাম। পিছন থেকে শুনলাম, ‘মাম্মা, মালাউন হইয়া আমগো মাইয়া লইয়া ফুর্তি করবা, খরচ করবা না তাতো হবে না... ’
আর কাহিনী বাড়াবো না, সব বলতে গেলে বড় সাইজের একটা উপন্যাস হয়ে যাবে। যত দিন যেতে লাগলো আমি আস্তে আস্তে প্রাক্টিক্যালি চিন্তা করতে শুরু করলাম। বাবুর সরকারী চাকরী, আমার ছোট বোন, ওর ছোট দুই ভাই, ইমিডিয়েট ছোট বোন, ওর ডিবি বড় চাচা, এস পি ছোট চাচা... ... সব কিছু চিন্তা করে সেপারেসন এর ডিসিশন নিলাম। ওকে বললাম। উত্তরে ও কিছুই বলল না। শুধু ফ্যাল ফ্যাল করে তাকিয়ে থাকল। ডিসিশন হল আমরা ইনিসিয়ালি এক মাস কোন রকম যোগাযোগ রাখব না। দেখি সহ্য করতে পারি কি না। না পারলে তখন নতুন করে ভেবে দেখা যাবে।
খবর পেতাম ওর জন্য প্রস্তাব আসছে একের পর এক। যেদিন এক মাস সময় শেষ হল ঐদিন সকালে ওর ছোট বোন ফোন দিয়ে বলল দাদা, ‘আমাদের ফ্যামিলি টা ধ্বংস করে দিও না...’’গুনে রেখেছিলাম। দোলা ঐদিন ৪৬ বার ফোন দিয়েছিল। আমি আমার ভালবাসা ধ্বংস করেছি তবু ওদের ফ্যামিলি ধ্বংস হতে দেই নি।
পরিশিষ্টঃ দোলার বিবাহিত জীবন সুখের হয়নি। জামাই কিচ্ছু করে না; বউয়ের টাকায় চলে আর কিছু দিন পর পর যৌতুকের জন্য প্রেসার দেয়। অধিকাংশ বাঙালি মেয়েদের মতো বিয়ের প্রথম দিনেই স্বামীর কাছে কনফেসন করেছিল ও; আমাদের সব কথা বলে দিয়েছিল। শুনেছিলাম বেশ কয়েকবার মেরেছেও ওকে। ওর জামাই আমাকে অনেক বার ফোন করে গালাগালি ও করেছে; প্রতিটা বাক্যে অবধারিত ভাবে ‘মালাউন’ শব্দটা থাকতো। দাঁতে দাঁত কামড়ে সহ্য করেছি। ওর সুখের কথা ভেবে একটা গালির ও রিপ্লাই দেই নি।
শেষ যেবার কথা হয়েছে বলেছিল ওদের একসাথে থাকা সম্ভব না, সেপারেসন এর জন্য চিন্তা করছে দু পক্ষ। আমি বলেছি সেপারেশন না করে একটা বাচ্চা নিতে।দোলার একটা ছেলে বাচ্চা হয়েছে; আমার নামের প্রথম অক্ষর দিয়ে ওর ছেলের নাম রেখেছে। কোন কিছুতে কষ্ট পেলে এখনও বাথরুম আটকে শাঁখা সিঁদুর পড়ে হাপুস নয়নে কাঁদে ( যেগুলো পুজোর সময় আমাদের বাড়িতে মেলায় কিনেছিল)।
আবার সবকিছু ধুয়ে মুছে বাইরে এসে বোরকা পরে অফিসে যায়...
আর আমি এখনও মাঝে মাঝে প্রথম আলোর ‘ব্রাহ্ম সমাজের’ সেই মলিন টুকরোটা পুরনো ডায়রি থেকে বের করে রোদে দেই, মলিন আর জীর্ণ ভালবাসাটুকু ফুরিয়ে যেতে দেই না...
আমি সব সময় ভালবাসার পক্ষে, তা সে যে ফর্মেরই হোক না কেন।
‘ভালবাসা তোমাদের ঘরে বৃষ্টি হয়ে নেমে আসুক’
[ লেখাটা উত্তম পুরুষে লেখা। আমার নিজের কাহিনী ভাবা ঠিক হবে না। এই পোস্ট থেকে কেউ কোন মেসেজ নিতে পারলে টাইপিং কষ্টটুকু সার্থক হবে।]