আনিস মিজানের কথা জানার পর থেকে অস্বাভাবিক কৌতূহলী হয়ে উঠল। আসলে সে এসব ‘অলৌকিক’ ব্যাপার–স্যাপার বিশ্বাস করে না। যদিও এক রাতে তার নিজের সঙ্গেই অদ্ভুত ঘটনা ঘটে—একজন মৃত মানুষ তাকে পথ চিনিয়ে বাড়ি পৌঁছে দিল। ঘটনাটা মাথা থেকে সরাতে পারেনি।

যুক্তি দাঁড় করাল—
ওই রাতে তার সঙ্গে যে ছিল, সে জীবিত মানুষই ছিল; রাউতিতে সে এসেছে অনেক দিন হয়ে গেছে, তবু ওই মানুষটির সঙ্গে তার দেখা হয়নি; তার মানে—যে মানুষটি তাকে পথ চিনিয়ে নিয়ে এসেছে, সে এই গ্রামের কেউ নয়, সম্ভবত অন্য গ্রামের।
আরেকটা জায়গায় আটকে যায় আনিস। সেদিন সে দোকানে পানি খেতে গিয়েছিল—মিজান তখন সঙ্গে ছিল না। যাওয়ার আগে মিজান বলেছিল, “একটা বিড়ি নিয়ে আইসেন, সবাই তো আমার মুরব্বি।” কিন্তু আনিস তাকে কখনও বিড়ি খেতে দেখেনি। লোকের মুখে শোনা—ভূত নাকি আগুন ভয় পায়। সে জন্য কি সেইদিন মিজান বিড়ি খায় না, নাকি অন্য কোনো কারণ? বিজ্ঞান বলে—ভূত আগুন ভয় পায়, এমন কোনো প্রমাণ নেই। তবু লোককথা তো লোককথাই, যুক্তির দাঁত ফসকে কোথাও একটা দাঁত থেকে যায়।
ইতিমধ্যে আনিস রাউতি গ্রামের সবার সঙ্গে ভালোভাবে মিশে গেল। প্রাইমারি স্কুলের মাস্টার, তার উপর ঢাকা থেকে এসেছে —মানুষ তাকে আলাদা সম্মানের চোখে দেখে। সে ঠিক করল—মিজানকে নিয়ে আরও খবর নেবে। শুরুটা হবে মোনা মিয়াকে দিয়ে; ঘটনাটা তো প্রথম তার চোখেই ধরা পড়েছিল।
একদিন বিকেলে আনিস মোনা মিয়ার দোকানে গিয়ে বসল। হাসিমুখে বসার ব্যবস্থা করে দিল মোনা মিয়া। আনিস জিজ্ঞেস করল,
—মোনা ভাই, ওই রাতের ঘটনাটা একটু বলবেন?
মোনা মিয়া দীর্ঘশ্বাস ফেলল, “মাস্টার সাহেব, আর বোইলেন না—হাটবার আছিল, রাইত্তা হইয়া গেছে; আমি দোকান বন্ধ কইরা বারিত রওনা দিলাম, ওই বারির কাছে যাইয়া দেহি…”
(এর পরের অংশটা “মিজান” পর্বে বলা আছে—কাঁঠালগাছ, সাদা কাপড়, মৃদু আলো, আর সেই ‘হিক হিক’ হাসি।)
ঘটনাটা শোনার পর আনিস একটু নরম গলায় বলল—
—মোনা ভাই, এমনটাও তো হতে পারে—চাঁদের আলোতে গাছের ছায়া পড়ে চোখে একটু বিভ্রম হয়েছিল। দিনটাও ছিল হাটবার। আমি-ও গ্রামেই বড় হয়েছি—অনেক হাটবার দেখেছি; কিন্তু আপনাদের হাটটা আলাদা, এত মানুষ আমি কমই দেখেছি। হাটবারে আপনাদের সবাই এত ব্যস্ত থাকেন যে কথা বলার ফুরসতই থাকে না। তার ওপর আপনার দোকান থেকে বাড়ি প্রায় দু’মাইল—সারাদিনের কাজের পর রাতে হেঁটে ফিরছিলেন। স্বাভাবতই ক্লান্ত—চোখের ভুল হতেই পারে।
—মিজান আপনাকে কী বলে ডাকত?
—কাকা কইরা ডাকত।
—কিন্তু ওই রাতে তো আপনাকে ‘তুই’ বলে ডেকেছিল?
মোনা মিয়া একটু থেমে বলল, “তয় আমি যে লুঙ্গি তুইলা হাঁটতেছিলাম—ওটা ক্যামনে দেহল?”
আনিস হেসে ফেলল,
—রাতটা ছিল চাঁদনি—দেখা যাওয়াটাই স্বাভাবিক। আপনাদের গ্রামে লুঙ্গি একটু তুলে হাঁটা নিত্যকার, সেখান থেকেও আন্দাজ হতে পারে। তার ওপর সারাদিনের ক্লান্তি, দূর হাঁটা, গরম—হয়তো তাই একটু বেশিই তুলেছিলেন।
মোনা মিয়ার মুখ শক্ত হলো,
—না মাস্টার সাহেব, আপনে যাই কহন না কেন—আমি ঠিকই দেহছি, আমি কোন ভুল দেহিনাই। আপনেরা সাহরের ( শহরের )মানুষ—এইসব বিসাস( বিশ্বাস) করেন না। আমি ঠিকই দেখাছি (দেখছি )।
যুক্তি দিয়ে আর লাভ নেই—বুঝল আনিস। কথা ঘুরিয়ে জিজ্ঞেস করল,
—ব্যবসা কেমন?
—আল্লাহ রহমতে ভালা।
—আপনার মেয়েটা খুব ভালা ছাত্রী—বিশেষ করে অঙ্কে। পড়াশোনা চালাতে থাকেন, অল্প বয়সে বিয়া দিয়েন না।
কথা শুনে মোনা মিয়ার চোখ চিকচিক করে উঠল—এটা দুঃখের পানি নয়, আনন্দের। আনিসের বুকটা নরম হয়ে গেল। কী সরল মানুষ এরা! উঠে পড়তেই মোনা মিয়া বলল,
—মাস্টার সাহেব, আরেক কাপ চা খান। এই লাল পিরানটা দেখেন—কেমন হইছে? মাইয়া লাল পিরান… লাল পিরান কইরা মাথা খারাপ কইরা দিছি—আইজ কিনলাম লাল পিরান।
আনিস বলল,
—খুব সুন্দর—আপনার মেয়ের গায়ে খুব মানাবে।
দোকান থেকে বের হওয়ার সময় আনিসের চোখ এড়ায়নি—বাবার চোখে মেয়েকে নিয়ে গর্বের জল।
দোকান ছেড়ে আনিস আরও কয়েকজন দোকানদার ও রিকশাওয়ালার সাথে কথা বলল—যারা বলে, মিজান যেদিন তাদের দোকান থেকে কিছু নেয় কিংবা রিকশায় ওঠে, সেদিন নাকি রোজগার ভালো হয়। সবার কথার মধ্যে একটা জিনিস ‘কমন’—ওই দিনগুলো ছিল হাটবার। হাটের দিনে দোকান–রিকশা—সবখানেই ভিড় আর বেচাকেনা বেশি। আনিস মনে–মনে হাসল—এত সহজ জিনিসটাকে কেন যে সবাই কঠিন ভাবে! সরল মানুষ, সরল ব্যাখ্যা—তবু রহস্যের ছায়া যেন তাদের বেশি টানে।
তবু করিম সাহেবের ঘটনার ব্যাখ্যা মিলল না। করিম সাহেব আর মিজানের বাবা—দু’জনই ইন্তেকাল করেছেন। জীবিত আছেন করিম সাহেবের স্ত্রী—কিন্তু তিনি দীর্ঘদিন অসুস্থ, কাউকে চিনতে পারেন না। অথচ ওই রাতের মিজানের ডাক তিনি–ও শুনেছিলেন। (করিম সাহেব এর বাড়ির ঘটনা টা “মিজান” পর্বে বলা আছে -- গভীর রাতে মিজানের আগমন, করিম সাহেব এর ছেলের এক্সিডেন্ট এবং মারা যাওয়া )
একদিন বিকেলে, আনিস হেঁটে হেঁটে মিজানদের বাড়ির দিকে গেল। গিয়ে আনিস আফজালকে পেল মিজানদের বাড়ির সামনে—আফজাল হলো মিজানের বড় ভাই। আফজালকে দেখে আনিস সালাম দিল এবং কেমন আছেন জানতে চাইল। উত্তরে আফজাল জানালেন, তিনি ভালো আছেন।
—আফজাল ভাই, এই পাকা বিল্ডিংটা কার?
—আমাগোই। আমার মেজো বোনের জামাই বিল্ডিংডা কইরা দিছে।
—তিনি থাকেন কোথায়? সবসময় দেখি তালা।
—ধাকায় (ঢাকায় ) চাকরি করেন। মাজে–মাঝে ঘুরতে আসেন—বিশেষ কইরা বর্ষায়। ওই যে বারান্দা দেহতেছেন—ওইখানেই বসা থাহেন। উনার নাকি পানি বহুত ভালা লাগে। বর্ষা হলে বারান্দার নিচ দিয়া পানি যায়, তাইডা (সে জন্য ) একটু উঁচা কইরা বানাইছে—যেন মনে হয় পানির উপর দাঁড়াইয়া আছেন।
—আমি প্রথম যেদিন দেখি, দূর থেকে আমারও মনে হয়েছিল—পানির ওপর বারান্দাটা। খুব সুন্দর। উনি বুঝি শৌখিন মানুষ।
—জি, মাস্টার সাহেব।
—বর্ষাকালে আমি কি এক রাত থাকতে পারি—আপনার দুলাভাইকে বলে?
—আমি কইমু। তয় আপনে থাইকেন না—মাজে–মাঝে রাইতে মিজান ওই বারান্দায় বসা থাহে (থাকে )।
মিজানের কথা শুনে আনিস কিছুটা বিরক্ত হলো। সঙ্গে সঙ্গে বলে উঠল
—আপনি দেখেছেন?
—না, তয় আনেক দেহছে।
—আপনার দুলাভাই?
—না।
আফজাল সঙ্গে সঙ্গে বলে উঠল,
—আমার মা একবার মিজানরে দেহছিল (দেখেছিল) সন্ধ্যার বেলা। আম্মা মাগরিবের নামাজ পড়া-সারা (শেষ ) কইরা গোরস্থানের কাছে হাঁটতেছিল, তসবিহ পড়তেছিল। তহন দেহি—মিজান ওই ডালিম গাছের ডালায় বসা, ওইখানে বইসা কি জানি খাইতেছিল। আম্মা জিগাইল, ‘মিজান, কি খাও?’ মিজান উত্তরও দিছে—কইছে, ‘অ্যাপল খাই আম্মা, বহুত মিঠা…।”
আনিস বিরক্ত হয়ে বলল,
—মিজান যখন মারা যায় তখন তার বয়স তেইশ–চব্বিশ। ন্যূনতম ওজন ৩৫–৪০ কেজি। এত ওজন নিয়ে ডালিম গাছের ডালে বসা যায়?
আফজাল কড়া গলায়,
—আপনেরা ধাকার (ঢাকার) মানুষ—এইসব বিসাস (বিশ্বাস) করেন না। কতবার দুলাভাইরে মানা করছি—ওই বারিতে রাইতে না থাইকা। উনি কথাই শোনেন না। যেদিন মিজান আইব—সেদিন বুজবে।
আনিস হেসে বলল,
—ভাই, আপনার দুলাভাই কোনোদিন মিজানকে দেখবে না। কারণ বারান্দার দু’পাশে গাছ—চাঁদের আলোর ছায়া ঠিক ওই বারান্দাতেই পড়ে। তাই সবার মনে হয় মিজান বসে আছে; আসলে ওটা ছায়া। এটা আপনার দুলাভাই বোঝেন, আপনারা বোঝেন না।
এ কথা বলার পরই আনিস টের পেল—আফজাল বিরক্ত। মিজান নিয়ে আরও দু’চার কথা বলতে চাইছিল, কিন্তু আফজাল ঘরের ভেতরে ঢুকে যেতে উদগ্রীব—তাই কথা আর এগোল না।
রাতে বাড়িতে বসে, স্কুলের দপ্তরী কবিরের সাথে গল্প করছিল আনিস। কবির আবার মিজানের কথা তুলতেই আনিস বিরক্ত হয়ে বলল,
—কবির, তুমি ঘুমাও। আমি একটু বাইরে বসি। আজকে খুব গরম—ঘুম আসছে না। আর শোনো—এই আজগুবি কথা–বার্তা আর না।
বাড়ির বাইরে এসে আনিস হাঁটতে–হাঁটতে পৌঁছে গেল মিজানদের বাড়ির কাছে। চাঁদ তখন নদীর বুকে রূপালি সিঁড়ি ফেলেছে। দূরে নৌকা যাচ্ছে—মাঝির গান ভেসে আসে। কথাগুলো স্পষ্ট নয়, কিন্তু সুরটা নরম—কানে লেগে থাকে। বারান্দার পাশে একটা মাচা (গাছের কাঠ কিংবা বাঁশ দিয়ে বানানো বসার ব্যবস্থা)। আনিস ভাবল—আজ রাতটা এখানেই কাটিয়ে দেবে। শুয়ে পড়ল।
ঘুম নামছিল ধীরে—ঠিক সেই সময় একটা শব্দ। আনিস চমকে উঠে পাশ ফেরে—
ডালিমগাছের ডালে বসে আছে মিজান। হাতে ডালিম, রসে ভেজা আঙুল। নিচে দুইটা বাচ্চা সাদা কাপড়ে মাটি নিয়ে খেলছে। তাদের চারপাশে নরম আলো—চাঁদের আলো, না কি?
বাতাস হঠাৎ ঠান্ডা হয়ে গেল। আনিসের শরীর অবশ। গলা শুকনো। মিজান কিছু বলছে—কিন্তু আনিস শুনতে পাচ্ছে না। মাথা টলে পরে যায় সে ।
মিজান কী বলেছিল - আনিস শুনতে পায়নি, আমি শুনতে পেরেছি
—মিজান বলেছিল।
“ কেডা—মাস্টার সাহেব নাকি, কেমন আছইন? ওই দেহেন, আমার দুইডা ভাই—খেলতাসে। আমার নিয়্যা আপনের গবেসনা (গবেষণা) কিত্তে (কতো) দূর? আর হুনেন—পচোম (পশ্চিম) পাড়ার আজিজা (আজিজ) হারামজাদারে কইয়েন, অরে আমি পাইলে এক আছাড় মাইরাম—বেডা! ঘরেত বউ রাইখা আরেক বেডির লগে ফসতি-নস্তি করে। আর হুনেন—এইবার ডালিমের ফলন ভালা হইবো। আমার ভাইরে কৈবেন—আপনেরে একটা ডালিম দ্যায়।”
পরিশেষে
আমি ঠিক করেছি—আমি যতদিন লেখা–লিখি করব, আমার কোনো লেখায় কাউকে মেরে ফেলব না। এখন বুঝতে পারছি না—আনিস অজ্ঞান হলো, নাকি মারা গেল। যদি মারা যায়, তবে আমি আমার লেখার শর্ত ভঙ্গ করলাম—এর জন্য আমি দুঃখিত। যদি অজ্ঞান হয়— তাহলে তার জ্ঞান ফিরুক, সে সুস্থ হোক। তারপর না হয় আনিসকে আবার নিয়ে আসব। আর যদি মারা যায়—তাহলে এখানেই শেষ।
তবু আমি মনে–প্রাণে আশা করি—আনিস ফিরে আসুক। সুস্থ হয়ে উঠে দাঁড়াবে। আনিসের জন্য অপেক্ষা না করে চলুন, আমরা পশ্চিম পাড়ার আজিজদের বাড়ি দেখে আসি—ওটা একটা অভিশপ্ত বাড়ি। আজিজের ‘বড় বড় বাবা’—মানে আজিজ এর দাদার বাবা —ছিল এই এলাকার নিকৃষ্ট, অত্যাচারী জমিদার। লোকের মুখে শোনা—প্রজাদের ওপর এমন অত্যাচার করত যা ভাষায় বলা যায় না। উদাহরণ হিসেবে শোনা যায়—কখনো–কখনো নাকি প্রজার মাথা কেটে তার লোকদের দিয়ে মাঠে ফুটবল খেলানো হতো। এত মানুষের অভিশাপ ছিল ওই বাড়িতে। অভিশাপের জন্য—না কি অন্য কারণে—শেষমেশ সেই প্রতাপশালী পরিবারটা ধ্বংস হয়ে যায়। চুলুন ঘুরে আসি, অভিশপ্ত আজিজ দেড় বাড়ি থেকে …….
…….. গভীর রাত। ক্লান্ত এক বৃদ্ধ মানুষ গ্রামের মেঠো পথ ধরে পশ্চিম পাড়ার দিকে হাঁটছে। অনেক দূর থেকে ভেসে আসে এক মেয়ের চিৎকার–ভেজা কান্না—“আমারে আর মাইরেন না, আপনের পায়ে পরি।”
বৃদ্ধ লোকটি স্পষ্টই বুঝতে পারে, আওয়াজটা ওই অভিশপ্ত বাড়ি থেকেই আসছে। তিনি সেই বাড়ির দিকেই ধীরে ধীরে এগিয়ে যেতে থাকেন……………
নোট: যারা আমার গল্পের প্রথম অংশ পড়েছেন, তাদের জন্য ছোট্ট একটি সংশোধন আছে—একজন শুভাকাঙ্ক্ষীর (যদিও উনাকে আমি চিনি না) পরামর্শে। প্রথম পার্টে একটু পরিবর্তন এসেছে। পরিবর্তনটা কী—তা জানতে আমার লেখা ‘মিজান’ পার্টটার কমেন্ট দেখলেই বুঝবেন। ওই পরিবর্তনটা এখানে আর এডিট করিনি, করবও না। যদি কোনোদিন এই লেখাগুলো বই আকারে আসে—সেই জায়গাতেই ওই পরিবর্তন থাকবে।
ছোট্ট আরেকটি অনুরোধ , যদি সম্ভব হয় অনুরোধ টুকু রাখবেন
Follow my Facebook Page
facebook.com/kolomeamisumon
কলমে আমি - Sumon Bhuiyan

অনুগ্রহ করে অপেক্ষা করুন। ছবি আটো ইন্সার্ট হবে।



