somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

বাউল সম্রাট লালন শাহর হরিশপুর

০২ রা এপ্রিল, ২০১১ দুপুর ১:০৭
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

প্রতিবছর এই সময়ে কুষ্টিয়ার ছেঁউড়িয়াতে ৫/৬ দিন ব্যাপী চলে লালনমেলা। সারাদেশ ও বিদেশ থেকেও লালন ভক্তরা এখানে আসে। তবে ঝিনাইদহের হরিণাকুণ্ডু উপজেলার হরিশপুরে আজও উপেক্ষিত বাউল সম্রাট লালন শাহের বসতবাড়ি। তার জন্মভূমি সংরক্ষণ ও সরকারি স্বীকৃতির দাবিতে হরিণাকুণ্ডু বাউল একাডেমি সোচ্চার হলেও জন্মভূমি সংস্কারের বিষয়ে উদ্যোগ নেয়নি কেউ। এখন আর কেউ জানেন না বাউল সম্রাট লালন এ গাঁয়েরই দরিদ্র গরিবুল্লা দেওয়ান ও আমেনা খাতুনের ঘরে জন্মেছিলেন। লালনের জন্মস্থান ও পৈতৃক ভিটা বাঁশ বাগানের নিচে বন-জঙ্গলে ঢেকে গেছে। ১৯৮৯ সালের ২৫ সেপ্টেম্বর হরিণাকুণ্ডু উপজেলা পরিষদ লালনের বাস্তুভিটায় একটি স্মৃতিফলক স্থাপন করে। সে বেদিও আজ ধ্বংসস্তুপে পরিণত হয়েছে। লালনের দীক্ষাগুরু এ গাঁয়েরই আরেক বাউল সাধক দরবেশ সিরাজ সাঁই ও পাঞ্জু শাহর মাজারও রয়েছে হরিশপুরে।
বিভিন্ন গবেষণাপত্র ও তথ্য প্রমাণে দেখা গেছে, লালন শাহর জন্মস্থান হরিশপুরে। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের অধ্যাপক মুহম্মদ আবু তালিব ও লালন গবেষক ড. খন্দকার রিয়াজুল হক তাদের গবেষণায় নিশ্চিতভাবে প্রমাণ করেছেন লালনের জন্মস্থান হরিশপুরেই। বিশিষ্ট লালন গবেষক মুহম্মদ আবু তালিব ১৮৮১ ও ১৮৮২ সালে তৎকালীন ঝিনাইদহ মহকুমার অধীন শৈলকুপা সাব রেজিস্ট্রার অফিসে লালন শাহর অনুকূলে সম্পাদিত হওয়া দুটি দলিল উদ্ধার করেন। উল্লেখ্য, তৎকালীন সময়ে হরিণাকুণ্ডুতে কোনো সাব রেজিস্ট্রার অফিস ছিল না। হরিণাকুণ্ডু থানার যাবতীয় জমি কেনাবেচা ও রেজিস্ট্রি হতো শৈলকূপা সাব-রেজিস্ট্রার অফিসের মাধ্যমে।
লালন সম্পর্কে বিভিন্নভাবে গবেষকরা লিখেছেন, ‘লালন নিজের থেকেই তার নিজ গ্রাম হরিশপুরের স্বনামধন্য বাউল সাধক দরবেশ সিরাজ সাঁইয়ের শিষ্যত্ব লাভ করেন। এক সময় বসন্ত রোগে আক্রান্ত হওয়ায় তার সঙ্গীরা তাকে ত্যাগ করেন। তখন তিনি কুষ্টিয়ার ছেঁউড়িয়ায় কালী নদীর ধারে যান। এরপর লালন ছেঁউড়িয়াতেই অবস্থান করেন এবং এখানেই তিনি সাধনকর্মের মাধ্যমে প্রতিভার বিকাশ ঘটান।’ দিন দিন ছেঁউড়িয়া লালন তীর্থে পরিণত হয়। বর্তমানে সারাবিশ্বের বাউলদের প্রধান তীর্থক্ষেত্র হচ্ছে কুষ্টিয়ার এই ছেঁউড়িয়া।
ইংরেজি ১৭৭২ সালে জন্মগ্রহণ করেন লালন শাহ। ১১৬ বছর বয়সে ১৮৯০ সালের ১৭ অক্টোবর রাতে তিনি মারা যান। বর্তমানে লালন উৎসব ছেঁউড়িয়াকেন্দ্রিক হয়ে পড়েছে। লালনের জীবদ্দশায় প্রতি বছর বসন্তের অন্তে শীতকালে একটি মহোৎসব দিতেন তিনি। সেখানে লালন শিষ্য ও তার সম্প্রদায়ের লোকেরা সবাই একত্রিত হয়ে সাঁইজির সঙ্গে সংগীত ও অলোচনায় মিলিত হতেন। এখনো প্রতি বছর এ সময় ছেঁউড়িয়াতে বিপুল উৎসাহ-উদ্দীপনায় লালন উৎসব পালিত হয়। সমাগম ঘটে লাখো ভক্তের। কিন্তু কালের বিবর্তনে লালনের জন্মস্থান হরিশপুর লালন তীর্থভূমি থেকে হারিয়ে গেছে। এখানে পালিত হয় না লালন উৎসব। তবে গত বছর হরিণাকুণ্ডুতে হয় লালন মেলা। হরিশপুরের প্রবীণদের মুখে শোনা যায়, দেশ স্বাধীনের পর কয়েক বছর এখানে লালন স্মরণ উৎসব হয়েছিল। এক সময় তা বন্ধ হয়ে যায়। তবে দেশ-বিদেশের লালন গবেষকরা এ বাউল সম্রাটের স্মৃতি খুঁজে পেতে মাঝে মধ্যেই হরিশপুরে আসেন এবং বাউল সম্রাটের জন্মস্থানের দৈন্যদশা দেখে হতাশ হন।
সরেজমিন হরিশপুরে লালনের স্মৃতিচিহ্ন খুঁজে পাওয়ায় এখন মুশকিল, শুধু মাজার ও স্মৃতিফলক আছে। গ্রামের প্রবীণ ব্যক্তিদের মুখে শুনতে শুনতে বাঁশ বাগানের মধ্যে জঙ্গলাবৃত স্থানে খুঁজে পাওয়া যায় একটি জরাজীর্ণ বেদি। এখানেই লালনের পৈতৃক ভিটা ছিল বলে চিহ্নিত করেন গবেষকরা। লালনের দীক্ষাগুরু দরবেশ সিরাজ সাঁইয়ের মাজার আছে হরিশপুর স্কুলের পাশে। সিরাজ সাঁইয়ের বংশধর পঞ্চম পুরুষের কয়েকজন বাস করেন গ্রামটিতে। তারা হলেন বারেক সর্দার, নজির সর্দার, আক্কাস সর্দার, আবুল সর্দার, গনি সর্দার ও মকবুল সর্দার। তাদের অবস্থাও করুণ, দরিদ্রতার মধ্যে বসবাস করছেন তারা। অন্যের জমিতে কৃষি কাজ করে জীবিকা নির্বাহ করেন। দরবেশ সিরাজ সাঁইয়ের পঞ্চম পুরুষ বারেক সর্দার ক্ষোভের সঙ্গে বলেন, যে লালনকে নিয়ে সারাবিশ্বে তোলপাড় চলছে সেই লালনের দীক্ষাগুরুর খোঁজ কেউ রাখে না। দীর্ঘদিন অবহেলিত থাকার পর সম্প্রতি লালন গুরু সিরাজ সাঁইয়ের কবরটি পাকা করা হয়েছে। মাজার বলতে যা বোঝায় সেরকম কিছুই হয়ে ওঠেনি এখানে। লালনের নিজের বাস্তুভিটাটিও সংরক্ষণ করার উদ্যোগ কেউ নেয়নি।
হরিশপুরের বাসিন্দা আলমগীর হোসেন জানান, লালন যে বটগাছের নিচে বসে দরবেশ সিরাজ সাঁইয়ের কাছে দীক্ষা নিতেন এবং সাধন করতেন সম্প্রতি সেই গাছটি ঝড়ে উপড়ে গেলে এখানে একটি স্মৃতিফলক করার জন্য উপজেলা পরিষদসহ বিভিন্ন স্থানে ছুটে গিয়েছেন তারা। কিন্তু সাধারণ একটি স্মৃতিফলকও এই ঐতিহাসিক স্থানে নির্মাণ করা সম্ভব হয়নি। তারা অভিযোগ করেন, সিরাজ সাঁই ও পাঞ্জু শাহসহ অনেক স্বনামধন্য বাউল সাধক ছিলেন হরিশপুর ও আশপাশের গ্রামে। এক কথায় হরিশপুর ছিল বাউলদের পুণ্যভূমি। তাদের লেখা অনেক আধ্যাত্মিক গান ছড়িয়ে-ছিটিয়ে রয়েছে। কিন্তু সেগুলো সংগ্রহের উদ্যোগ নেই বাংলা একাডেমিসহ সরকারের সাংস্কৃতিক মন্ত্রণালয়ে। ক্ষুব্ধ হরিশপুর ও হরিণাকুণ্ডু উপজেলাবাসী।
হরিণাকুণ্ডু বাউল একাডেমির আহ্বায়ক আতিয়ার রহমান চান্দু জানান, হরিশপুরে লালন ভাস্কর্য ও গ্রামটির সরকারি স্বীকৃতি এখন সময়ের দাবি। বিভিন্ন লালন গবেষকরা বলেছেন লালনের জন্মস্থান হরিশপুরে। হরিণাকুণ্ডু সরকারি লালন শাহ কলেজের ইংরেজি বিভাগের অধ্যাপক সাইদ আবু বক্কর জানান, এটা ঐতিহাসিকভাবে সত্য। হরিণাকণ্ডুর বাউল একাডেমির সদস্য হামিদ, জিহাদ, রাসেল, মিরা, ছমির, সেলিম সহ অনেকেই জানান, মানববন্ধনের মাধ্যমে একটি নতুন আন্দোলনের সূচনা করা হলো। হরিশপুর গ্রামটি পৃথিবীর মধ্যে দর্শনীয় স্থান করার আন্দোলন চলবে।

৬টি মন্তব্য ৪টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

স্বাধীনতা দিবসের অনুষ্ঠানে মুক্তিযোদ্ধাদের মুমিনী চেহারা ও পোশাক দেখে শান্তি পেলাম

লিখেছেন মহাজাগতিক চিন্তা, ২৭ শে মার্চ, ২০২৪ রাত ৯:৫৮



স্বাধীনতা দিবসের অনুষ্ঠানে স্টেজে উঠেছেন বত্রিশ মুক্তিযোদ্ধা তাঁদের চব্বিশ জনের দাঁড়ি, টুপি ও পাজামা-পাঞ্জাবী ছিলো। এমন দৃশ্য দেখে আত্মায় খুব শান্তি পেলাম। মনে হলো আমাদের মুক্তিযোদ্ধা আমাদের মুমিনদের... ...বাকিটুকু পড়ুন

দু'টো মানচিত্র এঁকে, দু'টো দেশের মাঝে বিঁধে আছে অনুভূতিগুলোর ব্যবচ্ছেদ

লিখেছেন মোহাম্মদ গোফরান, ২৮ শে মার্চ, ২০২৪ রাত ১২:৩৪


মিস ইউনিভার্স একটি আন্তর্জাতিক সুন্দরী প্রতিযোগিতার নাম। এই প্রতিযোগিতায় বিশ্বের বিভিন্ন দেশের সুন্দরীরা অংশগ্রহণ করলেও কখনোই সৌদি কোন নারী অংশ গ্রহন করেন নি। তবে এবার রেকর্ড ভঙ্গ করলেন সৌদি... ...বাকিটুকু পড়ুন

আমাদের দুই টাকার জ্ঞানী বনাম তিনশো মিলিয়নের জ্ঞানী!

লিখেছেন সাহাদাত উদরাজী, ২৮ শে মার্চ, ২০২৪ রাত ২:৫৯

বিশ্বের নামীদামী অমুসলিমদের মুসলিম হয়ে যাওয়াটা আমার কাছে তেমন কোন বিষয় মনে হত না বা বলা চলে এদের নিয়ে আমার কোন আগ্রহ ছিল না। কিন্তু আজ অষ্ট্রেলিয়ার বিখ্যাত ডিজাইনার মিঃ... ...বাকিটুকু পড়ুন

আমি হাসান মাহবুবের তাতিন নই।

লিখেছেন ৎৎৎঘূৎৎ, ২৮ শে মার্চ, ২০২৪ দুপুর ১:৩৩



ছোটবেলা পদার্থবিজ্ঞান বইয়ের ভেতরে করে রাত জেগে তিন গোয়েন্দা পড়তাম। মামনি ভাবতেন ছেলেটা আড়াইটা পর্যন্ত পড়ছে ইদানীং। এতো দিনে পড়ায় মনযোগ এসেছে তাহলে। যেদিন আমি তার থেকে টাকা নিয়ে একটা... ...বাকিটুকু পড়ুন

মুক্তিযোদ্ধাদের বিবিধ গ্রুপে বিভক্ত করার বেকুবী প্রয়াস ( মুমিন, কমিন, জমিন )

লিখেছেন সোনাগাজী, ২৮ শে মার্চ, ২০২৪ বিকাল ৫:৩০



যাঁরা মুক্তিযদ্ধ করেননি, মুক্তিযোদ্ধাদের নিয়ে লেখা তাঁদের পক্ষে মোটামুটি অসম্ভব কাজ। ১৯৭১ সালের মার্চে, কৃষকের যেই ছেলেটি কলেজ, ইউনিভার্সিতে পড়ছিলো, কিংবা চাষ নিয়ে ব্যস্ত ছিলো, সেই ছেলেটি... ...বাকিটুকু পড়ুন

×