ব্যাক্তিগত ঝামেলার জন্য অনেকদিন কিচ্ছু লেখা টেখা হয় না। সামনের আরও কয়েকমাসে কিছু লেখালেখি নয় সিদ্ধান্ত ছিল। আমার এদিকে আবার লেখালেখি মানে হাইফাই কিছু না, নিজের যৌক্তিক অবস্থা অন্যের সামনে তুলে ধরা মাত্র। সামান্য হাত চুলকানির মত ইস্যু যেমন চলচিত্র আমদানি, হুমায়ুন, গ্রামীণ ব্যংক ইত্যাদি কষ্টে উপেক্ষা করে গেছি। এবার পারলাম না। এই লেখায় থিওরিটিক্যালি কিছু আনব না সেই সাথে কম কথায় সারব। বিষয় অনন্ত। এম এ জলিল অনন্ত।
চলচিত্রের কি অবস্থা? বেদম খারাপ সময়ে আছি আমরা। এর চেয়ে খারাপ সময় আর ছিল না। জাতীয় জীবনের চলমান ছবি, দর্শন, জীবনধারা, সংস্কৃতিক সবই ফুটে উঠে চলচিত্রে। অথচ এই রাষ্ট্রের শিল্পের এই শক্ত মাধ্যম মৃত্যুর সাথে পাঞ্জা লড়ছে কয়েক দশক ধরে। চলচিত্রে দিনকে দিন রোগা আর নোংরা হয়ে পড়ছিল যখন তখন হাল ধরার মত লোকগুলো বিভিন্নভাবে অদৃশ্য হয়ে যায়। এ বিষয়ে আমার একটি লেখার অংশ কপি করতেছি, এতে আর এ বিষয়ে কিছুই বলার প্রয়োজন পরবে না। অসমর্থিত সুত্রে ওই লেখাটি লেখা হয়েছিল তারেক মাসুদের মৃত্যুর পরের দিন।
// গল্পটা এরকম ____ যে জহির রায়হান ওনাদের কয়েকজনরে যেমন তারেক মাসুদ, তানভীর মোকাম্মেল, চাষি নজরুল ইসলাম প্রভৃতিগণকে নিজ হাতে শেখাচ্ছিলেন চলচিত্রের আদি অন্ত। ইনারা তৈরি হচ্ছিলেন রুপালী পর্দায় স্বপ্ন বুনার কারিগর হিসেবে। ইনাদের সবাই সমান প্রতিভাধর ছিলেন না। অথবা চাষি নজরুল ইসলামের কাজ জহির রায়হান তেমন পছন্দ করতেন না। অথবা হয়ত ব্যাক্তিগতভাবেই চাষিকে তার অপছন্দ ছিল। কিংবা চাষিকে বুঝার চেষ্টা করেননি জহির রায়হান। সামান্য পক্ষপাতমূলক আচারন ইতিহাসের গতি পাল্টে দিতে পারে তা অনুমান করতে পারছিলেন না জহির।
তিনি নিজ চেষ্টা এবং আর্থিক সহযোগিতার মাধ্যমে এদের জন্য বিদেশে স্কলারশিপের ব্যবস্থা করেন। এরা ফিরে এসে নতুন দেশের সংস্কৃতি গড়ার কমরেড হিসেবে কাজ করবে এই ছিল প্রত্যাশা। কিন্তু এদের মধ্যে বাদ দেয়া হয়েছিল চাষি নজরুল ইসলামকে। ক্ষুব্ধ, হাতাশ নজরুল ইতস্তত বিক্ষিপ্ত ঘুরছিলেন। কিন্তু ভাগ্য তার প্রসন্ন ছিল। দেশে মুক্তিযুদ্ধ শুরু হল। পাক সেনারা নিরীহ বাংলাদেশীদের উপর নির্মম অত্যাচার শুরু করল। ধর্ষন, লুণ্ঠন, গনহত্যা বাতাসকে বিষিয়ে দিল। মুক্তিযুদ্ধের ছবি বানানোর জন্য তখন কি আর সেটের প্রয়োজন পরে_
তিনি ছবি বানালেন, চাষি নজরুল ইসলামের কালজয়ী ছবি ‘ওরা এগারো জন’। এই ছবিই তাকে শক্তিশালী চলচিত্রাকারের মর্যাদা দিল। আর এই সুযোগে এবং এই ছবিকে পুজি করে তিনি পরবর্তিতে স্বাধীন বাংলাদেশের চলচিত্র সংসদ(এফ.ডি.সি) এর অভিবাবকের আসনটা পোক্ত করে নেন। জহির রায়হানের অন্তর্ধান ছিল চাষির জন্য আরেকটি বড় সুযোগ। সর্বোপরি তার সবই হল। কিন্তু _
তারা ফিরে এলেন। তানভীর, তারেকরা এসে দেখলেন সব ফাঁকা। চাষি চরম প্রতিশোধ পরায়ণ হয়ে উঠলেন। হিংশা, লোভ, অন্যায় চাষিকে অন্ধ করে দেয়। ব্যাপারটা এমন হল যে চাষি বেঁচে থাকতে ওনাদের এফ.ডি.সি চত্বরে প্রবেশ অনিশ্চিত হয়ে পরল। প্রতিভাবান ও প্রশিক্ষিত ছোকড়ারা এফ.ডি.সি এর আশে পাশে তির্থের কাকের মত ঘুরতে থাকল কিন্তু হায় __ জাতীর বড়ই দুর্ভাগ্য, সব ক্ষেত্রেই এই জাতি দুর্ভাগা। মধুসূদন যথার্থ বলেছিলেন, ‘অভাগা যেদিকে চায়, সাগর শুকায়ে যায়’। //
সে সব পুরানা কথা, সেই থেকে শুরু হয়ে এ নাগাদ চলচিত্রের হালচাল আমাদের সবারই কমবেশি জানা। ছিনেমা নাকি ‘ছিঃনেমা’ হয়ে গেছে এতদিনে। হ্যাঁ সেই দুর্যোগে দেশের সবচেয়ে শক্তিশালী মিডিয়া পক্ষ ‘প্রথম আলো’ ও তার সাঙ্গপাঙ্গ সহযোগী শ্রেণী চলচিত্র নিয়ে ‘ছিঃনেমা’ রঙ্গ করে সেদিন জনগণকে সিনেমা হল আর বাংলা ছবির প্রতি আরো অবজ্ঞা উস্কে দিতে সাহায্য করেছিল। তাদের আরেক সুশীল সহযোগী চলচিত্রের এই দুঃসময়ে দর্শকদের কৌশলে ছোট পর্দার ডায়লগ বেইজড নাটকের দিকে নিয়ে যেতে থাকে। একান্নবর্তি নামক নাটকের মধ্য দিয়ে শুরু হয় এ যাত্রা। হতাশা ও শূন্যতায় দর্শক যখন বেশ ক্লান্ত তখন এই থেরাপি বেদম কাজ দেয়। গল্পের গুরু আনিসুল, নির্মাতা ফারুকি, পৃষ্ঠপোষক ইমপ্রেস টেলিফ্লিম। সেই থেকে শুরু প্রথম দিকে সবাই পজিটিভলি নিলেও কয়দিন বাদেই একটু অভিজ্ঞরা বিপদ টের পায়। সস্তা ডায়লগ, রগরগে ইঙ্গিত, খোলামেলা কথাবার্তা, আঞ্চলিক শব্দের যাচ্ছেতাই ব্যবহার, গল্পের অগভীরতা, সামাজিক মেসেজের অভাব এইসব ছিল এই নতুন ধারার প্রধান বৈশিষ্ট। এই ফাঁদ থেকে কম বয়স্ক দর্শক এখনো বেরুতে পারেনি। এইসম নাটক ছবিতে কাহিনী, জীবন দর্শন থাকে না, থাকে কথার বাজার। এইসব নাটকে সাধারনত কতগুলা বাঁচাল জোগাড় করে কথার বাজার আর ঝগড়া ঝাটির দোকান খুলে বসা হয়। একটা রাষ্ট্রের বিনোদন জগতে এই ধরনের সস্তা বিনোদন ধারা থাকতেই পারে এটা খুব বেশি সমালোচনার বিষয় নয় তবে ভয়ানক বিষয় হল এটি অল্প সময়ে হয়ে গেল বাংলাদেশের মেইন স্ট্রিম। ফারুকি আর তার বেশ কিছু সাঙ্গ পাংগ মিলে রীতিমত রাতারাতি এই যে বিনোদন-টিভি নাটকের ধারাই চেঞ্জ করে দিল তাতে অবশ্য তাদের যথেষ্ট শক্তিমত্তা ও পারদর্শিতার পরিচয়ও মেলে। কিন্তু সেটা অন্য আলোচনা। এইসব নাটক মোবাইল কোম্পানিদের পৃষ্ঠপোষকতায় সিডি-ডিভিডি আকারে সারাদেশে ছেয়ে গেল। ছেলেপোলেদের মুখে ছিনেমা নয় বরং এইসব নাটকের কাহিনী, ডায়লগ বাজার পেল। এই ইমপ্রেস টেলিফ্লিম, চ্যানেল আই, প্রথম আলো, প্রথম শ্রেণীর বুদ্ধিজীবী-সুশীল এরা কিন্তু সেখানেই ক্ষ্যান্ত দিল না, সিনেমার দর্শনের পুটকি মেরে ছবি(!) বানায়ে টিভি পর্দায় মুক্তি দিয়ে ‘সুস্থ ধারার চলচিত্র’ লেভেল দিয়ে ‘নাম’ ও মুক্তির আগেই বিজ্ঞাপনদাতাদের কাছ থেকে টাকা তুলে ‘দাম’ দুইটাই হাসিল করতে থাকে। সিনেমা গেল, সিনেমা হল গেল। এই কাহিনী এখানেই ‘অসমাপ্ত’ রেখে পরের অধ্যায়ে যাচ্ছি।
সাকিব খান নামের এক দ্বিতীয় সারির নায়ক এই সময়ে ফাঁকা মাঠে একমাত্র ‘নায়ক’ হিসেবে দাড়িয়ে গেল। তার সবটুকু যোগ্যতার কারনে না হলেও সেই ধীরে ধীরে এফডিসি নামের নিষিদ্ধ পল্লীর (আধুনিক বাংলাদেশি বাঙালি শিক্ষিত মধ্যবিত্ত একে এইরকমই মনে করে) প্রথম ও শেষ কথা হয়ে দাঁড়াল। প্রতিভার জোরে না হলেও সেই একমাত্র এফডিসি নামের প্রতিষ্ঠানটিকে টিকিয়ে রাখার যুদ্ধে নেমে গেল। সারা দেশে একের পর এক সিনেমা হলের অপমৃত্যু ঘটতেছে, একমাত্র সাকিব খান নামের এই অভিনেতাই তার অক্লান্ত পরিশ্রম দিয়ে টিকিয়ে রাখল বাংলাদেশ রাষ্ট্রের ফ্লিম ইন্ডাস্ট্রি। বিনিময়ে শিক্ষিত বাঙালি সমাজের কাছে সে খেতাব পেল, ‘হিরজা, হাফ লেডিস’ ইত্যাদি নামে। প্রশ্ন তুলে এরা, সাকিব খানের ছবি নিম্ন মানসম্পন্ন। নিচু শ্রেণীর মানুষের জন্য। ছবির নিম্ন/উচ্চ মান যাচাইয়ের আপনি কেউ না। তাছাড়া যারা সমালোচনা করে তারা সাকিবের ছবির দর্শকও নয়। আমি আমার বেশ আগের একটি ফেইসবুক স্ট্যাটাস উদাহরণ হিসেবে দিলাম। এক ফেসবুক বন্ধু স্ট্যাটাস দিয়েছিল
//‘মমতাজকে শিল্পি বলা আর শিল্পকে ধর্ষন করা একই জিনিস’... এর পৃষ্ঠে ‘মমতাজের গান বুঝদার শিল্প সমাজের দৃষ্টিতে কেউ না হলেও তাতে কিছুই যায় আসে না, মমতাজ বিশাল এক শ্রেণীর মানুষের প্রানের শিল্পি। মমতাজের গান বিশাল সংখ্যার মানুষের প্রানের কথা কয়। ‘তোরে লইয়া উদাসী হইয়া হানিমুনে যামু...ও ভাতিজার মামু’ এই গান হাড়ভাঙ্গা খাটুনী খাটা লক্ষ বস্ত্র শ্রমিক সেইসব নারীর বেয়াইয়ের কথা বলছে, তার বেয়াইয়ের প্রতি তার ভালাবাসা উথাল পাথাল, তার ভাতিজার মামু বেয়াইটির জন্য তার পিটুইটারি গ্ল্যান্ডে বেদম ক্ষরণ হয়, মনের আনন্দে সে গেয়ে তার হৃদয়ের কথা বলা এই গান। তার এই আবেগ, এই ভালবাসার মান নিম্ন না উচ্চ তা যাচাই করার কোন অধিকার আপনার নেই। থাকুক আপনার শিল্প, শীতের বাতাসে উবে যাক আপনার বিশুদ্ধ সংস্কৃতি চর্চা। মেহানতি রিকশাওয়ালারে বিশুদ্ধ আর্ট, শিল্প শিখানোর কি অধিকার আছে আপনার। আপনি কে? আমিই বা কে ? আমরা কেও না, 'কেউ' সেই মানুষ, কেউ সেই 'চাষা' যে তার একমাত্র জমি বিক্রি করে তার ছেলেকে পাঠিয়েছে সুদুর মধ্যপ্রাচ্যের খেজুর বাগানে, আর অসহায় স্বামী পরিত্যাক্তা মেয়েকে পাঠিয়েছে সাভারের কোন এক গার্মেন্টস ফ্যাক্টরিতে। সেই দুই ভাই বোনের প্রানের গানটা লিখেছিল শাহালম সরকার, ' বুকটা ফাইট্যা যায় ' ... অপরাধ একটাই 'ফ্যাইটা' যায়; 'ফেটে' যায় না; তাই সেই গান অশ্লীল, শ্লীলতার সার্টিফিকেট দেন আপনারা সংস্কৃতির ধারক বাহক 'শিক্ষিত-মধ্যবিত্ত' । ... তাই ভাই শিল্প গড়েন; শিল্পী গরেন ... কিন্তু মমতাজে হাত দিয়েন না । আপনি শিল্প, শিল্পি আর মান নিয়ে থাকুন’ //
যাই হোক এবার আসি তৃতীয় অধ্যায়ে।
সিনেমা হলের মৃত্যু আর সাকিব নির্ভর একচেটিয়া বাজার প্রশ্নে হল মালিক ও নির্মাতা এই দুই শ্রেণী অবধারিত ভাবেই দুই শিবিরে ভাগ হয়ে যায় এক সময়। হল না বাঁচলে সিনেমা অর্থহীন। হল বাঁচাতেই হবে যে কোন মুল্যে এই যুক্তি ছিল হল মালিকদের। সবচেয়ে সহজ উপায় চলচিত্র আমদানি। মারাত্বক বিরুধিতা করে নির্মাতা-প্রযোজক শ্রেণী। তারা প্রতিযোগিতায় টিকবে না এই যুক্তিতে। দুইদিকেই ঝামেলা ছিল, হল মালিকরা যাচ্ছেতাই বানিজ্যিক ছবি আমদানি করতে পারে, অন্যদিকে নির্মাতারা এখন যাচ্ছেতাই খাওয়াচ্ছে তখন ধাক্কা খাবে, চাপে পরে যাবে, একচেটিয়া বাজার হারাবে এইসব। অবশেষে গতবছর সরকারী ভাবে সিনেমা আমদানির সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। তার আগে বলা ভাল বাঙালী অধ্যুষিত পশ্চিম বাংলা রাজ্যের ফ্লিম ইন্ডাস্ট্রির অবস্থা কি। ৭-৮ বছর আগে সেখানেও খুব দুর্যোগ চলছিল। খুবই সস্তা ও গতানুগতিক ধারার চলচিত্র কোনরকমে খুড়িয়ে চলছিল। বড় শহরে হিন্দি-ইংরেজি ছবির দৌরাত্ব, ছোট শহর গুলোর যেমন মেদেনিপুর, মুর্শিদাবাদ, শিলিগুড়ি ইত্যাদি অঞ্চলের দর্শকদের উপর ভিত্তি করেই চলছিল বাংলা চলচিত্র। তবে কলকাতাতে একটা নিম্নবিত্ত শ্রেণী সবসময়ই বাংলা ছবির দর্শক হিসেবে ছিল। সেখানেই প্রসেনজিত নামের একজন অভিনেতা সুধীর্ঘ সময় ধরে হাল না ছেড়ে লেগে ছিল এর পেছনে। সেখানকার চলচিত্র আজ যে অবস্থাতে তার বেশিরভাগ সম্মান প্রসেনজিতের ‘হাল না ছেড়ে প্রায় একাকী মূলধারার বাংলা ছবিকে আঁকড়ে ধরে রাখাকে’ দেয়া হয়। উল্লেখ্য প্রসেনজিত অনেক ভাল মানের অভিনেতা এবং সাকিবের সাথে তাকে মেলাচ্ছি না। পুনুশ্চ সেখানে মূলধারার পাশে আরেকটি ক্লাসিক শক্তিশালী ধারা প্রবল ভাবে বিকশিত হয়েছিল। ইন্ডিয়ার যেকোন ফ্লিম ইন্ডাস্ট্রির চেয়ে টালিগঞ্জ বেশি ও ভাল মানের আর্টফ্লিম তৈরি করে। তবে সেটা শিল্প-সংস্কৃতি প্রভৃতি বিষয়ক আলোচনার ব্যাপার, আমাদের আলোচনার বিষয় মূলধারার সিনেমা ও সিনেমা হল। যাইহোক যেখানে হঠাৎ জিত নামে আরেকজন কম বয়স্ক অভিনেতে এসে রীতিমত আলোড়ন তোলে ফেলল। ‘সঙ্গী’ ও ‘সাথী’ নামের দুইটি বানিজ্যিক ছায়াছবি সহাসাই এই পরিবর্তন নিয়ে এল। সুপার ডুপার হিট এই দুই ছবি দর্শককে প্রবলভাবে হলমুখী করল। যদিও এই পরিবর্তনের আভাস আরও আগের থেকে শুরু হয়েছিল। ক্ষেত্র সেখানে তৈরি হয়েই ছিল। প্রডিউসাররা টাকা ঢালা শুরু করল। নির্মাতারা ভাল ক্যামারা, গল্প, মিউজিশিয়ান, কোরিওগ্রাফার নিয়ে এল। শুরু হল অধুনিক বাংলা বাণিজ্যিক মুল ধারার জয়যাত্রা। এর বিকাশ নিয়ে আমি আলাদা একটা পোস্ট করব ভেবে রেখেছি। এর দরকার আছে। এর থেকে আমাদের শিখবার আছে। মনে রাখবেন আমরা মূলধারার বাণিজ্যিক ছবির কথা বলছি। এবার চতুর্থ অধ্যায়।
সিনেমা আমদানির বিপক্ষে প্রবল জনমত গড়ে উঠল। বাম ডান এবং মধ্যপন্থী সবাই এর বিপক্ষে। আন্দোলন ফেইসবুক সহ সকল অনলাইন মিডিয়াতে একতরফাভাবে ঋনাত্বক ভাবমুর্তি গড়ে তুলল। আন্দোলনকারীরা মোটামোটি সফল হল। কিন্তু এতে ভাববার বিষয় ছিল অনেক। সরকার যখন শিল্প থেকে ভর্তুকি উঠাই নিতে চায় তখন পুঁজিপতিরা হাপিত্যেশ করে শিল্প মারা যাবে বইল্যা, এত শিল্পের আর পঙ্গুত্ব ছাড়ে না। আরেকটি রাস্তায় ইন্ডিয়া সফল ছিল। টাটা সহ অন্যন্য দেশি কোম্পানি যখন দাঁড়াচ্ছে তখন তারা টাটাদের পঙ্গু করে রাখার মত কোন ছাড় বা সুযোগ না দিয়ে বরং বিদেশী কোম্পানির প্রোডাক্টে ট্যাক্স যথেষ্ট বাড়িয়ে দেয়। এতে দেশি কোম্পানি বিকাশের পুর্ন সুযোগ তৈরি করে রাষ্ট্রটি। টাটারা নির্দিষ্ট সময়ে বড় কোম্পানির সাথে প্রতিযোগিতা করার যোগ্যতা অর্জন করে। পুঁজি ঠেকায় পুজিকে। আঞ্চলিক পুঁজি ঠেকাবে বাইরের পুঁজিকে। এটাই পুঁজির ধর্ম। সরকার ওয়াল্টন কোম্পানিকে সুযোগ করে দিয়েছে বলেই আজ সে চায়নার মাইওয়ান টাইপ ফ্রিজ, টিভেকে ধাক্কা দেবার ক্ষমতা অর্জন করেছে। ওয়াল্টন এর মত দেশি পুঁজির লক্ষ্যই থাকবে বিদেশী পুঁজিকে ঠেকানো। প্রশ্ন হল আমরা কি পাশের রাজ্যের ‘বাংলা’ ছবির সাথেও প্রতিযোগিতায় টিকতে পারব না? আমরা এতটা অক্ষম, নপুংশক? কোন ইন্ডাস্ট্রি আসলে আমাদের বাজার আর প্রতিযোগিতা থেকে সরিয়ে দিবে? অবশ্যই বলিউড। আমি হিন্দি ছবি আমদানির সম্পুর্ন বিপক্ষে। এটা ভয়ানক সর্বনাশ ডেকে আনা ছাড়া আর কিছুই না। খোদ পশ্চিম বঙ্গেও হিন্দি পোস্টার নিষিদ্ধ। হিন্দি ভাষা সারা বিশ্বের রাক্ষস ভাষাদের একটা। এসব ভাষা অন্য ভাষাকে ভক্ষন করে। হিন্দির উদ্ভব, বিকাশ ও রাক্ষস হয়ে উঠার আর্থসামাজিক ব্যক্ষা অন্য কোন পোস্টে আলোচনার যোগ্য। যাই হোক সহজ হিসাবে এখানে টালিগঞ্জের বাংলা ছবি ও হলিউডের ইংরেজি ছবির আমদানি প্রয়োজনীয়। ইংরেজি ছবির দর্শক শ্রেণী আলাদা। অন্যদিকে কলকাতার ছবি হলে এসে গেলে হল প্রান ফিরে পাবে। সকল মধ্যবিত্ত শিক্ষিত শ্রেণী আবার হলে আসবে। বাংলাদেশের নির্মাতারা চাপ অনুভব করবে বাজারে টিকে থাকার প্রয়োজনে ভাল ছবি বানাতে বাধ্য হবে। হলে দর্শক সমাগম দেখে প্রোডিউসাররা টাকা ঢালার প্রতিযোগিতায় নামবে। দু অংশের যৌথ চেষ্টায় ব্যাপক উন্নতি সাধন হবে, এক কথায় ফ্লিম ইন্ডাস্ট্রি পুরোদমে চাঙ্গা হয়ে উঠবে। চলচিত্র শর্তসাপেক্ষে আমদানি তাই আকস্মিক দ্রুত পরিবর্তনের জন্য আবশ্যক। এফডিসেকে জোরে ধাক্কা দিতে হলে এর যথেষ্ট প্রয়োজন। অনেকেই এর বিরুদ্ধে অনেক যুক্তি হয়ত দিবেন কিন্তু বাস্তবতা ভিন্ন জিনিস। গালভরা স্বপ্নের কথা বলা সহজ। এটা পুঁজির খেলা, টাকার খেলা। প্রথমেই হল চাঙ্গা হওয়া ফরজ। যাই হোক চলচিত্র ও পুস্তক আমদানি বিষয়ে একদিন বিস্তারিত চিন্তা শেয়ার করব ক্ষণ।
এবার পঞ্চম অংশে, ফ্লিম ইন্ডাস্ট্রিতে অনন্তের আবির্ভাব এক বিশেষ ঘটনা। এখানকার বাংলা ছবিতে এত টাকা লগ্নি বিশেষ ঘটনা। তাকে নিয়ে কি হচ্ছে আমরা সবাই জানি। আমি সরাসরি আমার একদিনের স্ট্যাটাস তুলে ধরলাম।
// বাঙ্গালী জাতটা এত বেহায়া আর বেকুব নিজের আত্বসম্মান রক্ষা করার দায়িত্ব এরা কোনদিনও অনুভব করে না। এতদিন সাকিবরে খানরে নিয়া রং তামশা করছে এখন লিস্টে যোগ করছে এম এ জলিল অনন্তের নাম। হিজড়া, হাফ লেডিস, মুর্খ, ছাগল কিছুই এদের বানাইতে বাদ রাখে নাই এই মধ্যবিত্ত শিক্ষিত ইস্মার্ট বাঙালীরা। আমি এখন টাঙ্গাইলে, এক সময় এখানে ৫টা সিনেমা হল ছিল, এখন মোটামুটি একটা কোন রকমে হৃৎপিণ্ডের সমস্যা নিয়ে পরে আছে। দেশের হাজার হাজার হল এখন মৃত। হল গুলা ভেঙে সেখানে শপিং মল কড়া হয়েছে ইস্মার্ট বাঙালী শিক্ষিত সমাজ সেখানে ঈদের বাজার করে এখন। এদের কোন বাপই এই হল গুলার মৃত্যু ঠেকাতে পারে নাই। পারে নাই স্বার্থসন্ধানী ইমপ্রেস টেলিফ্লিম, পারে নাই নুহাস চলচিত্র কেউ না কেউ না। একমাত্র যে বাপ যা কিছু পারছে তার নাম সাকিব খান। তার ছবি হলে নিয়ে আসে অর্ধশিক্ষিত ও অশিক্ষিত নিম্নবিত্ত ও মধ্যবিত্ত শ্রেণীকে। রাষ্ট্রের এই শ্রেণীটাই সবচেয়ে বড় অংশ। শিক্ষিত মধ্যবিত্ত উত্তেজনার বশে সাকিব খানরে নিয়া জোকস বানানোর ফাঁকে ভুলে গেছে আগে হল বাঁচাতে হয়, আগে দর্শক বাঁচাতে হয় তারপর ছবির সমালোচনা করতে হয়। বক্স অফিসে মুখ থুবড়ে পড়া ছায়াছবি চলচিত্র বাঁচাতে পারে না, টিভি পর্দায় প্রিমিয়ার কড়া ছবি ‘সিনেমা’ হতে পারে না। ছাগু ইস্মার্ট বাঙ্গালী চোখ মেলে চাইলেই লজ্জায় মাথা তুলতে পারবে না; পাশের রাষ্ট্রের বাংলা ভাষী সামান্য এক রাজ্যের ফ্লিম ইন্ডাস্ট্রি বাংলাদেশের চেয়ে একশগুণ ভাল। মাত্র ৮ থেকে দশ বছরে সেখানে রীতিমত বিপ্লব ঘটে গেছে। মূলধারার বাণিজ্যিক চলচিত্র সেখানে বিট করছে শক্তিশালী বলিউডকে। হিন্দি ছবির আইটেম গানকে ধাক্কা দিচ্ছে তাদের বাংলা আইটেম সং ‘কোকাকোলা’। তাদের ছবির মিউজিক, কম্পোজিং, বাজেট প্রমান করছে টাকা হলেই হয়, উদ্যোগ হলেই হয় ভাষা কোন সমস্যা না। বাংলা ছবিও কোটি টাকার ব্যবসা করতে পারে, বাংলা ছবিও হল কাপাতে পারে, বাংলা ছবিও বলিউডকে ধাক্কা দিতে পারে। আর এদিকের ইস্মার্ট বাঙ্গালী খেয়ালই করে নাই নীরব নামের একজন মডেল ইতিমধ্যে ১৪ টি ছবি করে ফেলেছে, ইমন নামের একজন নিরন্তর চেষ্টা করছে। বাঙ্গালী চ্যানেল আই ফারুকির চক্করে পরে ডায়লগ বেইস সস্তা নাটকের ফান্দে ধরা খাইছে সেইটা সে এখনও বুঝে নাই। অনন্ত কোটি কোটি টাকা ঢালতেছে, তার সাক্ষাৎকারে সে বলেছে, ‘আমি বিশ্বমানের ছবি বানাতে চাই’; বাঙ্গালী খেয়াল করে নাই লোকটি ভাল ছবি বানানোর কথা বলে নাই, বলেছে বিশ্বমানের ছবির কথা তারমানে সেত কিছু একটা করতে যাচ্ছেই; আর বাঙ্গালী তুই কিনা তার পিছেই লাগলি?...... পুনুশ্চঃ মানুষ হলে গিয়ে যা দেখে তাই চলচিত্র। যে ছবি ছবি দর্শকদের আনন্দ দেয় তাই সফল ছবি। সিনেমা মানেই হল আর দর্শক। এই দুটা নির্ভর করে টাকা ঢালা আর টাকা উঠানোর উপর। এই দুইটা ঠিক থাকলে অন্য দুইটা হল আর দর্শক বাইচ্যা থাকে। যখন এই দুইটা বাঁচে কেবল তখনই প্রশ্ন উঠে ওইটা কি ছিল? সিনেমা নাকি ছিঃ নেমা? //
আসুন অনন্ত সম্পর্কে কিছু জেনে নেই। জলিল ছিলেন একটা গার্মেন্টস এর আয়রন ম্যান। যে ব্যক্তি এই অবস্থা থেকে গার্মেন্ট ফ্যাক্টরির মালিক হতে পারে, আজকের ‘অনন্ত’ হতে পারে তাকে নিয়ে অন্যভাবে না ভাবলে আপনি ভুল করছেন। তিনি সাধারণ স্বপ্নদ্রষ্টা নন। তিনি একটা মাল। একেবারে বাঙালী মাল, খাটি বাঙালীর মত সে ভুলভাল ইংরেজি বলে আর ভাঙ্গা গলার উচ্চারণ শুনে আপনি হাসেন। মনে রাখবেন একটা ভাষিক দক্ষতা অর্জন নিঃসন্দেহে ভাল গুন কিন্তু তা স্মার্টনেসের মানদণ্ড হতে পারে না। আপনার দেশের মানুষেরা তো ক্লাস ওয়ান থেকে ষোল ক্লাস নাগাদ ইংরাজি পরে কয়জন আপনারা শুদ্ধ একসেন্ট ওয়ালা বিশুদ্ধ ইস্মার্ট বাঙালী? আপনি ভাষা বিকাশের সময় সীমাটা জানেন কি? চাইল্ড ডেভেলাপমেন্ট এর থিওরি অনুযায়ী তা ১.৫-৮ বছর। পাঠকদের মধ্যে যারা মাতৃভাষা মাতৃভাষা করে গলা শুকানো সুশীল আছেন তাদের বলি এইসব মাতৃভাষা কোন আলাদা বিষয় না। ২ বছরের বাচ্চারে যে সমাজে রাখবেন তার সেই ভাষার উচ্চারণ মুখে নিয়ে বেড়ে উঠবে, সেই ভাষাই হবে তার মাতৃভাষা। একফোঁটা ঝামেলা থাকবেনা সেখানে। অনন্ত সেই জিনিস যে বাংলা ছবির এডিটিং করাইতে গেছে হলিউডের ইউনিভার্সাল স্টুডিওতে। আর বুয়েটের শিক্ষার্থিদের পোস্টারে আকা, ‘ইউ পম গানা, ইউর মা...আম...আম...মাদার পম রাশিয়া...ইউ ইটিং ফুড ইন বাংলাদেশ’
হে বুয়েটের শিক্ষার্থিগন, যে রাষ্ট্র দরিদ্র জনগনের ট্যাক্সের টাকায় আপনাদের শিক্ষিত করে তুলতেছে সেই আপনারা কি কখনো রাষ্ট্রটির ফ্লিম ইন্ডাস্ট্রির জন্য একটা এডিটিং ল্যাব বুয়েটে থাকার প্রয়োজনীয়তা উপলিব্ধি করেছেন। আপনার পড়াশুনা শেষ হলে নিশ্চয়ই স্কলারশিপ নিয়ে ক্যালক্যাটে যাবেন। হলিউডতো ওখানেই। যাবার আগে অনন্তের সাথে নিজেকে দাড়িপ্ললায় মাপ দিয়ে ওজন দেখে যাবেন মনে করে।
সোয়াদ আহমেদ
৪ সেপ্টেম্বর, ২০১২

অনুগ্রহ করে অপেক্ষা করুন। ছবি আটো ইন্সার্ট হবে।




