১.
মানুষ সব প্রতিবন্ধকতাই একসময় কাটিয়ে উঠতে পারে; নিবিড় মানুষ, তাই সেও পেরেছে। এখন ইতি তার কাছে একসময়ের পড়া কোন বইয়ের অধ্যায়, যা অস্পষ্টভাবে মাথায় কদাচিৎ খেলা করে। ইদানীং সেটাও ফিকে হয়ে আসছে। অবশ্য এর কৃতিত্ব অনেকটাই কথা’র প্রাপ্য। কথা’র সাথে নিবিড়ের পরিচয় হয় ফেসবুকে, ইতির চলে যাওয়ার দুই বছর পর। একদিন ফেসবুকে কথার ফ্রেন্ড রেকুয়েস্ট পেয়ে ইগনোর করবে ভেবে নিবিড় ভুলবশত সেটা এক্সেপ্ট করে ফেলে। তারপরও সে কথাকে ফ্রেন্ডলিস্ট থেকে রিমভ করে দিতে পারত। কিন্তু নিয়তি তা আর হতে দেয়নি। কথা তাকে প্রথম ফেসবুক চ্যাটিংয়েই দারুন চমকে দেয়। “খুব কষ্টে আছেন বুঝি?”, কথা এটা চ্যাট উইন্ডোতে লিখে নিবিড়কে পাঠায়।
“কেন বলছেন এ কথা?”, নিবিড় জানতে চায়।
“আপনার প্রোফাইল পিকচার দেখে বুঝলাম। অনেক উদাস উদাস ভাব। জানেন নিশ্চই, কারো মনের অবস্থা ছবিতে খুব সহজেই ধরা পড়ে।”
নিবিড় আর কথার বন্ধুত্বের শুরু এভাবেই। বন্ধুত্ব যখন অনেক গভীর, ততদিনে ইতির দেয়া নিবিড়ের অন্তরে লেগে থাকা ঘা প্রায় শুকিয়ে এসেছে। একসময় নিবিড় কথাকে তার অতীতের গল্প বলে, যে গল্পে আছে ইতির সাথে ভালবাসাবাসি, অবশেষে তার দেয়া কষ্টের দাগ।
২.
“জীবন মানুষকে সুন্দর করে, অথবা জীবনকে মানুষ ! আমি শুধু যা কিছু সুন্দর, তা জীবনের রঙের সাথে মিশিয়ে দিতে চাই। তুমি সুন্দর, তাই তোমার রংটুকু একই ক্যানভাসে মিশিয়ে দিলাম।”
ঝকঝকে সাদা ব্যাকগ্রাউন্ডের উপর নিকষ কালো অক্ষরে লেখা কথাগুলো নিবিড়ের চোখের সামনে যেন নাচছে।
এত সুন্দর কথা সে লিখতে পেরেছে! নিজেরই যেন বিশ্বাস হতে চায় না। ইতি ফটো এলবামটি খুলেই প্রথমে এই কথাগুলো পড়বে। তারপরতো আরও বড় চমক- এলবামে শুধু ইতির ছবিই নয়, আছে প্রতেকটি ছবির সাথে একটা করে কবিতা! নিবিড় যতগুলো এসএমএস তাকে কবিতার ঢং এ দিয়েছে, এর সবকটাই এখানে আছে। সে এলবামটাও কিনেছে স্পেশাল অর্ডার দিয়ে। এলবামের কাভারের উপর একটা লাল রঙের ভালুক আকা; হাতে তার একতোড়া ফুল, যেন যে দেখছে তার দিকে ভালুকটি গভীর ভালবাসা নিয়ে ফুলের তোড়াটি এগিয়ে দিয়েছে।
আজ তাদের এনিভার্সারি। কিসের, সেটা জিজ্ঞেস করলে বিষয়টি অনেকের কাছে পুরোপুরি আদিখ্যেতাই মনে হবে। ঠিক এই দিনে নিবিড় সব দ্বিধা-দ্বন্ধ ঝেড়ে ফেলে ইতিকে তার মনের কথা জানিয়ে দিয়েছিল। আর ইতি? সে যেন এই মুহুর্তটার জন্যই অপেক্ষায় ছিল। নিবিড়ের হাত ধরে জিজ্ঞেস করেছিল, “আমাকে কখনো ছেড়ে যাবে না তো?”
“এসব কি কথা, ইতি?”, নিবিড় রাগ করে বলেছিল, “আজ আমাদের ভালবাসার শুরু, আর আজই তুমি এমন কথা বললে!”
ইতি মুচকি হেসে চুপ করে যায়। তারপর পুরো দু’বছর যে কোথায়, কোনদিকে চলে গেল টেরই পায়নি দুজনের কেউ। বছর ঘুরে আজ আবার সেই দিন- তাদের “প্রেম বার্ষিকি”। বন্ধুরা তো রীতিমত নিবিড়-ইতিকে খুচিয়ে মারে। তাদের কাছে প্রেমের বছরপূর্তি এমন কোন বড় ব্যাপার নয় যে তা ঘটা করে পালন করতে হবে। তবে নিবিড় আর ইতি বন্ধুদের সেসব কথা খুব একটা আমলে নেয় না।
কথা ছিল ইতি বিকেলে নিউ মার্কেটে আসবে। সেখান থেকে নিবিড়কে নিয়ে তার দরকারী কিছু কেনাকাটা করে যাবে ধানমন্ডির একটা রেস্টুরেন্টে। নিবিড় নিউমার্কেটের উদ্দেশ্যে রিক্সা নিতে যাবে, এমন সময় তার মোবাইল বেজে উঠে- “তুমি কোথায়?”, ইতির মিষ্টি গলা।
“আমি রিক্সা নিচ্ছি। এইতো চলে আসব।”
“শুনো, নিউমার্কেট আসতে হবেনা। তুমি আনাম রেংস প্লাজায় আস।”
হঠাত প্ল্যানের পরবর্তন হও্য়ায় কিছুটা বিরক্ত বোধ করলেও নিবিড় জানালো সে আসছে। রিক্সায় উঠে যথারীতি ঢাকা শহরের ট্রাফিক সিস্টেমের চৌদ্দগুষ্ঠি উদ্ধার করতে করতে সে ভাবছে ইতি তার এই ভিন্ন ধাচের উপহারটা দেখে কত খুশিই না হবে। নিবিড় এলবামটি আর একবার হাতে নিয়ে দেখে নেয়। ইতি বলেছে নিবিড়ের কবিতা ওর অসম্ভব ভাল লাগে। অনেকগুলর মধ্যে একটা কবিতা ইতির খুব পছন্দের। কবিতাটি নাকি ইতিকে মনে করিয়ে দেয় যে তার অস্ত্বিত্বের সিংহভাগ জুড়ে আছে একটা নাম- “নিবিড়”। এতা ভাবতে ভাবতে ইতির সবচেয়ে পছন্দের কবিতাটি নিবিড় বিড়বিড় করে আওড়ায়- বিনিদ্র রজনীর গহ্ববরে বাস করে আমি দেখি ভোরের আলোর ক্রম জাগরণ/সে আলয় তোমার রূপ স্নান করে; তোমাকে তুমিতে পূর্ণ করে/আমি নিশ্চুপ চেয়ে থাকি, চেয়ে থাকতে চাই/আমি ভালবাসি, আর ভালবাসা শেখাই…।
ইতি দাঁড়িয়ে ছিল আনাম রেংস প্লাজার ঠিক সামনে। বিকেলের কোমল রোদ তার সুন্দর মুখখানির উপর অবাধ খেলা করছে। এতে মিষ্টি চেহারাটি আরও কমনীয় আর মায়াবী দেখাচ্ছে। কিন্তু ইতি আজ একটুও সাজগোজ করেনি! নিবিড় বলেছিল কানের দুল আর চুড়ি পরে আসতে। কানের দুল সে পড়েছে, কিন্তু চুড়ি পরেনি। নিবিড়ের মনটা একটু খারাপ হয়ে গেল। ইতিতো কখনোই এমনটি করেনা! তাহলে আজ কি সে সাজতে বা চুড়ি পরতে ভুলে গেছে?
নিবিড় ইতির কাছে গিয়ে আলতো করে গাল টিপে দিয়ে বলে, “তোমাকে আজ অনেক সুন্দর লাগছে।”
“তোমাকেও”, বলেই ইতি মাথা নুইয়ে ফেলে। নিবিড়ের চোখ থেকে তার চোখ সরিয়ে নেয়।
“এই, কি হল? তুমি আমার দিকে তাকাচ্ছনা কেন?”, নিবিড়ের কন্ঠে উদ্বেগ।
“কিছুনা। চল কড়াইগোশ্ত এ যাই।”
নিবিড় এবার আরও অবাক হয়। যাওয়ার কথা ছিল সাতাশ নাম্বারে রেড টমেটো-তে। ওটার খাবার খুব ভাল, সেটা ইতিই তাকে বলেছে। আজ এই নিয়ে দ্বিতীয়বার প্ল্যান বদল করল ইতি। সে কোন সমস্যায় আছে ভেবে নিবিড় কোন প্রশ্ন না করে মাথা ঝাকায়। কড়াইগোশ্ত কাছেই। হেটে যেতে পাচ মিনিট লাগবে, তাই তারা রিক্সা না নিয়ে হেটে রওনা দেয়।
এখানে এই সময়টাতে কাস্টমারদের আনাগোনা থাকে প্রচুর। এই রেষ্টুরেন্টের খাবারও বেশ ভাল। নিবিড় ও ইতি একটা কোনার টেবিল ফাকা পেয়ে বসে পড়ে। ওয়েটারকে মেনু আনতে বলে নিবিড় এবার গভীর মনযোগে ইতিকে পর্যবেক্ষণ করতে থাকে। ইতি মাথা নুইয়ে বসে আছে। দৃষ্টি তার ফ্লোরের দিকে, যেন সেখানে লুকিয়ে থাকা কঠিন কোন রহস্যের জট খুলছে। নিবিড় একবার ভাবে সরাসরি ইতিকে জিজ্ঞেস করবে কি হয়েছে। তারপরই সেটা না করার সিদ্ধান্ত নেয়। কিছু হলে ইতি নিজে থেকেই সব বলবে। সবকিছুইতো সে নিবিড়কে বলে।
কিছুক্ষণ পর ওয়েটার খাবারের অর্ডার নিয়ে গেলে ইতি আস্তে করে তার মাথাটা তুলে সরাসরি নিবিড়ের দিকে তাকায়। ইতির চাহনী কেমন জানি বিষাদ ভরা; যেন কেউ ওখানে কষ্টের কালি ঢেলে দিয়েছে।
“আমাকে ভুলে যাও নিবিড়।”
নিবিড় ইতির দিকে তাকিয়ে আছে। ইতি বুঝতে পারছে না নিবিড় আদৌ তার কথা হৃদয়ঙ্গম করতে পেরেছে কি না!
“বাসা থেকে আমার বিয়ে ঠিক করে ফেলেছে”, এবার সে কথাগুলো একটু জোরে বলে উঠে।
নিবিড় কোন কথা না বলে একদৃষ্টে তাকিয়ে আছে দেখে ইতি বলে যায়, “আমি জানি এটা শুনে তুমি কি ভাবছ। ভাবছ আমি নিজেই যেখানে তোমাকে হারানোর ভয় পেতাম, সেখানে আমি এটা কিভাবে বলছি…বিশ্বাস কর নিবিড়, ভাল আমি তোমাকেই বাসি, আর বেসেও যাব সারা জীবন…”
এটা কি বাংলা ছবির কোন দৃশ্য? নিবিড় কি সেই ছবির কোন একটা সীনে নায়িকার অতি ন্যাকামো ভরা কথা শুনছে? কিন্তু তার সামনে বসা মেয়েটাতো ইতি! তার প্রিয় মানুষ, তার ভালবাসার মানুষ। সে এসব কি বলছে- বিয়ে, ভুলে যাওয়া! ইতি কান্না জড়ানো গলায় কি বলছে তা নিবিড়ের কানে প্রবেশ করছে না। সে শুধু দেখতে পাচ্ছে তার ঠোটের কম্পন, আর অশ্রুভরা চোখ। তার কাছে ইতির সবকিছুই এখন চরম ন্যাকামোতে ভরা নাঁকি কান্নার মত শুনাচ্ছে।
এক সময় নিবিড় দেখল ইতি ধীর পায়ে উঠে চলে যাচ্ছে। অবশেষে ইতির শেষ কথাটা তার কানে গিয়ে প্রবেশ করে- “ভাল থেক। আমার জন্য কষ্ট পেও না।”
ইতি পিছন ফিরলে দেখতে পেত নিবিড় একটা সুন্দর এলবাম দুই হাতে শক্ত করে ধরে বসে আছে। একসময় তার চোখ থেকে একফোটা অশ্রু এলবামে আকা ভালুকটির গায়ের উপর গিয়ে পড়ে।
৩.
কথা ততদিনে নিবিড়ের অনেক আপন, অনেক কাছের একজন মানুষে পরিণত হয়ে গেছে। নিবিড় বুঝতে পারে- অবশেষে আরেকটি ভালবাসার গল্পের সূচনা হতে যাচ্ছে।
আজ রবিবার। নিবিড় রাস্তায় দাঁড়িয়ে ঘড়ি দেখছে। কথা’র এতক্ষণে চলে আসার কথা। কথাকে সে ভালবাসে- নিবিড় কথাটা সেদিন ফোনে তাকে জানায়। সে তাকে অবাক করে দিয়ে বলে, “ইতি যেদিন তোমাকে ছেড়ে চলে গিয়েছিল, সেই দিনটি আসবে দুদিন পর- রোববার। ঠিক সেদিন আমি তোমার ভালবাসা গ্রহণ করব।"
ঐতো কথা আসছে। হালকা গোলাপী রঙের জামায় তাকে সুন্দর ও পবিত্র লাগছে। কাছে এসেই কথা নিবিড়ের দিকে তাকিয়ে মিষ্টি হাসে। নিবিড় কোনকিছু না বলে হঠাৎ কথার হাতে কিছু একটা ধরিয়ে দেয়। কথা জিনিসটার দিকে চোখ বড় বড় করে তাকিয়ে আছে দেখে নিবিড় ভাবল সে রাগ করেছে। এমন বোকার মত কাজ করা তার উচিত হয়নি। কিন্তু পরক্ষণেই কথার হাসি আরও প্রসারিত হতে দেখে নিবিড় স্বস্তির নিশ্বাস ফেলে। কথা তাকিয়ে আছে তার দেয়া সুন্দর উপহারটার দিকে। একটা ফটো এলবাম। কথা এলবামটির ভিতরে গিয়ে পাতা উল্টায়। সে অবাক হয়ে আবিষ্কার করে এলবামের ভিতরে তার নিজের একেকটা ছবির সাথে একটা করে কবিতা লেখা! সব শেষে সে এলবামের কাভারের দিকে মনোযোগ দেয়- লাল রঙের একটা ভালুক ফুলের তোড়া নিয়ে কথার দিকে হাত বাড়িয়ে দিয়েছে।
সর্বশেষ এডিট : ০২ রা ফেব্রুয়ারি, ২০১২ সকাল ১০:৪১

অনুগ্রহ করে অপেক্ষা করুন। ছবি আটো ইন্সার্ট হবে।




