বৃদ্ধ,দরিদ্র মানুষের শীত নিবারণ,তাদের সাহায্য করা,পথশিশুদের স্কুলে পড়ানো,মানুষকে এসব কাজে উদ্বুদ্ধ করা যেন তার নিত্যনৈমিত্তিক কাজের অংশ। ভার্সিটির পড়াশুনার তুমুল চাপের মাঝেও বন্ধুদের নিয়ে এসব স্বেচ্ছাসেবী কাজ সে করে চলে অবলীলায়।
দেশের প্রতি ওর গভীর আবেগ কাজ করে,তার পেছনের ইতিহাসও করুণ। একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধে ওর পরিবারের ওপর চলে নৃশংস অত্যাচার। মা মারা যান যুদ্ধের সময়। বোনটা লাঞ্ছিত হয় হানাদারদের হাতে। ওর বাবা আর একমাত্র চাচা গিয়েছিলেন মুক্তিযুদ্ধে। বাবা ফিরে আসেননি,চাচা ফিরে এসেছিলেন,পঙ্গু হয়ে।
এত আত্মত্যাগের বিনিময়ে যে স্বাধীনতা,সেই স্বাধীনতার পূর্ণাঙ্গ রূপটাই অমি খুঁজে ফেরে প্রতিক্ষণ। দেশের মানুষগুলোর ওপর তাই হয়তো এত টান ওর। স্বাধীন দেশের ছায়ায় পরে থাকা নিঃস্ব অসহায় ওই মুখগুলোর মাঝেই নিজের আপনজনদের খুঁজে ফেরে অমি। ওদের দুঃখ লাঘবের চেষ্টায় কোন কার্পণ্য নেই ওর।
একটাই বড়বোন আছে অমি’র। যুদ্ধের সময়কার পাশবিক অত্যাচারের শিকার হয়ে একসময় উদ্ধার হয়ে আসেন নারী পুনর্বাসন কেন্দ্রে। সেখানে একটা মৃত বাচ্চা প্রসব করেন। তারপর অনেক ঘাত প্রতিঘাত পাড়ি দিয়ে একা বেঁচে আছেন সমাজের আর দশটা মানুষের মাঝেই, অনেকটা নিঃসঙ্গতার শেকল পরে। তবে পত্রপত্রিকার হেডলাইন হতে সময় লাগেনা বছরের একটা সময়ে!! ডিসেম্বর মাসে বীরাঙ্গনাদের যে অন্যরকম সম্মানের চোখে দেখা হয় !! পেপারে ছবি আর সাক্ষাৎকার ছাপা হয়, দেয়া হয় ‘বীরাঙ্গনা’ খেতাব ! তারপর তাঁরা সময়ের স্রোতে হারিয়ে যায় মানুষের স্মৃতি থেকে। ব্যস্ত জীবনের চাকা মানুষের মৌলিক অনুভূতিতে যেন ফাটল ধরিয়ে দেয়, চেনা মুখগুলোও খুব অচেনা মনে হয়...।
অমি’র চাচা যুদ্ধ শেষে অমিকে কোলে নিয়ে বলেছিলেন, ” একটা লাল পতাকা এনেছি বাবা! তোর জন্য এই মাটির অধিকার নিয়ে এলাম! যত্ন করে রেখে দিস,এটা বিজয় নিশান। যতদিন উঁচু করে ধরে রাখতে পারবি,এই মাটির অধিকার কেউ কেড়ে নিতে পারবেনা!” সেই লাল নিশানটা খুব যত্ন করে রেখে দিয়েছে অমি। বিজয় নিশান মানে কি তা বোঝার বয়স তখনো হয়নি ওর। চাচা বলেছিল ওটা উঁচু করে ধরে রাখতে। তার মানে কী? কিছুই বোঝেনি সে। তবে নিশানটাকে বাঁশের আগায় লাগিয়ে মাঠময় দৌড়ে বেড়াতো অমি,ওর গাড় সবুজের ভেতরে টকটকে লাল রঙের বৃত্তটা যেন চুম্বকের মত টানতো ওকে।
স্বাধীনতার তিন বছর পর অমি’র চাচা মারা যান। যুদ্ধে মারাত্নক আঘাত পেয়েছিলেন মাথার বাম পাশটায়, একটা হাত পুরোপুরি অকেজো হয়ে যাওয়ায় কেটে ফেলা হয়। তারপরও কোন রকমে বেঁচে ছিলেন বছর তিনেক। মারা যাবার পর অমি’রা ওর খালার কাছে চলে আসে,সেখানেই বড় হয় অমি।
আজকে অমি অনেক বড় হয়ে গেছে,ভার্সিটির স্টুডেন্ট। দেশটা কিভাবে স্বাধীন হয়েছে তার রক্তাক্ত অনুভূতিটা নিজের জীবন দিয়েই অনুভব করতে পারে সে। তবে চাচার রেখে যাওয়া সেই ‘মাটির অধিকার’ কতটুকু ধরে রাখা সম্ভব হয়েছে !!!......তাই নিয়ে নিত্য প্রশ্ন যাগে অমির মনে। দেশের শাসকেরা আজকে নিজেদের আখের গোছাতে ব্যস্ত,অল্প একটু স্বার্থের জন্য দেশটাকে বিকিয়ে দিতেও কোন কার্পণ্য নেই ওদের। গদি দখলের লড়াইয়ে কে কাকে হারাতে পারে এই প্রতিযোগীতায় মত্ত হয়ে দেশের মানুষের মুখে হাসি ফোটানোর কথা ভুলেই গেছে তারা। যুদ্ধের পর শহীদদের রেখে যাওয়া এই ভাঙ্গাচোরা দেশটাকে শক্ত হাতে গড়ে তোলার মত বলিষ্ঠ কোন হাত এগিয়ে আসেনি,আসলেও টিকে থাকেনি বেশিদিন। ক্ষমতালোভী দালালদের ভীরে দেশপ্রেমিক নেতারা হারিয়ে গেছে অতলান্তে। যাদের আত্মত্যাগের বিনিময়ে আজকের এই স্বাধীনতা,সেই স্বাধীন দেশে তাদেরই জীবনের ভগ্নদশা অমি’র হৃদয়ে আনে গভীর শোকের রক্তপাত। ওর বাবার মাটিতে মিশে যাওয়া,মায়ের রক্তে ভেজা এই দেশের বুকে এখনো রাজাকারদের মুক্ত পদচারণা ওকে বিস্মিত করে!!! কিসের মাটির অধিকার? যেই অধিকার কতগুলো বিদেশী পরাশক্তির হাতে কুক্ষিগত...!! যেই অধিকার এখনো দেশের বুক থেকে জারজ মীরজাফরগুলোকে উৎখাত করতে পারেনি!!! ওরা তো এখনো দেশের মুক্তিযোদ্ধাদের বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে নিজেদের তকমা ওড়াচ্ছে !! ভুয়া মুক্তিযোদ্ধা সার্টিফিকেট নিয়ে ভোল পাল্টিয়ে দেশের মানুষকে আবারো চূড়ান্ত প্রহসনে করছে প্রতারিত!!!
কোথায় সেই বিজয় নিশান যাতে মাটির অধিকার হবে সুনিশ্চিত?!! যাকে উর্ধ্বে তুলে ধরে বাংলার মানুষ গাইবে বিজয়ের গান!! আজকে অমি’র মনে হয়,ওর মত পোড় খাওয়া কিছু মানুষই কেবল পতাকাটা রক্তের মত লাল করে রেখেছে হৃদয়ে,আর ওই পতাকাটা উর্ধ্বে তুলে ধরার মত শক্তিও যেন আবার খুঁজে বের করতে হবে অমিদেরই। এই মাটির অধিকার আরো দৃঢ় আর শক্তিশালী করে তবেই অমি ঊর্ধ্বে তুলে ধরবে বিজয় নিশান,তার আগ পর্যন্ত যুদ্ধের আগুনটা হৃদয়ে জ্বলতে থাকুক অবিরাম।
সর্বশেষ এডিট : ১৩ ই জানুয়ারি, ২০১২ বিকাল ৫:১২

অনুগ্রহ করে অপেক্ষা করুন। ছবি আটো ইন্সার্ট হবে।




