ট্রেনটার হুইসাল বেজেই চলছে। ছেড়ে যাচ্ছে স্টেশন। ট্রেনের যাত্রীরা কেউ হাসছে, কেউ গাইছে। কয়েকজন আমায় হাত নেড়ে ঢাকছে আর বলছে- ওঠে এসো! এটা স্বর্গীয় ট্রেন। আমি তখনও বসে আছি । চুপচাপ ট্রেনের চলে যাওয়া দেখছি। আমি জানি ট্রেনটা আজ চলে গেলে আবার কবে আসবে ঠিক নেই। আজও আবার আসতে পারে। আবার কাল কিংবা বহুদিন পর আসতে পারে। আবার এর পরেরটা হয়ত নরকগামী ট্রেন। নিয়ম মাফিক পরেরটায় আমাকে ওঠতেই হবে। চারপাশে ডানা মেলে উড়ছে আমার গোলাপি কাক। পিছনের মোমের শহরে দেয়ালের কার্ণিশে অপেক্ষায় বসে আছে আমার হলুদ পাখিরা । আঁধারের বনে শবযাত্রার শোক মিছিল বের করছে আমার নীল জোনাকপোকারা। অদ্ভুত এক মায়ার টানে আমি এখনও বসে আছি।
এই মায়া জিনিসটা বড়ই অদ্ভুত। কুহেলিকার শাদা চাদর জড়িয়ে তুমি এসে বলতে, চল! শালতলা পুকুর পাড়ে। চুপচাপ মায়ার হরিণের দেখা মিলত শালতলার পাড়ে। শেষ কয়টা দিন একই সুর বেজে চলত। পুকুরের মাছেরা শুধাত, একটা কবিতা বল। আমি বলতাম--লাশ ঘরে তোমার যে হলুদ চোখ। ওটা আমায় দাও। বিনিময়ে আমি তোমায় এক পুকুর জল দিব।
আমার প্রিয় রঙ হলুদ। হলুদ আলোয় আমি দিগন্তে হাঁটতাম। হলুদ পাখি আমার নিকটতম বন্ধু। সবুজের মাঝে হলুদ সরিষার ফুল – ঐ হলুদ আমার দেয়া। তোমার শেষ চলে যাওয়ার দৃশ্যটা আমি ক্যানভাসে হলুদ রঙ দিয়ে এঁকেছি। মরে গেলে মানুষ হলুদ হয়ে যায়। প্রাণ হারা মাছের চোখও হলুদ হয়ে ওঠে। আমার খুব ইচ্ছে জাগল—গভীর জলের ভিতর জীবন্ত মাছের চোখ দেখা। মাছের চোখের দৃশ্যাবলি এঁকে এঁকে আমি হলুদ হব। এক নিশীথে শালতলার সেই পুকুরে আমি নেমে পড়লাম। আমি দেখলাম, ভয়ানক সব সৌন্দর্য। চোখে চোখে ওরা কথা বলে। মাছে মাছে প্রেম, ভালোবাসা, দুঃখ কিংবা অভিমানের দৃশ্যাবলি মাছের চোখ দেখে নিপুণ হাতে এঁকেছি। আমার ভিতরে যে কান্ত দুঃখ জমা আছে, তা আমি মাছদের দেশে বলে এসেছি। তারা আমার শরীরে হলুদ রঙ মেখে দেয়। আত্মানন্দে আমি দুঃখগুলো ছড়িয়ে দিয়ে জলের উপরে ভেসে উঠি—নীরবে।
পরের ট্রেনটার হুইসাল বেজে ওঠে। ট্রেনটায় ওঠার আগে হলুদ রঙ দিয়ে আমি পৃথিবীটাকে ঢেকে দিলাম।
২১০৮১৪
(মুক্তগদ্যটা এবারের বইমেলায় নির্ঝরদা সম্পাদিত 'মুক্তগদ্য' কাগজে প্রকাশিত)