somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

অপেক্ষা

০১ লা নভেম্বর, ২০১৮ রাত ৯:৩১
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :



আমি যখন আনমোনা বালিকার মত একটা বিকেলকে দেখছি।গাছের পাতাগুলো ধূসর হয়ে আছে। শরত এর বিকেলগুলো ছোট হতে শুরু করেছে । আর আকাশ এর সেই মেঘগুলো ,কিযে সুন্দর!
তুমি,তোমার সকালে হয়তো কোন বই এর দোকান ঘুরে বেড়াচ্ছো। তোমার চশমার পাওয়ার বদলে গেছে আবারো।অনেকদিন আমাদের কথা হচ্ছেনা।
অনেকদিন তুমি আমাকে কোন চিঠি লিখছোনা। অনেকদিন কতদিনে হয় সেকথাই জানতে চেয়েছিলে সেই কবে! খুব ব্যস্ত যে আছো সেকথা বুঝতে পারি।

আসবার আগে প্যারিসের ক্যাফে দ্যু ট্রোসাডেরো তে দেখা হয়েছিল আমাদের। অজস্র মানুষ বসে ছিল।
আমরা দুজন সেই মানুষের কোলাহলে বসে শুধু মানুষ দেখছিলাম।
তোমার সাথে আমার দেখা হবার সেই দিনটা তো মনে পড়ে,একটা বাসে তোমার সাথে দেখা। তোমার হাতে একটা গীতবিতান। আমি অবাক হয়ে একবার তোমাকে আর একবার গীতবিতান দেখছি।
"আমি বাংলা জানি", এই কথাটা এমন সুন্দর করে বললে,বসে না থাকলে আমি ঠিক দাঁড়ানো থেকে পড়েই যেতাম। এই তো শুরু।

তোমার মা বাংলাদেশ থেকে তিনটা প্রিয় জিনিস নিয়ে ফিরেছিলেন,তুমি,গীতবিতান আর তোমার দাদীর আচারের রেসিপির নোট বই।
আমি মাস্টার্স করতে গিয়েছিলাম ।ভাষাশেখা থেকে শুরু করে সবকিছু নিয়ে ভীষন হিমশিম খাচ্ছিলাম।
তোমার সাথে দেখা হবার পর সবকিছু অনেক সহজ হলো। আমি বলি ম্যাজিক হলো।
আর তোমার বাসাতে গেলেই তোমার মা এমন করে জড়িয়ে ধরতেন,চুলের মধ্যে নাক ডুবিয়ে বলতেন,আহা বাংলাদেশ। মায়েদের অদ্ভুত কিছু প্রকাশ থাকে ভালোবাসার। তুমি বলছো।
ছোটবেলায় মা হারিয়েছিলাম ,তাই এই অধ্যায়টা আমার অজানা ছিল।
তোমাদের বাসায় গেলে আমি খিঁচুরি আর আচার খেতাম।তোমার মা ভাঙা ভাঙা বাংলায় আমার সাথে কথা বলতেন। তোমার বাবা গাড়ি এক্সিডেন্ট এ হঠাৎ চলে যাবার পর তোমার মা চেয়েছিলেন দেশেই থাকতে। কিন্তু পারেননি। সে না পারার কারনগুলো তোমার আজো অজানা।দশ বছরের তোমাকে নিয়ে ফিরেছিলেন নিজের দেশে।

প্যারিস এর সেই দিনগুলো ঝিরঝির বৃষ্টির মত মনেপড়ে যায়।
কত দিন শুধু তুমি আর আমি ,ঘন্টার পর ঘন্টা পথ হেঁটেছি।
তুমি বলতে ঢাকার স্মৃতির কথা! তোমার দাদাবাড়ি ছিল গনকুটলী লেন। তুমি যখন গল্প করতে,তোমার চোখ চকচক করতো। আমি ঘুড়ি আর নাটাই হাতে তোমাকে দেখতাম।
তোমার সাথে আমার দেখা হবার পর তুমি যেনো বিশাল একটা ঘরের মধ্যে বন্দীদশায় একটা জানালা পেয়েছিলে। এক যুগের বেশি সময় কেটে গিয়েছিল, একদিন ও তুমি বাংলা বলোনি । মাঝে মাঝে মায়ের সাথে রাগ করলে শুধু বাংলা বলতে।
আর তোমার পুরো স্কুল জীবন আর ভার্সিটি জীবন কেটে গেছে শুধু অদ্ভুত অপেক্ষায়, আবার বাংলাদেশে যাবে। মাকে নিয়েই যাবে।

আমার মাস্টার্স শেষ হবার পর আমি আমি ফিরে এসেছি দেশে। আসতে হয়েছে। তোমার মত আমার ও বাবা ছাড়া কেউ নেই।এই বাবা আমাকে বড় করেছে। আমাদের চারবোনকে বাবা একাই বড় করেছেন। বোনদের বিয়ে হয়ে যাবার পর বাবা আর আমি একসাথে থেকেছি।

আমি এসেছি কিন্তু আমার হৃদয় এর একটা বিশাল অংশ তোমার কাছে রেখে এসেছি। মাঝেমাঝেই একা হলে নিজেই খুঁজে বেড়াই সেই আমাকে।তুমি যখন প্যারিস এ গভীর ঘুমে থাকো,আমি তখন গণকটুলী লেন এর তোমাদের বাড়ির সামনে যেয়ে দাঁড়াই। জানালার শিক ধরে একজনকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখি। আমি জানি তিনি কে। আমি জানি তিনি কার অপেক্ষায় তাকিয়ে আছেন।

তোমার মায়ের চিকিৎসা চলছে। ডাক্তার পারমিশন দিলে তুমি তাকে নিয়ে আসবে । আমাদের বাড়িতে তোমার মায়ের জন্য একটা ঘর ঠিক করেছি। মায়ের কাছ থেকে যেসব রেসিপি ছবি তুলে এনেছিলাম, সব আঁচার বানিয়েছি। চালতা,আমড়া ,আম আর বরই।
তুমি আসবে বলে, তোমার ভালোলাগার সবকিছু জমা করছি।
তুমি এলে আমরা আজিমপুর কবরস্থান এ যাবো,যেখানে তোমার বাবার আর আমার মায়ের কবর আছে।
কি অদ্ভুত কো ইন্সিডেন্স তাইনা? আমাদের প্রিয় দুইজন মানুষ ওখানে শুয়ে আছেন।
আমি মায়ের কবরে গেলেই তোমার বাবার কবরে যাই। প্রথমদিন যেয়ে খুব সংকোচ লাগছিল। কি বলবো খুঁজে পাচ্ছিলাম না। পরে তোমার নাম বললাম। বললাম আমি তোমার খুব আপন বন্ধু। বললাম, তুমি কি ভীষনভাবে অপেক্ষা করছো এখানে আসবে তাই। তোমার মায়ের অদ্ভুত ভালোবাসার কথাও বলেছি। অপেক্ষার কথা বলেছি। খুব সুন্দর ঝিরঝির বাতাস বইছিল। মনে হচ্ছিল তোমার বাবা বাতাস হয়ে ছুঁয়ে যাচ্ছিলেন আমাকে।
তুমি আর তোমার মা যে গাছটা লাগিয়ে গিয়েছিলে। হাসনাহেনা।এত সুন্দর ফুল ফুঁটেছে তাতে। কিছু ফুল মাটিতে পরে ছিল। আমি অনেকক্ষন বসেছিলাম। আর হ্যা তুমি যে আসার আগে আমাকে অনেকগুলো একটা কার্ড দিয়েছিলে আর ফুলের পাঁপড়ি,আমি তা রেখে এসেছিলাম। কার্ড এর লেখাটা পড়ে শুনিয়েছি। আমি জানি তিনি শুনেছেন।
মায়ের কবরের কাছেও গিয়েছিলাম। তোমার দেয়া কার্ড আর ফুলের পাঁপড়ি ওখানেও দিয়ে এসেছি। মাকে বলেছি তোমার কথা। তোমার অদ্ভুত সুন্দর মনের কথা। তোমার মায়েরও গল্প করেছি। বলেছি,আমার মা করে ডাকবার একটা মানুষ আমি খুঁজে পেয়েছি।
মা শুনে খুশি হয়েছেন আমি নিশ্চিত। পৃথিবীর সব মায়েরা অসাধারন হয়,তোমার মাই আমাকে একদিন একথা বলেছিলেন।

অনেকেই খুব অবাক হয়। কি করে প্রতি সপ্তাহে ওখানে যাই!
যেতে হয়। জন্মের পরই যারা মা হারায়, তাদের বুকের ভিতর শূন্যতার এক গহ্বর থাকে। পৃথিবীর সব সুখ যদি তাকে হাতের মুঠোয় এনে দাও,সেই শূন্যতার একটুকুও ভরবেনা তাতে। যেই মা কখনো ছিলোনা তার জন্য এত কষ্ট ,এত শূন্যতা! যে বাবা তোমার জীবনে ছিল,দশটি বছর ধরে। তার জন্য কি অপরিসীম কষ্ট তোমার জমা,তা আমি বুঝি। কত ভালোবাসার স্মৃতি বুকে নিয়ে ঘুরে বেড়াও। কত অসম্পূর্ণতা! তাই তোমার দুঃখ ছুঁতে হাত বাড়িয়ে রাখি। এ হাত ভালোবাসার হাত। এ হাত দুঃখ ভাগ করার হাত।
যে কোন অপেক্ষাতেই অনেক সেকেন্ড,মিনিট,ঘন্টা জমা হয়ে দিন,রাত,মাস পেড়িয়ে বছর হয়।
দেখা হলে সেই অপেক্ষার যেই আনন্দ থাকে,সেই আনন্দর জন্য আমি বসে আছি। আমি জানি ,তুমিও আছো! তুমি এলে তুমুল বৃষ্টিতে ভিজতে ভিজতে আমরা আজিমপুর এ যাবো।
আমাদের সেই অপেক্ষা যতবড়ই হোক, সেটা তো বুকের সেই শূন্য গহ্বর না, যে কোনদিন পূর্ণ হবেনা!
সর্বশেষ এডিট : ০৫ ই নভেম্বর, ২০১৮ রাত ৮:৩২
১৫টি মন্তব্য ১৫টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

শোকের উচ্চারণ।

লিখেছেন মনিরা সুলতানা, ২৬ শে জুলাই, ২০২৪ সকাল ১০:১৬

নিত্যদিনের জেগে উঠা ঢাকা - সমস্তরাত ভারী যানবাহন টানা কিছুটা ক্লান্ত রাজপথ, ফজরের আজান, বসবাস অযোগ্য শহরের তকমা পাওয়া প্রতিদিনের ভোর। এই শ্রাবণেও ময়লা ভেপে উঠা দুর্গন্ধ নিয়ে জেগে... ...বাকিটুকু পড়ুন

যা হচ্ছে বা হলো তা কি উপকারে লাগলো?

লিখেছেন রানার ব্লগ, ২৬ শে জুলাই, ২০২৪ দুপুর ১:২৮

৫ হাজার মৃত্যু গুজব ছড়াচ্ছে কারা?

মানুষ মারা গিয়েছে বলা ভুল হবে হত্যা করা হয়েছে। করলো কারা? দেশে এখন দুই পক্ষ! একে অপর কে দোষ দিচ্ছে! কিন্তু... ...বাকিটুকু পড়ুন

আন্দোলনের নামে উগ্রতা কাম্য নয় | সন্ত্রাস ও নৈরাজ্যবাদকে না বলুন

লিখেছেন জ্যাক স্মিথ, ২৬ শে জুলাই, ২০২৪ বিকাল ৫:২৭



প্রথমেই বলে নেয়া প্রয়োজন "বাংলাদেশকে ব্যর্থ রাষ্ট্রে পরিণত করার সমস্ত অপচেষ্টা ব্যর্থ হয়েছে" ধীরে ধীরে দেশে স্বাভাবিক অবস্থা ফিরে আসছে। ছাত্রদের কোটা আন্দোলনের উপর ভর করে বা ছাত্রদের... ...বাকিটুকু পড়ুন

কোন প্রশ্নের কি উত্তর? আপনাদের মতামত।

লিখেছেন নয়া পাঠক, ২৬ শে জুলাই, ২০২৪ সন্ধ্যা ৬:১৬

এখানে মাত্র ৫টি প্রশ্ন রয়েছে আপনাদের নিকট। আপনারা মানে যত মুক্তিযোদ্ধা বা অতিজ্ঞানী, অতিবুদ্ধিমান ব্লগার রয়েছেন এই ব্লগে প্রশ্নটা তাদের নিকট-ই, যদি তারা এর উত্তর না দিতে পারেন, তবে সাধারণ... ...বাকিটুকু পড়ুন

চাকুরী সৃষ্টির ব্যাপারে আমাদের সরকার-প্রধানরা শুরু থেকেই অজ্ঞ ছিলেন

লিখেছেন সোনাগাজী, ২৬ শে জুলাই, ২০২৪ রাত ৯:০৭



আমার বাবা চাষী ছিলেন; তখন(১৯৫৭-১৯৬৪ সাল ) চাষ করা খুবই কষ্টকর পেশা ছিলো; আমাদের এলাকাটি চট্টগ্রাম অন্চলের মাঝে মোটামুটি একটু নীচু এলাকা, বর্ষায় পানি জমে থাকতো... ...বাকিটুকু পড়ুন

×