somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

" ঈদের কেনাকাটা ও এক পাটি জুতার গল্প "

১৫ ই সেপ্টেম্বর, ২০১০ দুপুর ১২:১৮
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

ঈদ এলেই কেনাকাটার জন্য বাজেট করতে হয়। সবার শীর্ষে দুই সন্তান। তারপর স্ত্রী, মা, ভাই, ভাইয়ের বউ। আত্মীয়স্বজন, পড়শি, বুয়া থেকে শুরু করে সিকিউরিটি গার্ডও বাদ পড়ে না। হিসাব করে দেখলাম, এই হিসাব প্রায় ৪০ হাজার টাকায় গড়িয়েছে। যার মধ্যে আমার জন্য এক টাকা বরাদ্দ রাখাও সম্ভব হয়নি।
চল্লিশোর্ধ্ব একজন মানুষের জন্য যদি ঈদের কেনাকাটায় বরাদ্দ কিছু না থাকে, তাতে কিছু যায়-আসে না। বরং না থাকাটাই স্বাভাবিক। স্বাভাবিক প্রায় সবার কাছে—স্ত্রী, সন্তান বা বন্ধু। শুধু স্বাভাবিক নয় মায়ের কাছে। প্রথমেই মা প্রশ্ন করেন, ‘তুমি কিছু কিনেছ বাবা।’
মায়ের জন্য বরাদ্দ আট হাজার টাকা কীভাবে পাঠানো যায়, সেটা নিয়ে কথা বলার জন্য ফোন করেছিলাম, সেটা নিয়ে মায়ের কোনো উদ্বেগ নেই। যদিও এ টাকা না হলে মায়ের ঈদের কেনাকাটা কিছুই হবে না বা সামান্যই হবে। তার পরও মা সবার আগে জিজ্ঞেস করেন, ‘তোমার জন্য কী কিনেছ?’ অথবা বলেন, ‘একটা পাঞ্জাবি কী কিনব? এখানে (ময়মনসিংহে) ভালো পাঞ্জাবিও তো পাওয়া যায় না। কিনব?’ মায়ের উদ্বেগের শেষ নেই। আমার চোখে কি জল?
রাতে বাতি নেভানোর পর দুই ছেলের সঙ্গে টুকটাক গল্প করছি। ঈদ শপিং জামা, জুতা, পাঞ্জাবি। পছন্দ হলো কি না, কারটা ভালো হলো, কারটা বেশি দামি—এসব। বড় ছেলের জন্য সাড়ে তিন হাজার টাকা দিয়ে এক জোড়া জুতা কিনেছি। জিজ্ঞেস করলাম, বাবা, তোমার জুতাটা তো অনেক সুন্দর, তাই না। ‘না বাবা, আমার জুতাটা সুন্দর, তবে সিঞ্জিত আরও সুন্দর একটা জুতা কিনেছে।’ তাই নাকি। আমি দীর্ঘশ্বাস ফেললাম।
ভাবলাম, এ দেশেই অনেক পরিবারের পুরো ঈদের বাজেট হয়তো সাড়ে তিন হাজার টাকা। ওর জুতা কিনতে গিয়েও আমাকে অনেকখানি বেগ পেতে হয়েছে। আর এরই মধ্যে ও অনেকটা আগ্রহ হারিয়ে ফেলেছে, জানি, কয়েক দিন গেলেই এই জুতা ওর আর ভালো লাগবে না।
হঠাৎ করেই আমার ছেলে জিজ্ঞেস করল, ‘বাবা, তোমার জন্য কিছু কিনবে না।’ ছোট ছেলে বলল, ‘আমি বড় হলে বাবা যা চায়, তা-ই কিনে দেব।’ ওর কথা শুনে একটু হাসলাম (মুখে হাসি আর চোখে জল)। বললাম, থ্যাংক ইউ, বাবা। এটাও আমার অনেক বড় পাওয়া।
বড় ছেলেকে আবার জিজ্ঞেস করলাম, বাবা, জুতাটা তোমার পছন্দ হয়নি? হয়েছে, তবে? কী বাবা। না ঠিক আছে। আমি বললাম, বাবা, তোমার জুতার দাম তো সাড়ে তিন হাজার টাকা। আর আমার সাড়ে তিন শ টাকার একটা জুতা হারিয়ে গিয়েছিল, সে জন্য আমার কী মন খারাপ হয়েছিল, শুনবে সেই এক পাটি জুতা হারানোর গল্প।
গল্পের কথা শুনে লাফিয়ে উঠল আমার ছেলেরা, হ্যাঁ বাবা, বলো, বলো। আমি বললাম, গল্প মানে সত্যি ঘটনা। ঠিক আছে, বলো। ছোট ছেলে বলল, বলো না বাবা। ওদের মা তখন গজগজ করছেন, এই মাঝরাতে উনি গল্প শুরু করেছেন। শেষ রাতে আবার উঠতে হবে। সকালে কত কাজ। আর উনি...
শোনো বাবা। আমি এসএসসি পরীক্ষা দেওয়ার পর অনেক কষ্ট করে আমার বাবা (শফিউল হক খান মিল্কী) আমার একটা আবদার রেখেছিলেন। আমাকে ৩৫০ টাকা দিয়ে পাওয়ারের এক জোড়া কেডস (স্নিকার) কিনে দিয়েছিলেন। সেটা ১৯৮২ সালের কথা। ৩৫০ টাকা জোগাড় করতে তখন আমার বাবার অনেক কষ্ট হয়েছিল। তার পরও বাবা আমার সেই আবদার রেখেছিলেন। কালো আর লাল রঙের সেই জুতা পরে আমি যখন হাঁটতাম, তখন মনে হতো আকাশে উড়ছি। তারপর...
সেই জুতা পরে বেড়াতে গেলাম চট্টগ্রামে। বড় কাক্কুর বাসায়। আমি আর আমার সমবয়সী ফুফাতো ভাই। দুজন একই সঙ্গে পরীক্ষা দিয়ে বেড়াতে বের হয়েছি। দুই দিন পর বড় কাক্কু (ব্যারিস্টার সলিমুল হক খান মিল্কী) আমাদের দুজনকে ডেকে বললেন, ‘যা, তোরা দুজন মিলে কক্সবাজার ঘুরে আয়।’ শুনে আমরা কিছুটা উত্তেজিত, আবার কিছুটা চিন্তিত। এর আগে একা কখনো দূরে কোথাও যাইনি। রাতে বাসার বাইরে বা হোটেলে থাকারও কোনো অভিজ্ঞতা নেই। ডেইজী আপা, বড় কাক্কুর ছোট মেয়ে বললেন, ওরা তো এখনো ছোট। একা একা যেতে পারবে কক্সবাজারে? কাক্কু বললেন, পারবে। বুঝিয়ে দিলেন কীভাবে যেতে হবে, কোথায় থাকতে হবে, কীভাবে কখন সমুদ্রসৈকতে যেতে হবে।
কক্সবাজার যাওয়ার এমন সুযোগ হঠাৎ করেই পেয়ে যাব স্বপ্নেও ভাবিনি। তখন আমাদের ১৭ বা ১৮ বছর বয়স। বাসা থেকে বের হতে মা-বাবার অনুমতি লাগে। একটু ভয় ভয় লাগছিল, তবে এক বাক্যেই রাজি হয়ে গেলাম আমরা। বড় কাক্কু আমাদের হাতে এক হাজার টাকা ধরিয়ে দিয়ে বললেন, ‘যা, ঘুরে আয়।’ এক হাজার টাকায় দুজনের কীভাবে কক্সবাজারে তিন দিন থেকে ঘুরে আসতে হবে, সেটাও বুঝিয়ে দিলেন।
পরদিন দুপুর গড়িয়ে যাওয়ার পর আমরা পৌঁছালাম কক্সবাজারে। মাঝারি মানের একটা হোটেলে উঠলাম। বিকেলে গেলাম সৈকতে ঘুরতে। তখনো আমার পায়ে সেই সাধের জুতা জোড়া। সমুদ্রের বিশালতায় হারিয়ে গেলাম। জুতা জল-বালুতে একাকার। একপর্যায়ে জুতা খুলে হাতে নিলাম। বিশাল সমুদ্রবক্ষে আবির রং ছড়িয়ে দিয়ে ধীরে ধীরে অস্ত গেল লাল সূর্য। মোহাবিষ্ট হয়ে তাকিয়ে থাকলাম সেদিকে।
সূর্যাস্তের পর হোটেলে ফিরছি। রিকশায়। ভেজা বালুমাখা কেডস রিকশার পাটাতনে। গল্পে মশগুল দুজনে হোটেলে ফিরলাম একটু পরই। রিকশা থেকে নামতে গিয়ে দেখি জুতার এক পাটি নেই। রাস্তায় পড়ে গেছে কোথাও। ছাঁৎ করে উঠল বুকের ভেতরটা। মনে হলো, সর্বস্ব হারিয়ে ফেলেছি। আবারও রিকশা নিয়ে ছুটলাম সেই পথেই। কিন্তু এত সাধের সেই কেডস আর ফিরে পেলাম না। আমার সব আনন্দ যেন নিমেষেই হারিয়ে গেল সেই এক পাটি জুতার সঙ্গে।
সমুদ্রের বিশালতা উন্মাতাল ঢেউ কিছুই আমায় স্পর্শ করছিল না। মন ভারী দেখে বিরক্ত হয়ে উঠল আমার ফুফাতো ভাই। শেষমেশ বলেই ফেলল, ‘চল, ফিরে যাই, আর ভালো লাগছে না।’
পরদিনই ফিরে এলাম চট্টগ্রামে। ডেইজী আপা জিজ্ঞেস করলেন, কি রে, এত তাড়াতাড়ি ফিরে এলি কেন? আমার ফুফাতো ভাই বলল কেডস হারানোর কাহিনি। জুতার ফিতা ধরে উঁচু করে ডেইজী আপা বললেন, এই এক পাটি তুই ফিরিয়ে নিয়ে এসেছিস কেন? এটা দিয়ে কী হবে? বলে আর হাসে... এমনিতেই খুব সামান্য বিষয় নিয়েই আপা হাসতে পারেন। আর এটা নিয়ে হেসে কুটি কুটি। আপা হাসছে আর আমার বুকের মধ্যে গুমরে মরছে চোখের জল না ফেলা দুঃখ। কি, বুঝতে পারছ? হ্যাঁ বাবা, খুব আস্তে উত্তর দিল আমার বড় ছেলে।
শোনো বাবা, আপাকে আমি কিছুতেই বোঝাতে পারিনি, কাউকেই হয়তো বোঝাতে পারব না, কী ফেলে এসেছি, কতটা কষ্ট পাচ্ছি! কোথায় হারিয়ে গেছে, আমার সেই অসম্ভব প্রিয় এক পাটি কেডস। ডেইজী আপা কিছুটা মনে হয় বুঝতে পেরেছিলেন। বললেন, চল, নিউমার্কেটে। তোকে জুতা কিনে দিচ্ছি। সেই জুতা আর নেই। আর কোনো দিন খুঁজেও পাব না। কিন্তু স্মৃতি আর কষ্ট এখনো খুব স্পষ্ট করেই লেগে আছে। আর কানে বাজে সেই হাসি। মন খারাপ হয়ে যায় অজান্তেই।
শুনছ বাবা। নাকি ঘুমিয়ে পড়েছ? শুনছি বাবা। মন খারাপ করে জবাব দিল আমার ছেলে। ‘বাবা, আমি কখনো জুতা হারাব না।’ না বাবা, সে জন্য বলিনি। বলছি, তোমরা না চাইতেই পেয়ে যাও, সেগুলো আসলে শুধু দামি হলেই হয় না। ভালো লাগতে হয়। না হলে মনে হয় কিছুই পাইনি। সামান্য সেই জুতাই আমার কাছে ছিল অনেক বড় কিছু। একসময় তুমিও হয়তো বুঝবে অথবা বুঝবে না। জুতাটা এখানে কিছু নয় বাবা, আবার অনেক কিছু। সেই জুতা হারানোর যে কষ্ট, সেটাই অনেক বড়। সেই ৩৫০ টাকার জুতাই আমার কাছে অনেক প্রিয়। আবার সাড়ে তিন হাজার টাকার জুতাও হয়তো তোমার কাছে কিছু না। বুঝে না-বুঝে আমার ছেলে বলল, ‘বাবা, আমি বুঝতে পারছি।’ ভাবলাম, আমার ঈদের বাজেট, সেই হারিয়ে যাওয়া জুতার জন্য মন খারাপ করা কিংবা মায়ের আকুতি—সবই কি হারিয়ে যাবে, নাকি মনে করিয়ে দেবে, ঈদ মানেই আনন্দ আর কষ্টের ভাগাভাগি। সবাইকে বোঝার চেষ্টা, নিজের কষ্ট চেপে রেখে অন্যকে খুশি করার চেষ্টা কিংবা কিছুই কিছু না। হয়তো সবই একদিন হারিয়ে যাবে সেই এক পাটি জুতার মতো। কিংবা হারিয়ে গিয়েও বেঁচে থাকবে মনের মধ্যে।
সূত্রঃ প্রথম আলো ; ১৫-০৯-২০১০
২টি মন্তব্য ২টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

আমি আর এমন কে

লিখেছেন রূপক বিধৌত সাধু, ১৩ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ বিকাল ৪:১৩


যখন আমি থাকব না কী হবে আর?
থামবে মুহূর্তকাল কিছু দুনিয়ার?
আলো-বাতাস থাকবে এখন যেমন
তুষ্ট করছে গৌরবে সকলের মন।
নদী বয়ে যাবে চিরদিনের মতন,
জোয়ার-ভাটা চলবে সময় যখন।
দিনে সূর্য, আর রাতের আকাশে চাঁদ-
জোছনা ভোলাবে... ...বাকিটুকু পড়ুন

২০২৪ সালের জুলাই মাস থেকে যেই হত্যাকান্ড শুরু হয়েছে, ইহা কয়েক বছর চলবে।

লিখেছেন জেন একাত্তর, ১৩ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ সন্ধ্যা ৬:৪৭



সামুর সামনের পাতায় এখন মহামতি ব্লগার শ্রাবনধারার ১ খানা পোষ্ট ঝুলছে; উহাতে তিনি "জুলাই বেপ্লবের" ১ জল্লাদ বেপ্লবীকে কে বা কাহারা গুলি করতে পারে, সেটার উপর উনার অনুসন্ধানী... ...বাকিটুকু পড়ুন

রাজাকার হিসাবেই গর্ববোধ করবেন মুক্তিযোদ্ধা আখতারুজ্জামান !

লিখেছেন সৈয়দ কুতুব, ১৩ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ রাত ১১:১৮


একজন রাজাকার চিরকাল রাজাকার কিন্তু একবার মুক্তিযোদ্ধা আজীবন মুক্তিযোদ্ধা নয় - হুমায়ুন আজাদের ভবিষ্যৎ বাণী সত্যি হতে চলেছে। বিএনপি থেকে ৫ বার বহিস্কৃত নেতা মেজর আখতারুজ্জামান। আপাদমস্তক টাউট বাটপার একজন... ...বাকিটুকু পড়ুন

চাঁদগাজীর মত শিম্পাঞ্জিদের পোস্টে আটকে থাকবেন নাকি মাথাটা খাটাবেন?

লিখেছেন শ্রাবণধারা, ১৪ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ দুপুর ১২:৫৭


ধরুন ব্লগে ঢুকে আপনি দেখলেন, আপনার পোস্টে মন্তব্যকারীর নামের মধ্যে "জেন একাত্তর" ওরফে চাঁদগাজীর নাম দেখাচ্ছে। মুহূর্তেই আপনার দাঁত-মুখ শক্ত হয়ে গেল। তার মন্তব্য পড়ার আগেই আপনার মস্তিষ্ক সংকেত... ...বাকিটুকু পড়ুন

ধর্মীয় উগ্রবাদ ও জঙ্গী সৃষ্টি দিল্লী থেকে।

লিখেছেন সৈয়দ মশিউর রহমান, ১৪ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ বিকাল ৩:১৫


((গত ১১ ডিসেম্বর ধর্মীয় উগ্রবাদ ও জঙ্গী সৃষ্টির ইতিবৃত্ত ১ শিরোনামে একটা পোস্ট দিয়েছিলাম। সেটা নাকি ব্লগ রুলসের ধারা ৩ঘ. violation হয়েছে। ধারা ৩ঘ. এ বলা আছে "যেকোন ধরণের... ...বাকিটুকু পড়ুন

×