একটা স্কলারশিপ নিয়ে একবার থাইল্যান্ড গিয়েছিলাম। আমাদের ইউনিভার্সিটির খুব কাছেই ছিল তালাত থাই মার্কেট । এশিয়ার অন্যতম বড় সবজি,ফল ও ফুলের বাজার। আমের মৌসুমে আমের খোঁজে সেখানে গেলাম একদিন সহপাঠিরা দল বেধে। মার্কেটের বিক্রেতাদের প্রায় সবাই মেয়ে, বেশিরভাগই সুন্দরী তবে ইংরেজি জ্ঞানহীন মূর্খ মানবী একেকজন। তাই তাদের কাছে জানারও উপায় ছিলনা এত বড় বাজারে কোথায় আছে আম। তাই খোঁজ দ্যা সার্চ অভিযান চালাতে হলো নিজেদেরই। রীতিমত গরুখোজা শেষে অবশেষে আমরা পাইলাম, ইহাকে পাইলাম। তবে ইহাকে পাইলেও কিনিতে গিয়া বুঝিলাম যে এখানে বাঘের চোখ পাওয়া সম্ভব হইলেও আম কেনা সহজ হইবে না । জানা গেল পাইকারী বাজার বিধায় এখানে ২০ কেজির কম আম নেয়ার সুযোগ নাই। আম টক না মিষ্টি জানারও উপায় নাই। আমার দেশে না হয় কেটে খেয়ে দেখা যায়। যাই হোক নো রিস্ক নো গেইন। এসেছি যখন আম আজ কিনেই ছাড়ব। আম বিক্রেতা এক বুড়ি। তার কাছে থাই ছাড়া বাকি সব ভাষা হিব্রুভাষা সমতুল্য। যাহা বাংলা তাহাই ইংরেজি।
'কি আম?' হাসান জানতে চাইল শুদ্ধ বাংলায়?
জবাবে বিচিত্র কয়েকটা শব্দ শুনলাম। আমরা নিজেদের মুখ চাওয়া-চাওয়ি করলাম। আমাদের কাছেও থাইভাষা হিব্রু সমতুল্য।
আমি একটা আম ছুরি দিয়ে কেটে দিতে বললাম তাকে। মুরাদ নিজের আঙুল ছুরি বানিয়ে আমের উপর পোজ দিয়ে বোঝাতে চাইল ব্যাপারটা । এটা দেখে মুরাদের হাত থেকে বুড়ি আম নিয়ে নিলেন। হয়তো ভাবলেন আমরা কোথাকার কোন আবুলের দল যারা ছুরি দিয়ে কেটে খেতে হয় তাই জানেনা।হতাশ হয়ে আমি একটা আম নিয়ে চুষে খাবার ভঙ্গি করতে চাইলাম। পরে এই পদ্ধতি বাদ দিলাম। পিছনে আবার বুড়ির সুন্দরী নাতনী বই নিয়ে বসে আছে। ঈভটিজিং এর ফ্যাকড়ায় পড়লে মহাবিপদ হবে এখানে । সবে মাত্র আমরা তখন থাই ভাষায় 'খাপ কুন খা' অর্থাৎ 'আপনাকে ধন্যবাদ' এই একটা বাক্যই শিখেছিলাম। মাইর খেয়ে থাই ভাষায় তাদেরকে ধন্যবাদটাই শুধু বলতে পারব।
বুড়ি একটু পর নাতনিকে সামনে ডেকে আনল। এতে আমরা সবাই ব্যাপক খুশি হলাম। মেয়ে যেহেতু পড়াশোনা করে তখন তার একটু আধটু হলেও তো ইংরেজি জানার কথা। এহসান ভাব নিয়ে শুরু করল, 'হাউ সুইট!' আড়চোখে তাকালাম আমরা ওর দিকে। মেয়েটাকে বলল নাকি আম কেমন মিষ্টি জানতে চাইল বোঝা গেল না। হাসান প্রশ্নটা বাংলা ইংরেজির খিচুরি দিয়ে আরেকটু ক্লিয়ার করল, 'ম্যাংগো হাউ সুইট,মানে আম কি মিষ্টি?'
হা করে চেয়ে থাকলো অবুঝ তরুণী।
সুন্দরী বিক্রেতার আবির্ভাবে উদ্দিপনা উপচে পড়ছিল তরুণ বাঙালী ক্রেতাদের। হাত,পা মাথা,মুখ,জিহবা একসাথে ব্যবহার করে আমরা তরুণীকে জানানোর চেষ্টা করলাম আমাদের চাহিদা। আফসোস! আমাদের সব চেষ্টা ব্যথ'। তরুণী অবুঝই রয়ে গেল। আমাদের অসহায়ত্ব ততক্ষনে তরুনীর মধ্যে সঞ্চারিত হয়েছে। আমাদেরকে বোঝার প্রাণপন চেষ্টা করছিল। একসময় মেয়ে ম্যাংগো,সুইট শব্দগুলো বুঝতে সক্ষম হলো । হতাশার অন্ধকার ভেদ করে এক চিলতে আশার আলো দৃশ্যমান হলো। হাজার হলেও পড়ুয়া মেয়ে। নানীর মত মূর্খ না।
মেয়েটা হঠাৎ দৌড়ে ক্যালকুলেটর আনতে ছুটল। আমাদের অঙ্ক শেখাবে নাকি! ২০ কেজি আমের দাম ঝুড়িতেই লেখা আছে। ২০ কেজি আমের দাম এত হলে ১ কেজি আমের দাম কত? সুন্দরী বিক্রেতার কাছে ঐকিক নিয়ম শিখে নিলাম।
অঙ্ক শেখা শেষে আমি জানার চেষ্টা করলাম, চিনির মত মিষ্টি হবে কিনা? 'আর দিজ ম্যাংগো লাইক স্যুগার?'
স্যুগার শব্দটা হয়তো বুঝল মেয়ে কিন্তু দোকানে আম ছাড়া যে সুগার টুগার কিছু বিক্রি হয় না জানিয়ে মাথা নাড়ল । বলল, 'নো সুগার হ্যাভ।'
শেষে মেনটস্ খেয়েই কিনা জানিনা মুরাদের দিমাগ কা বাত্তি জ্বলে গেল। আমাদের ইউনিভার্সিটির থাই প্রোগ্রাম অফিসার মিস ক্লুয়ামাইকে ফোন দিয়ে আমাদেরকে এহেন বিপদে সাহায্য চাইল। প্রব্লেম সল্ভড্। দোভাষীর দায়িত্ব নিয়ে আমাদের আম কিনে দিলেন তিনি। অন্যের সহযোগিতা নিয়ে আম কেনার সুকঠিন পরীক্ষায় পাশ করলাম। বাসায় এসেই আমের উপর ঝাপিয়ে পড়লাম সবাই মিলে। বিদেশি আম, না জানি কত রস তার!
প্রিয় পাঠক, আমগুলো কেমন ছিল জানতে চেয়ে বিব্রত করবেন না। যেমনই হোক আমগুলো কিনে আমরা কিন্তু মোটেও হতাশ হইনি সেদিন। আমগুলো যেমনই হোক তবু তা মিষ্টি মেয়ের আম! অনেক সাধের সে আম!!
সর্বশেষ এডিট : ০৩ রা জুন, ২০১৭ রাত ২:৫৩