সকালের কাগজে দেখলাম লিখেছে, “কেরলে ক’দিন”। ভাবলাম, পুজোয় কেরালা গেলে মন্দ হয় না। হাঁক পাড়লাম বউকে, শুনছ, এবার পুজোয় ভাবছি কেরালা যাব, খবরের কাগজে সুন্দর লিখেছে, কেরলে ক’দিন। ব্যস, ধুন্ধুমার কান্ড। সে গোড়ার শব্দগুলো মোটেও শোনেনি, শুনেছে, পে-রোলে ক’দিন। চুক্তিমতো মাস শেষ হলে আমার বউয়ের হাতে কিছু টাকা আলাদা করে তুলে দিতে হয়, কারন উনি পড়ান ছেলেকে, যে এখন ‘ক্লাস ওয়ান’। এ মাসের মাঝে ক’দিন বাপের বাড়ি গিয়েছিলেন আমার ‘উনি’ এবং ধরে নিয়েছেন, সে’দিনগুলোর টাকা আমি কাটতে চাইছি। ‘পে রোলে ক’দিন? আমি কি বাড়ির কাজের লোক যে দিনের হিসেব করছ?’ সে এক রণরঙ্গিনী মূর্তি! বলতে তো পারি না, যে উনি পেরলে আমার চৌকাঠ, মনে হয় ক’দিন যেন প্যারোলে আছি। ফলে টাকা কাটার কোনও ব্যাপার নেই এর মধ্যে। এইসব ভাবতে ভাবতে বোধহয় বিড়বিড় করে কিছু একটা বলে ফেলেছিলাম। হুঁশ এল ও-দিকের হুঙ্কারে, যত হিসেব খালি আমার ব্যাপারে। ওদিকে অফিসে কী করে বেড়াও সে কি আমি জানি না ভাবছ?
এই হয়েছে এক জ্বালা! রেগে গেলে ওর মাথার ঠিক থাকে না, যা মাথায় আসে, বলে ফেলে। মানে কথা-বার্তায় আর কোনও মার্জিন থাকে না। এ নিয়ে শ্বশুরমশাইকে অভিযোগ করেছিলাম একবার। উনি বললেন, ও নাকি ওর মার জিন পেয়েছে! আর আমি তো জানি, আমরা পুরুষেরা অফিসে যা কিছু করি, সবটাই ফিসফিস। যদিও ওইসব ‘ফিসি’ ব্যাপার-স্যাপার কী করে যেন ‘ফিস’ এর পর ‘ফাস’ না হয়ে কখনও কখনও ‘ফাঁস হয়ে গলায় এঁটে বসে। তাই পুরোপুরি ফেঁসে যাবার আগে বললাম, পে-রোল নয়, আমি কেরলে যাবার কথা বলেছি। এবারে উল্টোদিকের গলা আরও চড়া। ‘বেড়াতে যাব মানে? টাকা আসবে কোত্থেকে? এই তো সেদিন তোমার বই বের করতে গিয়ে গচ্ছা গেল একগাদা টাকা'।
এই বই আমার খুব দুর্বল জায়গা। বই আর বউয়ের লড়াই বোধহয় সর্বত্র। তার উপরে বইগুলো রেখেছি আবার খাটের নীচে। ফলে বিপত্তি আরও বেড়েছে। খোঁজ নিয়ে দেখবেন, কোনও বাঙালির বাড়িতেই খাটের তলা খালি নেই, সে আপনার যতগুলো ঘর বা আলমারি থাকুক না কেন। পুরোনো হাড়ি, টিনের সুটকেস, নিদেনপক্ষে একটা কাপড়ের পোটলা আপনি ওই খাটের তলায় নিশ্চিত পেয়ে যাবেন। অথচ আপনি যেখানেই বই রাখুন, সেটাই জায়গা নষ্ট। বই নিয়ে বউয়ের অমন খোঁচা খেয়ে ‘কমা’য় দাঁড়িয়ে গেলাম। নিরন্তর এই খোঁচা খেয়ে খেয়ে লাইফটা একদম দু-টাকার নোটের মতো হয়ে গেল মাইরি...। আর এ ছাড়া আমি তো জানি, পাঠক হিসেবে আমার ‘উনি’ সেই বিখ্যাত দর্শকের মতো, যিনি ‘সিরাজদৌল্লা’ নাটক দেখে পাশের একজনকে বলেছিলেন, “এই পলাশি লোকটা কেমন হে, সিরাজ এতবার ‘পলাশি’ ‘পলাশি’ বলে ডাকল, একবারও এল না”। তবুও আমাকে ‘কমা’তে দাঁড় করিয়ে রাখার ব্যাপারে ওর কোনও কমা-কমি নেই। ভয় হয়, এভাবেই হয়ত একদিন, কমা, কমা, ফুলষ্টপ।
এমন বিপদে আমার খুব প্রয়োজন হয় পচা, আমার বন্ধুর সঙ্গে দেখা করার। ও আজকাল এত ব্যস্ত, (কী নিয়ে এত ব্যস্ত কে জানে) যে দেখা পাওয়া খুব কঠিন। তবু কপাল গুনে সেদিন দেখা হয়ে গেল বাজারে। ওকে দেখেই মজা করে বলি,
- শুনেছিস তো, আমার একটা বই বেরিয়েছে। ভাবছি একদম নোবেল কমিটির কাছে পাঠাব রিভিউয়ের জন্যে। যা লিখেছি, নোবেল তো বাঁধা।
- হ্যাঁ, ওটা পেলে, বাকি পুরস্কারগুলো এমনিতেই এসে যাবে। পচা গম্ভীর।
- এটা তো ভেবে দেখিনি।
- ওই তো তোর দোষ, পুরো ব্যাপারটা নিয়ে ভাবিস না। তবে নোবেল পেলে একটা বিপদও আছে।
- বিপদ?
- হ্যাঁ, চুরি হয়ে যেতে পারে, যেমনটা হয়েছে কবিগুরুর ক্ষেত্রে। আর এই একটা ব্যাপারে আমাদের রাজ্য সরকার খুব অসহায় বোধ করে।
- সে তো বোধ করবেই। এতদিন হয়ে গেল, এখনও কবিগুরুর ‘নোবেল’ এর খোঁজ পাওয়া গেল না।
- না, সে জন্যে অসহায় নয়...
- তবে কীসের জন্যে?
- তোরা কোনও কিছু তলিয়ে ভাবিস না। এই যে কবিগুরুর নোবেল চুরি হয়ে গেল, সরকার কি বলতে পারছে, অন্যান্য রাজ্য থেকে এই রাজ্যে নোবেল চুরি কম হয়।
এর পর একটা হেঁচকি তুলে বাড়ির দিকে হাঁটা দিলাম।
বাড়ি ফিরেও পচার সেই নোবেল মাথায় ঘুরছে। বিয়ের দু-এক বছরের মধ্যেই টের পেয়েছি, ন্যাড়া কেন একবারের বেশী বেলতলায় যায় না। তো, পচা আবার বেলের জায়গায় ঢুকিয়ে গেল নোবেল। আচ্ছা, এই নোবেলটা কি আসলে নো-বেল! বেল নয়! পচা কি তবে অন্য কিছু ইঙ্গিত করে গেল! মানে, বিয়ে করেছ মানেই তো নো বেল, জামানত পাওয়া যাবে না। মাথাটা কেমন ঘুলিয়ে গেল। মনে পড়ল, এখন বইমেলা চলছে। যেতে হবে কালই...।
পরদিন বেলাবেলি পৌছে গেলাম বইমেলায়। এই বইমেলা যাওয়া নিয়েও মেলা ঝঞ্ঝাট পোয়াতে হয় সংসারে। ঝগড়ার সারমর্ম, ‘পয়সা নষ্ট’। বইমেলায় হঠাৎ চোখে পড়ল একটা রান্নার বই। লেখিকা শ্রীমতি বেলা দে। কিনে ফেললাম। বই হাতে পেয়ে বউয়ের সে কী আনন্দ! বউ আর বইয়ের এমনধারা সহাবস্থান আমি আগে কখনও দেখিনি। উফ্, এই প্রথম ‘বইমেলা মানেই পয়সা নষ্ট’ নয়। ভাবলাম, বাঁচা গেল, এবার বইমেলার বাকি ক-দিন নিশ্চিন্তে ফুরফুরে আনন্দ নিয়ে ঘুরে বেড়াব।
সে রাতে, বউ কাছে, আরও কাছে। নিজেকে তখন রাতের দুরন্ত ফেরিওয়ালা মনে হচ্ছে। ঠিক তখনই খুব অস্ফুট গলায় আমার ‘উনি’, বইটা দারুণ, কত-কত রান্নার কথা বলা আছে। সব এক-এক করে করব। শুনে, আমিও উচ্ছ্বসিত। সে সুখ যে কত ক্ষণস্থায়ী, সেটা বুঝতে পারলাম একটু পরেই। এর পরেই ওদিক থেকে মাঝরাতি আবদার, জানো, রান্নাগুলো সবই মাইক্রোওয়েভে করতে হবে। এই রোববারে চলোনা, একটা মাইক্রোওয়েভ কিনে আনি। দিদি বলছিল, কিনলে কনভেকশনই ভালো...। আর কিছু মনে নেই, একটু পরেই, পাশ থেকে প্রবল নাসিকা গর্জন, আর আমার মাথায় ঘন্টা বেজে চলেছে একটানা, বেল-নোবেল, বেল-নোবেল, বেল-নোবেল......।

অনুগ্রহ করে অপেক্ষা করুন। ছবি আটো ইন্সার্ট হবে।




