somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

অতঃপর পুনরায় জ্বলে উঠেছিল দুঃখিনী বাংলা বর্ণমালা

২৭ শে ফেব্রুয়ারি, ২০১২ বিকাল ৩:৪৬
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

২৭ ফেব্রুয়ারী, ২০০৪। মহান বাংলা ভাষা অর্জনের মাসে কলঙ্ককময়, অন্ধকারাচ্ছন্ন, চাপাতির আঘাতে ক্ষত-বিক্ষত এক রাত। অমর একুশে বই মেলা প্রাঙ্গণ থেকে বাসায় ফেরার পথে মৌলবাদী জঙ্গীদের ধারালো অস্ত্রে পাশবিকভাবে জখম ও রক্তাক্ত হয়েছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের প্রখ্যাত অধ্যাপক, প্রথাবিরোধী বহুমাত্রিক লেখক, মুক্ত বুদ্ধির জ্ঞানচর্চার অকুতোভয় পথ প্রদর্শক হুমায়ুন আজাদ। মৃত্যু থেকে কয়েক মুহূর্ত দূরে জীবন-মৃত্যু’র সন্ধিক্ষনে দোদুল্যমান ছিল তাঁর অকুতোভয় সাহসী প্রাণ। জঙ্গীদের হিংস্র আঘাতে সারা শরীরে ক্ষত নিয়ে অল্পের জন্যে মৃত্যু’র কাছ থেকে রক্ষা পেয়ে পুনরায় ফিরে এসেছিলেন এই নষ্ট সমাজ জীবনে, যেখানে তাঁকে দূষিত হতে হয়েছিল শানানো অস্ত্রে।
১৯৫২’র একুশে ফেব্রুয়ারী স্বাধীনভাবে মায়ের ভাষা বলার অধিকার আদায়ে দূর্বার সাহসে ছাত্র-জনতার মিছিলের শ্লোগানে জ্বলে উঠেছিল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় অঙ্গন। তার পুনরাবৃত্তি হয়েছিল সেই সময়কালে; যখন মৃত্যু’কে উপেক্ষা করে আধুনিক বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের সর্বশ্রেষ্ঠ ভাষাবিজ্ঞানী, কবি, উপন্যাসিক, সমলোচক, দার্শনিক হুমায়ুন আজাদ চিকিৎসাধীন ডাক্তারদের সঠিক চিকিৎসা-সেবায় জীবনে ফিরে আসতে প্রাণপন চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছিলেন সমগ্র বাঙালী জাতির জন্যে। সেদিনও দুঃখীনি বাংলা বর্ণমালা, প্রগতিশীল ছাত্রসমাজ পালন করেনি নিশ্চুপ ভূমিকা! বাংলা বর্ণমালা উদ্ভাসিত হয়ে উঠেছিল মিছিলে-শ্লোগানে, ব্যানারে-পোষ্টারে-ফেস্টুনে, দেয়াললিখনে। উদ্বেলিত হয়ে উঠেছিল তাঁর চিরচেনা শিক্ষাঙ্গনসহ গোটা বাংলাদেশ ও প্রবাসে বসবাসরত বাঙ্গালি জনমানুষ। ছাত্রসমাজের গণরোষে কুপোকাত হয়ে তাঁর সুচিকিৎসা করার ব্যবস্থা গ্রহন করেছিল জঙ্গী লালন-পালনকারী তৎকালীন চার দলীয় জোট সরকার। সত্যাশ্রয়ী, প্রতিবাদী ছাত্রসমাজ আর গণমানুষের অকৃত্রিম, অসীম ভালবাসা-শ্রদ্ধায় দেহে ক্ষত চিহ্ন নিয়েই পুনরায় যেন হয়েছিল তাঁর নতুন জন্ম। যা কখনোই চায়নি ধর্মের নামে লেবাসধারী ঐ হটকারীর দলবল ও ওদের ইন্ধদাতা এবং মুখোশধারী পৃষ্ঠপোষকের দল।
যে অদূরবর্তী বাংলাদেশের প্রতিচ্ছবি তাঁর প্রগতিশীল দার্শনিক চিত্তে সবসময় আঘাত করছিল সেই অনাঙ্ক্ষিত, দূর্দশাগ্রস্থ, হতাশাগ্রস্থ মাতৃভূমিকে নিয়ে তিনি রচনা করেছিলেন বাংলা সাহিত্যের অন্যতম শ্রেষ্ঠ উপন্যাস “পাক সার জামিন সাদ বাদ”। যা প্রথম প্রকাশ পেয়েছিল ইত্তেফাক ঈদ সংখ্যা’২০০৩ এ । তারপর, বই আকারে তাঁর অসীম ইচ্ছাশক্তি-উদ্যমে প্রকাশ পায় ২০০৪-এর অমর একুশে বই মেলায়। তথাকথিত ধার্মিক এবং ধর্মান্ধদের কাছে অপ্রিয় হলেও সেখানে নির্মোহ বিশ্লেষণের আঙ্গিকে বিধৃত হয়েছিল চরম সত্য যা দীপ্ত অভিবাদন পেয়েছিল প্রগতিশীল, মুক্তবুদ্ধির মানুষদের কাছ থেকে। উন্মোচিত হয়েছিল ধর্ম ব্যবসায়ীদের কালো মুখোশ, প্রতিক্রিয়াশীলদের পাশবিক কর্মকান্ড। তাই, ইত্তেফাক ঈদ সংখ্যায় বের হবার পরপরই পূর্বের মতোই তাঁর যুক্তিযুক্ত সত্যকে মেনে নিতে পারেনি নষ্ট সমাজের ঐসব ঘৃণ্য অমানুষেরা। অতঃপর, যারা মানুষখেকো পশুর চেয়েও ভয়াবহ রূপধারন করে জীবনের তরে নিঃশেষ করে দিতে চেয়েছিল তাঁকে। তখনও মৃত্যু দমিয়ে রাখতে পারেনি হুমায়ুন আজাদ’কে।
এ দেশের মানুষের অজেয় ভালবাসায় সিক্ত হয়ে ব্যাংককে সুচিকিৎসা নিয়ে পুনরায় ফিরে এসেছিলেন বাংলাদেশে। ধীরে ধীরে আগের অবস্থায় পৌঁছানোর লক্ষ্যে প্রস্তুত করতে থাকেন নিজেকে। সর্বদা অন্যায়ের প্রতি আপোসহীন সেই মহামানব কখনো টলেননি অপরাধী পশ্চাদগামীদের প্রতিনিয়ত হুমকিতে যা তিনি প্রথম সম্মুখীন হয়েছিলেন নারীবাদের গবেষণামূলক মহাগ্রন্থ ‘নারী’ রচনায়। তারপর হুমকি, যুক্তিহীন নিন্দা, অযাচিত সমলোচনা ও বিতর্ক প্রাত্যহিক ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছিল তাঁর কাছে। তবুও থেমে থাকেনি তাঁর বিরামহীন জ্ঞান অন্বেষণ, সত্যনিষ্ঠ-যুক্তিযুক্ত গ্রন্থ রচনা।
হামলার প্রায় ছয় মাস পর ৭ আগষ্ট, ২০০৪ তথাকথিত গণতত্রের রূপধারী সরকারের সূচালো ষড়যন্ত্রে তাঁকে পেন-এর আমন্ত্রনে পাঠানো হয়েছিল জার্মানীর মিউনিখ শহরে জার্মান কবি হাইনরিশ হাইনের উপর বৃত্তিমূলক গবেষণায়। পাঁচ দিন পর, ১২ আগষ্ট, ২০০৪ অপরাধচক্রের সুক্ষ চক্রান্ত্রে অমীমাংসীত কাজ সঙ্ঘটিত হবার মাধ্যমে একনায়কখ্যাত হিটলারের দেশে তাঁকে চিরতরে বিদায় নিতে হলো আকস্মিকভাবে; অনেকটা প্রশ্নবিদ্ধ হয়ে।
বাতাসের প্রকোপে প্রদীপ নেভার আগে শেষবারের মতো জ্বলজ্বল করে জ্বলে উঠে; মনে হয় সেই আগুনে পুড়ে ছাড়খার হয়ে যাবে চারপাশ। দেশমাতৃকার প্রতি অশেষ ভালবাসা-শ্রদ্ধায় হুমায়ুন আজাদও জ্বলে উঠতে চেয়েছিলেন পুনরায় সত্য প্রকাশে অটল থেকে অন্ধকারের কালো হাতগুলোকে চিরতরে গুড়িয়ে দিতে। বাংলা ভাষা ও সাহিত্যকে আরো সমৃদ্ধ করার লক্ষ্যে স্বাধীনভাবে জ্ঞানচর্চার জন্যে বাংলাদেশের দম আটকানো, ত্রাসগ্রস্থ, বিপদগ্রস্থ পরিবেশ থেকে সরে এসে শেষবারের মতো হলেও জ্বলার চরম আকাঙ্ক্ষা সম্ভবত তাঁর মনে ছিল। তাই, হয়ত বৃত্তি দিয়ে জার্মানিতে পাঠানো তাঁর কাছে ষড়যন্ত্র মনে না হয়ে; উপলব্ধি বোধে জীবন আশ্রয়ের শেষ স্থল হিশেবেই জেগেছিল।
যাইহোক, এখনো তাঁর উপর সেই হামলার সঠিক বিচার শেষ হয়নি। অপরাধী চোখের সামনে বন্দী থেকেও বিচারের জন্যে তদন্ত কার্যক্রম চলছে। যেসব ধর্মীয় ভন্ড, যুদ্ধাপরাধী দেলোয়ার হোসেন সাঈদী, মতিউর রহমান নিজামী আরো অনেকে হুমায়ুন আজাদকে বহুবার বিভিন্ন সভা-জলসায় ‘মুরতাদ’ বলে আখ্যায়িত করেছে এমন কি তাঁর উপর বর্বোরচিত হামলার পর “জাতীয় সংসদ”-এ পর্যন্ত তাঁকে নিয়ে ব্যঙ্গ-বিদ্রুপ করে হামলাকে সাধুবাদ জানিয়েছে, সেসবের প্রমাণ থাকা সত্বেও কেন থেমে আছে ওদের অন্যায়ের নায্য বিচার? ওদেরকে রিমান্ডে নিয়ে সঠিকভাবে জ্ঞিজ্ঞাসাবাদ করলেই বেড়িয়ে পড়বে থলের বিড়াল! কারন, সর্ষের ভেতরেই ভূত লুকিয়ে রয়েছে!
আমাদের বাংলাদেশে কোন প্রতিভাবান বরেণ্য ব্যক্তি প্রয়াত হলে তাঁর মৃতদেহের সামনে লোক দেখানো শ্রদ্ধার ফুলমাল্য অর্পণ করা হয়, দুই-চারটা স্মরণ-শোক সভা করা হয়, তারপর তাঁর পরিবার কিংবা তাঁর জন্যে সহানুভূতির হাত সমাজ কিংবা রাষ্ট্র বাড়ায় না। আর মৃত্যুর পর অসামান্য প্রতিভা ও তাঁর সৃষ্টিকর্ম কিংবদন্তিতুল্য হিশেবে সাময়িকভাবে আখ্যায়িত হয়। সুস্থ থাকলে সেইসব ব্যক্তির পাশে কোন সহ্রদয়বান মানুষ কিংবা রাষ্ট্র ভুল করেও পাশে এসে দাঁড়ায় না যদি রাষ্ট্র পরিচালিত সরকার ও এই প্রথাগত সমাজকে সেই ব্যক্তি গঠণমূলক সমালোচনা করে তাঁর সৃষ্টিকর্মে।
হুমায়ুন আজাদের এই প্রবচনটিকে বিনম্র চিত্তে স্মরণ করেই উপরোক্ত বচনগুচ্ছ লিখলাম-"বাঙালি মুসলমান জীবিত প্রতিভাকে লাশে পরিণত করে, আর মৃত প্রতিভার কবরে আগরবাতি জ্বালে।" কথাটি যথার্থ প্রমাণিত হলো অজস্র সময় অতিক্রম করে হুমায়ুন আজাদকে “মরণোত্তর একুশে পদক” প্রদান করে।
হুমায়ুন আজাদ স্যারের প্রবচনই তাঁকে নিজেকেই সত্য করে তুললো এবার, যদিও তাঁর অমর সৃষ্টিকর্ম যে কতটুকু সত্যনিষ্ঠ আর গণসাহিত্যের স্তম্ভ; প্রতিনিয়তই তা সত্য সমগ্র জাতির কাছে, মৃত্যুর পর এই রকম সম্মান বলা যায় প্রায়শই মূল্যহীন! তিনি জীবিত থাকলে আমার মনে হয় তা গ্রহণ করতেন না!
কিন্তু, এই করুণ সত্য দেরিতে হলেও নাড়া দিল বাংলাদেশ সরকারের করোটিক স্নায়ুতে আর এর মধ্য দিয়েই প্রমাণ হলো হুমায়ুন আজাদের দর্শন, সৃজনশীলতা-সৃষ্টিশীলতা কতটা দূরদর্শী ও সুদূরপ্রসারী যা তাঁর প্রবাদ প্রবচনগুচ্ছকেই কালজয়ী করে তুলে।
একটি স্বাধীন দেশে প্রত্যেক নাগরিকও তো অন্যায়ের সঠিক বিচার পাবার অধিকার রাখে! তাহলে, কেনই বা হুমায়ুন আজাদের মতো বাঙালী জাতির অন্যতম শ্রেষ্ঠ সন্তানের উপর ঘৃণ্যতর, আদিম পাশবিক হামলার আক্রমনকারীদের শাস্তি এখনো প্রশ্নবিদ্ধ হয়ে থেমে আছে?
০টি মন্তব্য ০টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

রাফসানের মা হিজাব করেন নি। এই বেপর্দা নারীকে গাড়ি গিফট করার চেয়ে হিজাব গিফট করা উত্তম।

লিখেছেন লেখার খাতা, ১১ ই মে, ২০২৪ রাত ১০:৪৩


ছবি - সংগৃহীত।


ইফতেখার রাফসান। যিনি রাফসান দ্যা ছোট ভাই নামে পরিচিত। বয়স ২৬ বছর মাত্র। এই ২৬ বছর বয়সী যুবক মা-বাবাকে বিলাসবহুল গাড়ি কিনে দিয়েছে। আমরা যারা... ...বাকিটুকু পড়ুন

ছাঁদ কুঠরির কাব্যঃ এঁটেল মাটি

লিখেছেন রানার ব্লগ, ১২ ই মে, ২০২৪ রাত ১:৫৬




শাহাবাগের মোড়ে দাঁড়িয়ে চা খাচ্ছিলাম, মাত্র একটা টিউশানি শেষ করে যেন হাপ ছেড়ে বাঁচলাম । ছাত্র পড়ানো বিশাল এক খাটুনির কাজ । এখন বুঝতে পারি প্রোফেসরদের এতো তাড়াতাড়ি বয়স... ...বাকিটুকু পড়ুন

আসুন সমবায়ের মাধ্যমে দারিদ্র বিমোচন করি : প্রধানমন্ত্রী

লিখেছেন স্বপ্নের শঙ্খচিল, ১২ ই মে, ২০২৪ ভোর ৪:১০



বিগত শুক্রবার প্রধানমন্ত্রী নিজ সংসদীয় এলাকায় সর্বসাধারনের মাঝে বক্তব্য প্রদান কালে উক্ত আহব্বান করেন ।
আমি নিজেও বিশ্বাস করি এই ব্যাপারে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী খুবই আন্তরিক ।
তিনি প্রত্যন্ত অন্চলের দাড়িয়ারকুল গ্রামের... ...বাকিটুকু পড়ুন

পাইলট ফিস না কী পয়জনাস শ্রিম্প?

লিখেছেন সায়েমুজজ্জামান, ১২ ই মে, ২০২৪ সকাল ৭:৪০

ছবি সূত্র: গুগল

বড় এবং শক্তিশালী প্রতিবেশী রাষ্ট্রের পাশে ছোট ও দূর্বল প্রতিবেশী রাষ্ট্র কী আচরণ করবে ? এ নিয়ে আন্তর্জাতিক সম্পর্ক অধিক্ষেত্রে দুইটা তত্ত্ব আছে৷৷ ছোট প্রতিবেশি... ...বাকিটুকু পড়ুন

ছেলেবেলার অকৃত্রিম বন্ধু

লিখেছেন ঢাবিয়ান, ১২ ই মে, ২০২৪ সন্ধ্যা ৭:০৯

খুব ছোটবেলার এক বন্ধুর গল্প বলি আজ। শৈশবে তার সাথে আছে দুর্দান্ত সব স্মৃতি। বন্ধু খুবই ডানপিটে ধরনের ছিল। মফস্বল শহরে থাকতো। বাবার চাকুরির সুবাদে সেই শহরে ছিলাম... ...বাকিটুকু পড়ুন

×