somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

গ্রেট ওশেন রোড ধরে ছুটে চলা এবং টুয়েলভ এপোসোলস-২

২৭ শে জানুয়ারি, ২০১২ রাত ১২:১৪
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :


প্যাকেনহ্যাম থেকে মেলবোর্ন শহর, জিলং, এন্জেল সী, লরনে বীচ পেরিয়ে এপোলো বে তে পৌঁছতে পৌঁছতে আমাদের বিকেল হয়ে গেল। গ্রেট ওশেন রোড এবং সেখানকার মূল আকর্ষণ পোর্ট ক্যম্পবেল এর টুয়েলভ এপোসল তখনো অনেক দূর। আমাদের রাব্বী ভাই ব্যাকপেইন নিয়ে এতক্ষন ড্রাইভ করেছেন। উনার এবং বড়পার কিভাবে যেন মনে হয়েছিল এপোলো বে তে গেলেই টুয়েলভ এপোসল পাওয়া যাবে! অনেকদিন আগে আসবার জন্যই হয়তো তারা ভুলে গেছিলেন। আমি তো গুগল ম্যাপে দেখছি মন্জিল এখনো বহুদ্দুর! রাব্বী ভাই নিজেও খবর নিয়ে এলেন আরো প্রায় তিন ঘন্টা ড্রাইভ বাকী। এতটা পথ ড্রাইভ করতে হবে ভাবতে আমরা দুইবোন বললাম বরং ফিরে যাই। কিন্তু তিনি ততক্ষনে ক্ষেপেছেন। পোর্ট ক্যম্পবেল যেয়ে তবে ছাড়বেন। মনে মনে খুশীই হই আমি। এতদূর এসে ফিরে যাব মনে হতে খারাপই লাগছিল। হয়তো তিনি এটা বুঝতে পেরে আবার চলতে শুরু করলেন।

এপোলো বে থেকে পোর্ট ক্যম্পবেল যাবার পথে গ্রেট ওটওয়ে ন্যাশনাল পার্ক পেরুতে হবে। এই পথটুকু আসলে গহীন জঙ্গল। পাহাড় আর ঘনবন। একবার পাহাড়ের নীচে ভ্যালী ছুঁয়ে চলছে গাড়ী, চলছে তো চলছেই। এত সুনশান নীরব পথ। চারাপাশে গাড়ীঘোড়া জনমানুষের নামগন্ধ নাই। শুধু পুরো ভ্যালীতে গরু ঘাস খাচ্ছে।



অনেক পরে পরে একটা দুটা বাড়ী। একসময় গাড়ী সমতল ছেড়ে উঁচুতে উঠতে শুরু করে। গহীন পাহাড়ী বনের মাঝখান দিয়ে সরু আকাবাঁকা রাস্তা। একে তো বিকেল, তার ওপর ঘন বনের জন্য আরো আলো আঁধার হয়ে কেমন যেন একটা থমকে যাওয়া সুন্দর। এখানকার বেশির ভাগ বন হল "বৃষ্টিস্নাত বন" (রেইন ফরেস্ট), তাই বনপথ ভেজা, বৃষ্টির জন্যই কিনা কে জানে, ঝরা পাতা পড়ে আছে পথ জুড়ে। সুন্দর, তবু কেমন গা ছমছম করে। অতিমাত্রার নীরব বলেই হয়তো। জাফনা এরই মাঝে ঘুমিয়ে গেছে আমার কোলে মাথা রেখে। তাই ছবি তোলার খুব সুবিধা করতে পারছিনা। কিন্তু একরকম দম বন্ধ করে নিরবে এই স্তব্ধ প্রকৃতিকে দেখছি বিস্ময়ে, মুগ্ধতায়। সবাই নীরব, গাড়ি ছুটে চলছে শুধু। অনেক পর পর এক একটা গাড়ী হয়তো অপর পাশ থেকে পাশ কাটিয়ে যায়। দীর্ঘপথ এই রকম চলে গহীন বন থেকে বের হতে পারি আমরা। অর্থাৎ ন্যাশনাল পার্কের গন্ডি থেকে বের হই। এরপর আবার আমাদের কনফিউজড হবার পালা। পথ কেন ফুরায় না। ঠিক পথে আছি নাকি কে জানে। এই নিত্যকার সমস্যা আবার পেয়ে বসে আমাদের। এই এক জ্বালা আর কি। তিনজনই তিনরকম বলি আর গাড়ী তারপরও চলছে যে কোন একদিকে। পরে অবশ্য দেখা যায়, পথ ঠিকই ছিল।








ক্রমশঃ বিকেল শেষ হয়ে আসছে। এদিকে গন্তব্যে পৌঁছা হল না এখনো। আবার কোথায় রাত্রিকালীন আস্তানা হবে তারও কোন কিছু ঠিক করা হয়নি। এইরকম করতে করতে একটা মোটেল এ থামা হল থাকার ব্যবন্থা দেখার জন্য। তারা জানাল, টুয়েলভ এপোসল একবারেই কাছে, সেটি পেরুলেই পোর্ট ক্যাম্পবেল এ থাকবার ভাল জায়গা মিলবে। টুয়েলভ এপোসল এর কাছে জনমানুষের জটলা দেখেই বোঝা গেল এই সেই স্থান। তবে শীতের সেই গোধূলী বেলায় শুরু হল টিপটিপ বৃষ্টি। তাই গাড়ী থেকে কোনরকমে নেমে এই ক্ষয়ে যাওয়া খাড়া পাহাড়ের সৌন্দর্য অল্প সময়ই দেখা গেল।







টুয়েলভ এপসোলস মূলত কতগুলো ক্ষয়ে যাওয়া পাললিক শিলা স্তম্ভের সমষ্টি। যেটি মূলত পোর্ট ক্যম্পবেল এ অবস্থিত তবে এদর ব্যপ্তি প্রিন্স টাউন থেকে পিটারবার্গ এলাকা অবধি। এখানকার পাললিক শিলার পাহাড়গুলো অনেক অনেক বছর আগে থেকে সাউদার্ন ওশেন এর উত্তাল ঢেউয়ের দাপটে এবং খারাপ আবহাওয়ার প্রভাবে পাহাড়ের পায়ের দিকে ক্রমশ ক্ষয়ে যেতে থাকে। এক সময় পাহাড়টি একটি ঝুলন্ত পাহাড়ের রূপ নেয়।






একসময় তাও ক্ষয়ে যেয়ে এক একটি প্রায় ৪৫ মিটার উচু খাড়া পাহাড় খন্ড হয়ে একাকি সাগর বুকে রয়ে যায়। এদের একটির সাথে অপরটির সাদৃশ্যই এটিকে পৃথিবীর অন্যতম আকর্ষনীয় স্থান এ পরিণত করেছে। অতীতে ১৯২২ সাল পর্যন্ত এদের নাম ছিল “sow and piglets” ! মাটনবার্ড আইল্যান্ড এলাকার গুলোকে sow এবং ছোট পাহাড় খন্ড গুলোকে piglets নামে ডাকা হোত। পরবর্তীতে এদর সবগুলাকে এপোসোলস নামে ডাকা শুরু হয় পর্যটন এর উদ্দেশ্যে। নামে টুয়েলভ এপসোলস হলেও এখানে কিন্তু বারোটি পাহাড় স্তম্ভ নেই। শুরুতে ছিল নটি, তবু কেন টুয়েলভ এপসোলস বলা হোত কে জানে। এই একাকী পাহাড় খন্ডও প্রতিনিয়ত ক্ষয়ে যাচ্ছে ঢেউয়ের তান্ডবে, ক্ষয়ে যাবার হার নাকি প্রতিবছরে ২ সেমি করে। এর ফলে ২০০৫ সালের ৩ জুলাই ৫০ মিটার উচু একটি স্তম্ভ ভেঙ্গে পড়ে বাকী আটটিকে রেখে, তাই এখন প্রস্তর স্তম্ভ আছে আটটি। আটটি মায়োসিন পাললিক শিলার পাহাড় খন্ড, যেগুলো একে অপরের থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে বিক্ষিপ্তভাবে উত্তাল সাউদার্ন ওশেনের বুকে একলা একলা দাঁড়িয়ে আছে। (সূত্র: উইকিপিডিয়া )






এই ক্ষয় প্রক্রিয়া হয়তো একদিন আরো এপসোলের জন্ম দেবে।


এই বিশাল সৌন্দর্যকে দেখে এতক্ষনের পথক্লন্তি সব নেই হয়ে গেল। টিপটিপ বৃষ্টি উপেক্ষা করে। আমরা দেখতে লাগলাম শখের সেই টুয়েলভ এপসোলস এর কয়েকটি। এই জায়গাটিকে ঘিরে গড়ে উঠেছে অনেক ট্যুরিস্ট আকর্ষণ। এমনকি হেলিকপ্টারে করে ওপর থেকে বিক্ষুদ্ধ সাগরের বুকে অটল দন্ডায়মান প্রস্থরখন্ডকে দেখে তৃপ্ত হতে পারেন ট্যুরিস্টরা। আমাদের সেই সময় বা অর্থ খরচের ইচ্ছা কোনটাই চির না। যেটুকু দেখেছি তাতেই ধন্য।



এরপর আমরা ছুটলাম মোটেলের খোঁজে। মোটেল যাও পাওয়া গেল ভালই তবে আমাদের রাব্বী ভাই এর ব্যাক পেইন, যে কোন বিছানায় উনি গুমাতে পারেন না। উনার নিজের স্পেশাল বিছানা ছাড়া। তাই উনি উল্টো মেলবোর্ন ফেরার শর্টকাট পথ জানার জন্য ব্যাকুল হয়ে গেলেন। মোটেল মালিক ভাল মানুষ। আমাদের শর্টকাট পথ বলে দিলেন।বাধ্য হয়ে আমরা আবার চললাম। এবার বাতলে দেয়া পথ ভুলে আমরা বনে ঢুকে পড়লাম। মিনিট পাঁচেক ড্রাইভ করার পর আমরা কেউ রাজি হলাম না এই বনপথ ধরে আবার ফিরে যেতে। কি যে গা ছমছম করা পথ। তার ওপর শুরু হয়েছে ঝুম বৃষ্টি। রাব্বী ভাই ব্যাক করলেন বন থেকে। এরপর আমরা আবার খেয়াল করে করে ঠিক পথ ধরে এগুলাম। অনেক পরে হাইওয়েতে উঠতে পেরে মনেপ্রানে শান্তি ফিরে এল।


পাঁচ ঘন্টা ড্রাইভ শেষে ক্লান্ত শ্রান্ত সবাই বাসায় এলাম। যত কস্টই হোক সেদিন ফিরে আসাটা শাপেবর হয়েছিল। কারন পরদিন ছিল তুমুল বৃষ্টি আর হাড় কাঁপানো ঠান্ডা। মেলবোর্নের ইতিহাসে গেল দশ বছরের সবচাইতে কঠিন ঠান্ডা পড়েছিল সেদিন। আমরা বাসায় জমিয়ে গরম কফি কেতে খেতে আমাদের তুমুল সেই জার্নির গল্প করছিলাম আর সেই ফাঁকে প্রথম পর্বটা ব্লগের জন্য লিখে ফেলেছিলাম।
সর্বশেষ এডিট : ০১ লা ফেব্রুয়ারি, ২০১২ রাত ১০:৩৬
১২টি মন্তব্য ১০টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

ছিঁচকাঁদুনে ছেলে আর চোখ মোছানো মেয়ে...

লিখেছেন খায়রুল আহসান, ১৮ ই এপ্রিল, ২০২৪ সকাল ১১:০৯

ছিঁচকাঁদুনে ছেলে আর চোখ মোছানো মেয়ে,
পড়তো তারা প্লে গ্রুপে এক প্রিপারেটরি স্কুলে।
রোজ সকালে মা তাদের বিছানা থেকে তুলে,
টেনে টুনে রেডি করাতেন মহা হুলস্থূলে।

মেয়ের মুখে থাকতো হাসি, ছেলের চোখে... ...বাকিটুকু পড়ুন

অহমিকা পাগলা

লিখেছেন আলমগীর সরকার লিটন, ১৮ ই এপ্রিল, ২০২৪ সকাল ১১:১৪


এক আবেগ অনুভূতি আর
উপলব্ধির গন্ধ নিলো না
কি পাষাণ ধর্মলয় মানুষ;
আশপাশ কবর দেখে না
কি মাটির প্রণয় ভাবে না-
এই হলো বাস্তবতা আর
আবেগ, তাই না শুধু বাতাস
গায়ে লাগে না, মন জুড়ায় না;
বলো... ...বাকিটুকু পড়ুন

হার জিত চ্যাপ্টার ৩০

লিখেছেন স্প্যানকড, ১৮ ই এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ১:৩৩




তোমার হুটহাট
চলে আসার অপেক্ষায় থাকি
কি যে এক ছটফটানি
তোমার ফিরে আসা
যেন প্রিয় কারো সনে
কোথাও ঘুরতে যাবার মতো আনন্দ
বারবার ঘড়ি দেখা
বারবার অস্থির হতে হতে
ঘুম ছুটে... ...বাকিটুকু পড়ুন

জীবনাস্ত

লিখেছেন মায়াস্পর্শ, ১৮ ই এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ১:৪৪



ভোরবেলা তুমি নিশ্চুপ হয়ে গেলে একদম,
তোমার বাম হাত আমার গলায় পেঁচিয়ে নেই,
ভাবলাম,তুমি অতিনিদ্রায় আচ্ছন্ন ,
কিন্তু এমন তো কখনো হয়নি
তুমি বরফ জমা নিথর হয়ে আছ ,
আমি... ...বাকিটুকু পড়ুন

যে দেশে সকাল শুরু হয় দুর্ঘটনার খবর দেখে

লিখেছেন এম ডি মুসা, ১৮ ই এপ্রিল, ২০২৪ রাত ৮:১১

প্রতি মিনিটে দুর্ঘটনার খবর দেখে অভ্যস্ত। প্রতিনিয়ত বন্যা জলোচ্ছ্বাস আসে না, প্রতিনিয়ত দুর্ঘটনার খবর আসে। আগে খুব ভোরে হকার এসে বাসায় পত্রিকা দিয়ে যেত। বর্তমানেও প্রচলিত আছে তবে... ...বাকিটুকু পড়ুন

×