বরাবর প্রিয়তমেষু অথবা রামগরুড়ের ছানা,
সময়গুলো কেমন যেন অদ্ভুত, তাই না? দুম করেই ম্যাজিক ওয়ান্ড এর ধোয়া হয়ে একটা বছর শেষ হয়ে গেল। ঠিক এক বছর আগের ১১।১১।১১ তারিখের ভোর থেকে রাত্রি কি তোমার মনে আছে? আমার ফেলে আসা ঠিকানার ওইদিনের দিনলিপির আদ্যোপান্ত সবকিছু মনে আছে। বাড়ি ভর্তি লোকজন, বাইরের উঠানে ইট দিয়ে বানানো গোটা চারেক চুলা, আর তার উপর ডেকচিতে চাপানো রান্না। মামনি, ফুপু, মামা, বাবা সবাই তখন ব্যস্ত। বাড়ি ভর্তি লোকের ভিড়ে একলা আমি সব কয়টা ঘর ঘুরে ঘুরে দেখেছিলাম আনন্দ, ব্যস্ততা আর আমার মাঝে কোথাও আবিষ্কার করেছিলাম একটা আনকোরা নতুন অনুভূতির পদচিহ্ন।
দুপুরের ঠিক আগেই এসেছিলে তুমি আর তোমরা । তারপর যা হয় আর কি! তোমাদের ঘরে আমাকে নিয়ে যাবার আগে নানী দাদীদের সতর্ক বাণী- গিয়েই লম্বা সালাম দিতে হবে,মাথায় কাপড় দিয়ে যাবে, মুখ তুলে কথা বলা যাবেনা, ভদ্রভাবে কথার উত্তর দিতে হবে হেন তেন অনেক কিছু। কিছু ঢুকেছিল কানে আর কিছু প্রতিফলিত হয়ে সোজা হাওয়ায় মিলেছিল বোধ হয় ! আর তাই তো , ঘরভরতি তোমার আত্মীয় স্বজনের সামনে গিয়ে আমি ঠিক ই খুঁজে নিয়েছিলাম তোমাকে। আচ্ছা, সত্যি বল তো, এত কষ্ট করে হাসি চাপছিলে কেন তুমি? আমাকে কি ভিনগ্রহের প্রাণী মনে হয়েছিল নাকি ? নাকি অবাধ্য ওড়নার মাথা থেকে নেমে যাওয়া আটকানোর আমার প্রাণান্ত চেষ্টা হাসি ফুটিয়েছিল একটা রামগরুড়ের ছানার মুখে ? আংটি বদল শেষ হলে যখন তোমার বাড়ির মুরুব্বিরা বিয়ে পড়ানোর কথা তুললেন, চোরা চোখে ঠিক ই তুমি তাকিয়েছিলে আমার দিকে ! সন্দেহ ছিল বুঝি ?
যাকগে সেসব কথা । তুমি কি জান , তোমাকে রামগরুড়ের ছানা কেন ডাকি? আচ্ছা, তুমি আমাদের বিয়ের এ্যালবাম টা দেখেছ? তোমার হাসিমুখের একটা ছবিও নেই সেখানে !আমার বন্ধুরা তো বলেই দিয়েছে, বাংলা সিনেমার ট্র্যাজিক নায়িকার মত নির্ঘাত তোমাকে তোমার বাবা মা জোর করে আমার সাথে বিয়েতে রাজি করিয়েছে। ক্যামেরা ক্লিক করার আগেই তোমার ক্যামেরা কনশাসনেস তোমার হাসি মুছে দেয় জানি, কিন্তু তাই বলে তোমার একটা দাঁত কেলানো অনিন্দ্য সুন্দর হাসিমুখের একটা ছবি ও কি থাকতে নেই?
আরেকটা কথা, বিয়ের বয়স এক বছর পেরুলেও আমাদের সংসার জীবন সাত মাসের। এগার বছর হোস্টেলে থাকা আমার কাছে সংসার মানেই ছিল ভিন্ন একটা জগত। রান্না মানেই টিভিতে দেখানো দুই একটা সখের রেসিপি, ভাত, ডিম ভাজি। মাছ রান্নায় যে এলাচ দারচিনি লাগেনা, সেইটা অখাদ্য রান্নাটা খেয়েই আবিষ্কার করেছি। কোনদিন ভাত পুড়িয়ে, কোনদিন ভাত গলে জাউ বানিয়ে ট্রায়াল এরর এপ্রচেই বুঝে গেছি ঠিকঠাক পানির মাপ। তবে কি জান? কোনদিন খাবার মুখে নিয়ে তুমি ওয়াক থু করে ফেলে দাওনি, এতে সবচেয়ে অবাক আমিই হয়েছি । অফিস থেকে বেরিয়ে গেটের সামনে যেদিন তোমাকে আমার জন্য অপেক্ষায় থাকতে দেখেছি সেদিন সত্যিই মনে হয়েছিল, ঢাকা শহরের এই ধুলো জ্যামে ভরা রাস্তাটাও আজ শেষ না হলে ভাল হত। কিংবা মাঝরাত্তিরে হঠাত পাশের ঘর থেকে দুমদাম বেলুন ফাটার শব্দ আর হাহা হিহি শব্দের উৎস খুঁজতে গিয়ে যখন আবিস্কার করেছি আমার বান্ধবীদের এনে লুকিয়ে রেখেছিলে আমার বার্থডে তে সারপ্রাইজ দেবে বলে তোমার চশমার আড়ালে থাকা চোখে লুকানো ভালবাসাটা খুঁজে পেতে একটুও দেরি হয়নি। আমার টাইফয়েডের জ্ঞানহীন চারটা দিনে তুমি কিভাবে আমার যত্ন করেছিলে আমি জানিনা। কিন্তু এক রাতে ঘুম থেকে ডেকে তুলে রাতে খাইনি কেন এইজন্য বকা দিয়েছিলে খুব। চোখ দিয়ে পানি পড়েছিল ঠিকই কিন্তু বুঝে নিয়েছিলাম এর পিছনে লুকানো তোমার উদ্বেগটুকু ।
প্রত্যেকের জীবনেরই একেকটা দিন একেকটা ভালবাসা কিংবা বিরহের গল্প । আমাদের ও ঠিক তাই । হয়ত বাজার করতে গেলে বেছে বেছে সবচেয়ে পাকা লাউটাই তুমি নিয়ে আস, বুড়ো গরুর মাংস ও ভাল ভেবে ঢুকাও বাজারের থলিতে আর কোন কোনদিন বাজারের আপেক্ষায় থাকা আমাকে খালি হাতে বাড়ি ফিরে বলে ওঠ, ওহ! একদম ভুলে গেছি আজ বাজার করার কথা। একটা দিন ই তো, চলো আমরা পাউরুটি দিয়ে স্যান্ডুইচ বানিয়ে খেয়ে ঘুমায়ে পড়ি। অথবা ছুটির দিনে বিকেলে যেদিন কোথাও ঘুরতে যাবার কথা, সেদিন সারা বিকেলটাই ঘুমিয়ে কাটাও ! তবুও আমাদের ঘুলঘুলিতে রোদের অভাব হয় না, ভালবাসার অশ্বথ টা শিকড় ছড়ায় দেয়াল জুড়ে আর বারান্দা ঘেঁষে পেঁচিয়ে ওঠে একটা সুখ আনন্দের বেগোনভেলিয়া !
ও হ্যাঁ, ভাল কথা, শুভ প্রথম বিবাহ বার্ষিকী রামগরুড়ের ছানা