somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

পরাজয়ের গল্প

০৪ ঠা ডিসেম্বর, ২০১১ দুপুর ১:০৭
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

১৯৭১ সাল।অক্টোবর মাস।সব গ্রামের মত রাঙ্গুনিয়া গ্রামেও মিলিটারি এসেছে।এই সময়ে কেউ পারতপক্ষে ঘর থেকে বের হয় না।আজ তবুও গ্রামের মোটামুটি সবাই একটা তেঁতুল গাছের নিচে জড় হয়েছে।সবাইকেই উত্তেজিত মনে হচ্ছে।উত্তেজনার মূল কারণ ফর্সা চেহারার একজন যুবক।সে নাকি একজন মুক্তি।
হাসান নামের এই যুবকটিকে বেঁধে রাখা হয়েছে তেঁতুল গাছটির সাথে।তার চুল উসকোখুসকো।গত তিনদিন শেভ না করায় গালে খোঁচা খোঁচা দাড়ি।তার চারপাশে গ্রামের লোকজন ছড়িয়ে ছিটিয়ে।কেউ বসে,কেউ দাঁড়িয়ে।কেউ সামনে আসার সাহস পাচ্ছেনা।

শিশুদের চোখে কৌতূহল।বৃদ্ধরা কিছুটা শঙ্কিত।তাদের সামনে কিছুক্ষণ পর এক নির্মম ঘটনা ঘটবে।শেষ না দেখে তারা যেতেও পারছে না।খোদ মেজর নির্দেশ দিয়েছেন যেন গ্রামবাসীদের সবাই হাসান কে মেরে ফেলবার দৃশ্য দেখে।তিনি গ্রামবাসীকে তার নিষ্ঠুরতার একটা নমুনা দেখাতে চান।তার কানে এসেছে গ্রামবাসীরা নাকি নানাভাবে মুক্তিযোদ্ধাদের সাহায্য করে।এই ঘটনা দেখার পর কেউ সেই সুযোগ নিতেও দশবার ভাববে।

প্রচণ্ড ক্লান্ত বোধ করছে হাসান।তৃষ্ণাও পেয়েছে প্রচুর।গত তিনদিন তার উপর অমানুষিক নির্যাতন করা হয়েছে।তিনদিন আগে রাঙ্গুনিয়া নামের এই ছোট গ্রামটিতে তারা একটি অপারেশনে এসেছিল।অন্যগুলোর চেয়ে এটি তুলনামূলক ভাবে সোজা।তাই মাত্র পাঁচজন এসেছিল তারা।রাস্তার পাশের একটি ছোট্ট ব্রিজ উড়ানোর কথা ছিলো।আধা ঘণ্টার কাজ।মিলিটারিরা এই ব্রিজ দিয়েই পাশের গ্রামে যাতায়াত করে।তাই ছোট হলেও গুরুত্বপূর্ণ অপারেশন।কিন্তু কীভাবে যেন মিলিটারিরা টের পেয়ে গেল।এতে তাদের পজিশন বদলাতে হল।তা করতে গিয়েই পায়ে গুলি খেল হাসান।আমির ভাই কিছুতেই তাকে ছেড়ে যেতে চাচ্ছিলেন না।কিন্তু সে জোর করে তাকে পাঠালো।সে চায়নি তার জন্য পুরো টিম ধরা পড়ুক।

এর পরের তিনদিন কি অমানুষিক টর্চার।হাসান ভেবেছিল সে মরেই যাবে।কিন্তু তা হয়নি।অবশ্য তার মুখ দিয়ে কোন কথাও বের করা যায়নি।শেষ পর্যন্ত মেজর সিদ্ধান্ত নিলেন,একে সবার সামনে মারা হবে।এতে গ্রামবাসীরও কিছু শিক্ষা হবে।

হাসান মাথা নিচু করে ছিল।মাথাটা একটু উঠাতেই দেখতে পেল অনেকেই তার দিকে তাকিয়ে আছে।এদের চোখে তার জন্য স্নেহ এবং একই সাথে আফসোস।এক মহিলাকে দেখে তার নিজের মায়ের কথা মনে পড়ে গেল।‘কেমন আছ তুমি মা?একবার যদি তোমায় দেখতে পারতাম...’মনে মনে বললো হাসান।সে যখন যুদ্ধে আসতে চাইল মায়ের কি রাগ!কিছুতেই আসতে দিবে না।ঐদিন মাত্র উনিশ হল।কোন মা চায় এই বয়সের ছেলে যুদ্ধে যাক?বাবাও আসতে দিতে চাননি।সবাইকে আগ্রাহ্য করে সে এখন মৃত্যুর সামনে দাঁড়িয়ে।কি জীবন!

আরে,একটা মেয়েকে দেখা যাচ্ছে।জানালার ফাঁক দিয়ে হাসানের দিকে তাকিয়ে আছে।রেনুর মতই বয়স।রেনু হাসানদের পাশের বাসায় থাকতো।এখন কেমন আছে?যুদ্ধে আসার দিন ওই সবচেয়ে বেশি কেঁদেছিল।হাসান বলেছিল,’তোমার জন্য হলেও আমি আবার ফিরে আসব।’বোকা রেনুটাও তা বিশ্বাস করেছিল।আহা,চোখ বারবার ভিজে উঠে কেন?

হাসানের সামনে দাঁড়ানো দুইজন মিলিটারি আর একজন রাজাকার।তারা অপেক্ষা করছে মেজরের জন্য।মেজর দ্বিতীয় দিন হাসানকে ওর টিমের অবস্থান জিজ্ঞেস করেছিল।জবাবে হাসান মেজরের মুখে থুথু মেরেছিল।আর এতেই অত্যাচারের মাত্রা আরও বাড়লো।প্রথমদিনতো শুধু নখ তুলেছিল।পরের দিন দুটো আঙ্গুলই কেটে ফেলল।কী ব্যাথা...কী ব্যাথা...!

‘ও বাজান,পানি খাইবা?’এক বুড়ো প্রশ্ন করল।
হাসান ইশারায় হ্যা বলল।মুখ দিয়ে শব্দও বের হচ্ছেনা।গত রাতে প্রচন্ড মার দেওয়া হয়েছে তাকে।তিনটি দাঁত কোথায় উড়ে গেছে কে জানে!ঠোঁটটাও কাঁটা।ফুলে গেছে অনেকখানি।জিহ্বা দিয়ে রক্তের স্বাদ নিতে চাইল সে।নাহ্‌,রক্তও নেই।রক্ত বের হতে হতে হয়ত এখন বন্ধই হয়ে গিয়েছে!

পানি পেল না হাসান।আগ বাড়িয়ে কথা বলায় মিলিটারিদের একজন প্রচন্ড এক চড় বসাল বুড়োকে।বুড়োর চোখ দিয়ে পানি পড়তে লাগলো।

এই পানি লজ্জার।

ভয় পেয়ে কেউ আর কোনো কথা বললোনা।কি দরকার অমানুষদের ঘাটানোর...।

আরও দশ মিনিট গেল।অধৈর্য্য বোধ করছে হাসান।আর কত দেরি করবেন মেজর?পায়েও অসম্ভব ব্যাথা করছে।তার মনে পড়লো ক্লাস নাইনে একবার ফুটবল খেলতে গিয়ে পায়ে ব্যাথা পেয়েছিল সে।মায়ের সে কি বকা।কিছুতেই আর ফুটবল খেলতে দিবে না।আর এই পায়েই কালকে রাতে গুলি খাওয়া অংশটায় ছুরি দিয়ে কিছুক্ষণ খোঁচানো হয়েছে।উফ্‌...কি ব্যাথা।কাটা মুরগির মত কিছুক্ষণ চেঁচিয়ে গেছে সে।কারো চেহারার কোনো পরিবর্তন হয়নি।

ঐতো মেজর কে দেখা যাচ্ছে।এগিয়ে আসছেন হাসানের দিকে।

মেজর আলি শফিক।লাহোরে জন্ম।ক্যাডেট কলেজে পড়ার সময় জুনিওরদের জন্য নিত্য নতুন শাস্তি বের করতেন।নিষ্ঠুরতা দেখিয়ে একরকম মজা পান তিনি।এখন বাঙালি ছেলেগুলোকেও নতুন নতুন কায়দায় টর্চার করেন।

মেজর কে দেখে গ্রামের লোকজন ভয় পেয়ে একটু দূরে সরে গেল।মেজর মুচকি হেসে হাসানের দিকে তাকালেন।তাঁর মুখ শক্ত হয়ে গেল।কাল রাতে ছেলেটি তার মুখে থুথু দিয়েছে।কতবড় সাহস।এত সাহস কোথায় পায় বাঙালি ছেলেগুলি?

উল্টো হয়ে ঝুলে আছে হাসান।মাথার রগগুলো দপদপ করছে।মেজরের নির্দেশে তাকে উল্টে ঝুলানো হয়েছে।কিছুক্ষণ পর তাকে গুলি করা হবে।কি আশ্চর্য,একটুও ভয় লাগছে না তার।বরং কিছুটা অলস অলস লাগছে।মায়ের চেহারাটা খুব মনে আসছে।বাবার গম্ভীর মুখখানিও চোখে ভাসছে।অপুটার কথাও মনে পড়ছে।‘ইশ্‌শ্‌...একবার যদি চুমু খেতে পারতাম ভাইটিকে...’।রেনুকে খুব দেখতে ইচ্ছে করছে।‘একবার যদি জড়িয়ে ধরতে পারতাম।আর কখনও দেখা হবে না তোমার সাথে।অনেক ভালবাসি তোমায় রেনু,অনেক ভালবাসি’।আবারো চোখ ভিজে উঠলো তার।

হঠাৎ করে হাসানের মনে হল সে হেরে গেছে।হেরে গেছে পাকিস্তানি কুত্তাগুলোর বিপক্ষে।

‘না,আমি হারিনি।আমাকে জিততেই হবে।মার জন্য,বাবার জন্য,অপু,রেনুর জন্য।বাংলার সব মানুসের জন্য জিততে হবে’।

সে তাকালো নিচের দিকে।মেজরকে দেখা যাচ্ছে।তিনি নির্দেশ দিলেন গুলি করার।

‘হে আল্লাহ্‌, আমাকে একটু শক্তি দাও।একটু কথা বলার শক্তি দাও।একটা চিৎকার দেওয়ার শক্তি দাও...’।প্রার্থনা করল সে।

মিলিটারিটি বন্দুক উঁচিয়ে ধরেছে।হাসান উত্তেজনা বোধ করছে।সে বুঝতে পারছে আল্লাহ্‌ তার দোয়া কবুল করেছেন।তার মুখ হাসি হাসি হয়ে গেল।

গ্রামবাসী অবাক হয়ে তাকিয়ে আছে।ছেলেটার মুখ এত উজ্জল কেন?সে হাসছে কেন?

মেজর ভয়ার্ত চোখে তাকিয়ে আছেন।তিনি কুলকুল করে ঘামছেন।ছেলেটা এত আত্মবিশ্বাসী থাকছে কেমন করে?আশ্চর্য!আবারো তার মনে হল,এত সাহস কোথায় পায় বাঙালি ছেলেগুলি?

আরও কয়েক সেকেন্ড গেল।

নির্দেশ পেলেই এখন ট্রিগারে চাপ দেয়া হবে।

হাসানও প্রস্তুত।

মেজর কাঁপা কাঁপা গলায় নির্দেশ দিলেন,’শুট হিম’

তার আদেশ ছাপিয়ে গেল হাসানের চিৎকারে....সে রগ ফুলিয়ে পৃথিবীর সব শক্তি জড় করে বলল,

জয়য়য়য় বাংলা

হাসানকে গুলি করা হয়েছে।তার মৃতদেহ ঝুলছে উল্টো হয়ে।কপালের মাঝখানটায় একটা ফুঁটো।সেই ফুঁটো দিয়ে রক্ত গড়িয়ে পড়ছে।

রেনুর মত দেখতে মেয়েটার চোখে এখন জল।
স্নেহের দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকা মহিলার চোখেও জল।
বুড়োও কাঁদছে।তবে এই কান্না শ্রদ্ধার,এই কান্না অহংকারের।
শিশগুলির চোখে বিস্ময়।
মিলিটারিটির চোখেমুখে অপমান।
রাজাকারটির চোখে ভয়।
একমাত্র মেজরের চোখে লজ্জা।মাথা নিচু করে তিনি বুঝতে পারলেন,তিনি হেরে গেছেন।
হেরে গেছেন উনিশ বছরের উল্টো হয়ে ঝুলে থাকা একটি বাঙালি ছেলের কাছে।জীবনে প্রথমবারের মত তিনি পরাজয়ের স্বাদ পেলেন।
মেজর শফিকের চোখেমুখে এখনো পরাজয়ের ছায়া।সারা শরীর ঘামে ভরা।
সবাই কি টের পেয়ে গেছে,তিনি যে হেরে গেছেন?একটু একটু করে মাথা উঁচু করলেন তিনি।
নাহ্‌,কেউ টের পায়নি।
ভাগ্যিস কেউ টের পায়নি।
৭টি মন্তব্য ৫টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

শ্রমিক সংঘ অটুট থাকুক

লিখেছেন হীসান হক, ০১ লা মে, ২০২৪ সকাল ৯:৪৮

আপনারা যখন কাব্য চর্চায় ব্যস্ত
অধিক নিরস একটি বিষয় শান্তি ও যুদ্ধ নিয়ে
আমি তখন নিরেট অলস ব্যক্তি মেধাহীনতা নিয়ে
মে দিবসের কবিতা লিখি।

“শ্রমিকের জয় হোক, শ্রমিক ঐক্য অটুট থাকুক
দুনিয়ার মজদুর, এক হও,... ...বাকিটুকু পড়ুন

কিভাবে বুঝবেন ভুল নারীর পিছনে জীবন নষ্ট করছেন? - ফ্রি এটেনশন ও বেটা অরবিটাল এর আসল রহস্য

লিখেছেন সাজ্জাদ হোসেন বাংলাদেশ, ০১ লা মে, ২০২৪ দুপুর ১২:৩৪

ফ্রি এটেনশন না দেয়া এবং বেটা অরবিটার


(ভার্সিটির দ্বিতীয়-চতুর্থ বর্ষের ছেলেরা যেসব প্রবলেম নিয়ে টেক্সট দেয়, তার মধ্যে এই সমস্যা খুব বেশী থাকে। গত বছর থেকে এখন পর্যন্ত কমসে কম... ...বাকিটুকু পড়ুন

প্রতিদিন একটি করে গল্প তৈরি হয়-৩৭

লিখেছেন মোঃ মাইদুল সরকার, ০১ লা মে, ২০২৪ দুপুর ১২:৫১




ছবি-মেয়ে ও পাশের জন আমার ভাই এর ছোট ছেলে। আমার মেয়ে যেখাবে যাবে যা করবে ভাইপোরও তাই করতে হবে।


এখন সবখানে শুধু গাছ নিয়ে আলোচনা। ট্রেনিং আসছি... ...বাকিটুকু পড়ুন

একাত্তরের এই দিনে

লিখেছেন প্রামানিক, ০১ লা মে, ২০২৪ বিকাল ৫:৩৬


শহীদুল ইসলাম প্রামানিক

আজ মে মাসের এক তারিখ অর্থাৎ মে দিবস। ১৯৭১ সালের মে মাসের এই দিনটির কথা মনে পড়লে এখনো গা শিউরে উঠে। এই দিনে আমার গ্রামের... ...বাকিটুকু পড়ুন

হুজুররা প্রেমিক হলে বাংলাদেশ বদলে যাবে

লিখেছেন মিশু মিলন, ০১ লা মে, ২০২৪ রাত ৯:২০



তখন প্রথম বর্ষের ছাত্র। আমরা কয়েকজন বন্ধু মিলে আমাদের আরেক বন্ধুর জন্মদিনের উপহার কিনতে গেছি মৌচাক মার্কেটের পিছনে, আনারকলি মার্কেটের সামনের ক্রাফটের দোকানগুলোতে। একটা নারীর ভাস্কর্য দেখে আমার... ...বাকিটুকু পড়ুন

×