এখন ঠিক মধ্যরাত। ১২.০৪ মিনিট। আমার পাশে শুয়ে থাকা ভদ্রলোকের পরচয়টা জানা খুব দরকার। দেখা যাবে আমি ঘুমে ঢলে পড়লাম, আর মশাই আমার সবকিছু নিয়ে চম্পট! কেন যে এই পাগলের দেশে আসলাম, সে আফসোসে এখন নদীর জলে ডুবে মরে যেতে ইচ্ছা হচ্ছে।কিন্তু উপায় নেই, এই অদ্ভুত দেশে নদী যদি থেকেও থাকে, তা এখন শুকিয়ে নিশ্চই বরফ হয়ে গেছে। এখন নাকি “winter in full swing”…এর মানে আমি যতদূর আচ করতে পারছি তা হচ্ছে- ‘শীতের নাম বাবাজি’! ঠান্ডা যে কত প্রকার ও কী কী তা হাড়ের ঠকঠক কাপুনি ভালই জানান দিয়ে যাচ্ছে। মনে হচ্ছে শরীরের প্রতিটি আনাচে-কানাচে কে যেন সুই দিয়ে ক্রমাগত খুচিয়ে যাচ্ছে। হায়রে কুদ্দুস, দেখে যা তোর সৌভাগ্যবান বন্ধু এখন কি অবস্থায় আছে। তুই তো ভিসা না পেয়ে কান্নাকাটি করলি, আর আমি ভিসা পেয়ে এখানে এসে কান্নাকাটি করছি।
“Here, have it.”
কথাটির উৎস খুজতে গিয়ে দেখি একটা “অতিরিক্ত” সাদা হাত আমার দিকে পাউরুটি বাড়িয়ে দিয়েছে। লোকটা ইংরেজি বলেছে তা বুঝতে পেরেছি, তবে মুখের কথা স্পষ্ট নয়! আমি হাত বাড়িয়ে পাউরুটিটা নিলাম। উপায় নেই, ফকিরের দেশ থেকে এখানে এসে সাহেব বনে যাওয়ার কোন সুযোগ নেই।
“I also hungry…eat…eat…bread…”
এবার কথাটি যে আমার পাশে শুয়ে থাকা লোকটির মুখ থেকে এসেছে, এ ব্যাপারে সন্দেহের কোন অবকাশ নেই। অবাক কান্ড, এই বেটা এতক্ষন শুয়েছিল, আর এখন দেখি ঠিকই পাউরুটি চেয়ে নিচ্ছে; তাও আবার ইংরেজিতে!
দুজনে একমনে পাউরুটি চিবুচ্ছি। আমাদের খাওয়া দেখলে যে কেউ বলবে দুটি অতি ক্ষুধার্ত রামছাগল পরম আনন্দে ঘাস চিবিয়ে যাচ্ছে। পাঠক বেয়াদবি ক্ষমা করবেন। মাস্টার্স পাশ করে লন্ডনের মত অতি ঠান্ডা দেশের একটা পার্কে মাঝরাতে বসে পাউরুটি চিবানো, আর লক্ষ্যহীন ছাগলের ঘাস খাওয়ার মধ্যে খুব একটা পার্থক্য এই মুহুর্তে আমি খুজে পাচ্ছিনা। আমার মধ্যরাতের সাথীর দিকে তাকিয়ে রামছাগল বিষয়ক ধারনাটা আরও পাকাপোক্ত হয় বৈকি! কেন, সেই কথা বলে আমার গল্প দীর্ঘায়িত করতে চাইনা।
“এই ছাগল, এক মিনিটের ভিতর এটা ইংরেজিতে অনুবাদ কর”- ‘রামছাগলটি কি ঘাস খাইতেছে?’
আমি মাথার ঘাম পায়ে ফেলে বাক্যটির ইংরেজি অনুবাদ করার চেষ্টা করে যাচ্ছি, কিন্তু কিছুতেই কিছু হচ্ছে না-
A goat is…
The goat is…
Is the goat…
রামছাগলের কি আর কোন ইংরেজি প্রতিশব্দ আছে? স্যার কে কি জিজ্ঞেস করা যায়? এ ক্ষেত্রে একটা ছোট্ট সমস্যা আছে। প্রশ্নটা করা মাত্র তিনি অবশ্যই উচ্চস্বরে পুরো ক্লাসকে জানিয়ে দেবেন- “তুমি পরীক্ষায় পাশ করিতে পারিবেনা, বরং এই টেবিল-চেয়ারদিগের পাশ করার সমূহ সম্ভাবনা…”
“ভাই উডেন (উঠেন)…হ্যালো…ব্রাদার wake, wake ব্রাদার।”
দ্বিতীয় রামছাগল আমার ঘুম ভাঙ্গিয়ে দিল! আমি বুঝে উঠতে পারছিলামনা স্বপ্নে রেবতি স্যারকে কেন দেখলাম। স্কুল পাস করেছি সেই কবে…!
“চলেন জব সেন্টারে যাই। কাজতো খুজন দরকার। শেষে না খাইয়া মরতে হইব।”
আমি ঘুরে আমার রামছাগল সঙ্গীর উপর দৃষ্টিপাত করলাম। তার নামটা জানা দরকার, না হলে দেখা যাবে এক সময় রামছাগল ভাই ডেকে বসে আছি। আমি উঠে বসতে বসতে বললাম, “চলেন যাই…ইয়ে কি যেন আপনার নামটা…?”
“আমার নাম হাবিব। আমনের নামডা অবশ্য আমি জানি…রফিক।”
“কিভাবে জানলেন? আমিতো বলিনি!”
“আমনের ব্যাগডার গায়ের লেহা আছে…হে হে।”
এরই মধ্যে আমার ব্যাগে লাগানো নেম ট্যাগ দেখে নিয়েছে! ব্যাটা খুব ধূর্ত। ভাষার টান শুনেতো মনে হয় কুমিল্লার লোক। তাহলেতো আরও সাবধান হওয়া দরকার…।
সামনে একটা বিশাল সাইনবোর্ড, তাতে লেখা Tradition Job Centre । জবের সাথে ট্রেডিশন এর কি সম্পর্ক তা ভেবে বের করতে পারলাম না। বাংলাদেশী জব সেটারের কাছে এর চেয়ে ভাল কিছু আশাও করা যায় না। যাই হোক, জব সেন্টারের নাম ছাড়াও ভাবার মত আরও অনেক গুরুত্বপূর্ন বিষয় আছে। জব না পেলে পড়াশুনা চালিয়ে যাওয়া তো দূরের কথা, বেচে থাকাটাই কষ্টকর হয়ে পড়বে।
আজকেও কোন আশার আলো দেখতে পাচ্ছিনা! জব সেন্টারের বাইরে অনেক লম্বা লাইন। এর মধ্যে একজন আবার কোন একটা টিভি চ্যানেলকে হাত পা নেড়ে সাক্ষাৎকার দিচ্ছে। টিভির সামনে আরও অনেকেই তাদের হাতে ধরে থাকা চানাচুর, বিস্কিট, অথবা পাউরুটি তোলে ধরছে; তার মানে- দেখ দেশ ও বিশ্বের ভাইয়েরা, আমরা কত কষ্টে আছি। এর মধ্যে কয়েকজন (হাবিব অন্যতম) আবার হাসিমুখে ইংরেজি V চিহ্ন দেখাচ্ছে। তার মানে তারা লন্ডনে আসতে পেরেই বিজয়ী! এখানে আসার আগে আমিও তাই ভাবতাম; লন্ডন মানেই সোনার হরিণ। এখনতো সেই সোনার হরিণের দেশেই আছি, কিন্তু সোনার হরিণটা কোথায় তাই দেখতে পাচ্ছিনা!
যখন সুমন দালাল প্রথমবারের মত আমাকে “মাত্র” ৮ লক্ষ টাকায় লন্ডনের ভিসা পাইয়ে দেওয়ার কথা বলে, তখন ভেবেছিলাম আকাশের চাদটা হাতের মুঠোয় চলে এসেছে! ভিসা পাওয়ার পরদিন বাবা বাজার থেকে বেশ বড়সর একটা বোয়াল মাছ কিনে নিয়ে আসেন, হয়ত লন্ডনগামী ছেলের কাছে এর চেয়েও বড় কিছু পাওয়ার আশায়…কিন্তু এখন? অন্যের দেয়া ভিক্ষা গ্রহণ করে বেচে থাকতে হচ্ছে! দেশের যোগ্য মিডিয়ার কল্যানে বাবা অবশ্য ইতিমধ্যেই জেনে গিয়েছেন তার পূত্র এখন সেই বোয়াল মাছটার মতই বড় হা করে অন্যের দেয়া ক্ষাদ্যকণা গ্রাস করে বেচে আছে…
“রফিক ভাই, একটা কাজের খোজ পাইছি। ফলের ইশটিকার লাগাইতে হইব। আমগো রতন আছে না? হেতে কইছে। তিনজন নিব। সপ্তাহে ৬০ পাউন্ড। খারাপ কি? কি কন?”
হাবিব উচ্ছসিত হয়ে খবরটা আমাকেই কেন দিচ্ছে বুঝতে পারলাম না। সে কি এটা জানেনা যে আরেকজন প্রতিদ্বন্দীকে চাকরীর খবর জানানো মানে নিজের সমস্যা সৃষ্টি করা! আর রতনই বা কে?
“চলেন, ওই যে রতন দাড়াইয়া আছে।”
হাবিবের কথায় মনে একটা আশার আলো দেখতে পেলাম। কুমিল্লার লোক বলে তাকে খারাপ ভাবায় এখন নিজের কাছেই লজ্জা লাগছে।
একটা সাইনবোর্ড দেখে বুঝলাম যায়গাটা নাম Westminister. হাবিবের কথাই ঠিক। আমরা যে বিল্ডিংটার সামনে দাঁড়িয়ে আছি, তাতে তিনজন লোক নেবে। এটার খবর কেও এখনও পায়নি; ইস্ট লন্ডন থেকে বেশকিছুটা দূরে হওয়ার কারনে হতে পারে। তবে আমি এই বিষয় নিয়ে মোটেই চিন্তিত নই। আমি ভাবছি কিভাবে চাকরিটা বাগিয়ে নেয়া যায়। ফলের (যদিও আমার সন্দেহ হচ্ছে এটা আদৌ ফলের দোকান কি না) দোকানের মালিক ব্রিটিশ, তাই আশা করা যায় আমার মাস্টার্স ডিগ্রীর দাম এখানে পাব।
চাকরী আমাদের দুজনেরই হয়ে গেল। ফলের ট্যাগ লাগানোর পরিবর্তে পায়খানা কেন পরিষ্কার করতে হবে, সে বিষয়ে আমি বা হাবিব কেউই কোন উচ্চবাচ্চ্য করলাম না। আমি প্রথমেই বুঝতে পেরেছিলাম এটা কোন ফলের দোকান নয়; ফলের দোকানে খাবারের মেনু থাকে না! পাঠকরা জেনে ‘পুলকিত’ হবেন যে, ব্রিটিশ মালিককে দেশ থেকে আমার মাস্টার্স ডিগ্রী অর্জনের কথা অনেক ঘাম ঝরিয়ে ইংরেজিতে বোঝানোর পর তিনি আমাকে যা বললেন তার যথাসম্ভব ভদ্র ভাষা নিম্নরূপ (একজন “ব্রিটিশ” ইংরেজি বোঝা বাঙ্গালী ভাই কর্ত্রিক অনুবাদিত)-
“আমি তোমার এই ডিগ্রীটি বড়জোড় আমার পশ্চাদ্দেশ পরিষ্কার করার কাজে লাগাতে পারি।”
আমি ভদ্রলোকের কথায় কিছু মনে করিনি। মাস্টার্স পাশ করে আমি ঠিকমত ইংরেজিই বলতে পারিনা, আমার আবার কিসের অহং! এখানে বাংলাদেশী কেও ইংরেজি না জানলে সে অশিক্ষিতের পর্যায়েই পড়ে। তবে সে যদি জার্মান, ফ্রেঞ্ছ, অথবা ইটালিয়ান হয়, তাহলে সেটা তার গর্বের বিষয় হয়ে দাঁড়ায়। তাদের দেশতো আর ১৬ কোটি মানুষের ক্ষুধা নিবারণের জন্য কারো কাছে হাত পাতে না।
রাত আবারও ১২টা। পার্কের একটা বেঞ্ছে বসে আছি। পাশে হাবিব। রতন এখনো আমাদের থাকার ব্যবস্থা করতে পারেনি, তাই আজ রাতটাও এখানেই কাটাতে হবে।
“একটু আগুন জ্বালানি দরকার, কি বলেন রফিক ভাই?”
প্রশ্নের কোন উত্তর না পেয়ে হাবিব হাতে ম্যাচ নিয়ে কাগজ খুজতে ব্যাস্ত হয়ে পড়ে।
“এটা বাংলাদেশ না যে রাস্তাঘাটে কাগজ কুড়িয়ে পাবেন। এই নেন”, বলে আমি কিছু কাগজ এগিয়ে দিলাম। হাবিব লজ্জিতভাব করে আমার হাত থেকে কাগজগুলো নিয়ে আগুন ধরায়। ঠিক ৪ মিনিটের মাথায় পুলিশ এসে সেই আগুন নিভিয়ে আমাদের ইংরেজিতে কিছু একটা বলে শাসিয়ে যায়। প্রায় হিব্রু ভাষায় বলা ইংরেজি থেকে “jail” ও “fine” কথা দুটি উদ্ধার করতে পারলাম।
“যাক, কিছু সময়তো আরাম পাওয়া গেল, কি বলেন?”
এক মুহূর্তের স্বস্তি পেয়ে হাবিবের মুখে আনন্দের হাসি খেলে যায়। আমিও না হেসে পারিনা; অন্তত আমার মাস্টার্স ডিগ্রীর সার্টিফিকেট আর মার্কশীট কিছু একটাতো দিতে পেরেছে…

অনুগ্রহ করে অপেক্ষা করুন। ছবি আটো ইন্সার্ট হবে।




