somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

মহামারী নিয়ন্ত্রণ : ইতিহাসের অভিজ্ঞতা

১১ ই জুন, ২০২০ রাত ২:৪৭
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

প্রায় তিন বছর হল ইতিহাস, তথ্য ও তর্ক নামে একটি ফেসবুক গ্রুপ (Click This Link) শুধু ইতিহাসের চর্চায় নিজেদের নিয়োজিত রেখেছে। সেখানে নানা দেশের নানা পর্বের নানা বিষয়ের ইতিহাস নিয়ে লেখকেরা লেখেন। শুধু লেখকদের গুণে নয়, পাঠকদের মন্তব্যেও সেখানে ইতিহাসচর্চা উজ্বল হয়ে থাকে।
আমাদের এই সময়কালটা করোনা আতঙ্কের এবং তা থেকে মুক্তির আকাঙ্ক্ষার। পৃথিবীর অধিকাংশ দেশের অধিকাংশ মানুষ এই নিয়ে চর্চা করছে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরে এত বড় বিপর্যয় আর আসে নি আমাদের জীবনে।
এই সঙ্কটের সময়ে অন্যান্য নানা আলোচনার মতো ইতিহাসচর্চার জগতেও এই ভাইরাস সংক্রমণ ব্যাপক প্রভাব ফেলেছে। ইতিহাসে কীভাবে কবে কোন কোন মারাত্মক ভাইরাস, ব্যাকটেরিয়া ঘটিত আক্রমণ হয়েছে, কত মানুষ সেখানে মারা গেছেন, কীভাবে তার হাত থেকে মুক্তি পাওয়া গেছে - সেই সব চর্চা স্বাভাবিকভাবেই বেড়েছে।
ইতিহাসচর্চায় নিবেদিত এই গ্রুপেও এই নিয়ে লেখালেখি চলছে। আমরা সেখানেই পড়লাম একটি অনবদ্য লেখা। ডাক্তার জয়ন্ত দাস মহাশয়ের কলমে গুটিবসন্ত রোগের চিকিৎসার ইতিহাস। টীকাকরণ কি, কবে থেকে তার ইতিহাস শুরু হল, তার প্রাক ইতিহাস কি - চিকিৎসাবিজ্ঞানের এইসব প্রশ্নগুলিকে সহজ সরল আকর্ষণীয় ভাষায় সেখানে বর্ণনা করা হয়েছে।
লেখাটি এগারোটি পর্বে ভেঙে ভেঙে লেখক লিখেছেন। লেখায় রয়েছে অনেক আকর্ষণীয় ছবি ও তথ্যসূত্র।
সেইসব বাদ দিয়ে মূল লেখাটি আমরা এখানে দিয়ে দিলাম। তবে ছবি, তথ্যসূত্র এখানে থাকল না।
---------------------------------------------------------

গুটিবসন্ত মহামারি নির্মূল ও ভারত
ড. জয়ন্ত দাস

কথারম্ভ

আমরা এখন একটা সারা পৃথিবীব্যাপী মহামারির মধ্যে দিয়ে যাচ্ছি। মহামারীর কারণ একটি ভাইরাস। রোগটার নাম কভিড-১৯, আর ভাইরাসটির নাম নভেল করোনা ভাইরাস, বা সার্স-কভ-২। এই ভাইরাসের উপযুক্ত ওষুধ নেই, টিকা নেই, তাই আমাদের আতঙ্কের সীমাও নেই। এতদিনে আমরা জেনে গেছি অতীতে এরকম মহামারি হয়েছিল।
• একশ বছর আগে স্প্যানিশ ফ্লুতে বিশ্বে ৫ থেকে ১০ কোটি মানুষ মারা গিয়েছিল; তখন তার কোনো ওষুধ বা টিকা ছিল না।
• ছ’শ বছরের বেশি আগে ইউরোপের অর্ধেকের বেশি মানুষ প্লেগে মারা গিয়েছিল।
• আর দেড়’শ বছর আগে ভারতে প্লেগে মারা গিয়েছিল প্রায় এক কোটি মানুষ—এরও কোনো টিকা বা ওষুধ তখন ছিল না।
• তবে ১৯৭০-এর আগে পর্যন্ত এতাবৎ ইতিহাসে সব থেকে বেশি মানুষ মেরেছে গুটিবসন্ত বা স্মলপক্স। বিংশ শতকে গুটিবসন্ত মারা গেছে ত্রিশ কোটি মানুষ, তার আগে এরোগে যে কত মরেছে তার লেখাজোকা নেই। অথচ এখন গুটিবসন্ত অতীতের ধূসর স্মৃতিমাত্র।

কী করে এমন হল? মনে রাখবেন, গুটিবসন্তের মতো কোভিড-১৯ হল একটি ভাইরাসঘটিত অসুখ যা শ্বাসের মধ্যে দিয়ে ছড়ায়।

আজ থেকে মাত্র ২২০ বছর আগে গুটিবসন্তের কোনো ওষুধ ছিল না (এখনও তেমন নেই), কোনো ‘টিকা’ ছিল না। মৃত্যুহার ছিল মোটামুটি ২৫% থেকে ৩০%। খেয়াল রাখবেন কোভিড-১৯ এর মৃত্যুহার সর্বত্রই ১০% এর নীচে। (অবশ্য গুটিবসন্তের দুটি ধরন ছিল, তার মৃদু ধরনটিতে মৃত্যুহার কম ছিল, সেটা কম হতো, তাই তাকে হিসেব থেকে বাদ দিচ্ছি।) বাচ্চাদের গুটিবসন্তে মৃত্যুহার ছিল ২৫%, এমনকি অনেক সময় ৫০%-এরও বেশি। আজ থেকে একশ বছর আগেও এদেশে পাঁচ-সাত বছর অন্তর গুটিবসন্তের তীব্র মহামারি হত। প্রবাদ ছিল, ‘শীতলাদেবী’-র একবার আগমন দেখেনি যে বাচ্চা, তাকে পরিবারের পুরো সদস্য হিসেবে ধরবে না, একটা বসন্ত মহামারি কাটালে তারপর শিশুর ভবিষ্যৎ ভাবা যেতে পারে। রোগী বেঁচে গেলেও মুখে কুৎসিত দাগ হয়ে যেত আর অন্ধ হত অনেকেই—পঞ্চাশ বছর আগেও এদেশে অন্ধত্বের একনম্বর কারণ ছিল গুটিবসন্ত। আর এখন আমরা করোনা নিয়ে আতঙ্কগ্রস্ত হয়েছি বটে, কিন্তু সেদিন সত্যিই মারি নিয়ে ঘর করা ছাড়া অন্য উপায় ছিল না, আর সেভাবেই মানুষের সভ্যতা এগিয়েছে।

এখন গুটিবসন্ত বিদায় নিয়েছে। পৃথিবীর ইতিহাসে এখনো পর্যন্ত একটিমাত্র অসুখকে আমরা চিরদিনের মত পৃথিবী থেকে বিদায় করতে পেরেছি। কোভিদ-১৯ এর মতো গুটিবসন্ত ছিল একটি ভাইরাসঘটিত অসুখ। আরেকটি রোগকেও আমরা পৃথিবী থেকে প্রায় দূর করে দিয়েছি, পোলিও। সেটাও ভাইরাসজনিত। পোলিও বা গুটিবসন্তর ভাইরাস মারার মতো কোনো কার্যকর ওষুধ নেই, কিন্তু এদের দূর করা গেছে।

কীভাবে গুটিবসন্ত দূর করা গেল? তা থেকে আজকে করোনা ভাইরাস দূর করার ব্যাপারে কোনো শিক্ষা নেওয়া যায় কি? কোয়ারান্টিন, লকডাউন আর আজ ক্লোরোকুইন, কাল এজিথ্রোমাইসিন, পরশু ফ্যামোটিডিন, তারপরের দিন হোমিওপ্যাথি বটিকা—এরকমভাবে গুজব ছাড়িয়ে কি কোনো মহৌষধ আবিষ্কার রোগ নির্মূল কোথাও কোনোদিন হয়েছে? বিজ্ঞান এগনোর সাথে সাথে ওষুধ ও টিকা আগের চাইতে ঢের তাড়াতাড়ি আবিষ্কার করা যাচ্ছে ঠিকই, কিন্তু তার সীমা কোথায়? আর পরাধীন দেশে সাহেবদের হাতের চিকিৎসা, স্বাস্থ্যব্যবস্থা—এর বাইরে দেশীয় কোনো উদ্যোগ কাজে লেগেছিল কি?

গুটিবসন্ত নির্মূল করার ইতিহাস দেখি। হয়তো ইতিহাসের কিছু শিক্ষা পাওয়া যেতে পারে। তবে কিনা, ইতিহাসের প্রথম শিক্ষা হল,অতীতের ঘটনা হুবহু একভাবে আরেকবার ঘটে না।

ইন্টারনেট ঘাঁটতে গিয়ে দেখলাম, ১৭৫৭ সালে এডোয়ার্ড জেনার নামে এক বালককে গুটিবসন্তের ‘টিকা’ দেওয়া হল।

সেকি কথা? এডোয়ার্ড জেনার নিজেই তো গুটিবসন্তের টিকার আবিষ্কর্তা! আর ১৭৫৭ সাল মানে পলাশির যুদ্ধের বছর, তখন জেনার নেহাত শিশু, টিকা আবিষ্কার হবে এর চল্লিশ বছর পরে। তাহলে? তাহলে কি জেনার জন্মানোর আগেই গুটিবসন্তের টিকা চালু ছিল? কিন্তু তা কী করে হয়? জেনারের টিকা থেকেই তো টিকাকরণের প্রথম শুরু। শুধু গুটিবসন্ত কেন, কোনো টিকাই ছিল না জেনারের টিকা আবিষ্কারের আগে। টিকার ধারণাই ছিল না, এমনই লেখে আমাদের ইতিহাস বইতে, ডাক্তারি বইতেও।জেনার হলেন টিকাকরণের জনক, Father of vaccinology।

তাহলে কী, সেটা পরে বুঝব। আপাতত আমরা চলি জেনারের সঙ্গে, জেনারের সময়ে। তখন ইউরোপ, এশিয়া, আফ্রিকা সর্বত্র গুটিবসন্ত এক ভয়াবহ রোগ, আর কলম্বাসের পর স্প্যানিশ লুটেরাদের কল্যাণে আদি আমেরিকানরা দলে দলে মারা পড়ছে এই রোগে। তবে তার দু’হাজার বছর আগেও মানুষ জানত যে এই রোগটা একবার হলে পুনরায় হবার সম্ভাবনা নেই বললেই চলে, তাই মহামারির সময় আগে রোগ হয়েছে শুধুমাত্র এমন কাউকেই রোগীর যত্নের জন্য ডাকা হত। এ থেকে ধারনা হল, আচ্ছা, কৃত্রিম উপায়ে কোনোভাবে রোগ ঘটিয়ে দিলে কেমন হয়? কৃত্রিম রোগ কি স্বাভাবিক রোগের মতই ভয়ানক হবে? আজ থেকে কয়েকশো বছর আগে ভারত, চীন বা মধ্যপ্রাচ্যে চিকিৎসকেরা নিশ্চয় এটা নিয়ে ভেবেছিলেন। কিন্তু তাঁরা ঠিক কী ভেবেছিলেন তা জানার কোনো উপায় আজ নেই। তবে নীরোগ মানুষের দেহে গুটিবসন্তের ‘রস’ প্রবেশ করিয়ে কম ভয়াবহ রোগ ঘটানো ও সেভাবে ভয়াবহ রোগের হাত থেকে বাঁচার পদ্ধতি চীন ও ভারতে অন্তত কয়েক শতাব্দী ধরে চালু ছিল।

প্রাচীন এশিয় পদ্ধতির গুটিবসন্ত টিকা ইউরোপ-আমেরিকায় পৌঁছেছিল, আর বালক জেনার-এর নিজের হাতে যে টিকা দেওয়া হয়েছিল, সেটা এই টিকা-ই বটে। তবে পরে আর টিকার পাশ্চাত্য ইতিহাসে এই প্রাচীন টিকা-র কপালে ‘স্বীকৃতির টিকা’ জোটেনি। ইউরোপ-আমেরিকায় এই পদ্ধতি পৌঁছানোর ইতিহাস আমরা জানি। কিন্তু চীন বা ভারতে এই টিকার ইতিহাস অনেকটাই লোককথা থেকে জানা গেছে, আর জানা গেছে ইউরোপীয়দের লেখা থেকে।

আমরা এখানে একে টিকাকরণ বলছি বটে, কিন্তু টিকার ইংরেজি হল ভ্যাক্সিন। ল্যাটিন ভাষায় vacca মানে গরু, গরুর দেহ থেকে প্রথম গুটিবসন্তের টিকা তৈরি হয়েছিল বলেই সেটার নাম vaccine। প্রথমে ভ্যাক্সিন মানে কেবল গুটিবসন্তের টিকা ছিল। পরে ঐ একই নীতিতে কাজ করা অন্য রোগের টিকাগুলোকে একই নামে, অর্থাৎ ভ্যাক্সিন বলে ডাকা হতে লাগল—যেমন পোলিও ভ্যাক্সিন—যদিও সেগুলো তৈরিতে গরুর কোনো ভূমিকা ছিল না। ভারতীয় ‘টিকা’ কথাটার আদি অর্থ বিশেষভাবে দাগ দেওয়া, যেমন রাজার কপালে রাজটিকা।
গুটিবসন্তের বিশ্বজয়ের কাহিনী
চিকিৎসাবিজ্ঞানের ঐতিহাসিকদের মতে, দশহাজার বছর আগে, কৃষি শুরু হবার সময় এই রোগ প্রথম জন্ম নেয়। মিশরে তিন হাজার বছরের পুরনো মমিতে এর চিহ্ন দেখা গেছে। ভারতবর্ষে এই রোগ অত্যন্ত পুরাতন বলে ভাবা হয়। সুশ্রুত সংহিতা বা চরক সংহিতায় ‘মসূরিকা’ নামে সম্ভবত এই রোগেরই উল্লেখ আছে, তবে এই সংহিতাদুটিতে এই রোগকে তেমন গুরুতর বলা হয়নি, তাই মসূরিকা সত্যিই গুটিবসন্ত কিনা সে নিয়ে সন্দেহ আছে। হয়তো ৫০০ সাধারণ পূর্বাব্দ নাগাদ (BCE), যখন ঐ সংহিতাদুটি সংকলিত হয়, তখন ভারতে গুটিবসন্ত তেমন বেশি ছিল না, বা কোনো কারণে তার আক্রমণ তেমন ভয়াবহ ছিল না। তাবে সাধারণাব্দ (CE) নবম শতকে সংকলিত ‘মাধবনিদান’ গ্রন্থে এই রোগের যে বিবরণ পাওয়া যায় তাতে মনে হয় সেসময় গুটিবসন্ত ভয়াবহ রূপ ধারণ করেছে, ও এদেশে একটি বড় ঘাতক রোগ হয়ে দাঁড়িয়েছে।
চীনদেশে এরোগ বহুদিনের, এবং ভারতের মতো চীনেও এর দেশীয় পদ্ধতিতে ‘টিকাকরণ’ চালু হয়েছিল—এই পদ্ধতি কিন্তু জেনার-এর আবিষ্কৃত পদ্ধতির চাইতে আলাদা। এশিয়া, আফ্রিকা ও ইউরোপের যেখানে যেখানে জনবসতি ছিল তার সর্বত্র এই রোগ বহু শতাব্দী ধরে ছিল। কিন্তু যতদিন আমেরিকা বাকি পৃথিবীর থেকে আলাদা হয়ে ছিল ততদিন অর্থাৎ কলম্বাসের আমেরিকা আগমনের আগে পর্যন্ত আমেরিকাতে এই রোগ আসেনি। এখন যেমন কোভিড-১৯ অতিমারি এক দেশ থেকে আরেক দেশে মানুষের মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়েছে, তখনও মানুষের মাধ্যম ছাড়া গুটিবসন্ত ছড়াতে পারত না। তাই ১৪৯২ সালে কলম্বাস আমেরিকায় আসার পরে স্প্যানিশ নাবিক ও সৈন্যদের হাত ধরে গুটিবসন্ত রোগ নতুন বিশ্ব, অর্থাৎ দক্ষিণ এবং উত্তর আমেরিকাতে ছড়িয়ে পডল।
আমেরিকা মহাদেশে এই রোগটি ছড়িয়ে পড়ার সময় একটা জিনিস লক্ষণীয় ছিল। স্প্যানিশ নাবিকরা সবাই আক্রান্ত হত না এবং আক্রান্ত হবার পরে অনেকেই সুস্থ হয়ে উঠত। কিন্তু আমেরিকার আদিম অধিবাসীদের শরীরে রোগের বীজাণু একবার শরীরে ঢুকে গেলে প্রায় প্রত্যেকেই রোগে আক্রান্ত হত এবং রোগের ভয়াবহতা বেশি হত, আর অধিকাংশই মারা পড়ত। কেন স্প্যানিশদের রোগ কম হত, আর আমেরিকান আদি অধিবাসীদের রোগ বেশি হত ও অধিক মারাত্মক হত? গুটিবসন্তের বীজাণু স্পেনে বহুদিন ছিল, ফলে অনেক নাবিক বা সৈন্যের এ-রোগ আগে হয়েছিল। তাতে শুধু সেই নাবিক বা যোদ্ধা গুটিবসন্ত থেকে বাঁচত তাই নয়, তার দলে থাকা অন্য মানুষের সংক্রমণের সম্ভাবনা কমে যেত—একে বলে হার্ড ইমিউনিটি। অন্যদিকে আমেরিকান আদি অধিবাসীগণ পুরুষাণুক্রমে এই বীজাণুর সংস্পর্শে আসেনি, ফলে তাদের কারো আগে রোগ হয় নি, প্রতিরোধ-ক্ষমতাও গড়ে ওঠেনি, হার্ড ইমিউনিটি-র প্রশ্নই ওঠেনা। আবার গুটিবসন্ত নিয়ে অভিজ্ঞতা ছিল বলে স্প্যানিশরা চিকিৎসার নামে রোগীর ক্ষতি করত না, কিন্তু আদি আমেরিকানরা রোগটি সম্পর্কে অপরিচিত থাকায় রোগ হলে ভুল চিকিৎসা করে এরা রোগীর ক্ষতি করত। স্প্যানিশদের সাধারণ স্বাস্থ্য ও খাবারদাবার মোটের ওপর ভাল ছিল, আর ঐসময়ে স্বভূমিচ্যুত আদি আমেরিকানরা অপুষ্টিতে ভুগত। এর ওপরে ছিল তাদের দাস বানানো ও ইচ্ছাকৃতভাবে তাদের মধ্যে গুটিবসন্ত ছড়ানো।
প্রসঙ্গত, কোভিড-১৯ অতিমারীর ক্ষেত্রে এই হার্ড ইমিউনিটি-র ধারণাটি প্রয়োগের কথা আসছে। বলা হচ্ছে, লকডাউন ইত্যাদি করে রোগের ছোঁয়া বাঁচিয়ে সাময়িক লাভ, লকডাউন খুললে ভাইরাস পুরোদমে ছড়াবে। অনেকে বলছেন, বয়স্করা যেহেতু কোভিডে আক্রান্ত হলে মৃত্যুর সম্ভাবনা বেশি, কমবয়সীদের মধ্যে এই রোগ হতে দেওয়া যেতে পারে, অবশ্য তাদের বয়স্ক মানুষের থেকে দূরে থাকতে হবে। কমবয়সীদের মধ্যে মূলত মৃদু রোগ হবে, মৃত্যু তেমন বেশি হবে না। এভাবে দেশের অন্তত ৬০% মানুষের একবার কোভিড রোগ হয়ে গেলে, বাকিরাও ‘হার্ড ইমিউনিটি’ (Herd immunity)-র সুবিধা পাবেন। ফলে এরপর সহজে রোগ হবে না, আর বড় মহামারি আটকানো যাবে।
যেহেতু আজ থেকে মাত্র দুশো কুড়ি বছর আগেও গুটিবসন্ত রোগের কোন উপযুক্ত চিকিৎসা ছিল না এবং টিকাও ছিলনা, তাই ভারতবর্ষে ইউরোপে বা পৃথিবীর সর্বত্রই এই রোগ মহামারি হিসেবে দেখা দিত, এবং তাকে নিয়ন্ত্রণ করার কোন উপায় জানা ছিল না। তবে মানুষ নিশ্চেষ্ট ছিল না। ভারত ও চীনদেশে গুটিবসন্তের ‘টিকা’ কমবেশি চালু ছিল। গুটিবসন্তের গুটির রস থেকে মালমসলা নিয়ে এই টিকা দেওয়া হত। আজ আমরা জানি, এর অর্থ হল গুটিবসন্তের ভাইরাস শরীরে প্রবেশ করানো। ফলে টিকা নেবার পরে দেহে গুটিবসন্তর লক্ষণ দেখা দিত, কিন্তু সাধারণত সেটা স্বাভাবিক গুটিবসন্তের চাইতে কম ভয়াবহ হত। টিকার ফলে গুটিবসন্ত হয়ে রোগী মারা যাবার ঘটনা অল্প হলেও অতি-বিরল ছিল না। টিকা বা ইমিউনাইজেসন-এর যে ইতিহাস আমরা পড়ি, তাতে এই ‘টিকা’ অস্বীকৃত। জেনার-এর কাউপক্স টিকা দিয়েই টিকা-র শুরু ধরা হয়, আর জেনারকে ফাদার অফ ভ্যাকসিনোলজি অর্থাৎ টিকাকরণের জনক বলা হয়। তাই জেনার নিয়ে কথা বলতে গেলে টিকা নিয়ে দু-চার কথা জানা দরকার।
টিকা কাকে বলে? বীজাণুঘটিত অসুখ থেকে বাঁচার জন্য আমাদের শরীরে, মূলত রক্তে, কিছু কোষ আছে। যখন কোনো বীজাণু, তা ব্যাকটেরিয়া-ছত্রাক-ভাইরাস যাই হোক, শরীরে ঢোকে, তখন এই দেহকোষগুলি বহিরাগত শত্রুকে মারার মতো রাসায়নিক তৈরি করে, মূলত অ্যান্টিবডি। প্রথমবার বীজাণু ঢুকলে তাকে শত্রু বলে চিনে ঠিকঠাক অ্যান্টিবডি তৈরি করতে সময় লাগে, কিন্তু শরীর সেই বীজাণুকে চিনে রাখে, যেন পুলিশের খাতায় নাম-ওঠা দাগি আসামি। ঐ একই বীজাণু পরে আবার শরীরে ঢুকলে খুব দ্রুত সুনির্দিষ্ট অ্যান্টিবডি তৈরি হয়। আমরা বলি শরীর ঐ বীজাণুর বিরুদ্ধে প্রতিরোধ ক্ষমতা অর্জন করেছে। এইজন্যই একবার গুটিবসন্ত হলে দ্বিতীয়বার তা হয় না।
টিকা এই সুযোগটাকে কাজে লাগায়। পুরনো পদ্ধতিতে টিকাকরণে গুটিবসন্তের বীজাণুই শরীরে ঢুকিয়ে দেওয়া হত, তাতে শরীরে প্রতিরোধ ক্ষমতা আসত। কিন্তু সেটা নিরাপদ ছিল না। টিকার গুটিবসন্তের বীজাণু থেকে গুটিবসন্ত হত, হয়ত তা কম মারাত্মক হত—তবে অল্প কিছু মানুষ স্রেফ টিকার জন্যই গুটিবসন্তে মারা যেতেন। জেনার যে টিকা আবিষ্কার করলেন তাতে ঐ একইভাবে সুস্থ মানুষের চামড়া ফুঁড়ে বীজাণু ঢুকিয়ে দেওয়া হত, তবে সেটা গো-বসন্তের বীজাণু। গো-বসন্ত আর গুটিবসন্ত এ-দুটো রোগের ভাইরাসের গঠন কাছাকাছি হওয়াতে মানুষের শরীর গো-বসন্ত ভাইরাসের বিরুদ্ধে যে অ্যান্টিবডি তৈরি করে সেটা গুটিবসন্তের ভাইরাসকেও মেরে ফেলে, ফলে রোগ হয় না। অবশ্য এটা খানিক আন্দাজি কথা, গো-বসন্তের বিরুদ্ধে গড়ে ওঠা শারীরিক প্রতিরোধ গুটিবসন্তকে আটকাবে কেন সে ব্যাখ্যা মেলা শক্ত—একে এক আকস্মিক সৌভাগ্যই বলতে হবে। গো-বসন্তের জীবন্ত ভাইরাস আমাদের শরীরে ঢুকিয়ে দিলেও তা তেমন রোগ সৃষ্টি করতে পারে না—প্রতিটি প্রাণীর শরীরে রোগ ঘটানো ভাইরাস সাধারণত আলাদা (পাদটিকা ১ দেখুন)। এই যে বীজাণু (বা তার অংশ) শরীরে ঢুকিয়ে শরীরকে দিয়ে তার প্রতিরোধ তৈরি করা, একে বলে সক্রিয় প্রতিরোধ টিকা। যেমন মুখে খাবার পোলিও টিকা—এতে থাকে জ্যান্ত পোলিও ভাইরাস, কিন্তু বিশেষ প্রক্রিয়ায় এই ভাইরাসের আক্রমণ করার ক্ষমতা কমিয়ে দেওয়া হয়। আবার পোলিও টিকার আরেকটা রকম আছে, তাতে মৃত পোলিও ভাইরাস ইঞ্জেকশন দেওয়া হয়। টিটেনাস ব্যাকটেরিয়া মেরে তার দেহাংশ দিয়ে টিটেনাস-এর টিকা বানানো হয়।
নিষ্ক্রিয় প্রতিরোধ টিকাতে সরাসরি অ্যান্টিবডি ব্যবহার করা হয়। যেমন জলাতঙ্কগ্রস্ত পশু তেমনভাবে কামড়ালে কেবল সাধারণ সক্রিয় প্রতিরোধ টিকা যথেষ্ট নয়, তার সঙ্গে জলাতঙ্ক-ভাইরাস মারার অ্যান্টিবডি ইঞ্জেকশন করে দিতে হয়। রোগ হবার আগেই দেওয়া হচ্ছে, এবং অ্যান্টিবডির মাধ্যমে কাজ করছে, তাই এটাও টিকা, কিন্তু নিষ্ক্রিয় প্রতিরোধ টিকা।
শেষ করার আগে বলে রাখি, গুটিবসন্তের ল্যাটিন নাম Variola (ভ্যারিওলা)। জেনার-এর টিকার আগে গুটিবসন্তের রস দিয়ে যে টিকাকরণের পদ্ধতি ছিল, তা ভারতে টিকা নামে পরিচিত হলেও, ইউরোপে ডাক্তারি পরিভাষায় তার নাম ছিল Variolation (ভ্যারিওলেশন), অর্থাৎ গুটিবসন্ত ঘটানো, Immunization (ইমিউনাইজেশন) বা অনাক্রম্যতা তৈরি নয়।
পরের পর্বে আমরা এডোয়ার্ড জেনার-এর অবদান নিয়ে আলোচনা করব। আমরা আরও দেখতে চাইব, ভারতে বা চীনে যে প্রাচীন পদ্ধতিতে টিকা দেওয়া হত, তা টিকা-র শর্ত পূরণ করেছিল কিনা।
পাদটিকা ১- কোভিড, সার্স, বার্ড ফ্লু, সোয়াইন ফ্লু এসব ভাইরাস পশুপাখি থেকে পরিবর্তিত অর্থাৎ মিউটেটেড হয়ে মানুষে এসে রোগ সৃষ্টি করছে। ফলে এক প্রাণীর রোগ তৈরি করা ভাইরাস অন্য প্রাণীতে রোগ করতেই পারে না, এমন নয়।

গোয়ালিনীর গর্ব আর জেনার-এর হাতে টিকার দাগ
ইংরেজ চিকিৎসক এডওয়ার্ড জেনার গুটিবসন্তের চিকিৎসা ও প্রতিরোধ নিয়ে বহুবছর ধরে ভাবছিলেন। তাঁর ছোটবেলায় এক গোয়ালিনীর মুখে শুনেছিলেন— “আমার গুটিবসন্তের ভয় নেই, কেননা আমার গো-বসন্ত (কাউপক্স) হয়ে গেছে।” এ-কথাটা যে ইংরেজ বা ইউরোপীয় ডাক্তাররা কেউ জানতেন না, তা কিন্তু নয়। অনেকেই জানতেন। কিন্তু ব্যাপারটা নিয়ে তাঁরা তেমন তলিয়ে ভাবেননি। কেন ভাবেননি সেটা আমরা পরে দেখব। তার আগে “টিকা আবিষ্কার” জিনিসটা কী, রবীন্দ্রনাথের ‘জুতা আবিষ্কার’-এর সঙ্গে তার কিছুমাত্র মিল আছে কিনা, সেটা একবার দেখি।
ফ্র্যান্সিস গ্যালটন-এর একটি বহুশ্রুত উদ্ধৃতি জেনার-এর আবিষ্কার প্রসঙ্গে বেশ জুতসই। উদ্ধৃতিটি হল, বিজ্ঞানে কোনো নতুন জিনিস প্রথমবার ভাবতে পেরেছেন বলেই তাঁকে সেই জিনিসটি আবিষ্কারের কৃতিত্ব দেওয়া হয় না। কৃতিত্ব তাঁরই যিনি বিশ্বের দরবারে আবিষ্কারটি সুপ্রতিষ্ঠিত করেছেন। ইংরাজিতে বললে, “In science credit goes to the man who convinces the world, not the man to whom the idea first occurs.”। কথাটা অন্যভাবে খুঁটিয়ে দেখলে বুঝব, ইংরেজ গোয়ালা-গোয়ালিনীদের ’বিশ্বে’ গো-বসন্ত হলে গুটিবসন্ত হয়না, এটা সুপ্রতিষ্ঠিত ছিল। অথচ তার কৃতিত্ব কেউ পায়নি। কোনটা বিজ্ঞান আর কাদের হাতে পড়লে সাধারণ জ্ঞান বিজ্ঞানের পর্যায়ভুক্ত হয়ে ওঠে, আপাতত আমরা সে প্রশ্নে ঢুকছি না। শুধু লক্ষ্য করব, গোয়ালাদের এই জ্ঞান কোনো ব্যক্তিগত আবিষ্কার ছিল না, ছিল গোষ্ঠিগত জ্ঞান। এই গোষ্ঠিগত জ্ঞান ছিল বলে গোয়ালারা গো-বসন্ত আছে এমন গরু হয়তো ইচ্ছে করেই ঘাঁটত যাতে নিজের শরীরে গো-বসন্ত হয়। এই জ্ঞান তখনও ওদেশের চিকিৎসক সমাজের ছিল না। অন্যদিকে, শরীরে গুটিবসন্ত রোগের বীজাণূ চামড়া কেটে প্রবেশ করালে মৃদু গুটিবসন্ত হয়ে মারাত্মক বসন্তের হাত থেকে রেহাই মেলে, এটাও ছিল আরেক গোষ্ঠিগত বা ঐতিহ্যবাহী জ্ঞান, যা ভারত-চীন থেকে খুব সম্ভবত তুরস্ক হয়ে ইউরোপে ঢুকেছিল। সে-জ্ঞানটিও কিন্তু বিজ্ঞানের পর্যায়ভুক্ত ছিল না, এমনকি টিকাকরণের মূলনীতির সঙ্গে সম্পূর্ণ মিললেও একে টিকা বলে ডাকাই হল না। ভাষা বড় জটিল আবরণ।

আমরা এবার জেনার-এর কাহিনীতে আসি। তিনি গোয়ালা-গোয়ালিনীদের জিজ্ঞাসাবাদ এবং পর্যবেক্ষণ করে নজর করলেন যে, এদের অনেকের চামড়ায় ছোট গুটি মত বেরোয়, সামান্য একটু রোগ হয় এবং তা সেরে যায়, কোনো বড় ক্ষয়ক্ষতি হয় না। তিনি দেখলেন, দুধের বাঁটের কাছে গরুরও এই ধরনের কিছু গুটি হয়। এই রোগটি হলো কাউপক্স বা গো-বসন্ত। জেনার ভাবলেন, আচ্ছা, এই গো-বসন্তের রস চামড়া কেটে শরীরে ঢুকিয়ে দিলে কেমন হয়? যদিও এর কার্যপ্রণালী খুব ভালো করে বোঝা যায়নি, তবে আমরা এখন যুক্তিসঙ্গত অনুমান করতে পারি, ঠিক কী কারণে একজন মানুষের গোবসন্ত হলে তার স্মলপক্স বা গুটি বসন্ত হয় না, বা হলেও কম তীব্র হয়। গো-বসন্ত এবং গুটিবসন্ত এ-দুয়ের বীজাণু বা ভাইরাসের গঠন কাছাকাছি। তাই একবার গো-বসন্ত হলে শরীরের গো-বসন্তের বিরুদ্ধে যে প্রতিরোধ ক্ষমতা গড়ে ওঠে তা স্মলপক্স বীজাণুকে আটকে দেয় বা তাকে বেশি ক্ষতি করতে দেয় না। তবে এ নিয়ে অন্য মতও আছে, সময় হলে পরে আলোচনা করা যাবে।
১৭৯৬ সাল, আজ থেকে ঠিক ২২৪ বছর আগে আজকের মতোই এক মে মাসের দিন। সারা নেমস (Sarah Nelms) নামে এক তরুণী গোয়ালিনীর হাতে একটা গো-বসন্তের গুটি দেখে রেখেছিলেন জেনার। সেই গুটি থেকে রস (তখনকার ভাষায় লিম্ফ) নিয়ে জেমস ফিপস (James Phipps) বলে আট বছরের এক বালকের হাতে জেনার টিকা দিলেন। পৃথিবীর ইতিহাসে বিখ্যাততম টিকা। কয়েকদিনের মধ্যে ছেলেটির একটু জ্বর হল, বগলে সামান্য ব্যথা। ন’দিনের মাথায় তার ঠাণ্ডা বোধ হতে শুরু করল, আর খিদে কমে গেল। কিন্তু পরের দিন তার শরীর প্রায় সুস্থ। এর দু’মাস পরে জেমস ফিপস-এর শরীরে জেনার গুটিবসন্তের রস প্রবেশ করিয়ে দিলেন—এটা অবশ্য কোনো নতুন পদ্ধতি নয়, ভারত-চীন-তুরস্ক হয়ে ইংল্যান্ডে আসা ভ্যারিওলেশন পদ্ধতি। তারপর অধীর প্রতীক্ষা। কোনো রোগলক্ষণ দেখা দিল না।
প্রসঙ্গত জেমস ফিপস-এর বাবা ছিল গরীব ভূমিহীন চাষী, জেনার তাঁকে নিজের বাগানের মালির কাজ দেন।
সাধারণাব্দ (CE) ১৮০০ সাল নাগাদ এডোয়ার্ড জেনার-এর টিকা আবিষ্কার হবার ১৭০ বছর পরে বিশ্ব থেকে গুটিবসন্ত নির্মূল করা গেল। তবে প্রাচীনকালে ভারত ও চীনে গুটিবসন্তের রস সুস্থ মানুষের দেহে ঢুকিয়ে, কম মারাত্মক রোগ তৈরি করে ভয়াবহ রোগ আটকানোর প্রথা ছিল। স্বয়ং জেনার এই প্রাচীন টিকা নিয়েছিলেন বাল্যকালে। জেনার-এর আবিষ্কারের ছোট একটি বিবরণ দিয়েছি তৃতীয় পর্বে। আজ চতুর্থ পর্বে দেখতে চাইব কেমন করে জেনার এমন টিকা আবিষ্কার করলেন যা মানবসভ্যতার সবথেকে বড় মারণব্যাধিকে হার মানাল। আর দেখব ডাক্তাররা কেমনভাবে নিলেন জেনার-এর এই আবিষ্কারকে, কেমন করে টিকার ব্যাপক ব্যবহারের ছাড়পত্র মিলল।

ইংল্যান্ডের রয়্যাল সোসাইটি ভ্যাক্সিনেশন মানল না!
১৭৯৭ সালে জেনার নিজের হাতে জেমস ফিপস নামে বালকের দেহে প্রথমে গো-বসন্ত রোগের বীজাণু প্রবেশ করালেন, এটাই হল ইতিহাসে প্রথম স্বীকৃত ভ্যাক্সিনেশন। আর তার মাস-দুয়েক পরে সেই একই বালকের দেহে জেনার গুটিবসন্তের বীজাণু প্রবেশ করালেন-- এটা অবশ্য প্রাচীন ভ্যারিওলেশন পদ্ধতিই।
আমরা এর আগে দেখেছি, ভয়াবহ গুটিবসন্ত রোগ আটকানোর উপায় হিসেবে এই পদ্ধতি ভারত ও চীনে চলত। এর নাম ছিল ভ্যারিওলেশন, আর জেনার-এর পদ্ধতির নাম হবে ভ্যাক্সিনেশন। এই শব্দদুটো আমাদের মনে রাখতে হবে।
জেনার যেভাবে গো-বসন্ত আর গুটিবসন্ত বীজাণু মানুষের দেহে ইচ্ছেমত প্রবেশ করিয়ে পরীক্ষা করেছিলেন, আজকের দিনে এইভাবে সরাসরি মানুষের ওপর পরীক্ষা করার চিন্তাও বাতুলতা মাত্র। কিন্তু সেসময় এরকম পরীক্ষা চলত । আর তখন চিকিৎসাশাস্ত্র এতোই অনুমাননির্ভর ছিল, মানুষের ওপর করা পরীক্ষার এতোই অভাব ছিল যে এক-দুজন মানুষের রোগ ঠেকানো গেলে সেটাকেই একটা বেশ বড়সড় প্রমাণ বলে ভাবা হত। তাই জেনার-এর টিকার এমন হাতেগরম ফল সাধারণভাবে অগ্রাহ্য হবার কারণ ছিল না। কিন্তু ইংল্যান্ডের ডাক্তার সমাজ এই টিকা আবিষ্কারকে চট করে মেনে নিতে পারলেন না, বরং তাদের একটা বড় অংশ একে উড়িয়ে দিতে চাইলেন।
তখন ইংল্যান্ডে বিজ্ঞানের আবিষ্কারকে মান্যতা দেবার মতো একটাই বড় সংস্থা ছিল—রয়াল সোসাইটি। রয়্যাল সোসাইটিতে জেনার তাঁর গবেষণাপত্র পাঠালেন, কিন্তু সোসাইটি তা ছাপল না, ফিরিয়ে দিল। অবশ্য এর পেছনে অনেক কারণ আছে, আর তা পুরোটা জেনারের এই পরীক্ষা নিয়ে অবিশ্বাসের ফল নয় (পাদটিকা ১)। তখন অনন্যোপায় জেনার তাঁর অভিজ্ঞতার ভাঁড়ার ঝেড়ে ২৩টি কেস রিপোর্ট একত্র করে একটি ছোট বই ছাপালেন—An Inquiry into the Causes and Effects of the Variolae Vaccinae।
জেনারের এই বইতে ছিল ২৩-টি কেস রিপোর্ট। তখনকার বিচারে সংখ্যাটি কম বলা যেত না। তবে সবকটি কেস একরকম ছিল না।
• রিপোর্টে উল্লিখিত ২৩ জনের মধ্যে প্রথম ১২ জনের আগে গোরুর ছোঁয়াচ থেকে স্বাভাবিকভাবে গো-বসন্ত হয়েছিল, এবং জেনার বারবার ভ্যারিওলেশন করেও তাদের দেহে গুটিবসন্তের লক্ষণ বিন্দুমাত্র আনতে পারেন নি। এই ১২ জনের অনেকে বাড়ির অন্য গুটিবসন্ত রোগীর সেবা করেছে, কিন্তু গুটিবসন্ত হয়নি। এ থেকে জেনারের সিদ্ধান্ত ছিল, গো-বসন্ত হল গুটিবসন্ত থেকে অনেক কম মারাত্মক ছোঁয়াচে একটি রোগ, এবং একবার গো-বসন্ত হয়ে গেলে তার গুটি-বসন্ত হবে না।
• জেনারের কেস নম্বর ১৩, ১৪ ও ১৫ ছিল ঘোড়ার বসন্ত বা হর্সপক্স নিয়ে। তাঁর বইয়ের প্রথম অংশে জেনার দেখাতে চেয়েছিলেন, গো-বসন্ত আসলে এসেছে ঘোড়া থেকে—সেটা তাঁর পরীক্ষাতে প্রমাণ হয়নি, এবং পরেও একথা ভিত্তিহীন বলেই ভাবা হয়েছে। এদের ঘোড়ার বসন্ত থেকে টিকা দিয়ে তা কাজে লাগেনি। জেনার বললেন, হর্সপক্স গো-বসন্তের মতো অতটা সুরক্ষা দেয় না।
• এরপরের কেস ১৬ এবং কেস ১৭ সবথেকে বিখ্যাত, আমাদের পূর্বপরিচিত সারা নেমস ও জেমস ফিপস। সারা নেমস-এর হাতে গো-বসন্তের গুটি হয়েছিল, আর সেই গুটি থেকে রস নিয়ে জেমস ফিপস-কে দেওয়া হয়েছিল। মাসদুয়েক পর জেমস ফিপস-এর চামড়ায় গুটিবসন্তের বীজাণু প্রবেশ করিয়ে দেওয়া হলেও তার ভ্যারিওলেশন-এর কোনো লক্ষণ দেখা দেয় নি, গুটিবসন্তও হয়নি। ভ্যারিওলেশন-এর জন্য ব্যবহৃত গুটিবসন্তের বীজাণুটি নষ্ট হয়ে গেছে কিনা দেখতে চাইলেন জেনার। যে বীজাণুর ‘স্যাম্পল’ ফিপস-এর শরীরে ঢুকিয়েছিলেন, সেই একই স্যাম্পল থেকে রস নিয়ে জেনার ফিপস-এর বাড়ির লোকেদের কয়েকজনের চামড়ায় প্রবেশ করালেন—তাদের কিন্তু ভ্যারিওলেশন-এর স্বাভাবিক লক্ষণগুলি প্রকাশ পেল।
• গো-বসন্তের রস টিকা দিলে, একজন মানুষের শরীরে ঐ টিকার স্থানে যে ফুস্কুড়ি হয়, তা থেকে রস নিয়ে আরেকজন মানুষের চামড়ায় টিকা দিলে কী হয়? শেষ ৫-টি কেস (নম্বর ১৯ থেকে ২৩) দিয়ে জেনার এটা দেখতে চাইলেন। ১৯ নম্বর কেস এক বালক। তার চামড়ায় জেনার সরাসরি গোরুর দেহ থেকে পাওয়া গো-বসন্তের রস টিকা দিলেন, সেই বালকের টিকার জায়গায় ফুস্কুড়ি হল। সেই ফুস্কুড়ির রস নিয়ে ২০ নম্বর বালকের চামড়ায় টিকা দিলেন, আবার তার ফুস্কুড়ি থেকে রস নিয়ে ২১ নম্বর, তার থেকে রস নিয়ে ২২ নম্বর, ও ২২ নম্বর বালকের রস ২৩ নম্বর বালকের চামড়ায় টিকা দিলেন। তারপর ২১ নম্বর, ২২ নম্বর ও ২৩ নম্বর বালকের দেহে তিনি ভ্যারিওলেশন পদ্ধতিতে গুটিবসন্তের বীজাণু দিলেন। তাতে তাদের গুটিবসন্ত রোগ হল না, ও ভ্যারিওলেশনের পরে যে প্রতিক্রিয়া স্বাভাবিক তাও হল না—ঠিক যেমন জেমস ফিপস-এর হয়নি। এ থেকে জেনার-এর সিদ্ধান্ত হল, গো-বসন্তের ভ্যাক্সিন ‘শৃঙ্খল’ (chain) মানুষের দেহে বজায় রাখা যায়। সহজ কথায়, গো-বসন্তের টিকা মানুষর দেহে দিয়ে যে ফুস্কুড়ি হয়, তা থেকে রস নিয়ে দ্বিতীয় একজন মানুষের দেহে দিয়ে সেখানে আবার ফুস্কুড়ি তৈরি করা যায়, এবং সেই ফুস্কুড়ির রস থেকে তৃতীয় মানুষের শরীরে ফুস্কুড়ি করা—এই পদ্ধতি পরপর অসংখ্যবার চালানো যায়। এবং এইভাবে ফুস্কুড়ি তৈরি হওয়া সমস্ত মানুষই গুটিবসন্ত থেকে সুরক্ষা পায়।
পাদটিকা ১-- এর বছর দশেক আগে জেনার রয়াল সোসাইটিতে তাঁর অন্য গবেষণাপত্র পাঠিয়েছিলেন, এবং সেটি প্রকাশিত হয়েছিল। সেই গবেষণাপত্র ছিল সদ্যোজাত কোকিলছানার আচরণ বিষয়ক। এতে অবাক হবার কিছু নেই, সে সময় জেনার-এর মতো যেসব ভদ্রলোক বিজ্ঞানী (Gentleman Naturalist) ছিলেন তাঁদের আগ্রহ বহুমুখী হত, চিকিৎসক কেবল ডাক্তারি নিয়েই ভাববেন, এমন স্পেশালাইজেশনের যুগ তখনও আসেনি। কিন্তু সে কথা থাক। কোকিলছানা নিয়ে জেনার-এর গবেষণাপত্র প্রকাশিত হলে কী হবে, ঐ গবেষণার মূল বক্তব্য নিয়ে অধিকাংশ ভদ্রলোক বিজ্ঞানী জেনারের মত সমর্থন তো করেনইনি, উপরন্তু তাঁকে উৎকেন্দ্রিক ভেবেছিলেন। তবে সেটা ছোট ব্যাপার।
অন্য, এবং বেশি গুরুত্বপূর্ণ, কারণটি হল, ভদ্রলোক বিজ্ঞানীরা জানতেন গোয়ালাদের মধ্যে একটা প্রচলিত কথা আছে যে গো-বসন্ত হলে সেই মানুষের পরে আর গুটিবসন্ত হয় না। যে কোনো পণ্ডিতগোষ্ঠীর মতো তাঁদেরও এইসব ‘অ-ভদ্রলোকের’ মধ্যে চালু প্রথা নিয়ে যথেষ্ট অবজ্ঞা ছিল। ফলে সেটাই যখন জেনার রয়্যাল সোসাইটির মতো উচ্চমার্গের পণ্ডিতসভায় চালাতে চাইলেন, তাঁদের এতদিনকার উচ্চবর্ণের অহঙ্কার ঘা খেল। তাঁরা বললেন, যতসব ছোটলোকের প্রথা—এনিয়ে মাথা ঘামাবার কোনো দরকার নেই। পরে অবশ্য জেনার-এর ভ্যাক্সিন সুপ্রতিষ্ঠিত হয়ে গেলে, “মন্ত্রী কহে, আমারো ছিল মনে / কেমনে বেটা পেরেছে সেটা জানতে” বলে এসেছিলেন এঁদের অনেকেই।
রাণী মারিয়া থেরেজা-র (১৭১৭- ১৭৮০ সাধারণ অব্দ) নাম এখন অনেকেই ভুলে গেছেন। পূর্ব-ইউরোপের নানা দেশে পর্যটকেরা এখনও অজস্র প্রাসাদ ও গীর্জায় অষ্টাদশ শতকের এই প্রবল-প্রতাপশালী রাণীর সপরিবার চিত্র দেখে অবাক হয়ে গাইডকে জিজ্ঞেস করেন—কে এই রাণী? পর্যটকের দোষ নেই, প্রথম মহাযুদ্ধে অস্ট্রো-হাঙ্গারিয়ান সাম্রাজ্য প্রথম আক্রমণ শুরু করেছিল বটে, কিন্তু বিশ্বযুদ্ধের শেষে সেই সাম্রাজ্য ধ্বংস হয় যায়—তাই সেখানকার পূর্বতন রাণীকে কে-ই বা মনে রাখবে!
সম্রাট দ্বিতীয় ফ্রেডেরিক, ফ্রেডরিক দ্য গ্রেট (১৭১২-১৭৮৬ সাধারণ অব্দ) নামেই বেশি খ্যাত, প্রুশিয়া সাম্রাজ্যের ‘আলোকপ্রাপ্ত চরম-ক্ষমতাধর’এর ধারনার প্রবক্তা, ভবিষ্যতের জার্মানির মেরুদণ্ড গড়ে তোলার নায়ক, তাঁকেও আমরা খুব বেশি মনে রাখিনি। অথচ মনে রেখেছি এই সময়ের এক ব্যর্থ ‘অপদার্থ’ শাসক, ফ্রান্সের সম্রাট ষোড়শ লুই-কে (১৭৫৪ -১৭৫৩ সাধারণ অব্দ), কারণ তাঁর গলা গিলোটিনে কাটা পড়েছিল।
আর মনে রেখেছি রাশিয়ার সম্রাজ্ঞী জারিনা দ্বিতীয় ক্যাথেরিন দ্য গ্রেট-কেও (১৭২৯-১৭৯৬ সাধারণ অব্দ), তবে সেটা বোধহয় স্বামীকে সরিয়ে সিংহাসন দখল আর অজস্র সেক্স-স্ক্যান্ডালের জন্য।
কিন্তু অষ্টাদশ শতকের দ্বিতীয়ার্দ্ধের ইউরোপের এই বিখ্যাত রাজপরিবার-গুলোর মধ্যে কী মিল ছিল বলুন তো?
এঁদের সবার টিকা দেওয়া ছিল। না, রাজটিকা নয়, সেটাও ছিল হয়তো, আমি গুটিবসন্তের টিকার কথা বলছি। এবং এই টিকা তাঁদের সকলকেই গুটিবসন্ত থেকে আজীবন সুরক্ষা দিয়েছিল।
দাঁড়ান দাঁড়ান, এঁরা তো ১৮০০ সালের আগেই ধরাধাম ত্যাগ করেছিলেন। আর জেনার সাহেবের টিকা আবিষ্কার হল ১৭৯৭ সালে, সেটা চালু হয়েছিল ১৮০০ সালে। এঁরা টিকা পেলেন কোত্থেকে? শুধু এঁরা নিজেরা নন, এঁদের পরিবারের সবাই টিকা নিয়েছিলেন, এমনকি সম্রাট দ্বিতীয় ফ্রেডেরিক প্রুশিয়া-র সৈন্যদলের সবাইকে টিকা দেবার ব্যবস্থা করেছিলেন! রহস্যটা কোথায়?
যারা একটু মন দিয়ে পড়েছেন তাঁরা অবশ্যই বুঝতে পেরেছেন, রহস্য কিছু নেই। এই রাজারাণীরা গুষ্টিশুদ্ধু যে টিকা নিয়েছিলেন তা জেনারের টিকা নয়, তা হল ভারত-চীন থেকে তুরস্ক হয়ে আমদানি করা ভ্যারিওলেশন—গুটিবসন্তের রস থেকে প্রস্তুত করা টিকা। জেনারের টিকা চালু হবার পর থেকে যার ভূমিকা অস্বীকার করার জন্যই যেন, জেনারের টিকা থেকেই ইতিহাসে ভ্যাক্সিন-এর শুরু, এমন একটা ধারনা চালু হয় । ইউরোপকেন্দ্রিক ইতিহাসে এমনই হবার কথা। কিন্তু সেটা বলার পরেও প্রশ্ন থাকে—কেন একটা প্রচলিত টিকা-পদ্ধতি ইউরোপে চালু হয়ে, সেখানকার রাজাগজাদের স্বীকৃতি পেয়েও তারপর ইতিহাস থেকে একেবারে নামসমেত লোপাট হয়ে গেল! কোন ভূমিতে জেনারের ভ্যাক্সিন সারজল পেয়ে প্রতিষ্ঠা পেল?
অষ্টাদশ শতকের ইউরোপে বছরে চার লক্ষ মানুষ গুটিবসন্তে মারা যেত, আর মোটামুটি সমসংখ্যক মানুষ একচোখ বা দুচোখেই অন্ধ হয়ে যেত। বাচ্চাদের বসন্ত হলে শতকরা আশিজন মরে যেত। রাজপরিবারগুলোও রক্ষা পেত না। বেঁচে গেলে চামড়ায় দাগ এতোই বিশ্রী হত যে রোগটার ল্যাটিন নাম ছিল ‘ভ্যারিওলা’, চামড়ায় দাগের রোগ, আর ইংরেজি নাম পক্স কথাটাও মুখে গর্ত হবার প্রাচীন ইংরেজি শব্দ থেকে নেওয়া। এরকম রোগের চিকিৎসা খুঁজছিলেন সবাই, কিন্তু সেটা এল পূর্বদিক থেকে।
আমরা আগেই দেখেছি ভারত, চীন আর আফ্রিকার কোনো কোনো জায়গায় কয়েক শতাব্দী ধরে ভ্যারিওলেশন টিকা চালু ছিল। কোনো রোগীর গুটিবসন্তের গুটির রস অন্য মানুষের চামড়ায় টিকা হিসেবে দেওয়া হত। টিকা দেবার পরে টিকার জায়গাটা ফুলে গোটা বেরত, জ্বর হত। দেহের অন্যত্রও সামান্য গুটিবসন্তের গুটি বেরত, তারপর সেরে যেত। ক্বচিৎ কদাচিৎ কারও টিকা নেবার ফলে পুরোদস্তুর গুটিবসন্ত হয়ে মৃত্যু পর্যন্ত ঘটতে পারত। তাছাড়া যেহেতু অন্য মানুষের শরীরের রস দেওয়া হচ্ছে, তাই টিকা থেকে টিবি, সিফিলিস এসব হতে পারত, আর পুঁজ হয়ে কষ্টকর ঘা হওয়া বেশ সাধারণ ঘটনা ছিল। কিন্তু গুটিবসন্তের মতো ভয়ানক রোগ আটকাতে লোকে টিকার এইটুকু বিপদ মেনে নিত।
অটোমান সাম্রাজ্য থেকে সপ্তদশ শতকের শেষদিকে ইউরোপীয়দের লেখা ভ্যারিওলা টিকার প্রথম বিবরণ পাওয়া যায়, আর তারাই ইউরোপে এ-বিষয়ে লিখে পাঠায়। ছ’শ বছর ধরে আজকের ইরাক থেকে বর্তমান তুরস্ক পর্যন্ত অটোমানদের বিরাট সাম্রাজ্য ছিল, প্রথম বিশ্বযুদ্ধে তা বিলুপ্ত হয়। তুরস্কের ইস্তাম্বুল থেকে কয়েকজন ইংরেজ ১৭১৪ সালে ভ্যারিওলেশনের পদ্ধতির বিবরণ দিয়ে লন্ডনের রয়্যাল সোসাইটিকে চিঠি লেখেন।
ইংরেজ অভিজাত-কন্যা লেডি মেরি মন্টাগু-র (১৬৮৯ -১৭৬২ সাধারণ অব্দ ) গুটিবসন্ত হয়েছিল—তাঁর মুখটা দাগে কদর্য হয়ে যায়। পরের বছর তাঁর ভাই গুটিবসন্তে মারা যায়। তারপর লেডি মন্টাগু-র স্বামী ইংল্যান্ডের রাজপ্রতিনিধি হিসেবে ইস্তাম্বুলে আসেন। এখানে এসেই লেডি মন্টাগু ভ্যারিওলেশন টিকা-পদ্ধতি দেখেন আর একে গুটিবসন্তের বিরুদ্ধে একমাত্র হাতিয়ার বলে বুঝতে পারেন। তিনি নিজের বাচ্চা ছেলেকে টিকা দেন। ইস্তাম্বুল থেকে লন্ডনে ফিরে লেডি মন্টাগু তাঁর পরিচিতির বৃত্তে থাকা অভিজাত ইংরেজদের বোঝান--টিকা ছাড়া তাঁদের ছেলেমেয়েদের বাঁচার রাস্তা নেই ।
ডা. চার্লস মাইটল্যান্ড প্রথমে লেডি মন্টাগু-র কথায় নিজের বাচ্চা মেয়েকে টিকা দেন, তারপর ভ্যারিওলেশন-এর ট্রায়াল করার জন্য তিনি রাজকীয় অনুমোদন লাভ করেন ও ছয়জন বন্দীর দেহে টিকা দিয়ে তার ফলাফল লিপিবদ্ধ করেন। বন্দীদের অবশ্য টোপ দেওয়া হয়েছিল যে ট্রায়ালে অংশগ্রহণ করলে সাজা মকুব হবে। রাজকীয় চিকিৎসকদের অধিকাংশ এই ট্রায়ালের বিপক্ষে ছিলেন। চিকিৎসকদের একটি পরিদর্শক দল এই ট্রায়ালের ওপর কড়া নজর রাখে। ডা. মাইটল্যান্ড বন্দীদের প্রথমে ভ্যারিওলেশন অর্থাৎ গুটিবসন্তের রস দিয়ে টিকাকরণ করলেন। তারপর এদের গুটিবসন্ত রোগীদের সংস্পর্শে এনে দেখা গেল রোগটি ওদের হল না। এর কয়েকমাস পর ১৭২২ সালে স্বয়ং প্রিন্সেস অফ ওয়েলস-এর দুই কন্যাকে ভ্যারিওলেশন করলেন ডা. মাইটল্যান্ড। এরপর ইংল্যান্ডে অভিজাত সমাজে ভ্যারিওলেশন পুরোদমে চালু হয়ে গেল।
সেই অষ্টদশ শতকের মাঝামাঝিই গোটা ইউরোপে চিকিৎসক সমাজ একটা বৈশিষ্ট্য অর্জন করেছিল। এক দেশে একটি আবিষ্কার হলে তা দ্রুতই অন্যদেশে ছড়িয়ে পড়ত। (পাদটীকা ১) ফলে ইংল্যান্ডের ডাক্তাররা একবার ভ্যারিওলেশন মেনে নিলে, গোটা ইউরোপে এই টিকা ছড়িয়ে পড়ল। এবং আগে যেমন বলেছি, ইউরোপের রাজারাজড়া সবাই এই টিকা নিলেন—যদিও তখনও জনসাধারণের টিকাকরণ নিয়ে তেমন প্রচেষ্টা ছিলনা—একমাত্র প্রুশিয়ার সম্রাট দ্বিতীয় ফ্রেডেরিক সৈন্যদলের সবাইকে টিকা দেবার ব্যবস্থা করেছিলেন।
ইউরোপে টিকাকরণের প্রায় সঙ্গে সঙ্গে উত্তর আমেরিকায় ইউরোপীয় কলোনিগুলোতে ভ্যারিওলেশন ছড়িয়ে পড়ল। বিশেষ করে বোস্টন ও ম্যাসাচুসেটস-এর নান জায়গায় কয়েকজন ডাক্তার ভ্যারিওলেশন শুরু করলেন। কিন্তু সেখানে এর বিরুদ্ধ জনমত শক্তিশালী ছিল—বোস্টনের এক ডাক্তারের বাড়িতে টিকা দেবার অপরাধে কে বা কারা বোমা মেরেছিল। শেষ পর্যন্ত অবশ্য ১৭২১ সালের গুটিবসন্ত মাহামারির সময় টিকার পক্ষে থাকা ডাক্তাররা পরীক্ষা সহকারে প্রমান করে দেখালেন যে, টিকা নিলে ক্ষতি হয় কম। বোস্টনের ১২,০০০ মানুষের আর্ধেকের গুটিবসন্ত হয়েছিল—যাদের টিকা দেওয়া হয়নি তাদের শতকরা ১৪ ভাগ মারা যায়। অন্যদিকে টিকা দেওয়া লোকেদের শতকরা মাত্র ২ ভাগ মানুষ মারা গিয়েছিল। বিশ্বের ইতিহাসে মহামারি বিষয়ে এটাই প্রথম পরিসংখ্যান-তত্ত্বের প্রয়োগ।
ভ্যারিওলেশন ইউরোপ-আমেরিকায় রীতিমত জাঁকিয়ে বসেছিল। তাহলে সমস্যা কী এমন ছিল যে জেনারের টিকা বা ভ্যাক্সিন আসার পরে ভ্যারিওলেশন গুরুত্ব হারাল, আর চল্লিশ বছরের মাথায় ভ্যারিওলেশনকে ইংল্যান্ড আইন করে তুলে দিল? ভ্যারিওলেশন টিকা দেবার রস যেহেতু অন্য মানুষের দেহ থেকে নেওয়া হত, টিকার জায়গায় ঘা, এমনকি সিফিলিস ও টিবি-রোগ হওয়ার সম্ভাবনা ভ্যারিওলেশন পদ্ধতিতে ছিল। কিন্তু তা তো জেনারের পদ্ধতিতেও ছিল, কারণ জেনারের ভ্যাক্সিন দুভাবে তৈরি হত—সরাসরি গোরুর বসন্তগুটির রস থেকে, অথবা (গো-বসন্তের বীজাণু দিয়ে) মানুষের হাতে ফুস্কুড়ি তৈরি করে, সেই ফুস্কুড়ির রস থেকে।
ভ্যারিওলেশনে মূল বিপদ, যা ভ্যাক্সিনে ছিল না, তা হল এই:
গো-বসন্ত মানুষের দেহে প্রায় কখনই গুরুতর রোগ তৈরি করে না। অন্যদিকে, ভ্যারিওলেশন পদ্ধতিতে ব্যবহার করা হত গুটিবসন্তের রস, অর্থাৎ গুটিবসন্তের ভাইরাস থেকে —তা থেকে কিন্তু সবসময়েই অল্পস্বল্প রোগলক্ষণের জন্ম দিত, আর কোনো ক্ষেত্রে ঐ টিকা থেকেই একেবারে পুরোদস্তুর গুটিবসন্ত হত, বিরল ক্ষেত্রে গুটিবসন্তের মহামারির উৎস হয়ে দাঁড়াত কোনো একজন টিকা পাওয়া মানুষের টিকাজনিত গুটিবসন্ত।
পাদটীকা ১- অন্যদিকে, ভারতে বিভিন্ন অঞ্চলে ভ্যারিওলেশন-এর আলাদা আলাদা ধরন ও প্রথা ছিল। এই ঐতিহ্যবাহী পদ্ধতিটি যে যার মতো ধরে রাখতেন বটে তবে তা নিয়ে সংগঠিত মতবিনিময়ের বালাই ছিল না। এক জায়গায় টিকা দিতেন ব্রাহ্মণ টিকাদার, অন্য কোথাও নাপিত, অন্যত্র আবার মালাকার সম্প্রদায়ের লোক, আবার কোথাও টিকাকার ছিলেন মুসলমান। তাদের মধ্যে সামাজিক আদান-প্রদান কম ছিল, ফলে জ্ঞানের আদান-প্রদান ও অভিজ্ঞতার সার-সংকলন বা বিস্তার ভারতের টিকাকারদের মধ্যে হয়নি।
এমনকি ভারতের পূর্ব , পশ্চিম ও উত্তর প্রান্তে (বাংলা, গুজরাট বা পাঞ্জাবে) ভ্যারিওলা টিকা চালু থাকার কয়েক শতাব্দী পরেও মধ্য বা দক্ষিণ ভারতের অধিকাংশ জায়গায় এই টিকা দেওয়া হত না।

রয়্যাল সোসাইটি যখন জেনারের গবেষণাপত্র ছাপল না, তখন জেনার তাঁর অভিজ্ঞতা থেকে ২৩-টি কেস রিপোর্ট একত্র করে একটি ছোট বই ছাপালেন। সেই পুস্তিকাটিও প্রথমে ইংল্যান্ডের ডাক্তারদের মধ্যে বিরাট সাড়া জাগায়নি। তবে কয়েকজন ডাক্তার ব্যক্তিগতভাবে বইটি পড়ে বা জেনারের সঙ্গে আলাপের সুবাদে, তাঁর পদ্ধতিতে ভ্যাক্সিন দিতে চাইলেন। আমরা এখানে মনে রাখব, ভ্যাক্সিন কথাটা কিন্তু তখনও ব্যবহার করা শুরু হয়নি, তবে গুটিবসন্তের রস থেকে ভ্যরিওলেশন পদ্ধতি তখন প্রাচ্য থেকে এসে ইউরোপে মোটামুটি চালু হয়ে গেছে, আর তার জায়গায় গো-বসন্তের গুটি থেকে ভ্যাক্সিন চালু করার চেষ্টা করতে হচ্ছে জেনারকে। (পাদটীকা ১)

জেনার নিজে লন্ডনে গিয়ে তিনমাস ধরে ভ্যাক্সিন দেবার জন্য ভলেন্টিয়ার খুঁজলেন, কিন্তু একজনকেও পেলেন না। অন্যদিকে ঐ লন্ডনেই জেনারের পদ্ধতিতে জেনারের সংগ্রহ করে আনা (গো-বসন্তের) রস দিয়ে ভ্যাক্সিন দিচ্ছিলেন কেউ কেউ, বিশেষ করে সার্জন হেনরি ক্লাইন। এর বেশ কিছু পরে ডা. জর্জ পিয়ারসন আর ডা. উইলিয়াম উডভাইল নিজেদের রোগীদের জন্য জেনারের ভ্যাক্সিন সমর্থন করতে শুরু করলেন। এইভাবে একে একে বেশ কয়েকজন ডাক্তার জেনারের ভ্যাক্সিন ব্যবহার করা শুরু করার পরে জেনার সারা ইংল্যান্ড জুড়ে সমীক্ষা চালালেন—কোথায় কে এই ভ্যাক্সিন ব্যবহার করেছেন আর তার ফল কী। তাঁর সমীক্ষায় দেখা হত, জেনারের ভ্যাক্সিন নেবার পরে কারও স্বাভাবিকভাবে গুটিবসন্ত হয়েছে কিনা। অথবা তাদের ভ্যাক্সিন দেবার পরে ভ্যারিওলেশন করলে তার স্বাভাবিক প্রতিক্রিয়া, যেমন জ্বর, গায়ে গুটি বেরনো, এসব হয়েছে কিনা। ভ্যাক্সিন নেবার পরে গুটিবসন্ত হলে, বা ভ্যারিওলেশন-জনিত গুটি বেরোলে, ভ্যাক্সিন সুরক্ষা দেয় নি ধরা হত।

জেনারের সমীক্ষা তাঁর অনুমানকে সমর্থন করল। অবশ্য ভ্যাক্সিন দেবার প্রক্রিয়ায় বেশ কিছু গলদ হয়েছিল, সেসব ক্ষেত্রে নানা সমস্যা হয়। তবে অল্প সময়ের মধ্যেই গুটি বসন্তের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে ভ্যাক্সিন এক কার্যকরী পদ্ধতি এটা সবাই মেনে নিল, আর ১৮০০ সাধারণাব্দে (CE) এই পদ্ধতি ইংল্যান্ডের বাইরে প্রায় পুরো ইউরোপে ছড়িয়ে পড়তে শুরু করল। ভ্যারিওলেশন-এর ক্ষেত্রে আমরা যেমন দেখেছি, একটি কার্যকর চিকিৎসা-ব্যবস্থা ইউরোপের একটি দেশে চালু হলে তা দ্রুত সারা ইউরোপে এবং শ্বেত-আমেরিকায় ছড়িয়ে পড়ত, কেননা এই দেশগুলোর সরকারদের মধ্যে লড়াই চললেও বৈজ্ঞানিক প্রতিষ্ঠানগুলো প্রায়শই নিজেদের মধ্যে আদানপ্রদান বজায় রাখত।
ব্রিটেন এবং ফ্রান্স সেই সময়ে যুদ্ধে জড়িত থাকা সত্ত্বেও নেপোলিয়ান ফ্রান্সে এই ভ্যাক্সিন চালু করলেন এবং জেনারকে ফ্রান্সের উচ্চ রাষ্ট্রীয় সম্মানে ভূষিত করলেন।

তবে ভ্যাক্সিন ইউরোপেই থেমে থাকল না। ইংল্যান্ডের এক ডাক্তার জেনারের কাছ থেকে ভ্যাক্সিনের নমুনা নিয়ে আমেরিকার হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক বেঞ্জামিন ওয়াটারহাউস-কে সেটা পাঠান। ওয়াটারহাউস আমেরিকার একটি স্টেট ‘নিউ ইংল্যান্ড’-এ ভ্যাক্সিন দেওয়া শুরু করেন, তারপর তিনি স্বয়ং প্রেসিডেন্ট থমাস জেফারসন-কে ভার্জিনিয়া স্টেটে ভ্যাক্সিন চালু করতে অনুরোধ করেন। জেফারসন ভ্যাক্সিন দেবার কাজে সমর্থন করেন, আর ওয়াটারহাউস-কে প্রধান করে আমেরিকায় একটা জাতীয় ভ্যাক্সিন ইনস্টিটিউট তৈরি হয়। এর অনতিবিলম্বে আমেরিকায় জাতীয় ভ্যাক্সিন প্রোগ্রাম শুরু হয়। এই কাজের গুরুত্ব তখন অনেক আমেরিকান বোঝেন নি—কিন্তু পরে অধ্যাপক বেঞ্জামিন ওয়াটারহাউস-কে তাঁর দেশে প্রাপ্য সম্মান দেওয়া হয়, চিকিৎসাশাস্ত্রের ইতিহাসে তিনি ‘আমেরিকার জেনার’ এই অভিধা পান।

সারা পৃথিবী জুড়ে জেনারের ভ্যাক্সিন ও খ্যাতি ছড়িয়ে পড়ে। জেনার তাঁর আবিষ্কার থেকে বিরাট অর্থ রোজগার করতে চাননি। বরং ভ্যাক্সিন নিয়ে অবিশ্রাম কাজ করার সময় দিতে গিয়ে জেনারের প্রাইভেট প্র্যাকটিস নষ্ট হয়েছে, তাঁর আর্থিক ক্ষতি হয়েছে। ১৮০২ সালে বৃটিশ পার্লামেন্ট জেনারকে দশহাজার পাউন্ড, আবার ১৮০৭-এ আরও কুড়িহাজার পাউন্ড পুরষ্কার দেয়।
তবে জেনারকে অনেক নিন্দামন্দ আর গালাগালিও সইতে হয়েছে। শেষে বোঝা গেল জেনারের ভ্যাক্সিন অত্যন্ত কার্যকর, ভ্যারিওলেশন-এর মতো গুটিবসন্ত ছাড়াবার বিপদ এতে নেই। এই ব্যাপারটা পরিষ্কার হবার পরে নানা পদ্ধতি অবলম্বন করে জেনারের ভ্যাক্সিন বিপুল পরিমাণে উৎপাদন করে সাধারণ মানুষকে দেওয়া হয়। (পাদটিকা ২)
১৮৪০ সালে ইংল্যান্ডে ভ্যারিওলেশন আইনত নিষিদ্ধ হল, আর ভ্যাক্সিন-ই গুটিবসন্ত ঠেকানোর একমাত্র উপায় বলে গৃহীত হল। প্রাচ্যের পদ্ধতির ওপর পাশ্চাত্যের পদ্ধতি, জেনারের পদ্ধতির প্রাধান্য স্বীকৃত হল। কিন্তু একই সঙ্গে প্রাচ্য পদ্ধতিকে অবদমনের ও তাকে হেয় করার কাজটিও শুরু হল। প্রাচ্যের পদ্ধতি যে একসময় একমাত্র ভরসা ছিল, ইতিহাস থেকে সে কথা মুছে দেবার প্রচেষ্টা শুরু হল। ভারতবর্ষেও ইংরেজের হাত ধরে জেনারের ভ্যাক্সিন ছড়িয়ে পড়েছিল, তবে তার ইতিহাস কিন্তু ইউরোপ বা শ্বেত-আমেরিকার থেকে অনেকটাই আলাদা ছিল। আমরা এর পরের কোনো পর্বে সেদিকে নজর দেব।

পাদটীকা ১- গোয়ালিনীর কথা শুনে জেনার গো-বসন্ত নিয়ে ভেবেছিলেন, এই কাহিনীটি সাম্প্রতিককালে চ্যালেঞ্জ করা হয়েছে। বলা হচ্ছে যে জেনার-এর নজরে আসে, কিছু চাষীর গো-বসন্ত হলে গুটিবসন্ত হত না । কিন্তু তবুও আমাদের মূল প্রতিপাদ্য— গো-বসন্ত হলে গুটিবসন্ত আটকায়, এই জ্ঞানটি ঐতিহ্যবাহী জ্ঞান—সেই তত্ত্ব বহাল থাকছে।
পাদটীকা ২- বিংশ শতকে ভ্যাক্সিন-ভাইরাস, গো-বসন্ত ভাইরাস, আর গুটিবসন্ত ভাইরাস-এর ডিএনএ বিশ্লেষণ করে দেখা গেল জিনগতভাবে এরা পৃথক। সেটা খুব আশ্চর্য ব্যাপার। এব্যাপারে অনেকগুলি আলাদা আলাদা সম্ভাবনা ভাবা যায়।
১) জেনার যে গো-বসন্তের রসই নিয়েছিলেন, কিন্তু সেই গো-বসন্তের ভাইরাস ক্রমশ মিউটেট করেছে।
২) জেনারের ভাইরাসের সঙ্গে প্রথমেই, বা পরবর্তীকালে কোনো সময়ে, অন্য কোনো ভাইরাস (এমনকি মানুষের গুটিবসন্ত ভাইরাসও হতে পারে) মিশে গিয়েছিল, এমন হতে পারে।
৩) জেনারের ভাইরাস আদতে গো-বসন্ত ভাইরাসই নয়, অন্য কোনো ভাইরাস।
বাংলা ১৪০২ সনে একটি বই রবীন্দ্র পুরষ্কার পায়। বইটির নাম ‘চিকিৎসাবিজ্ঞানের ইতিহাস’, লেখক নারায়ণ চন্দ্র চন্দ, প্রকাশক প্রতিক্ষণ পাবলিকেশন প্রঃ লিঃ, প্রথম প্রকাশ ১৯৯৪ সাধারণাব্দ (CE)। প্রায় চার’শ পাতার এই বইতে গুটি বসন্ত নিয়ে লেখা হয়েছে যে ভারতে আয়ুর্বেদশাস্ত্রে এই রোগের প্রতিষেধক হিসেবে কলমী শাকের রস এবং বাসক পাতা সেবন করার আর রুদ্রাক্ষ ধারণ করার বিধান ছিল। জেনারের টিকা নিয়ে লেখা আছে, অথচ ভারতীয় ভ্যারিওলেশন সম্পর্কে কোনো উল্লেখ নেই। মনে রাখতে হবে এটা কোনো ব্যতিক্রম নয়। ভারতের এই টিকা সম্পর্কে জানেন এমন লোক খুব কম, যদিও বিংশ শতকের গোড়াতেও ভ্যারিওলেশন বাংলা থেকে পুরো বিলুপ্ত হয়নি।
প্রায় একই শিরোনামের আরেকটি বই। বইটির নাম ‘চিকিৎসাবিজ্ঞানের ইতিহাস, উনিশ শতকে বাংলায় পাশ্চাত্য শিক্ষার প্রভাব’, লেখক বিনয়ভূষণ রায়, প্রকাশক সাহিত্যলোক, প্রথম প্রকাশ ২০০৫ সাধারণাব্দ (CE)। চার’শ পাতারও বেশি এই বইতে গুটিবসন্ত নিয়ে অল্পই লেখা হয়েছে। ব্রিটিশ সরকার ১৮৫০ সালে বসন্তরোগ নিয়ে কলকাতায় যে অনুসন্ধান কমিটি গঠন করেন, তার একজন সদস্য ছিলেন মধুসূদন গুপ্ত। তাঁর বক্তব্য এই বইয়ের ৪০৫ ও ৪০৬ পৃষ্ঠাতে তুলে ধরা হয়েছে। মধুসূদন গুপ্ত বলেছেন (বঙ্গানুবাদ বিনয়ভূষণ রায়ের)—
“ব্যক্তিবিশেষকে বাংলা টিকা দেওয়া বিপজ্জনক। এর দ্বারা একই পরিবারভুক্ত অন্য কেউ আক্রান্ত হতে পারে। কারণ যে সমস্ত শিশুদের টিকা দেওয়া হয়নি, তাদেরই টিকা দেওয়া হয়। কিন্তু বাংলা টিকা নেবার জন্য যে সমস্ত প্রতিবেশী ইংরেজি টিকা নেয়নি তাদের মধ্যে সংক্রামিত হয়ে ক্ষতিকারক হতে পারে। বাংলা টিকার জন্য অনেকেরই মৃত্যু ঘটে।… হিন্দুস্থানি জনসাধারণ দেবী শীতলার অন্ধভক্ত। … বিশ্বনাথ মালী নামে একজন দেশীয় ব্যক্তি (টিকাকর্মী) এই সমস্ত হিন্দুস্থানি ব্যক্তিদের টিকা দিয়ে ১৮৫০ সালে ১২,০০০ টাকা রোজগার করেছিল।” (পাদটীকা ১)
মধুসূদন গুপ্তের বক্তব্যের পরে লেখক বিনয়ভূষণ তাঁর নিজের কথা বলছেন। তার মধ্যে দু-একটা উল্লেখযোগ্য লাইন এইরকম—
“শহর অথবা গ্রামের মধ্যবিত্ত ও নিচু শ্রেণীর হিন্দুদের অবস্থাও একইরকম ছিল। অন্য পরিবারে বাংলা টিকার দৌলতে তদের মধ্যেও বসন্তরোগ সংক্রামিত হত। কারণ টিকাকর্মীরা তাদের পাশের কোনও পরিবারের শিশুকে যখন টিকা দিত তখন ওই রীতি ও নীতি অনুসারে সেই শিশু আক্রান্ত হত এবং মহামারী হিসেবে তা ছড়িয়ে পড়ত।”
বিনয়ভূষণ রায়ের বইটি অত্যন্ত তথ্যবহুল, খুবই পরিশ্রম করে লেখা আকর পুস্তক, কিন্তু সেখানেও দেশীয় পদ্ধতিতে টিকাকরণ এল কেবলমাত্র নেতিবাচক ভূমিকা নিয়ে। মধুসূদন গুপ্ত সে-সময়ে কথাগুলি ভুল লেখেন নি, কিন্তু তার আগে কয়েক শতক ধরে দেশীয় পদ্ধতি যে ইতিবাচক ভূমিকা পালন করে এসেছে তার উল্লেখ বিনয়ভূষণ কোথাও করলেন না। আর নারায়ণ চন্দ্র চন্দ-র বইটি একটি গবেষণাধর্মী বই, রবীন্দ্র পুরষ্কারে ভূষিত, সেটিতে ভারতে গুটিবসন্তের চিকিৎসার উল্লেখ করা হল, কিন্তু দেশীয় টিকা সম্পর্কে লেখক আদৌ অবহিত বলে মনে হল না। অথচ দেশীয় টিকার গুণ না জানার কথা নয়! এটা জানতে কোনো প্রাচীন পুঁথি পড়তে হয় না, কোনো প্রত্নতাত্ত্বিক উৎখননে যোগ দিতে হয় না। উনবিংশ শতকে বাংলায় স্বাস্থ্য ও চিকিৎসা নিয়ে বেশ কয়েকটি পত্র-পত্রিকা বেরিয়েছিল, তাতে এই টিকা নিয়ে আলোচনা যথেষ্ট হয়েছিল, সেগুলি সমস্ত পাঠাগার থেকে হারিয়ে যায় নি, এমনকি সেগুলি সংকলিত করে বই বেরিয়েছে। উদাহরণ হিসেবে আমরা প্রদীপ বসু সম্পাদিত “সাময়িকী পুরনো সাময়িকপত্রের প্রবন্ধ সংকলন” প্রথম খণ্ড (আনন্দ পাবলিশার্স, প্রথম সংস্করণ ১৯৯৮) দেখতে পারি। “চিকিৎসক ও সমালোচক” সাময়িকপত্রে ১৮৯৫ সালে লেখা শ্রী সৌরীন্দ্রমোহন গুপ্তের লেখা “প্রাচীন আর্য্যচিকিৎসা বিজ্ঞান” প্রবন্ধটিতে আর্যদের চিকিৎসা ও আয়ুর্বেদ সম্পর্কে অনেক বড় বড় কথা আছে, সেগুলো বিশ্বাস করার দরকার নেই। কিন্তু সেখানে একটি শ্লোক উদ্ধৃত করা হয়েছিল।
“ধেন্যস্তন্য মাণ্ডুচি বা নরাণাঞ্চ মসিচিকা
তাজ্জলম বাহুমূলাচ্চ শাস্ত্র তেন গৃহীতবান।
বাহুমূলে চ শস্ত্রাণি রক্তোৎপত্তি কয়েরঃ চ,
তাজ্জলম রক্ত মিলিতেব স্ফোটকজ্বরঃ সম্ভবেৎ।”
শ্রী সৌরীন্দ্রমোহন গুপ্ত এর অর্থ করেছেন—
“গরুর বাঁট হইতে কিম্বা মনুষ্যের স্কন্ধ হইতে কফোনি পর্য্যন্ত, কোন বসন্ত হইতে, ছুরিকা করিয়া বীজ গ্রহণ পূর্ব্বক, অস্ত্র দ্বারা স্কন্ধ হইতে কফোনির যে কোন স্থানে একটু বিদ্ধ করিয়া দিলে রক্ত বাহির হইবে, তারপর তৎস্থানে সেই বসন্তের বীজ প্রয়োগ করিয়া দিলে জ্বর উৎপন্ন হইবে। তারপর স্থানান্তরে সেই বীজ প্রয়োগে গাত্রে স্বাভাবিক বসন্তের ন্যায় বসন্ত উৎপন্ন হইবে কিন্তু জ্বর হইবে না, সুতরাং কোন প্রকার ঔষধেরও আবশ্যক নাই এবং রোগীকে ইচ্ছানুরূপ পথ্যও প্রদান করা যাইতে পারে। … একবার পূর্বোক্তরূপ টিকা প্রদান করিলে, সমস্ত জীবনে আর বসন্ত হইবার ভয় নাই…।”
এই শ্লোকটি অর্বাচীন হতে পারে, বা সৌরীন্দ্রমোহন গুপ্তর দাবি বাড়াবাড়ি হতে পারে। মূল কথা হল ১৮৯৫ সালেও অন্তত বৈদ্যসমাজে দেশীয় পদ্ধতিতে টিকাদান অর্থাৎ ভ্যারিওলেশনের পক্ষে লেখালেখি চলেছে, কিন্তু তার এক’শ বছর পরে আমাদের চিকিৎসাশাস্ত্রের গবেষকরা এ ব্যাপারে এমন উদাসীন বা অজ্ঞ হয়ে পড়লেন যে হয় ভ্যারিওলেশনের একদা-প্রবল অস্তিত্ত্বই তাঁরা ভুলে গেলেন কিংবা তাকে কেবলমাত্র নেতিবাচক কাজ বা কুসংস্কার হিসেবে চিহ্নিত করলেন।
অনেকে বলেন ইংরেজরা আমাদের পদ্ধতি ‘চুরি করে’ ভ্যাক্সিন বানিয়েছিল। তাঁরা এটা খেয়াল করেন না, ভারতে বা চীনে দেশীয় পদ্ধতি কয়েক শতক ধরে থাকা সত্ত্বেও তার থেকে নিরাপদ টিকা আবিষ্কারের দিকে পদক্ষেপ নেওয়া হয়নি। এর কতগুলো সামাজিক রাজনৈতিক ও প্রাতিষ্ঠানিক কারণ ছিল—ছোট ছোট গণ্ডীবদ্ধ সমাজ ও রাজত্ব, নানা জাতের টিকাদারদের মধ্যে অভিজ্ঞতা বিনিময়ের অভাব ও ফলে টিকার তত্ত্ব নিয়ে কোনো নতুন ধারনা না গড়ে শীতলাপূজা আর আপ্তবাক্য আওড়ানো, ইউরোপের বৈজ্ঞানিক সোসাইটির মতো কিছুর অভাব, ইত্যাদি। কিন্তু বিপরীতে, যাঁরা জেনারের ভ্যাক্সিনকে একান্ত পাশ্চাত্যের দান বলে ভাবেন, তাঁরাও কি ইতিহাসকে অস্বীকার করেন না? মজা হল, দেশীয় টিকার ইতিহাসকে এমনকি চেষ্টা করে অস্বীকার করার কাজটুকুও করতে হয়না, কেননা এই ইতিহাসটাই লোপাট হয়ে গেছে! এবং সেই লোপাট করার কাজটা ইউরোপীয়রা একা করেনি। করেছে আমাদের ইউরোপ-মুখী দৃষ্টিভঙ্গিও।
এই করোনা-কালে এই আকালে আমরা কি কেবল ইউরোপ-আমেরিকার দিকে তাকিয়ে থাকার হাত থেকে নিজেদের মুক্ত করতে কোনো ভাবনাই ভাবব না? নাকি, ভ্যারিওলেশনের মতো অত্যন্ত বস্তুবাদী দৃষ্টিভঙ্গির কর্মপ্রণালীর সঙ্গে আমরা যেমন সেকালে শীতলাপুজোর মন্ত্র মিশিয়েছিলাম, আজও আমরা বৈজ্ঞানিক ওষুধের সঙ্গে গঙ্গাজল মিশিয়ে এক বিরিঞ্চিবাবা-ককটেল তৈরির সাধনায় মগ্ন থাকব?
পাদটীকা ১-- দেশীয় পদ্ধতিতে টিকাদারের রোজগার খুব খারাপ হত না, তবে বছরে ১২,০০০ টাকা প্রায় অসম্ভব ছিল। সাধারণত এদের আয় হত মাসে এক’শ টাকার নীচে।৫ প্রসঙ্গত, এই সময়ে অবস্থাপন্ন মানুষদের রোজগার কীরকম ছিল? এর ১৫ বছর আগে মেডিক্যাল কলেজ তৈরির সময় ঐ মধুসূদন গুপ্ত ভারতীয় শিক্ষকদের মধ্যে সর্বাধিক বেতন পেতেন, মাসে ষাট টাকা, আর সাহেব অধ্যক্ষ পেতেন তাঁর কুড়িগুণ, মাসে ১২০০ টাকা।
হলওয়েল সাহেব। ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির সার্জেন। অন্ধকূপ হত্যা নিয়ে সত্য-মিথ্যা মিশিয়ে একটি বইতে সিরাউদ্দৌলা তথা তৎকালীন ভারতীয় শাসকদের কলঙ্কিত করেছিলেন। হলওয়েল সাহেব কিছুদিন পরে বাংলা থেকে ইংল্যান্ডে ফিরে যান।তাঁর ১৭৬৭ সালে লেখা গুটিবসন্তের টিকার বিবরণ হচ্ছে এ-বিষয়ে ইউরোপীয়দের বিবরণগুলোর মধ্যে অন্যতম প্রাচীন।_(৫)_

কী লিখেছিলেন হলওয়েল?
"ব্রাহ্মণদের বিশেষ গোষ্ঠি ... প্রতি বছর এই কাজ করত... বৃন্দাবন, বারাণসী ও এলাহাবাদ থেকে ছোট ছোট দলে [গুটিবসন্ত] রোগের সময়ের আগে এসে...।... একটা ছোট যন্ত্র দিয়ে তারা [চামড়ায়, সাধারণত হাতে] সামান্য রক্ত বেরনোর মতো ক্ষত করত, তারপর তারা দুভাঁজ করা কাপড়ের বটুয়া (যা তারা তাদের কোমরের কাপড়ে সবসময় বেঁধে রাখত) থেকে ছোট একটুকরো তুলোয় করে গুটিবসন্তের জিনিস দু-তিন ফোঁটা গঙ্গাজলে ভিজিয়ে, ঐ ক্ষততে লাগাত, তারপর একটা সামান্য ব্যান্ডেজ দিয়ে দিত, হুকুম করত যেন ছয়ঘন্টার মধ্যে ঐ ব্যান্ডেজ খোলা না হয়।_(৬)_
গর্ভবতী নারী, আগে টিকা পায়নি এমন মানুষ, যাদের গুটিবসন্ত হতে পারে তেমন লোকদের সদ্য টিকা দেওয়া মানুষের কাছাকাছি আসতে বারণ করা হত—কারণ কাছাকাছি এলে তাদের গুটিবসন্তের খারাপ আক্রমণ হতে পারত। যাকে টিকা দেওয়া হত তার খাবারদাবার সম্পর্কে কঠিন বাধানিষেধ আরোপ করা হত। টিকা দেবার পরে তার গায়ে যতদিন জ্বর না আসছে ততদিন তাকে বারবার ঠাণ্ডা জলে স্নান করানো হত, আর সাধারণত ছ’দিনের মাথায় জ্বর আসত। তখন দিন-তিনেক স্নান বন্ধ রাখা হত। তারপর গুটি বেরত। তখন আবার যতদিন গুটি পেকে খোসা না উঠছে, ততদিন বারংবার স্নান করানো শুরু হত। সেই সময় কাঁটা দিয়ে গুটির পুঁজ বের করে রোগীর কষ্ট দূর করা হত, আর পরের বছর টিকা দেবার মালমশলা সংগ্রহও হত। টিকা দেবার জিনিসটি সর্বদা আগের বছর সংগৃহীত রস, যা শুকিয়ে রাখা হত।"
হলওয়েল লিখেছেন, কেবল দক্ষ ব্রাহ্মণেরা টিকা দেবার কাজ করতেন। সাধারণত তাঁরা এলাহাবাদ, বারাণসী, বৃন্দাবন প্রভৃতি সুদূর হিন্দু পবিত্রভূমি থেকে আসতেন। টিকা দেবার পুরো সময়টাতে তাঁরা ‘অথর্ব বেদ’-এর মন্ত্র পড়তেন। হলওয়েল সাহেবের উদ্দিষ্ট পাঠকরা ছিলেন ব্রিটিশ ডাক্তাররা, বিশেষ করে রয়্যাল সোসাইটির সদস্যরা। হলওয়েল যখন লিখছিলেন তখন একই ভ্যারিওলেশন পদ্ধতি তুরস্ক থেকে ইংল্যান্ডে ঢুকেছে, তার কার্যকারিতা ও নিরাপত্তা নিয়ে ইংরেজ ডাক্তারদের সন্দেহ ছিল। ভ্যারিওলেশন হিন্দু সমাজের মাথা অর্থাৎ ব্রাহ্মণদের কাজ, বেদমন্ত্র পাঠের সঙ্গে করা হত, এমন বললে ইংরেজ ডাক্তারদের কাছে এটি বেশি গ্রহণযোগ্য হত। ভারত সম্পর্কে যেসব ইংরেজ ডাক্তার খবর রাখতেন, তাদের কাছে ব্রাহ্মণদের পরিচয় ছিল সুপ্রাচীন ভারতীয় সভ্যতার প্রতিনিধি হিসাবে।
আসলে কিন্তু ভ্যারিয়েলেশন কেবল ব্রাহ্মণদের একচেটিয়া ছিল না, আর পদ্ধতিটি সবসময় একই রকম থাকত না। সে কথায় পরে আসব।
সৌভাগ্যক্রমে হলওয়েল ছাড়াও আরও কিছু ব্যক্তির এই বিষয়ে ইংরাজিতে লেখা পাওয়া গেছে। এমন একজন হলেন রাধাকান্ত দেব। হলওয়েলের বিবরণের প্রায় পঞ্চাশ বছর পরে ১৮৩১ সালে রাধাকান্ত লিখেছেন—
“ফাল্গুন মাসের কোনো পবিত্র দিনে সুস্থ বাচ্চা ছেলে বা মেয়েকে টিকাদারেরা টিকা দিত। তাদের ওপরহাতে ছুঁচলো কোনো জিনিস বিঁধিয়ে দেওয়া হত, আর আগে তুলোতে লাগিয়ে রাখা পুঁজ ঢুকিয়ে দেওয়া হত। পুঁজ সংগ্রহ করা হত আগের কোনো প্রাকৃতিক গুটিবসন্তের পাকা গুটি থেকে। বাচ্চাদের জ্বর না আসা পর্যন্ত বারবার স্নান করানো আর ঝাল ও রসাল খাবার খাওয়ানো হত, ষষ্ঠ বা সপ্তম দিনে জ্বর আসত আর গুটিবসন্ত বের হত। তার তিনদিনের মাথায় জ্বর চলে যেত, গুটিগুলো থাকত, আর [গুটি বেরনোর] পঞ্চমদিনে সেগুলোর ওপর জল ঢেলে সেগুলো ভালভাবে বের করা হত। সাতদিনের মাথায় গুটির ওপরে কাঁচাহলুদ মাখানো হত যাতে সেগুলো তাড়াতাড়ি পাকে। নবম বা দশম দিনে গুটিগুলো পাকত, তখন বৈঁচির কাঁটা দিয়ে সেগুলো ফুটো করে দেওয়া হত। এই হল চিকিৎসা, আর এটা তিনসপ্তাহের মধ্যে বন্ধ করে দেওয়া হত, আর রোগী দিব্যি ভাল হয়ে যেত। পুরো সময়টা রোগী আর রোগীর বাড়ির লোকেদের খুব সাবধানে ও আলাদা ঘরে রাখা হত। কোনো অপরিচ্ছন্ন মানুষকে সেখানে ঢুকতে দেওয়া হত না। রোগীর বাবা-মা আর বাড়ির লোকেরা শুচিভাবে থাকতেন, আর দেবী শীতলার পুজো করতেন—শীতলা হলেন বসন্তরোগ আদি গায়ে ফুটে বেরনোর রোগসমূহের অধিষ্ঠাত্রী দেবী। টিকাদারদের বাড়ির অবস্থা অনুযায়ী পারিশ্রমিক দেওয়া হত, তবে সাধারণত দরিদ্ররা টিকাপিছু একটাকা আর অবস্থাপন্নরা দু’টাকা দিতেন।”
দেখা যাচ্ছে টিকা দেবার মূল ব্যাপারটা হলওয়েল আর রাধাকান্ত দেব মোটামুটি একরকমই বলেছিলেন। শীতলার পুজো, মন্ত্র আওড়ানো ইত্যাদি নিয়ে কেউ কেউ অন্যরকম বলেছেন। মূল বিতর্ক হল টিকা দেবার জিনিসটা কী, তাই নিয়ে। হলওয়েল আর রাধাকান্ত দেব দুজনেই বলছেন তুলোয় টিকার বীজ থাকত, আর টিকা দেবার পরে গায়ে গুটি বেরোলে তার পুঁজ সংগ্রহ করা হত, যা দিয়ে অন্যদের টিকা দেওয়া হত।
তবে যে বছর গুটি থেকে রস সংগ্রহ করা হত, সে বছরই সেই রস টিকার মাধ্যমে অন্যের ওপর প্রয়োগ করা হত কিনা, এ-ব্যাপারে রাধাকান্ত দেব স্পষ্ট করে কিছু বলেন নি।
• হলওয়েল এবং অন্য কয়েকজনের বক্তব্যে আমরা দেখছি, আগের বছরের গুটির রস নিয়ে টিকা দেওয়া হত।
• আবার অন্য লেখাতে পাচ্ছি, একজনকে টিকা দিয়ে সে-বছরই সেই রোগীর গুটির রস টিকা হিসেবে ব্যবহার করা হত।
এখন এই সিদ্ধান্ত সমগ্র প্রক্রিয়াটির ক্ষেত্রে কিন্তু যথেষ্ট গুরুত্বপূর্ণ। টিকার রস কয়েকদিনের মধ্যে ব্যবহার করলে তাতে অন্য জীবাণু (বিশেষ করে টিবি ও সিফিলিস) বেঁচে থাকার ও সেই সব রোগ ছড়াবার সম্ভাবনা বেশি। আবার, একবছর পরে ব্যবহার করলে গুটিবসন্তের বীজাণু না-ও বেঁচে থাকতে পারে, বা কম সংখ্যক হয়ে যেতে পারে, এমনকি কমজোরিও হয়ে যেতে পারে।
টিকার পদ্ধতিতে আরও কিছু রকমফের ছিল। ‘নীচু’ ব্রাহ্মণ ছাড়াও মালাকার/মালি, কুম্ভকার, শঙ্খকার, তাঁতি, নাপিত ইত্যাদিরা টিকা দেবার কাজ করতেন। এদের অধিকাংশই কাছেপিঠের শহর-গ্রাম থেকে আসতেন, বারাণসীর মতো দূরদেশ বা ‘পবিত্রভূমি’ থেকে আসা টিকাকার কমই ছিল। তবে টিকা নেবার ব্যাপারে জাতিভেদ ছিল। উঁচুজাতের বালকের হাতে টিকা দিয়ে সেই টিকার স্থানে হওয়া ফুস্কুড়ি থেকে রস নিয়ে টিকা দিতে চাইতেন সকলে।
আগের বছরের গুটিবসন্তের গুটি থেকে রস সংগ্রহ করে রাখা ও পরের বছর সেই রস দিয়ে টিকা দেওয়া চলত। আবার একজনের (সাধারণত ব্রাহ্মণ বালকের) হাতে টিকা দিয়ে তার টিকার জায়গাটা দিন আট-দশ পরে ফোঁড়ার মতো পেকে গেলে সেই জায়গা থেকে রস নিয়ে সেবছরই অন্যদের টিকা দেওয়ার প্রক্রিয়াও প্রচলিত ছিল ।

আগে দেখেছি ইউরোপ এই ভ্যারিওলেশন টিকা নিয়ে গুটিবসন্তের প্রকোপ থেকে খানিকটা রক্ষা পায়। ভারতে এই টিকা কতটা চালু ছিল? ব্রিটিশ-পূর্ব ভারত নিয়ে তেমন তথ্য জানা নেই, কিন্তু ব্রিটিশ আসার পরে কিছু কৌতূহলোদ্দীপক তথ্য আছে।
হলওয়েল সাহেব। ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির সার্জেন। অন্ধকূপ হত্যা নিয়ে সত্য-মিথ্যা মিশিয়ে একটি বইতে সিরাউদ্দৌলা তথা তৎকালীন ভারতীয় শাসকদের কলঙ্কিত করেছিলেন। হলওয়েল সাহেব কিছুদিন পরে বাংলা থেকে ইংল্যান্ডে ফিরে যান।তাঁর ১৭৬৭ সালে লেখা গুটিবসন্তের টিকার বিবরণ হচ্ছে এ-বিষয়ে ইউরোপীয়দের বিবরণগুলোর মধ্যে অন্যতম প্রাচীন।_(৫)_

কী লিখেছিলেন হলওয়েল?
"ব্রাহ্মণদের বিশেষ গোষ্ঠি ... প্রতি বছর এই কাজ করত... বৃন্দাবন, বারাণসী ও এলাহাবাদ থেকে ছোট ছোট দলে [গুটিবসন্ত] রোগের সময়ের আগে এসে...।... একটা ছোট যন্ত্র দিয়ে তারা [চামড়ায়, সাধারণত হাতে] সামান্য রক্ত বেরনোর মতো ক্ষত করত, তারপর তারা দুভাঁজ করা কাপড়ের বটুয়া (যা তারা তাদের কোমরের কাপড়ে সবসময় বেঁধে রাখত) থেকে ছোট একটুকরো তুলোয় করে গুটিবসন্তের জিনিস দু-তিন ফোঁটা গঙ্গাজলে ভিজিয়ে, ঐ ক্ষততে লাগাত, তারপর একটা সামান্য ব্যান্ডেজ দিয়ে দিত, হুকুম করত যেন ছয়ঘন্টার মধ্যে ঐ ব্যান্ডেজ খোলা না হয়।_(৬)_
গর্ভবতী নারী, আগে টিকা পায়নি এমন মানুষ, যাদের গুটিবসন্ত হতে পারে তেমন লোকদের সদ্য টিকা দেওয়া মানুষের কাছাকাছি আসতে বারণ করা হত—কারণ কাছাকাছি এলে তাদের গুটিবসন্তের খারাপ আক্রমণ হতে পারত। যাকে টিকা দেওয়া হত তার খাবারদাবার সম্পর্কে কঠিন বাধানিষেধ আরোপ করা হত। টিকা দেবার পরে তার গায়ে যতদিন জ্বর না আসছে ততদিন তাকে বারবার ঠাণ্ডা জলে স্নান করানো হত, আর সাধারণত ছ’দিনের মাথায় জ্বর আসত। তখন দিন-তিনেক স্নান বন্ধ রাখা হত। তারপর গুটি বেরত। তখন আবার যতদিন গুটি পেকে খোসা না উঠছে, ততদিন বারংবার স্নান করানো শুরু হত। সেই সময় কাঁটা দিয়ে গুটির পুঁজ বের করে রোগীর কষ্ট দূর করা হত, আর পরের বছর টিকা দেবার মালমশলা সংগ্রহও হত। টিকা দেবার জিনিসটি সর্বদা আগের বছর সংগৃহীত রস, যা শুকিয়ে রাখা হত।"
হলওয়েল লিখেছেন, কেবল দক্ষ ব্রাহ্মণেরা টিকা দেবার কাজ করতেন। সাধারণত তাঁরা এলাহাবাদ, বারাণসী, বৃন্দাবন প্রভৃতি সুদূর হিন্দু পবিত্রভূমি থেকে আসতেন। টিকা দেবার পুরো সময়টাতে তাঁরা ‘অথর্ব বেদ’-এর মন্ত্র পড়তেন। হলওয়েল সাহেবের উদ্দিষ্ট পাঠকরা ছিলেন ব্রিটিশ ডাক্তাররা, বিশেষ করে রয়্যাল সোসাইটির সদস্যরা। হলওয়েল যখন লিখছিলেন তখন একই ভ্যারিওলেশন পদ্ধতি তুরস্ক থেকে ইংল্যান্ডে ঢুকেছে, তার কার্যকারিতা ও নিরাপত্তা নিয়ে ইংরেজ ডাক্তারদের সন্দেহ ছিল। ভ্যারিওলেশন হিন্দু সমাজের মাথা অর্থাৎ ব্রাহ্মণদের কাজ, বেদমন্ত্র পাঠের সঙ্গে করা হত, এমন বললে ইংরেজ ডাক্তারদের কাছে এটি বেশি গ্রহণযোগ্য হত। ভারত সম্পর্কে যেসব ইংরেজ ডাক্তার খবর রাখতেন, তাদের কাছে ব্রাহ্মণদের পরিচয় ছিল সুপ্রাচীন ভারতীয় সভ্যতার প্রতিনিধি হিসাবে।
আসলে কিন্তু ভ্যারিয়েলেশন কেবল ব্রাহ্মণদের একচেটিয়া ছিল না, আর পদ্ধতিটি সবসময় একই রকম থাকত না। সে কথায় পরে আসব।
সৌভাগ্যক্রমে হলওয়েল ছাড়াও আরও কিছু ব্যক্তির এই বিষয়ে ইংরাজিতে লেখা পাওয়া গেছে। এমন একজন হলেন রাধাকান্ত দেব। হলওয়েলের বিবরণের প্রায় পঞ্চাশ বছর পরে ১৮৩১ সালে রাধাকান্ত লিখেছেন—
“ফাল্গুন মাসের কোনো পবিত্র দিনে সুস্থ বাচ্চা ছেলে বা মেয়েকে টিকাদারেরা টিকা দিত। তাদের ওপরহাতে ছুঁচলো কোনো জিনিস বিঁধিয়ে দেওয়া হত, আর আগে তুলোতে লাগিয়ে রাখা পুঁজ ঢুকিয়ে দেওয়া হত। পুঁজ সংগ্রহ করা হত আগের কোনো প্রাকৃতিক গুটিবসন্তের পাকা গুটি থেকে। বাচ্চাদের জ্বর না আসা পর্যন্ত বারবার স্নান করানো আর ঝাল ও রসাল খাবার খাওয়ানো হত, ষষ্ঠ বা সপ্তম দিনে জ্বর আসত আর গুটিবসন্ত বের হত। তার তিনদিনের মাথায় জ্বর চলে যেত, গুটিগুলো থাকত, আর [গুটি বেরনোর] পঞ্চমদিনে সেগুলোর ওপর জল ঢেলে সেগুলো ভালভাবে বের করা হত। সাতদিনের মাথায় গুটির ওপরে কাঁচাহলুদ মাখানো হত যাতে সেগুলো তাড়াতাড়ি পাকে। নবম বা দশম দিনে গুটিগুলো পাকত, তখন বৈঁচির কাঁটা দিয়ে সেগুলো ফুটো করে দেওয়া হত। এই হল চিকিৎসা, আর এটা তিনসপ্তাহের মধ্যে বন্ধ করে দেওয়া হত, আর রোগী দিব্যি ভাল হয়ে যেত। পুরো সময়টা রোগী আর রোগীর বাড়ির লোকেদের খুব সাবধানে ও আলাদা ঘরে রাখা হত। কোনো অপরিচ্ছন্ন মানুষকে সেখানে ঢুকতে দেওয়া হত না। রোগীর বাবা-মা আর বাড়ির লোকেরা শুচিভাবে থাকতেন, আর দেবী শীতলার পুজো করতেন—শীতলা হলেন বসন্তরোগ আদি গায়ে ফুটে বেরনোর রোগসমূহের অধিষ্ঠাত্রী দেবী। টিকাদারদের বাড়ির অবস্থা অনুযায়ী পারিশ্রমিক দেওয়া হত, তবে সাধারণত দরিদ্ররা টিকাপিছু একটাকা আর অবস্থাপন্নরা দু’টাকা দিতেন।”
দেখা যাচ্ছে টিকা দেবার মূল ব্যাপারটা হলওয়েল আর রাধাকান্ত দেব মোটামুটি একরকমই বলেছিলেন। শীতলার পুজো, মন্ত্র আওড়ানো ইত্যাদি নিয়ে কেউ কেউ অন্যরকম বলেছেন। মূল বিতর্ক হল টিকা দেবার জিনিসটা কী, তাই নিয়ে। হলওয়েল আর রাধাকান্ত দেব দুজনেই বলছেন তুলোয় টিকার বীজ থাকত, আর টিকা দেবার পরে গায়ে গুটি বেরোলে তার পুঁজ সংগ্রহ করা হত, যা দিয়ে অন্যদের টিকা দেওয়া হত।
তবে যে বছর গুটি থেকে রস সংগ্রহ করা হত, সে বছরই সেই রস টিকার মাধ্যমে অন্যের ওপর প্রয়োগ করা হত কিনা, এ-ব্যাপারে রাধাকান্ত দেব স্পষ্ট করে কিছু বলেন নি।
• হলওয়েল এবং অন্য কয়েকজনের বক্তব্যে আমরা দেখছি, আগের বছরের গুটির রস নিয়ে টিকা দেওয়া হত।
• আবার অন্য লেখাতে পাচ্ছি, একজনকে টিকা দিয়ে সে-বছরই সেই রোগীর গুটির রস টিকা হিসেবে ব্যবহার করা হত।
এখন এই সিদ্ধান্ত সমগ্র প্রক্রিয়াটির ক্ষেত্রে কিন্তু যথেষ্ট গুরুত্বপূর্ণ। টিকার রস কয়েকদিনের মধ্যে ব্যবহার করলে তাতে অন্য জীবাণু (বিশেষ করে টিবি ও সিফিলিস) বেঁচে থাকার ও সেই সব রোগ ছড়াবার সম্ভাবনা বেশি। আবার, একবছর পরে ব্যবহার করলে গুটিবসন্তের বীজাণু না-ও বেঁচে থাকতে পারে, বা কম সংখ্যক হয়ে যেতে পারে, এমনকি কমজোরিও হয়ে যেতে পারে।
টিকার পদ্ধতিতে আরও কিছু রকমফের ছিল। ‘নীচু’ ব্রাহ্মণ ছাড়াও মালাকার/মালি, কুম্ভকার, শঙ্খকার, তাঁতি, নাপিত ইত্যাদিরা টিকা দেবার কাজ করতেন। এদের অধিকাংশই কাছেপিঠের শহর-গ্রাম থেকে আসতেন, বারাণসীর মতো দূরদেশ বা ‘পবিত্রভূমি’ থেকে আসা টিকাকার কমই ছিল। তবে টিকা নেবার ব্যাপারে জাতিভেদ ছিল। উঁচুজাতের বালকের হাতে টিকা দিয়ে সেই টিকার স্থানে হওয়া ফুস্কুড়ি থেকে রস নিয়ে টিকা দিতে চাইতেন সকলে।
আগের বছরের গুটিবসন্তের গুটি থেকে রস সংগ্রহ করে রাখা ও পরের বছর সেই রস দিয়ে টিকা দেওয়া চলত। আবার একজনের (সাধারণত ব্রাহ্মণ বালকের) হাতে টিকা দিয়ে তার টিকার জায়গাটা দিন আট-দশ পরে ফোঁড়ার মতো পেকে গেলে সেই জায়গা থেকে রস নিয়ে সেবছরই অন্যদের টিকা দেওয়ার প্রক্রিয়াও প্রচলিত ছিল ।

আগে দেখেছি ইউরোপ এই ভ্যারিওলেশন টিকা নিয়ে গুটিবসন্তের প্রকোপ থেকে খানিকটা রক্ষা পায়। ভারতে এই টিকা কতটা চালু ছিল? ব্রিটিশ-পূর্ব ভারত নিয়ে তেমন তথ্য জানা নেই, কিন্তু ব্রিটিশ আসার পরে কিছু কৌতূহলোদ্দীপক তথ্য আছে।
সেন্সাস বা জনগণনা। যিশুর জন্মের সময় নাকি সেখানকার রাজা জনগণনার জন্য সমস্ত লোককে একজায়গা থেকে আরেক জায়গায় নিয়ে যাচ্ছিলেন, আর তাই নাকি আস্তাবলে যিশুর জন্ম হয় (সাধু লুকের সুসমাচার)। জনগণনা খুব প্রাচীন পদ্ধতি হলেও, নিয়মিত সেন্সাসের চল সভ্যতার নিরিখে নেহাতই অল্পদিনের, আর তাতে রোগ ব্যাধি বা টিকাকরণের সংখ্যা গুনে রাখা একেবারেই হাল আমলের ব্যাপার। তাই বাংলায় ১৭৫৭ সালের পর থেকে কার্যত বৃটিশ শাসন প্রতিষ্ঠিত হলেও সে-সময় কতজন দেশীয় পদ্ধতিতে টিকা নিয়েছিল, সেটা জানা একান্ত অসম্ভব। অবশ্য ইউরোপের ক্ষেত্রেও তাই। কিন্তু এদেশে একশ’ বছর সাম্রাজ্য চালানোর পরে, বিশেষ করে সিপাহী যুদ্ধের পরে, বৃটিশরা বুঝল সেন্সাস জাতীয় কিছু তথ্য উপনিবেশ চালানোর জন্য একান্তই জরুরি। যেমন সিপাইদের তথ্য। যেমন স্কুলের তথ্য। শ্রমিকদের তথ্য। জেলখানার তথ্য।
প্রথমে জেলখানার তথ্যেই আসি। ঊনবিংশ শতকের মাঝামাঝি বেঙ্গল প্রেসিডেন্সির জেলবন্দীদের সরকারি পরিসংখ্যানে দেখা যে শতকরা ষাটভাগেরও বেশি বন্দী দেশীয় পদ্ধতির টিকা নিয়েছেন। জেলে যারা যায় তাদের সামাজিক অবস্থা গড়পড়তা মানুষের চাইতে খারাপ হয়। তাই জেলবন্দীদের মধ্যে শতকরা ষাট জন ভ্যারিওলেশন করে থাকলে জনসাধারণের মধ্যে এই সংখ্যাটা আরও বেশি হবার কথা।


১৮৭২-৭৩ সালে সরকার বাহাদুর সতের হাজারের কিছু বেশি মানুষের ওপর একটা সমীক্ষা করেন। তার মধ্যে ছিল জেলবন্দী, স্কুলছাত্র, সরকারি ডিসপেন্সারিতে আসা নানা রোগী, আর কিছু শ্রমিক। দেখা গেল তাদের মধ্যে শতকরা ৬৬ ভাগ দেশীয় পদ্ধতিতে টিকা নিয়েছে আর মাত্র ৫ ভাগ জেনারের সরকারি টিকা নিয়েছেন। খেয়াল রাখতে হবে ততদিনে এদেশে জেনারের পদ্ধতি সত্তর বছর ধরে চালু আছে। আরেকটা জিনিস লক্ষ্য করার মতো। বাকিদের মধ্যে শতকরা ১৮ ভাগের গুটিবসন্ত হয়ে গেছে, অর্থাৎ তাদের কোনো টিকার দরকার নেই। বাকি মাত্র ১১ ভাগ কোনোরকম সুরক্ষা পায়নি।
সমস্ত তথ্য মিলে আমরা এখন জানি, দেশীয় এই টিকা তখন বাংলা প্রেসিডেন্সিতে খুবই চালু ছিল। এই অঞ্চলের তখনকার জনসংখ্যার শতকরা প্রায় ২০ ভাগ ছিল ‘অন্ত্যজ অস্পৃশ্য’। তারা বাদে বাংলা, ঊড়িষ্যা, বিহার ও আসাম-এর প্রায় প্রত্যেকেই টিকা নিতেন। সারা ভারতের চিত্র অবশ্য এরকম ছিল না। সারা ভারতে্র মধ্যে সুবে বাংলাতে প্রথম ইংরেজ শাসন স্থাপিত হয়, সেখানে দেশীয় টিকা খুব চালু ছিল। সুবে বাংলা বলতে বর্তমান দুই বাংলা, বিহার, উড়িষ্যা। বাকি ভারতের মধ্যে বর্তমান উত্তরপ্রদেশের পূর্বাংশে, গুজরাট, মহারাষ্ট্রের উপকূল এলাকা, পশ্চিম পাঞ্জাব থেকে সিন্ধ অঞ্চলে, রাজস্থানের কোথাও কোথাও, কুমায়ুন, তামিলনাড়ুর উত্তরদিক—এসব জায়গায় দেশী টিকা কমবেশি চালু ছিল। এছাড়া বাকি ভারতে দেশীয় টিকা চালু ছিল বলে জানা যায় নি।
বাংলায় টিকাকারের কাজ করতেন ‘নীচু’ ব্রাহ্মণ, মালাকার/মালি, কুম্ভকার, শঙ্খকার, তাঁতি, নাপিত ইত্যাদিরা। এদের অধিকাংশই কাছেপিঠের শহর-গ্রাম থেকে আসতেন, বাংলার বাইরে আবার এসব জাতের মানুষ ছাড়াও অন্যান্য জাতের লোকেরা টিকাকার ছিলেন, যেমন কুনবি, সিন্দুরিয়া, আর রোজা। রোজা বা ওঝাদের সাধারণ কাজ ছিল ঝাড়ফুঁক। তাই টিকাকরণ একদিকে লোকধর্মের অনুসঙ্গ হিসাবে ছিল, অন্যদিকে প্রান্তিক মানুষের অপদেবতায় বিশ্বাস ইত্যাদির সাথে ঠাঁই করে নিয়েছিল বলে মনে হয়।
ব্রাহ্মণ্য শাস্ত্রীয় বিধান বা আয়ুর্বেদ থেকে উৎপন্ন হয়ে টিকার প্রথাটি লোকধর্মে মিশেছিল, নাকি লোকধর্ম থেকে ব্রাহ্মণত্ব অর্জন করেছিল, নাকি উভয় দিক থেকেই একত্রে এসেছিল, তার বিচার করা এখন কার্যত অসম্ভব। আরও উল্লেখ্য হল, বাংলার বাইরে অন্তত টিকাকারদের মধ্যে মুসলমান ছিলেন, আবার গোয়ার মতো জায়গায় ক্যাথলিক পাদ্রিরাও ছিলেন। এরা শীতলা মন্ত্র জপ করতেন কিনা তা অবশ্য জানতে পারিনি।
কিন্তু এ-সত্ত্বেও ভ্যারিওলেশন সর্বভারতীয় প্রথা হয়ে উঠতে পারেনি। বারাণসীর পশ্চিমদিকে দিল্লি পর্যন্ত গোটা উত্তরভারত, নেপাল, তখনকার হায়দারাবাদ, মাইশোর ও মাদ্রাজ প্রেসিডেন্সি (অর্থাৎ গোটা দক্ষিণ ভারত) ও নেপালে এই টিকা চালু থাকার কোনো প্রমাণ নেই। মহারাষ্ট্র ও মধ্যপ্রদেশের কিছু কিছু অঞ্চল ছাড়া টিকার প্রমাণ মেলেনি।
তবে উল্লেখ করার মতো বিষয় হল অষ্টাদশ শতকের শেষদিকে কলকাতা বা বাংলায় ইংরেজদের মধ্যে দেশী টিকার প্রচলন হয়েছিল। ১৭৮০ থেকে ১৮০০ সাল পর্যন্ত এখানকার ইংরেজরা দেশীয় টিকা নিতেন, কিন্তু সেটা এ-দেশের সংস্কার হিসেবে নয়। আগেই আমরা দেখেছি, সেই সময় ইংল্যান্ডে ভ্যারিওলেশন প্রচলিত হয়েছে। এদেশে বসবাসকারী ইংরেজ তারপরে বুঝতে পারেন ভারতে দেশী টিকা নেওয়া দরকার।
ইউরোপে ভারিওলেশন-কে সরিয়ে জেনারের টিকা চালু হবার পরে, এদেশেও দেশীয় পদ্ধতি সম্পর্কে বৃটিশ মনোভাবের দ্রুত পরিবর্তন ঘটে। ইউরোপে চালু হবার প্রায় সঙ্গে সঙ্গে ১৮০২ সালে ভারতে জেনারের ভ্যাক্সিনের আগমন ঘটে। অবশ্য ভারতে বসবাসকারী ইংরেজ ও অন্যান্য ইউরোপীয়রা তার প্রথম লক্ষ্য ছিল। জেনারের ভ্যাক্সিন এদেশের ইংরেজদের এই প্রথম একটা নিরাপদ ও ইউরোপীয় বাঁচার পথ দেখাল। গুটিবসন্তের ভয় থেকে তারা নিজেদের পুরো মুক্ত করতে পারবে, আর তার জন্য কোনো বিজাতীয় (অর্থাৎ ভারতীয়) প্রথার কাছে আত্মসমর্পণ করতে হবে না, এমন আশ্বাস পেয়ে এদেশের ইংরেজরা কলকাতা, মাদ্রাজ ও বোম্বে থেকে ১৮০৬ সালে মোট প্রায় আট হাজার পাউন্ড পাঠাল। জেনারের কাছে সে টাকার মূল্য বড় কম নয়। আমরা আগে দেখেছি বৃটিশ পার্লামেন্ট স্বয়ং জেনারকে সর্বসাকূল্যে ত্রিশহাজার পাউন্ড দিয়েছিল।
জেনারের টিকার প্রথম লক্ষ্য ছিল ইউরোপীয়রা। কিন্তু করোনা-র সময় আমরা যেমন দেখছি, ছোঁয়াচে রোগের জন্য একা নিরাপদ থাকা যায় না, আশেপাশের সবাই নিরাপদ থাকলে তবেই আপনি নিরাপদ, জেনারের টিকা নিয়েও বৃটিশ সরকার সেরকম ভেবেছিল। ইউরোপীয়দের পরে তাদের টিকা দেবার লক্ষ্য হল ইউরোপীয়দের কাছে থাকা মানুষজন। বাড়ির চাকরবাকর, সিপাহী, সে সময় ইউরোপীয়দের হাতে গড়া অর্থকরী ফসল নীল ও আফিম ক্ষেতের শ্রমিক। এদের ভ্যাক্সিন দেওয়া হল। আর যেহেতু ভ্যারিওলেশন থেকে গুটিবসন্ত ছড়ানোর সামান্য হলেও সম্ভাবনা আছে, এদের ভারতীয় টিকা নিষিদ্ধ হল।
এরপর ইউরোপীয়দের দাবি উঠবে, তাদের উপনিবেশে অর্থাৎ গোটা ভারতে ভ্যারিওলেশন বন্ধ করে ভ্যাক্সিনেশন চালু করতে হবে, নইলে তাদের নিজেদের নিরাপত্তা থাকে না যে! কিন্তু ভারতে সে কাজটি করা কি তেমন সহজ ছিল? কীভাবে ভ্যাক্সিনেশন চালু হয়েছিল? প্রাচীন দেশীয় পদ্ধতি ভ্যারিওলেশন আবার ভারতবাসীর ধর্মীয় আচরণের সঙ্গেও যুক্ত, তার বিলোপে কি কোনো বাধা আসেনি? আর, কেবলমাত্র ভারতে থাকা ইউরোপীয়দের নিরাপত্তা ছাড়া অন্য কোনো বোধ, কোনো সিভিলাইজিং মিশন কি বৃটিশকে এদেশে ভ্যারিওলেশন তুলে ভ্যাক্সিনেশন চালু করাতে অনুপ্রাণিত করেনি?
ট্রপিক্যাল মেডিসিন। কথাটা ইউরোপীয়দের তৈরি। মূলত ভারতে এসে ইংরেজ ডাক্তাররা এদেশের রোগ নিয়ে ভারতের রোগ, বাংলার রোগ, ইত্যাদি শব্দবন্ধ ব্যবহার করত। একসময় এদের একটা সাধারণ নাম দিল, ট্রপিক্যাল রোগ। রোগ নিয়ে জার্ম থিয়োরি বা জীবাণুতত্ত্ব-র হাত ধরে প্রতিষ্ঠা পেল ট্রপিক্যাল রোগ-তত্ত্ব, কিন্তু তার জমি স্থাপিত ছিল জীবাণুতত্ত্বের বিজ্ঞানভূমির বাইরেও, ইউরোপীয় মননেই। চিকিৎসার জন্য হল আলাদা একটা বিভাগ, ট্রপিক্যাল মেডিসিন। ইউরোপীয়রা আফ্রিকা আর এশিয়ার যত জায়গা দখল-আধাদখল করেছিল সবই হল ট্রপিক। ভৌগলিকভাবে ট্রপিক্যাল মানে নিরক্ষরেখার পাশে উষ্ণ অঞ্চল। ট্রপিক্যাল রোগ হল ইউরোপ ও ইউরোপের বাইরে অন্য আবহাওয়ার রোগ, ইউরোপীয় মননে তা অন্য মানুষের রোগ। ইউরোপীয়দের সে রোগ আক্রমণ করছে বটে, তবে সেটা ঘটনাচক্রে।

কলেরা, ম্যালেরিয়া, পীতজ্বর, কালাজ্বর—এসব রোগ ছিল ট্রপিক্যাল মেডিসিনের চর্চার বিষয়। প্লেগ ও কুষ্ঠ ইউরোপে খুবই ছিল, কিন্তু সেখানে সভ্যতা বাড়ল, এসবের প্রকোপ কমল, ফলে এরাও ট্রপিক্যাল মেডিসিনের আওতায় এল। কেননা ট্রপিক্যাল অসুখ অন্য সভ্যতার, এমনকি, অ-সভ্যতার রোগও। এই কথাগুলো ট্রপিক্যাল মেডিসিনের টেক্সট-বইয়ে আলাদা করে বলার দরকার হয়নি। উপনিবেশ গড়তে গড়তে কয়েকশ’ বছর ধরে রোগ ও সভ্যতার এই সম্পর্ক পাশ্চাত্য ধারনায় গেঁথে গেছে। ট্রপিক্যাল মেডিসিন হল চিকিৎসার এমন একটা ধারা যা অন্যদের রক্ষা করার খাতিরে এই ‘অন্য’-দের জীবনযাত্রা বদলে সভ্য করে, অন্য-কে মূলধারায় আনে।


কিন্তু সমস্যা ছিল গুটিবসন্ত নিয়ে। এ কি ট্রপিকের অসুখ? ঐতিহাসিকভাবে গুটিবসন্ত কেবল ট্রপিকের অসুখ নয়। ইউরোপে তার প্রকোপ কম ছিল না। তার থেকে বড় কথা, ভ্যারিওলেশন গ্রহণ করছে যে ইউরোপ, সে কিন্তু নিজেকে পাল্টাচ্ছে, পাল্টাচ্ছে ভারত-চীন-তুরস্কের প্রথায়। অন্যকে বদল করে, সভ্য করে, স্যানিটাইজ করে অসুখ দূর করার প্রকল্পটি কলেরা বা ম্যালেরিয়ার ক্ষেত্রে চলছে। কিন্তু গুটিবসন্তের ক্ষেত্রে উলটপুরাণ! ভ্যারিওলেশনকে দায়ে পড়ে মেনে নেওয়া হয়েছিল বটে, কিন্তু ইউরোপের বিজ্ঞানচর্চার জগতে ছিল এক অবাঞ্ছিত দখলদার। রেঁনেসা পরবর্তী ইউরোপ যখন তার জ্ঞানরাজ্যকে এক যুক্তিগ্রাহ্য ও সামগ্রিক রূপ দিতে চাইছে, আর একাডেমিক সোসাইটিগুলি যেখানে প্রায়ই জাতি বা রাষ্ট্রের সীমানা ছাড়িয়ে জ্ঞান-বিনিময় করছে, সেখানে প্রাচ্যদেশীয় রহস্যময় টিকার আগমন পাশ্চাত্য শ্রেষ্ঠত্বকে ব্যাঙ্গ করছিল। পাশ্চাত্যের ‘নিজস্ব’ এবং কার্যকর কিছু দরকার ছিল। অপ্রাতিষ্ঠানিক ‘অবৈজ্ঞানিক’ চর্চার ধারা থেকে উদ্ভূত হয়েও জেনার-এর ভ্যাক্সিন পাশ্চাত্যের নিজস্বতার শ্রেষ্ঠত্বকে প্রতিষ্ঠা করল। ভ্যাক্সিন টিকা দেবার পদ্ধতি আত্মসাৎ করল ভ্যারিওলেশন থেকে, কিন্তু এই প্রাচ্য শিকড় ভুলে যাবার চেষ্টা জারি থাকল। উপকথায় গোয়ালিনীর গো-বসন্ত জায়গা পেল, কিন্তু ভ্যারিওলেশন পদ্ধতিকে জেনার হুবহু অনুসরণ করলেও তা বিস্মৃতিতে চলে গেল। পাশ্চাত্যের ইতিহাসবোধ বস্তুনিষ্ঠ সন্দেহ নেই!

ভারতে গুটিবসন্তের ভ্যাক্সিন এল উনবিংশ শতকের গোড়ার দিকে। প্রথমে তার লক্ষ্য ছিল দেশের ইউরোপীয়দের রক্ষা। কিন্তু ছোঁয়াচে অসুখ বলে ইউরোপীয়দের রক্ষা করার তাগিদে তাদের চারপাশের ভারতীয়দেরও রক্ষা করতেই হয়। ফলে বাড়ির চাকর, সিপাহী, খামারের মজুরচাষী—এদেরও ভ্যাক্সিন দেবার চেষ্টা করতে হল। এতদিন যে ইউরোপীয়রা ভারতে এসে ভারতীয় পদ্ধতিতে টিকা নিতে পেরে বেঁচেছে, আজ তার অবস্থান উলটে গেল। তার মনে হল গুটিবসন্তকে ভ্যাক্সিনে আটকানো যায়, আর ভারতীয়রা পুরনো টিকা দিয়ে এই রোগকে নিজের ঘরে ডেকে আনছে। বসন্তরোগের দেবীর পুজো সারা ভারতেই চালু ছিল—উত্তরে যিনি শীতলা দক্ষিণে তিনিই দেবী মারিয়াম্মা। ভ্যাক্সিন আসার পরে আত্মবিশ্বাসী ইউরোপীয়-মননে রোগের কাছে ভারতীয়দের এই আত্মসমর্পণ তাদের চারিত্রিক দুর্বলতার আরেকটা প্রকাশ হয়ে উঠল।
ভ্যাক্সিন দিয়ে ইউরোপীয়দের রক্ষা করা ঔপনিবেশিক রাষ্ট্রের প্রথম প্রয়োজন ছিল। কিন্তু পাশ্চাত্য চিকিৎসার ঔৎকর্ষ আর সভ্য ইংরাজ রাজত্বের প্রজা-হিতৈষণা, এ-দুটো একসাথে প্রকাশের জন্য ভারতীয়দের ভ্যাক্সিন যে ভারি সুবিধার, তা রাষ্ট্র দ্রুতই বুঝেছিল। উনবিংশ শতকের প্রথমে ভ্যাক্সিন আসার সময়ে ভারতের বড় অংশে বৃটিশ নিজের আধিপত্য বিস্তার করেছে ঠিকই, কিন্তু তখনও মারাঠাদের সঙ্গে লড়াই চলছে। উত্তর ও মধ্যভারতের বিরাট অংশে ইংরাজের প্রাধান্য স্বীকার করে নানা রাজা-বাদশা রাজত্ব করছেন। তাদের তুলনায় ইংরেজ রাজত্ব শ্রেয় বলে দেখানোর একটা তাগিদ বৃটিশের ছিল। এর বছর-পঞ্চাশ পরে অপশাসনের অভিযোগে দেশীয় রাজ্য (যেমন অওধ) দখল করবে কোম্পানি। নিজের সুশাসনের নিদর্শন রাখার দরকার কোম্পানি আগে থেকেই বুঝেছিল।
১৮০২ সালে প্রথম ভ্যাক্সিন চালু হল বোম্বেতে। তারপরে বোম্বের ইংরেজ গভর্নরের মন্তব্য ছিল, “এই একটা কাজের মধ্যে আমাদের প্রেস্টিজ বেড়েছে আর মানুষের কাছে আমাদের সম্পর্কে খুব ভাল ধারনা তৈরি করেছে।” ইংরেজরা ধরে নিয়েছিল ভারতের জনগণ তাদের এমন উপকার করায় খুব কৃতজ্ঞ থাকবে, আর হিন্দুদের পবিত্র জীব গোরুর শরীর থেকে এই ভ্যাক্সিন তৈরি হয়েছে বলে তারা খুব খুশি হবে। কিন্তু দু-এক বছরের মধ্যেই বোঝা গেল ভারতবাসী সহজে এই ভ্যাক্সিন মেনে নেবে না। অবশ্য ইউরোপে ভারিওলেশন ও তারপরে ভ্যাক্সিনেশন নিয়ে বিস্তর প্রতিরোধ ছিল, কিন্তু ভারতের লোকের যে ইউরোপীয়দের মতোই প্রত্যাখানের যুক্তি থাকতে পারে সেটা ইউরোপীয় শাসক ভাবল না, অন্তত সেরকম লিখল না কোথাও।

এখানে ইংরেজরা ভ্যাক্সিনেশনের ব্যর্থতার মধ্যে দেখলেন—“নেটিভদের কুসংস্কার ও কুঁড়েমি... তাদের ভাগ্যনির্ভরতা, যার ফলে তারা গুটিবসন্তের কাছে আত্মসমর্পন করে।” যে সব ইংরেজ ভাক্সিন দেবার কাজে কোনোভাবে যুক্ত ছিলেন তাদের প্রায় সকলের বক্তব্যের মূল সুর এক। হিন্দুরা সমস্ত আবিষ্কারের বিরুদ্ধে, আর খেটে খাওয়া মানুষগুলো স্টুপিড ও বোধহীন। তারা বোঝে না সরকারি ভ্যাক্সিন ব্যবস্থা কতটা আশীর্বাদ। হিন্দুধর্মের খারাপ প্রভাবে তাদের মন-বুদ্ধি বাঁধা পড়ে আছে, যুক্তিবোধ আচ্ছন্ন। যে বিষয় একেবারে সরাসরি তাদের পক্ষে লাভজনক, সেটা পাবার জন্যও তারা পুরনো প্রথা ত্যাগ করবে না। এরা যুক্তিহীন ধর্মবিশ্বাস আর জাতপ্রথার জন্য ভ্যাক্সিন কম নিচ্ছে। (১)


অন্যদিকে, ভ্যাক্সিনের বিফলতার অনেকটা দায় পড়ল দেশীয় টিকা অর্থাৎ ভ্যারিওলেশনের ওপর। ডা. হলওয়েলের বিবরণে আমরা দেখেছি যখন ইংল্যান্ডে ভ্যারিওলেশন চালু হচ্ছে তখন এদেশের সাহেব ডাক্তাররা এদেশীয় ভ্যারিওলেশনের গুণগান করতেন। এখন সাহেব ডাক্তারদের বক্তব্য একেবারে উলটে গেল। ভ্যারিওলেশনের কোনো ইতিবাচক প্রভাব থাকতে পারে সেটা তাঁরা অস্বীকার করলেন। বলা হল ঐসব কুসংস্কার বন্ধ না করলে ভ্যাক্সিনেশন চলবে না। আবিষ্কার করা হল, কলকাতায় দশ-পনেরোজন টিকাদার গুটিবসন্তকে টিকিয়ে রাখছে। তারা ভ্যাক্সিন নিয়ে আতঙ্কজনক মিথ্যা গুজব ছাড়াচ্ছে, যাতে তাদের ব্যবসা বজায় থাকে। এক ভ্যাক্সিন কমিশনার বললেন,
“... যে দেশে শিশুহত্যা আর সতীদাহ ধর্মের দোহাই দিয়ে এই সেদিন পর্যন্ত চলেছে, সেদেশে অজ্ঞান হিন্দুদের ভুলপথে চালানোর জন্য ধর্মান্ধরা আছে। তাদের সরল ও বিশ্বাসী মনে ভয় জাগানোর জন্য নতুন সব কিছুকে এরা ধর্মবিরোধী বলে চালায়... এদের খুনে ব্যবসা আর চালাতে দেওয়া যায় না।”
কিন্তু ইংরেজদের মধ্যেও দেশী টিকাদার সম্পর্কে এর বিপরীত ভাবনা ছিল। যেমন ঢাকার সিভিল সার্জন জেমস ওয়াইজ বললেন, ভ্যাক্সিনেশন শুরু হবার আগে ভ্যারিওলেশন বন্ধ করা ঠিক হবে না। ভ্যাক্সিনেশনের সামগ্রিক দায়প্রাপ্ত চার্লস সাহেব ১৮৬০ সালে সমস্ত পরিসংখ্যান খতিয়ে দেখে বললেন, ভ্যারিওলেশন থেকে মহামারি বিশেষ ছড়ায় না, আর বড়জোর শতকরা ১ জন মানুষ এতে মারা যায়। তাই টিকাদারদের সরকারি নিয়ন্ত্রণে এনে ভ্যারিওলেশন চালানো হোক। এই বিতর্ক প্রায় পঞ্চাশ বছর চালানোর পরেও একমত হওয়া যায় নি। তবে ১৮৭০ নাগাদ পুরনো ভারিওলেশন টিকাদারদের সরকারি ভাক্সিন দেবার কাজে বিপুলভাবে নিয়োগ করা হয়েছে। একসময় যাদের সমস্ত সমস্যার মূল বলে চিহ্নিত করা হল, তাদেরই নতুন ব্যবস্থার অংশীদার করে নেওয়া হল। (১)
অন্যদিকে প্রভাবশালী নেটিভদের ভাক্সিন দিয়ে তার প্রচার করে ভাক্সিনকে জনপ্রিয় করতে চাইল সরকার। মোঘল বাদশাহ পরিবার, পুনের পেশোয়া পরিবার, বারাণসীর মহারাজা, বিভিন্ন জমিদার, নানা ব্রাহ্মণ গোষ্ঠি—এদের ভ্যাক্সিন দিয়ে তার প্রচার করা হল। শিক্ষিত উচ্চবর্ণের হিন্দুরা কেউ কেউ ভ্যাক্সিনের সমর্থনে পুস্তিকা লিখলেন। ‘মাঝারি’ জাতির নেতাস্থানীয় মানুষদের টিকা দেওয়া হল, তার প্রচার হল। এর সঙ্গে হিন্দু ও মুসলমান সম্প্রদায়ের কিছু ইংরাজি শিক্ষিত ও বৃটিশ ঘনিষ্ঠ মানুষও ভ্যাক্সিন চালু করার পক্ষে সওয়াল করলেন।
এর বিপরীতে আদিবাসী অঞ্চলে বা তৎকালীন অওধের মতো অঞ্চলে দেশী ভ্যারিওলেশনের কোনো অভিজ্ঞতা মানুষের ছিল না। তাদের ওপর জোর করে ভ্যাক্সিন চাপানোর চেষ্টা হল, এবং সেটা ভারতীয়রা প্রায় সম্পূর্ণ প্রত্যাখান করলেন। আবার বৃটিশের সঙ্গে সহযোগিতা করে চলা অনেক প্রতিষ্ঠিত এদেশীয়রাও ভ্যাক্সিনের বিরোধিতা করেছেন। নানা মিউনিসপ্যালিটিতে প্রতিনিধিরা ভ্যাক্সিনের প্রস্তাব বাতিল করেছেন—গোরুর ওপর অত্যাচার আর গোরুর পুঁজ শরীরে নেওয়া তাঁদের পছন্দ ছিল না।
ভ্যাক্সিনের কর্মক্ষমতা, গুণমান ও পরিমাণের স্বল্পতা নিয়ে ইংরেজ আধিকারিকদের মধ্যে বিস্তর চাপান-উতোর হয়। (২) কিন্তু ভারতীয়রা এব্যাপারে তেমন মন্তব্য করেছেন এমন দেখা যায় না। কিন্তু সত্যিই কি যে পরিমাণ ভ্যাক্সিন ভারতে আনা দরকার ছিল সে পরিমাণ ভ্যাক্সিন কোনোদিন বৃটিশরাজ ভারতে এনেছিল? যেটুকু এনেছিল তার গুণমান অক্ষুণ্ণ ছিল? ভ্যাক্সিন দিয়ে ভারতের মানুষকে যথাযথ সুরক্ষা দেওয়া গিয়েছিল? আর, ভারিওলেশন পদ্ধতির মতো একবার ভ্যাক্সিন দিয়ে সারাজীবন সুরক্ষা মিলবে, ইংরেজদের এই ধারনা কি সত্যি ছিল?
প্রতিটি প্রশ্নের উত্তর হবে না, না, এবং না। পরবর্তীকালে জেনারের ভ্যাক্সিন বিশ্ব থেকে গুটিবসন্তকে নির্মূল করার বিশাল সাফল্য অর্জন করে। আমরা পরের পর্বে দেখব, সাফল্য পাবার পর সেই কাহিনী দিয়ে ঔপনিবেশিক ভারতে ভ্যাক্সিনের অতীত বৈজ্ঞানিক ত্রুটি ও ভ্যাক্সিন প্রয়োগে সরকারি বিফলতা—দুইই ঢেকে রাখা হয়েছে।
বাগদাদ থেকে বোম্বে—ভাসমান জাহাজে সার্জনের ছুরি এক শিশুর হাত কেটে পুঁজ গেঁথে দিচ্ছে আরেকজনের শরীরে। ১৮০২ সালে প্রথম জেনারের ভ্যাক্সিন ভারতে আসে। বোম্বেতে স্থলপথ ও জলপথে এই ভ্যাক্সিন আসে, তবে মাল হিসেবে তা আসেনি, এসেছিল শিশুদের হাতের ঘা হিসেবে! ইস্তাম্বুলে প্রথম একটি শিশুর হাতে গো-বসন্তের টিকা দেওয়া হল। তার টিকার জায়গার ফুস্কুড়ির থেকে রস নিয়ে আরেকজন শিশুকে টিকা দেওয়া হল। তার ফুস্কুড়ির রস থেকে আবার পরের শিশু... এইভাবে চলল বোম্বেতে জাহাজ ভেড়া পর্যন্ত। (১)
ভ্যাক্সিন প্রথম আসে বোম্বেতে, এবং এই প্রেসিডেন্সিতে সবথেকে বেশি সফল হয়। এমনকি সেখানেও উনবিংশ শতকের মাঝামাঝি মোট জনসংখ্যার মাত্র ১.৫ শতাংশ ভ্যাক্সিন পেয়েছিল। প্রথমদিকে মানুষের হাতের ভ্যাক্সিনজনিত ফুস্কুড়ি থেকে রস নিয়ে অন্যকে ভ্যাক্সিন দেওয়া চলত। তারপর গরুর রস থেকে ভ্যাক্সিন নেবার প্রক্রিয়া চালু করার চেষ্টা শুরু হয়, আর কুড়ি বছর পরে সে প্রচেষ্টার ফল পাওয়া যায়। বিংশ শতকের প্রথমে বোম্বে প্রেসিডেন্সিতে ভারতের প্রথম ভ্যাক্সিন ইনস্টিটিউট স্থাপিত হবার পরে ঘাটতি কিছু কমে। সে সময় বোম্বে প্রেসিডেন্সির একবছরের নিচে বাচ্চাদের শতকরা ৮০ ভাগ ভ্যাক্সিন পায়।
বাংলার অবস্থা এর থেকে খারাপ ছিল। আর সারা ভারতের গড় ছিল আরও খারাপ, যেমন বর্তমান উত্তর ও মধ্য প্রদেশ অঞ্চলের একবছরের নীচের শিশুদের অর্ধেক মাত্র ভ্যাক্সিন পেয়েছিল। অথচ ১৮৬৫ সাল থেকে বৃটিশ সরকার প্রথমে কলকাতার আশেপাশে, তারপর আস্তে আস্তে সারা বাংলা প্রেসিডেন্সিতে, দেশীয় ভ্যারিওলেশন আইনত নিষিদ্ধ করে। ১৯০০ সাল নাগাদ বাংলার বাচ্চাদের মধ্যে ২০ শতাংশের বেশি এবং প্রাপ্তবয়স্কদের একটা বড় অংশ ইংরেজি ভ্যাক্সিনের সুযোগ পায়নি। তাদের জন্য দেশীয় টিকাও হল বেআইনি! ভ্যাক্সিন যোগানে সমস্যা ছিল। ভারতে গো-বসন্ত ছিল বিরল। শুরু হবার পর নব্বই বছর ভ্যাক্সিনের বড় অংশ বৃটেন থেকে আমদানি করতে হত। কীভাবে এই ভ্যাক্সিন আসত? আমরা দেখেছি, প্রথম ভ্যাক্সিনের মালমসলা এসেছিল বাচ্চা ছেলেদের হাতের ঘায়ের মাধ্যমে। এরপরে অবশ্য শুকনো মামড়ি, রস ইত্যাদি হিসেবে সীল করে ভ্যাক্সিন পাঠানো হত। তার কার্যক্ষমতা নিয়ে বৃটিশ কর্মচারীরা যথেষ্ট সন্দেহ প্রকাশ করেছেন। ঐ আমদানি করা ভ্যাক্সিন দিয়ে এদেশে সফল টিকা পেয়েছে, এমন বাচ্চার হাতের রস নিয়ে ভ্যাক্সিন দেওয়া শুরু হল তারপর। সেটা চলল অনেক বছর। সেই অভিজ্ঞতা অনেক সময় বেশ ভীতিপ্রদ ছিল।

১৮৯৩ সালের বাংলা স্যানিটারি কমিশনার স্বয়ং লিখেছেন—
“বাচ্চাটির সঙ্গে তার মা কাঁদতে কাঁদতে শহর বা গ্রামে চলেছেন। বাচ্চার হাতের ফুস্কুড়ি থেকে যতটা সম্ভব রস চেঁচে নিয়ে, তার ঘা-টির ওপর দুদিক থেকে চিমটের মতো হাতের চাপ মেরে আরও রস বের করা ছিল ভাক্সিনকারীদের সাধারণ অভ্যাস। এক গ্রাম থেকে আরেক গ্রাম, এক শহর থেকে আরেক শহর এইভাবে বাচ্চাটিকে কষ্ট দেওয়া চলত। পরে তার হাতে বেদনাদায়ক ঘা হয়ে বহুদিন তা থাকত। এরকম বাচ্চাদের টিটেনাস বা জ্বর, এমনকি স্রেফ ক্লান্তিতে মারা পড়ার ঘটনাও জানা আছে। সুতরাং বাংলার মানুষ যে ভ্যাক্সিন নিয়ে বিরূপ এতে আশ্চর্যের কিছু নেই। বাবা-মায়েরা ভ্যাক্সিনকারীদের কাছে থেকে ছেলেমেয়েদের লুকিয়ে রাখেন।” (২)


১৮৫০ সাল থেকে এদেশে গরুর গো-বসন্ত গুটির রস থেকে ভ্যাক্সিন দেবার জন্য প্রচেষ্টা শুরু হয়। কিন্তু বোম্বেতে এই পদ্ধতি চালু হতে বছর কুড়ি লেগেছিল। আর আগের পরিচ্ছেদে আমরা যেমন দেখছি, বিংশ শতকের দোরগোড়ায় দাঁড়িয়েও এই পদ্ধতি অন্তত বাংলায় যথেষ্ট পরিমাণে শুরু হয়নি। এখানে ভ্যাক্সিনকারীরা উঁচুজাতের গরীব বাচ্চার হাতে ভাক্সিন দিয়ে তাকেই ‘সোর্স’ হিসেবে ব্যবহার করতেন। উঁচুজাতের শিশুর রস শরীরে নেবার ব্যাপারে এদেশের উঁচু বা নীচু জাতের মানুষ তত আপত্তি করতেন না। কিন্তু নীচুজাতের রক্তরস উঁচুজাতের লোকেরা নিজের বাচ্চাকে দিতে দিতেন না। অবশ্য ইউরোপীয়রা যে এসব সংস্কার থেকে মুক্ত ছিলেন তা বলা যায় না। দেশী টিকাকারদের যখন ভ্যাক্সিনকারী হিসেবে নিয়োগ করা হয়েছিল তখন সাহেব ডাক্তাররা মালি বা নাপিত ইত্যাদি জাতের লোকদের সঙ্গে কাজ করা তাঁদের ডাক্তারি পেশার পক্ষে অপমানকর বলে বিরোধিতা করেছিলেন।

আগেকার দেশীয় পদ্ধতির টিকাদাররা ছিল সমাজের নিজের লোক। আর সরকারি আদেশনামায় বলিয়ান ভ্যাক্সিনকারীরা ছিল ভয়ের পাত্র। পাঞ্জাবের একটি সরকারি প্রতিবেদন বলছে, এরা ছিল অসৎ ও নিষ্ঠুর। একটা বাচ্চাকে ভ্যাক্সিনের সোর্স হিসেবে তুলে নিত তারা, তারপর ঘুষ না দিলে রস বের করার নামে অত্যাচার করত। । অন্যদিকে বোম্বেতে ভ্যাক্সিনেশনে এমন অভিযোগ ছিল না বললেই চলে, আর সেখানেই ভ্যাক্সিন সবচাইতে বেশি হয়েছিল।

কুসংস্কারের জন্য ভারতীয়রা ভ্যাক্সিন নিতে চায় নি, উঁচুজাতের হাতের রস-ই কেবল গ্রহণ করে অসুবিধা তৈরি করেছে—এসব সত্যি। তেমনই তাদের ভ্যাক্সিন-বিরোধিতার সত্যিকারের কারণ ছিল।
• ভ্যাক্সিনকারীদের অত্যাচারের কথা আমরা দেখলাম।
• এছাড়া ছিল ভ্যাক্সিন না পাবার সমস্যা। যথেষ্ট পরিমাণে ভ্যাক্সিন সরবরাহ নিশ্চিত করার আগেই ইংরেজরা বহু জায়গায় দেশীয় টিকা তুলে দিয়েছিল। ফলে মানুষের কাছে মনে হচ্ছিল, সরকার তাদের জীবন বিপন্ন করতে চায়। এমন সরকারের দেওয়া ভ্যাক্সিনের ওপর তার ভরসা স্বভাবতই কমেছিল।
• দেশীয় পদ্ধতিতে বিপদ ছিল ঠিকই, কিন্তু তার কার্যকারিতা নিয়ে সন্দেহ ছিল না। ঠিকভাবে দেশীয় টিকার নেবার পরে কখনই গুটিবসন্ত হত না। ভ্যাক্সিন নেবার পরেও কিন্তু গুটিবসন্ত হত, এবং সেটা সাহেবরা জানতেন। নেটিভদের সেরকম সন্দেহ একেবারে ছিল না তা নয়।
• ভ্যাক্সিনে কাজ না হবার কারণ মূলত দুটি।
o প্রথমত, আমদানি করা ভ্যাক্সিন অনেক সময়ে দীর্ঘদিন পরে ব্যবহার করা হত, তখন তাদের কার্যকারিতা ফুরিয়ে গেছে। অনেক পরে ভ্যাক্সিন ঠিকভাবে দীর্ঘসময় সংরক্ষণ করার পদ্ধতি আবিষ্কৃত হয়।
o দ্বিতীয়ত, দেশীয় ভ্যারিওলেশন একবার দিলেই তা সারা জীবন সুরক্ষা দিত, কিন্তু জেনারের ভ্যাক্সিন একবার দিলে সারা জীবন সুরক্ষা দিত না। এমনকি ইউরোপেও এই ব্যাপারটা পরে বোঝা যায়, ও দ্বিতীয় ‘বুস্টার’ ভ্যাক্সিন চালু হয়। ভারতে সেটা চালু হয়েছে অনেক পরে।


যে ইতিহাস আমরা পড়ি তাতে গুটিবসন্ত থেকে আমাদের রক্ষা করেছিল জেনারের ভ্যাক্সিন, এটা লেখা থাকে। কিন্তু ভ্যাক্সিন দেবার ক্ষমতা আমাদের শাসকদের হাতে ছিল, আর তারা ছিল বিদেশী। ভ্যাক্সিন নিয়ে আমাদের আপত্তি ও সমস্যাগুলি প্রায় সর্বত্র অগ্রাহ্য হয়েছিল। সাহেব প্রশাসক ও সাহেব ডাক্তাররা যতদিন পর্যন্ত নিজেরা ভুল সংশোধন না করতেন ততদিন আমরা নিরুপায় ছিলাম। আমাদের ইতিহাসে এসব লেখা নেই। ইউরোপে ভুল বলে জানা জিনিস এদেশে বহুদিন চলত, শাসকের দয়া হলে ভুল সংশোধিত হত।

টিকাকরণের ইতিহাসের এই ভুল সংশোধনের জন্যও বোধকরি আমরা আজানা কোনো শাসকের দিকে চেয়ে আছি। দাসত্ব কেবল রাজনৈতিক পরাধীনতা নয়, তা শিরায় ঢুকে যাওয়া এক অভ্যাস, একথাটা খুব মিথ্যে নয় বোধহয়।
একদিন করোনা-র ভ্যাক্সিন বেরোবে। আমরা হয়তো জেনারের ভ্যাক্সিনের মতোই অন্যের দয়ায় ভ্যাক্সিন পাব। অথবা পাব না। ভ্যাক্সিনের ইতিহাস হয়তো পুনরাবৃত্তি হবে। প্রথমে ছিল ট্রাজেডি, আমরা গুটিবসন্তে দেখেছি। এবারে দেখব করুণ কৌতুক—নির্বোধকে ভবিষ্যৎ কোনোদিনই ক্ষমা করেনি।

সর্বশেষ এডিট : ১২ ই জুন, ২০২০ রাত ১২:০১
১টি মন্তব্য ০টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

শাহ সাহেবের ডায়রি ।। মুক্তিযোদ্ধা

লিখেছেন শাহ আজিজ, ১৯ শে এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ১২:২১



মুক্তিযুদ্ধের সঠিক তালিকা প্রণয়ন ও ভুয়া মুক্তিযোদ্ধা প্রসঙ্গে মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রী আ ক ম মোজাম্মেল হক বলেছেন, ‘দেশের প্রতিটি উপজেলা পর্যায়ে মুক্তিযোদ্ধা যাচাই বাছাই কমিটি রয়েছে। তারা স্থানীয়ভাবে যাচাই... ...বাকিটুকু পড়ুন

ভারতীয় রাজাকাররা বাংলাদেশর উৎসব গুলোকে সনাতানাইজেশনের চেষ্টা করছে কেন?

লিখেছেন প্রকৌশলী মোঃ সাদ্দাম হোসেন, ১৯ শে এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ২:৪৯



সম্প্রতি প্রতিবছর ঈদ, ১লা বৈশাখ, স্বাধীনতা দিবস, বিজয় দিবস, শহীদ দিবস এলে জঙ্গি রাজাকাররা হাউকাউ করে কেন? শিরোনামে মোহাম্মদ গোফরানের একটি লেখা চোখে পড়েছে, যে পোস্টে তিনি... ...বাকিটুকু পড়ুন

চুরি করাটা প্রফেসরদেরই ভালো মানায়

লিখেছেন হাসান মাহবুব, ১৯ শে এপ্রিল, ২০২৪ বিকাল ৪:৫৩


অত্র অঞ্চলে প্রতিটা সিভিতে আপনারা একটা কথা লেখা দেখবেন, যে আবেদনকারী ব্যক্তির বিশেষ গুণ হলো “সততা ও কঠোর পরিশ্রম”। এর মানে তারা বুঝাতে চায় যে তারা টাকা পয়সা চুরি... ...বাকিটুকু পড়ুন

ঘুষের ধর্ম নাই

লিখেছেন প্রামানিক, ১৯ শে এপ্রিল, ২০২৪ সন্ধ্যা ৭:৫৫


শহীদুল ইসলাম প্রামানিক

মুসলমানে শুকর খায় না
হিন্দু খায় না গাই
সবাই মিলেই সুদ, ঘুষ খায়
সেথায় বিভেদ নাই।

হিন্দু বলে জয় শ্র্রীরাম
মুসলিম আল্লাহ রসুল
হারাম খেয়েই ধর্ম করে
অন্যের ধরে ভুল।

পানি বললে জাত থাকে না
ঘুষ... ...বাকিটুকু পড়ুন

ইরান-ইজরায়েল দ্বৈরথঃ পানি কতোদূর গড়াবে??

লিখেছেন ভুয়া মফিজ, ১৯ শে এপ্রিল, ২০২৪ রাত ১১:২৬



সারা বিশ্বের খবরাখবর যারা রাখে, তাদের সবাই মোটামুটি জানে যে গত পহেলা এপ্রিল ইজরায়েল ইরানকে ''এপ্রিল ফুল'' দিবসের উপহার দেয়ার নিমিত্তে সিরিয়ায় অবস্থিত ইরানের কনস্যুলেট ভবনে বিমান হামলা চালায়।... ...বাকিটুকু পড়ুন

×