somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

২৬ আগস্ট 'ফুলবাড়ী দিবসে'র ডাক

২৬ শে আগস্ট, ২০১১ রাত ১২:৪১
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :


২৬ আগস্ট: সাম্রাজ্যবাদ বিরোধী লড়াইয়ের নতুন অধ্যায়
তেল-গ্যাস-কয়লাসহ ‘জাতীয় সম্পদ রক্ষার আন্দোলনে’র এক যুগের পরিক্রমায় উত্থাপিত হয়েছে ‘জাতীয় সার্বভৌমত্ব’, ‘জাতীয় সম্পদের সর্বোচ্চ ব্যাবহার’ ও ‘জাতীয় সক্ষমতা প্রতিষ্ঠা’র মত গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন। এর পাশাপাশি পরিবেশ-প্রতিবেশ রক্ষার প্রশ্নটিও এর বাইরে থাকেনি। ফুলবাড়ীতে ‘উন্মুক্ত পদ্ধতি’তে কয়লা উত্তোলনের আত্নঘাতি সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে বৃহত্তর দিনাজপুরবাসীর সচেতন অংশগ্রহন প্রমান করেছে- পরিবেশ-প্রকৃতির ক্ষয়ক্ষতি সম্পর্কে সমস্টিক সচেতনতা। পরিসংখ্যানগত দিকে নজর দিলেও এটি স্পস্ট, উন্মুক্ত পদ্ধতিতে কয়লা উত্তোলনে কয়লার বিনিময় মুল্য থেকে পরিবেশ-প্রতিবেশ গত ক্ষয়-ক্ষতির পরিমান বহুগুন বেশি। যে পরিবেশ-প্রতিবেশ এর মাঝে আমরা বসবাস করি, তার মধ্য থেকেই জীবন-জীবিকার জন্য সম্পদ আহরন করে থাকি। পরিবেশের এই বাস্তবতার উপরেই নিরর্ভর করে আমাদের জীবন-যাপন। ফলে পরিবেশের ক্ষয়-ক্ষতি যে প্রকৃতপক্ষে বসবাসরত জনগোষ্ঠীর অস্তিত্বের সাথে সম্পর্কিত, তা অনুধাবনে দিনাজপুরবাসীর ভুল হয়নি। বহুজাতিক কোম্পানী ‘এশিয়া এনার্জি’র (বর্তমান নাম গ্লোবাল কোল ম্যানেজমেন্ট বা জিসিএম) বিরুদ্ধে নিজেদের অস্তিত্ব রক্ষার এই ঐক্যবদ্ধ লড়াইয়ের ভেতর দিয়েই তাই স্পষ্ট হয়েছে ‘জাতীয় সার্বভৌমত্ব রক্ষা’র প্রশ্ন। সর্বোপরি সাম্রাজ্যবাদ বিরোধী লড়াই-সংগ্রামের ইতিহাসে যুক্ত হয়েছে আরেকটি নতুন অধ্যায়।

'২৬ আগস্ট ২০০৬’ সেই সূচনা অধ্যায়ের নাম। যে অধ্যায়ে বিশ্ব প্রত্যক্ষ করছে সাম্রাজ্যবাদী মুনাফার দাপুটে শক্তির বিপরীতে লড়াইয়ের চেতানায় ভাস্বর গণজাগরণের এক আভূতপূর্ব দৃশ্য। ধ্বংস-মৃত্যু হাহাকারের তলানি থেকে উঠে নিজভুমিতে অধিকার প্রতিষ্ঠার মরণপন লড়াই। ফুলবাড়ী, লড়াইয়ের সেই রাক্তাক্ত জনপদের নাম। শহীদ আমিন, তরিকুল, সালেকিনের রক্ত মিশে আছে যে মাটিতে

‘ফুলবাড়ী কয়লা প্রকল্প’; ধ্বংসযজ্ঞের অপর নাম
সাম্রাজ্যবাদী বহুজাতিক কোম্পানির ইতিহাস শুধুমাত্র স্থানীয় জনসাধারণের জীবনই নয়, বরং মাটি-পানি-প্রাণ-প্রকৃতি ধ্বংসের ইতিহাস। কয়লা প্রকল্পে কাজ করার কোন অভিজ্ঞতা ছাড়াই শুধুমাত্র মুনাফা, ধ্বংস আর লুটের বাসনায় ‘উন্নয়নে’র মিথ্যে বুলি আওড়িয়ে ‘এশিয়া এনার্জি কোম্পানি’ এসেছে তার লোভাতুর আগ্রাসী জিহ্বা দোলাতে দোলাতে। তদবির, ঘুষ ও দুনীর্তির মাধ্যমে কয়লা উত্তলনের অনুমতি পেয়ে ৫ লক্ষাধিক মানুষকে আবাসভূমি থেকে উচ্ছেদ প্রচেষ্ঠার নাম দিয়েছে ‘ফুলবাড়ী কয়লা প্রকল্প’ নামে।

সাধারণত কয়লা উত্তালনের দুইটি উপায়- ‘ভূগর্ভস্থ খনন পদ্ধতি’ ও ‘উন্মুক্ত খনন পদ্ধিত’। ‘উন্মুক্ত পদ্ধতি’তে কয়লা আহরনে বড় এলাকা জুড়ে গভীর পুকুর খনন করে কয়লা স্তর উন্মুক্ত করতে হয়। প্রয়োজন অনুযায়ী পুকুরের গভীরতা ৩০০ থেকে ১০০০ ফুট পর্যন্ত হয়ে থাকে। কোম্পানির প্রকাশিত হিসেবে প্রথামিকভাবে খনির জন্য প্রায় ২০০০ হেক্টর জমির প্রয়োজন হবে বলে উল্লেখ করা আছে। এছাড়াও খনির মেয়াদকালে খনি ও সহযোগী স্থাপনার জন্য প্রায় ১০ হাজার হেক্টর জমির প্রয়োজন পরবে। বোঝা সহজ, এই পরিমান অঞ্চলের জনগণকে অনত্র সরিয়ে নিতে হবে। অথচো ‘কৃষি জমির সামান্ন ক্ষতি ছাড়া প্রত্যক্ষভাবে খনির সম্ভাব্য এলাকায় বসবাসরত জনগণের ওপর খুব সামন্যই প্রভাব পড়বে’ বলে তারা মিথ্যে প্রবোধ দেয়ার চেষ্টা করেছে। ক্ষতির পরিমান কম দেখিয়ে লাভের অংশকে বহুগুন বাড়িয়ে দেখানো লুটেরাদের চিরাচরিত নিয়ম। প্রকৃতপক্ষে, শুধু খনির জন্য নির্ধারিত এলাকাতেই ২ লক্ষ মানুষ বসবাস করে। এর সাথে খনির সহযোগী স্থাপনার জন্য আশেপাশের এলাকা ধরলে আদিবাসীসহ কমপক্ষে ৪-৫ লক্ষ মানুষ উচ্ছেদ হবে। শুধু মানুষই নয়, ধ্বংস হবে ওই এলাকার স্কুল-কলেজ, মসজিদ-মন্দির-র্গিজা, হাসপাতল, বাজার, ইতিহাস ও ঐতিহ্যের স্মারক পুরাকীর্তিসহ মাটির ওপরের সকল সম্পদ। এর চাইতেও বড় কথা, ধ্বংস হবে বাংলাদেশের শস্যভান্ডার বলে পরিচিত উত্তরবঙ্গের বিরাট অংশের কৃষি জমিসহ ওই এলাকার সমস্ত মাটি-পানি-প্রাণ ও প্রকৃতি।

বাংলাদেশের ভূ-প্রকৃতি অনুযায়ী মাটির নিচে ৫-১০ ফুট গভীরেই পানির প্রবাহ। ফলে ৩০০-১০০০ ফুট গভীর পুকুর কেটে কয়লা তুলতে সমস্ত পানি অপসারণ করে খনি এলাকা শুস্ক করতে হবে। সমিক্ষা অনুযায়ী প্রতি মিনিটে প্রায় ৮ লক্ষ লিটার পানি অপসারিত করতে হবে। ফলাফলে একদিকে আশেপাশের এলাকায় স্থায়ী জালাব্ধতা তৈরি হবে, অন্যদিকে পুরো উত্তরবঙ্গের বিশাল অঞ্চলের মাটির নিচ পানি শূন্য হবে; এতে পুরো এলাকা মরুভূমিতে পরিণত হয়ে চাষাবাদের অনুপযুক্ত হয়ে যাবে। এছাড়াও ‘এসিড মাইনিং ড্রেনেজ’ অথাৎ বৃষ্টির পানি ধৌত বিষাক্ত এসিড জালের মত ছড়িয়ে এক নদী থেকে আরেক নদীতে প্রবাহিত হয়ে সারাদেশের পানিকে বিষাক্ত করার মত অবস্থা তৈরি করবে। শুধু উত্তরবঙ্গ নয়, মাটি-পানি-প্রকৃতির এই বিপর্যয়ে সারাদেশ স্থায়িভাবে ক্ষতিগ্রস্থ হবে। এছাড়াও উন্মুক্ত কয়লাখনিতে দুর্ঘটনার সম্ভাবনাও বেশি, এবং তা নিয়ন্ত্রণের প্রযুক্তি আজো অবিস্কৃত হয়নি। ১৯৬৭ সালে থেকে আমেরিকার পেনসিলভানিয়ার এরকম একটি কয়লাখনি আজও জ্বলছে।


"এই ভিটা ছাড়বোনা, এই মাটি ছাড়বোনা
ছাড়তে বলো ছেড়ে দেবো তাগড়া জানের মায়া
এই লাঙ্গল ছাড়বোনা, এই কাস্তে ছাড়বোনা
ছাড়বোনাতো সিনায় সিনায় ধানী জমির মায়া
ও সিধু মাঝিরে ও কানু মাঝিরে
তোর ভাইয়েরা নতুন দিনের বাজায় সিঙারে
আমিন তরিকুল সালেকীন বাজায় সিঙারে
- অমল আকাশের গান 'ফুলবাড়ী ও ফুলবাড়ী' থেকে কয়েক লাইন"


প্রকৃতি-পরিবেশ বিপর্যয়ের প্রশ্নে সারাবিশ্ব যখন ঐক্যবদ্ধ ব্যাবস্থা গ্রহনের পদক্ষেপ নিচ্ছে, তখন বাংলাদেশে প্রকৃতি -পরিবেশ ধ্বংসের এই প্রকল্পকে উন্নয়নের মুলা হিসেবে ঝুলিয়ে দেয়া হয়েছে জনগণের সামনে। দেশে দেশে উন্মুক্ত খনন পদ্ধতি যখন কেবল পরিত্যজ্যই নয় আইন করে নিষিদ্ধ করা হচ্ছে, তখন কয়লার গল্প ফেঁদে, লাভের নানান ক্ষতিয়ান দিয়ে এশিয়া এনার্জি ও তাদের এদেশীয় দোসরদের প্রচর হচ্ছে, ‘উন্মুক্ত পদ্ধতিতে কয়লা উত্তোলনের ফলে বাংলাদেশ আর্থনৈতিকভাবে ব্যাপক উপকৃত হবে’।

উন্মুক্ত পদ্ধতিতে কয়লা খনির লাভ-ক্ষতির খতিয়ান
ফুলবাড়ী কয়লাখনির লাভক্ষতির হিসাব মেলাতে স্থানিয় জনগণই উদ্যগ নিয়ে ২০০৪-০৫ অর্থবছরে ওই অঞ্চলে উৎপাদিত ফসলের পরিমান ও মূল্যসহ অন্যান্য উল্লেখযোগ্য স্থাবর-অস্থাবর, সরকারি, আধা সরকারি, বেসরকারি প্রতিষ্ঠান ইত্যাদির মূল্য পরিমাপ করেছিলো। ফসলের মধ্যে ২০০৪-০৫ সালে ধান, গম, সরিষা, আলু, ভূট্ট, কলা ইত্যাদির মোট উৎপাদন মূল্য ২০৭ কোটি ৯৯ লক্ষ ৩৬ হাজার টাকা। আখ, পাট, মরিচ, রসুন, পেয়াঁজ, আদা, হলুদ, শাক-সবজি, আম, কাঠাল, লিচুসহ ফলফলাদির উৎপাদন মূল্য ধরা হয় উপরে উল্লেখিত ফসলের সমপরিমান মূল্য, যার যোগফল ৪১৫ কোটি ৯৮ লক্ষ ৭২ হাজার টাকা। গবাদি পশুর মধ্যে গরু, ছাগল, ভেড়া, মহিষ ইত্যাদির বার্ষিক উৎপাদনের গড় মূল্য ৭ কোটি ৯২ লক্ষ ৪৫ হাজার টাকা; হাঁস, মুরগীর বার্ষিক উৎপাদনের গড় মূল্য ৯ কোটি ৬০ লক্ষ, ৩৬ হাজার টাকা, এর মধ্যে ডিমের হিসেব বাদ। এই অঞ্চলের ১টি নদী, ২টি বিল, ৯৮৪টি পুকুর, ৮৪টি খাস পুকুর ইত্যাদিতে মাছের বার্ষিক বাণিজ্যিক উৎপাদন ৭০০ মেট্রিক টন, যার গড় মূল্য আরো ৫ কোটি ৬০ লক্ষ টাকা। এবং সরকারী বিভিন্ন অফিসের মধ্যে ২টি অফিসের আয়ের হিসাব, জমির পরিমান, পরিবেশগত ক্ষতি ইত্যাদি বিবেচনায় সর্বমোট ক্ষতির পরিমান দাড়ায় ২৪ হাজার ১৪০ কোটি ৭০ লক্ষ ৫০ হাজার ৯ শত ৪৯ টাকার মত। (সূত্র: অনির্বাণ, বর্ষ ১০, সংখ্যা ১, জুন ২০০৫) উপরের হিসেবটি শুধুমাত্র একটি অর্থ বছরের হিসেব আর এতে ভ্যাট, বিভিন্ন প্রাতিষ্ঠানিক কর, আয়কর, বাজারের ইজারা, ব্যাংক-বীমাসহ বিভিন্ন সরকারি অফিসের আয় ইত্যাদি এই পরিসংখ্যানে তুলে ধরা হয় নি। এইভাবে খনির ৩০ বছরের মেয়াদ কালে ক্ষতির পরিমান নিশ্চিত ভাবে আরো অনেক অনেক বৃদ্ধি পাবে।



এইবার লাভের করা যাক। ফুলবাড়ীতে উত্তোলন যোগ্য কয়লার পরিমান সর্বশেষ হিসেব অনুযায়ী প্রায় ৫৭২ মিলিয়ন টন। এছাড়াও উন্নতমানের সিলিকা বালি, সিরামিক বালি, মধুপুর ক্লে, নুড়ি পাথরসহ উন্নতমানের পাথর, এমনকি হীরাও পাওয়ার সম্ভাবনা আছে। এশিয়া এনার্জির প্রস্তাবে এইগুলোর কোন হিসেব ধরা হয় নাই। অথাৎ কয়লা তো নেবেই, তার সাথে ফাউ হিসেবে এগুলোও উদরে পুরবে। চুক্তরি প্রস্তাবকাল ২০০৫-০৬ সনে আন্তর্জাতিক দাম অনুযায়ী শুধু কয়লা থেকে, প্রতিটন ৫০-৬০ ডলার করে প্রতিবছর ৫ হাজার কোটি টাকা হিসেবে ৩০ বছরে কোম্পানির আয় করার কথা ১ লক্ষ ৫০ হাজার কোটি টাকা। বাংলাদেশ কি পাবে? রয়ালিটি হিসেবে বাংলাদেশের পাওয়ার কথা উত্তোলিত কয়লার মাত্র ৬%; রয়ালিটি ও ভ্যাটসহ ৩০ বছরে আয় ৪৬ হাজার কোটি টাকা, অথাৎ বছরে মাত্র ১৫ শত কোটি টাকার মত। আর এটাই বাংলাদেশের অর্থনীতিতে আকাশচুম্বী প্রভাব ফেলবে বলে প্রচার চালানো হয়েছিলো! অথচ ২০০৫-০৬ অর্থবছরে বাংলাদেশের বার্ষিক রফতানি আয় ৫১ হাজার কোটি টাকা এবং প্রবাসীদের পাঠানো রেমিটেনের সরকারী পরিমাণ ২৫ হাজার কোটি টাকা। এতে লাভ-ক্ষতির ফলাফল আসলে কি দাড়ায়! আর প্রস্তাবিত চুক্তিটি ২০০৫-০৬ সালের যখন কয়লার দাম আন্তর্জাতিক বাজারে টন প্রতি ৫০-৬০ ডলার ছিল, কিন্তু বর্তমানে দাম বেড়েছে ফলে কোম্পানির লাভ আরো বাড়বে। এইসব বাদ দিলেও আসল প্রশ্ন হলো, কয়লার শতকরা ৯৪ ভাগ বিদেশী বেনিয়ার হাতে তুলে দেয়ার এই চুক্তি কার স্বার্থে, কার উন্নয়নে? এতে কি বাংলাদেশের জনগণের স্বার্থ সংরক্ষিত হয়েছে? এদিয়ে কি বাংলাদের উন্নয় সম্ভব? ‘বাজার অর্থনীতির’ দর্শন অনুযায়ী ‘বাজারের সমাজিক দায়িত্ব হচ্ছে এক মাত্র মুনাফা করা।' কাজেই মাটি-পানি-প্রাণ-প্রকৃতি কিংবা মানুষের বর্তমান-ভবিষ্যৎ ইত্যাদি বিবেচনা বাদ দিলেও এই প্রস্তাব হরিলুট ছাড়া কিছু নয়।

বিদেশী বিনিয়োগের উন্নয়ণ তত্বে রাষ্ট্র ও সরকার বহুজাতিকের গর্বিত এজেন্ট
‘বিদেশী বিনিয়োগ’ মানেই যে উন্নয়ন নয় দীর্ঘদিন ধরে বহুজাতীক কোম্পানিগুলোর সাম্রাজ্যবাদী তৎপরতার মধ্যে দিয়ে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশ সেই অভিজ্ঞতা অর্জন করেছে। ব্রাজিল, কলাম্বিয়া থেকে শুরু করে নাইজেরিয়া, ঘানা, কোস্টারিকা সকল দেশ ছিল প্রাকৃতিক সম্পদের দিক থেকে খুবই সমৃদ্ধশালী। এসব দেশের সম্পদের প্রতিটি ক্ষেত্র এখন বিপর্যস্ত, বিকলাঙ্গ, দখলীকৃত। পশ্চিম আফ্রিকার দেশগুলোতেও কয়েক দশক ধরে চলেছে এই তথাকথিত 'উন্নয়ন কর্মকান্ড।' নাইজেরিয়াসহ আরো বহু দেশ পরিনত হয়েছে বিদেশী বহুজাতিক কোম্পানির চুষে ফেলে দেয়া এমন ছোবড়ায়; দারিদ্র-দুর্ভিক্ষ-অপুষ্টিপীড়িত মৃত্যুপুরীতে। প্রশ্ন জাগতে পারে, তৃতীয় বিশ্বের এইসব ‘স্বাধীন’, ‘সার্বভৌম’ দেশে কি করে এই লুন্ঠনের বিনিয়োগ চেপে বসলো?



এসব দেশের সরকার নির্বাচন থেকে শুরু করে রাষ্ট্রীয় পরিকলনার সকল ক্ষেত্রে সাম্রাজ্যবাদের শক্তিশালী তৎপরতা পরিস্কারভাবে চোখে পরবে। প্রত্যেকের রয়েছে দীর্ঘ সামরিক শাসনের অভিজ্ঞতা। সামরিক অথবা বেসামরিক, নির্বাচিত অথবা অনির্বাচিত, জাতীয় অথবা বিজাতীয় যে সরকারই হোক না কেন, তাদের প্রধান পরিচয় তারা গণবিরোধী, লুটেরা চরিত্রের। তারা বহুজাতীক কোম্পানি ও সাম্রাজ্যবাদের দাস। বাংলাদেশেও রাষ্ট্র ও সরকারের চেহারা একই। বিগত তিন দশকের বেশি সময় ধরে দেশের অর্থনীতি নিয়ন্ত্রিত হয়েছে বিশ্বব্যাংক ও আইএমএফের পরার্মশে, প্রকল্পে। ‘টেকশই উন্নয়ন’ ও ‘দারিদ্র দূরিকরণে’র নামে দেশের কৃষি, শিল্প, জ্বালানি থেকে শুরু করে শিক্ষা, স্বাস্থ্যসহ সকল সেবাখাত বেসকারিকরণ ও বিদেশি বিনিয়োগের জন্য উন্মুক্ত করা হয়েছে। বন্ধ হয়েছে একে একে বস্রকল, পাটকলসহ অন্যান্য কলকারখানা। এমন কি এখন যে জ্বালানি সম্পদ হতে পারতো বাংলাদেশের উন্নয়নের ভিত্তি, তাও তুলে দেওয়া হচ্ছে বহুজাতিকের হাতে। ৯০ দশকের পর থেকে ধারাবাহীক ভাবে বিভিন্ন ‘উৎপাদন বন্টন চুক্তি’র (পিএসসি) মাধ্যমে জল-স্থলের গ্যাস ক্ষেত্রগুলো সাম্রাজ্যবাদী বহুজাতিক কোম্পানির হাতে তুলে দেয়ার নীতিতে ‘বিএনপি’, ‘আওয়ামীলিগ’, ‘চার দলিয় জোট’সহ বর্তমান ‘মহাজোট সরকারে’র অবস্থানও একই রকম, অভিন্ন। সম্প্রতি ১৬ জুন দেশের সমুদ্রসীমা নির্ধারণ না করেই সমুদ্রের ২টি গ্যাসব্লাক; ১০ ও ১১ নং ‘মডেল পিএসসি ২০০৮’ এর আওতায়, উত্তোলন যোগ্য গ্যাসের প্রায় ৮০ ভাগ মালিকানা মার্কিন বহুজাতিক কোম্পানি ‘কনোক-ফিলিপস’কে প্রদান, উত্তোলিত গ্যাস বিদেশে রপ্তানি করার সুযোগ রেখে চুক্তি স্বাক্ষর করলো ‘মহাজোট সরকার।' এই প্রক্রিয়ায় দীর্ঘদিন ধরে ‘জাতীয় নিরাপত্তার স্বার্থে’র নামে সকল চুক্ত গোপন রাখা হয়েছে, নিরাপত্তার নামে জাতীয় সংসদে পর্যন্ত আলোচনা না করে ‘জাতীয় নিরাপত্তাকে’ই সবচেয়ে বেশি হুমকিগ্রস্ত করা হয়েছে।

২৬ আগস্ট 'ফুলবাড়ী দিবসে'র ডাক
বর্তমান বিশ্ববাস্তবতায় কোনো দেশের স্বাধীনাত, সার্বভৌমত্বের অর্থ নিজেদের জ্বালানি সম্পদের ওপর কর্তৃত্ব। অথচো আমাদের কর্তৃত্ব নেই আমাদের সম্পদ, জীবন-জীবিকার ওপর। লক্ষ প্রাণের বিনিময়ে অর্জিত স্বাধীনতা, সার্বভৌমত্ব এখন বিপর্যস্ত, হুমকির সম্মুখীন। ফুলবাড়ী বাংলাদেশের সকল লড়াকু জনগণের ঠিকানা। আসুন ফুলবাড়ীর বীর জনতার কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে নতুন ভবিষ্যত বিনির্মাণে সংহত-ঐক্যবদ্ধ হই।দেশের ভবিষ্যৎ নির্ভর করে প্রাকৃতিক ও মানব সম্পদের সর্বোচ্চ ব্যবহারের মাধ্যমে উৎপাদনের ভিত্তি গড়ে তোলার ওপর। আমরা যদি জ্বালানি সম্পদ দিয়ে প্রকৃতি ও পরিবেশ উপযোগী উৎপাদন ক্ষেত্র বিকশিত করতে না পারি, তবে আমাদের মানব সম্পদও ব্যবহার করতে পারবো না। আমরা থেকে যাবো পরনির্ভশীল দাসে, পরিণত হবো পরাধীন ভিক্ষুকে। দেশ, জাতি, জনগণের সামনে এখন তাই সবচেয়ে বড় কর্তব্য হচ্ছে নিজের সম্পদ রক্ষা করা, তার ওপর কর্তৃত্ব কায়েম করা।

তাই ফুলবাড়ীর কয়লাখনি রক্ষার এই আন্দোলনের ওপর শুধুমাত্র ওই এলাকার নয়, নির্ভর করছে বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ। জ্বালানি সম্পদ হিসেবে কয়লার ব্যাবহার বা অর্থনৈতিক বিবেচনা তো বটেই, ফুলবাড়ীর কয়লাখনি আজকে বাংলাদেশের অস্তিত্বেরও প্রশ্ন। খদ্য সংকট জর্জরিত বর্তমান অবস্থায় জাতীয় অর্থনৈতিক-রাজনৈতিক নিরাপত্তা নিশ্চিতকরণ, পরিবেশগত সম্পদ রক্ষাসহ দেশের ভবিষ্যত আমরা মুষ্টিমেয় কয়েজন কমিশন ভোগী জাতীয় বেঈমান, মীরজফরদের হাতে তুলে দিতে পারিনা। কয়লাসহ, স্থল ও সমুদ্রের গ্যাসক্ষত্রগুলো উজাড় হওয়ার আগেই এর বিরুদ্ধে আমাদের রুখে দাড়াতে হবে। ফুলবাড়ীর গণউত্থান এখন পর্যন্ত কেবল ফুলবাড়ীকেই নয়, রক্ষা করেছে মাটি-কৃষি-পানি-প্রাণ-প্রকৃতিকে, নির্ধারণ করেছে উপযোগী শিল্পের বিকাশের মধ্যে দিয়ে বাংলাদেশের জাতীয় সক্ষমতা প্রতিষ্ঠার ভবিষ্যতকেও। ফুলবাড়ীর লাড়াই তাই আমাদের নতুন ভবিষ্যতের দিশা। ২৬ আগস্টের ডাক তাই দেশ বিরোধী, জনস্বার্থ বিরোধী সকল ধরণের গোপন চুক্তির বিরুদ্ধে রুখে দাড়ানোর ডাক। ফুলবাড়ী বাংলাদেশের সকল লড়াকু জনগণের ঠিকানা। আসুন ফুলবাড়ীর বীর জনতার কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে নতুন ভবিষ্যত বিনির্মাণে সংহত-ঐক্যবদ্ধ হই।



নোট: প্রতিবেশ আন্দোলন, নারায়ণগঞ্জ শাখা থেকে প্রকাশিত ভাজপত্র 'প্রতিবেশে'র ফুলবাড়ী দিবস সংখ্যার নিবন্ধ।
১টি মন্তব্য ০টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

ন্যায় বিচার প্রতিষ্ঠা করা সকলের দায়িত্ব।

লিখেছেন নাহল তরকারি, ০৫ ই মে, ২০২৪ রাত ৮:৩৮



এগুলো আমার একান্ত মতামত। এই ব্লগ কাউকে ছোট করার জন্য লেখি নাই। শুধু আমার মনে জমে থাকা দুঃখ প্রকাশ করলাম। এতে আপনারা কষ্ট পেয়ে থাকলে আমি দায়ী না। এখনে... ...বাকিটুকু পড়ুন

তাবলীগ এর ভয়ে ফরজ নামাজ পড়ে দৌড় দিয়েছেন কখনো?

লিখেছেন লেখার খাতা, ০৫ ই মে, ২০২৪ রাত ৯:২৬


আমাদের দেশের অনেক মসজিদে তাবলীগ এর ভাইরা দ্বীন ইসলামের দাওয়াত দিয়ে থাকেন। তাবলীগ এর সাদামাটাভাবে জীবনযাপন খারাপ কিছু মনে হয়না। জামাত শেষ হলে তাদের একজন দাঁড়িয়ে বলেন - °নামাজের... ...বাকিটুকু পড়ুন

ফেতনার সময় জামায়াত বদ্ধ ইসলামী আন্দোলন ফরজ নয়

লিখেছেন মহাজাগতিক চিন্তা, ০৫ ই মে, ২০২৪ রাত ১১:৫৮



সূরাঃ ৩ আলে-ইমরান, ১০৩ নং আয়াতের অনুবাদ-
১০৩। তোমরা একত্রে আল্লাহর রজ্জু দৃঢ়ভাবে ধর! আর বিচ্ছিন্ন হবে না। তোমাদের প্রতি আল্লাহর অনুগ্রহ স্মরণ কর।যখন তোমরা শত্রু ছিলে তখন তিনি... ...বাকিটুকু পড়ুন

=নীল আকাশের প্রান্ত ছুঁয়ে-৭ (আকাশ ভালোবেসে)=

লিখেছেন কাজী ফাতেমা ছবি, ০৬ ই মে, ২০২৪ দুপুর ২:১৯

০১।



=আকাশের মন খারাপ আজ, অথচ ফুলেরা হাসে=
আকাশের মন খারাপ, মেঘ কাজল চোখ তার,
কেঁদে দিলেই লেপ্টে যাবে চোখের কাজল,
আকাশের বুকে বিষাদের ছাউনি,
ধ্বস নামলেই ডুবে যাবে মাটি!
================================================
অনেক দিন পর আকাশের ছবি নিয়ে... ...বাকিটুকু পড়ুন

পানি জলে ধর্ম দ্বন্দ

লিখেছেন প্রামানিক, ০৬ ই মে, ২০২৪ বিকাল ৪:৫২


শহীদুল ইসলাম প্রামানিক

জল পানিতে দ্বন্দ লেগে
ভাগ হলোরে বঙ্গ দেশ
এপার ওপার দুই পারেতে
বাঙালিদের জীবন শেষ।

পানি বললে জাত থাকে না
ঈমান থাকে না জলে
এইটা নিয়েই দুই বাংলাতে
রেষারেষি চলে।

জল বললে কয় নাউযুবিল্লাহ
পানি বললে... ...বাকিটুকু পড়ুন

×