somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

আবোল তাবোল- ৭(বদনা বন্দনা! সুশীল সমাজের সভ্যগণের প্রবেশ কঠোরভাবে নিষিদ্ধ।)

০২ রা মে, ২০০৯ রাত ৩:০৩
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

অষ্ট প্রহরের যাপিত জীবনের গল্প!

তখন সবে উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষা দিয়েছি। প্রকৌশলী হবার মহান ব্রত নিয়ে চিটাগাঙ সানরাইজে (ইয়াসিন পাগলার পাঠশালা) কোচিং করি অর্থাৎ কীনা হাজিরা দিই। জিইসি মোড় থেকে প্রতিদিন রিকশা মেরে যাই। পথেই প্রবর্তক মোড়ে একটি মাজার আছে। মাজার বিষয়ক এলার্জির কারণে সেদিকে তেমন একটা খেয়াল দেয়া হয়নি। তার উপর মাজারের পাশেই প্রিমিয়ার ইউনিভার্সিটি! সে সময় আমার বয়স কম (১৮!)। মাজার দেখার চাইতে মেয়ে দেখা উত্তম - এই ফতোয়ার উপর আমল করার চেষ্টা করছি। এর মধ্যেই একদিন মাজারটা ও দৃষ্টি কেড়ে নিল। ঘটনা হলো, মাজার গেটের সামনেই একটা প্রাইভেট কার থেকে নামছিলেন দুই সুবেশী নারী (বুঝতেই পারছেন দৃষ্টি আকর্ষনের কারণ )। মা-মেয়ে বোঝাই যায়। এদিক ওদিক তাকিয়ে মাজার গেটের পাশের একটা দোকান হতে দু'টি বদনা কিনলেন (সেখানে সারি সারি দোকান-সবার একটাই বিক্রয়যোগ্য পণ্য 'বদনা') আর দু'জনে অনভ্যস্থ হাতে মাথার কাপড় ঠিক করতে করতে বদনা হাতে মাজারে প্রবেশ করলেন! সে এক দেখার মত দৃশ্য। তখনি খেয়াল করলাম মাজারের নাম, 'সৈয়দ বদনা শাহ' এর মাজার। ও খোদা! তোমার পেয়ারা বান্দার একী নাম? পরে জেনেছিলাম, ঐ মাজারে প্রবেশের সময় বদনা হাতে থাকা আবশ্যক। বদনা বিক্রেতাদের তো পোয়াবারো!

এ প্রসঙ্গে একটা তথ্য দিয়ে রাখি, আমাদের চিটাগাঙের মানুষের অত্যধিক মাজার প্রীতির কারণে এখানে মাজারের সংখ্যা ও বেশী (অর্থনীতির চাহিদা–যোগানের সেই শ্বাশত সম্পর্ক আর কী!); ফলে নাম সংকট একটি স্বাভাবিক ব্যাপার। এখানে আছে হাড্ডি শাহ, চাইল-ডাইল শাহ এর মত অনেক মাজার। অবশ্য, গাজীপুরের মৌচাকে একবার দেখেছিলাম "লোহা শাহের মাজার"।

যাই হোক, মূল প্রসঙ্গে আসি। হ্যাঁ বদনা! বাঙ্গালীর জীবনের অতীব প্রয়োজনীয় একটি তৈজস পত্র। যে কোন বিষয়ে লিখতে বা জানতে গেলে আমার প্রথম পছন্দ উইকিপিডিয়া। কিন্তু, এবার সেখানে বারে বারে ঢূঁ মেরে ও বদনা বিষয়ে কোন আর্টিকেল পেলাম না! ব্লগের উইকিপিডিয়ানেরা কৈ?

সেক্ষেত্রে, নিজের জীবনের অভিজ্ঞতাই ভরসা।

প্রথমেই বলে রাখি, বদনার আরো একটি প্রচলিত প্রতিশব্দ আছে আর তা হলো "লোটা" বা "লোডা"! এটি দেখতে অনেকটা চা বানানোর কেতলীর মত, যদিও কেতলীর কাজের সাথে এর কাজের কোন তুলনাই চলে না। তবে, শ্লীলতা ও ভদ্রতার স্বার্থে এর কাজ নিয়ে বিস্তারিত আলোচনায় গেলাম না; চক্ষুষ্মান ব্যক্তি মাত্রই বুঝে নেবেন। শুধু এটুকু বলতে পারি গ্রামের পথে কাউকে লোটা হাতে ছুটে যেতে দেখলে যত জরুরী প্রয়োজনই থাক, সে সময় তাকে পিছু না ডাকার অলিখিত নিয়ম আছে। কারন, সে সময় সে এমন এক ডাকে সাড়া দিতে ছুটে চলেছে যাকে অগ্রাহ্য করার সাধ্য স্বয়ং আমেরিকার মহাশক্তিধর প্রেসিডেন্টের ও নেই।

বহু বহু বছর পুর্বে এই দেশে কালিদাস নামের একজন কবি বাস করতেন। "মেঘদূত" নামের অমর কাব্য লিখে তিনি অল্প-স্বল্প (!) নাম কামিয়েছিলেন। এ রকম প্রতিভাধর কবিকেও তাঁর স্ত্রী ঘর হতে বের করে দিয়েছিলেন অকর্মণ্যতার অজুহাতে (ঠিকই তো, কাব্য করে কি আর পেটের আগুন নেভে, সে সময় তো আর বিএনপি- আওয়ামী লীগ ছিল না যে তিনি কোন এক দলে যোগ দেবেন)। গৃহত্যাগ কালে কবি কিছুই নিলেন না নিজের লোটা আর কম্বলটা ছাড়া! (কাগজ-কলম নেন নি; পরবর্তী সময়ে কাব্যচর্চা করেছেন কিভাবে, আল্লাহ মালুম! তখন তো এ সব সহজলভ্য ও ছিলো না)। যাই হোক, সেই থেকেই সম্ভবতঃ "লোটা-কম্বল" শব্দটি তল্পিতল্পা শব্দের সমার্থক হয়ে উঠেছে! (সঞ্জিব চট্টোপাধ্যায় এর "লোটা-কম্বল" না পড়ে থাকলে দ্রুত পড়ে ফেলুন, নয়তো জীবনে জীবনে অনেক কিছুই মিস করলেন।)

ফিরে আসি, লোটার কথায়। প্রাচীন কালে স্বাস্থ্য কর্মীরা ছিল না। স্বাস্থ্যসম্মত স্যানেটারী পায়খানা ও আবিষ্কৃত হয় নি। তাই, আগান-বাগান আর ঝোপঝাড়ই ছিলো ভরসা। এ মহতী কার্য্যসম্পাদনে বাঙ্গালীর বিশ্বস্থ বন্ধু ও সাথী সেই লোটাই। সময়ের পালা বদলে স্বাস্থ্য সচেতনতা আসলো। আসলো কাঁচা পায়খানা (দেশীয় ভাষায় "টাট্টিখানা")। সেইপথ ধরে স্যানেটারী পায়খানা এবং সবশেষে হাই কমোড (ইংলিশ টয়লেট নামে সুখ্যাতি আছে এর)। ভারত ভেঙে পাকিস্তান হল, তারপর পাকিস্তান ভেঙে বাংলাদেশ। কত রাজা গেলো, কত রাজা এলো। সবই বদলে গেলো। বদলালো না লোটার অবস্থান। আপনার টয়লেটের শোভাবর্ধনে আজো সে অপরিহার্য। দেশ ছেড়ে বিদেশে যান, বসতি গড়েন। হয়তো, বাঙ্গালীর অতি প্রিয় ভাত ছেড়ে দিতে পারেন। লুঙ্গীকে ও খ্যাৎ বলে অবলীলায় ত্যাগ করতে পারেন। কিন্তু, বদনা? পারবেন? পানির দেশের মানুষ আমরা; আমাদের পানির প্রয়োজন কি টিস্যু দিয়ে মিটবে? অতএব, বদনার আবেদন - সে চিরন্তন।

এখানে, আরেকটি কথা বলতেই হয়। বদনা যে শুধু ত্যাগের কাজে ব্যবহৃত হয়, তা কিন্তু নয়।

এ প্রসঙ্গে একটা ঘটনা বলি। প্রকৃতির ডাকে সদ্য সাড়া দিয়ে বাড়ির পথ ধরেছেন জনৈক ব্যক্তি। পথে বহুদিনের পুরানো শত্রুর দেখা পেয়ে তাকে লোটা হাতেই তাড়া! এতে তাড়া খাওয়া ব্যক্তির শারিরীক কোন ক্ষয়-ক্ষতি না হলেও অপমানের যে চুড়ান্ত হয়েছিলো তা তো আর বলার অপেক্ষা রাখে না! সুতরাং, সময়ে সময়ে মোক্ষম অস্ত্র হিসেবেও যে একে ব্যবহার করা যায়, তার প্রমান পেলেন।

এতো গেলো লোটা হাতে নিয়ে তাড়ার গল্প। এবার, লোটা কেড়ে নিয়ে বিপদে ফেলার গল্প। তখন পুরোদমে স্কাউটিং করি। দড়ি-টড়ি দিয়ে গেরো বানাই আর লর্ড ব্যাডেন পাওয়েলের মন্ত্রে পরোপকারের দীক্ষা নিই। সেবার গিয়েছিলাম বার্ষিক সমাবেশে (স্কাঊটের ভাষায় ক্যাম্পিং)। অন্য পেট্রোল (আট জনের একটা দলকে পেট্রোল বলে) যাতে শান্তিতে কাজ-কাম করতে পারে সে জন্য আমি সহ আমাদের ছয় রেজিষ্টার্ড বদ ছেলেপেলেকে এক পেট্রোলে ঢুকিয়ে দেয়া হলো। ইউনিট লীডারেরা মোটামুটি অতিষ্ঠ হয়ে উঠেছিলেন সে তিনদিনে। যাইহোক, ভালো-মন্দে মিলিয়ে শেষ দিনের ক্যাম্পফায়ার ও শেষ। সেই সাথে, খাওয়া-দাওয়াও মাশাআল্লাহ সেই রকম হলো। তারপর ঘুমাবার আগে সবাই ব্যস্ত হয়ে পড়লো আড্ডা, ব্যাগ গোছানো ও অন্যান্য কাজে। তখনি, শুরু হল আমাদের মিশন। এখানে বলে রাখি, ক্যাম্পিং এর নিয়ম হলো যে কয়দিন ক্যাম্পিং চলে, সে কয়দিনে বাঁশ আর দড়ি দিয়ে স্কাউটদের অসংখ্য গেজেট (শেলফ থেকে শুরু করে চেয়ার -টেবিল পর্যন্ত) তৈরী করতে হয়। এদের ভীড়ে লোটা বাবাজীর জন্যও একটা গেজেট বরাদ্দ হয়। নিয়মানুসারে, আবার সকল গেজেট তাঁবুর বাইরে সাজিয়ে রাখতে হয়। আমরা আট জন চার গ্রুপে ভাগ হয়ে একে একে হানা দিলাম সব তাঁবুতে। সিনিয়ার-জুনিয়ার বাছবিচার না করে সবখান থেকেই সবার অলক্ষ্যে নিয়ে এলাম শুধু মাত্র লোটাগুলো। মিশন কামিয়াব; অতএব, ভালো ছেলের মত তাঁবুর বাতি নিভিয়ে ঘুম। তারপর যা হলো তা শুধুই ইতিহাস! ডিসেম্বরের কনকনে শীতের রাত। রাত যত গভীর হয় ততই বিভিন্ন তাঁবুতে এক একজনের ডাক আসে আর চিরসাথী লোটার সন্ধানে তার দিকবিদিক ছুটে যাবার আওয়াজে সে রাতে ভালো করে ঘুমাতে পারি নি এই আর কী!

সবশেষে, বলতে চাই, লোটা আমাদের বাঙালী জীবনের অপরিহার্য অনুসঙ্গ; আমাদের জাতীয় তৈজসপত্র। একে নোংরা জ্ঞানে তাচ্ছিল্য করার পরিণতি কী ভয়াবহ তা তো জানলেনই। সাম্যবাদের এক প্রকৃষ্ট উদাহরণ এই বস্তু। ধনী-গরীব, আবাল-বৃদ্ধ-বণিতা নির্বিশেষে সকলকেই সে একই মাত্রায় সমাদর করে। প্রতিদিন সকাল-বিকাল এর দরবারে নিয়ম করে হাজিরা দিতেই হয় (কোষ্ঠকাঠিন্যের রোগী হলে এ মতবাদ প্রযোজ্য নয়)। আর এখনকার গরমে যাদের "খাচ্ছে স্যালাইন, যাচ্ছে স্যালাইন" পরিস্থিতি তাদের জন্য এর কোন বিকল্প নেই।

অতএব, সমস্বরে বলি,
জয়তু বদনা!
তোমায় ছাড়া বাঁচিনা!
কী খালেদা, কী হাসিনা,
বদনা ছাড়া চলে না!
জয়তু বদনা!

ব্যক্তিগত অনুপ্রেরনাঃ

ভেবে ভেবে বলি
ব্লগীয় অনুপ্রেরনাঃ
বাঙ্গালী সংস্কৃতি ও বদনা
বদনা বন্দনা


পূর্বের সমগোত্রীয় পোষ্টঃ
আবোল তাবোল-৬ (জীবনচক্র)
আবোল তাবোল-৫ (বৌদি)
আবোল তাবোল-৪ (লুঙ্গী)
আবোল তাবোল-৩ (নাস্তিকতা)
আবোল তাবোল-২ (নববর্ষ)
আবোল তাবোল-১ (নোয়াখাইল্লা)


১৬টি মন্তব্য ১৫টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

মা

লিখেছেন মায়াস্পর্শ, ২৫ শে এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ১২:৩৩


মায়াবী রাতের চাঁদনী আলো
কিছুই যে আর লাগে না ভালো,
হারিয়ে গেছে মনের আলো
আধার ঘেরা এই মনটা কালো,
মা যেদিন তুই চলে গেলি , আমায় রেখে ওই অন্য পারে।

অন্য... ...বাকিটুকু পড়ুন

কপি করা পোস্ট নিজের নামে চালিয়েও অস্বীকার করলো ব্লগার গেছে দাদা।

লিখেছেন প্রকৌশলী মোঃ সাদ্দাম হোসেন, ২৫ শে এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ২:১৮



একটা পোস্ট সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে বেশ আগে থেকেই ঘুরে বেড়াচ্ছে। পোস্টটিতে মদ্য পান নিয়ে কবি মির্জা গালিব, কবি আল্লামা ইকবাল, কবি আহমদ ফারাজ, কবি ওয়াসি এবং কবি... ...বাকিটুকু পড়ুন

শাহ সাহেবের ডায়রি ।। গানডুদের গল্প

লিখেছেন শাহ আজিজ, ২৫ শে এপ্রিল, ২০২৪ বিকাল ৪:২৮




তীব্র দাবদাহের কারণে দুবছর আগে আকাশে ড্রোন পাঠিয়ে চীন কৃত্রিম বৃষ্টি নামিয়েছিলো। চীনের খরা কবলিত শিচুয়ান প্রদেশে এই বৃষ্টিপাত চলেছিলো টানা ৪ ঘন্টাব্যাপী। চীনে কৃত্রিম বৃষ্টি নামানোর প্রক্রিয়া সেবারই প্রথম... ...বাকিটুকু পড়ুন

ভারতকে জানতে হবে কোথায় তার থামতে হবে

লিখেছেন আরেফিন৩৩৬, ২৫ শে এপ্রিল, ২০২৪ সন্ধ্যা ৬:৪৫


ইন্ডিয়াকে স্বপ্ন দেখানো ব্যাক্তিটি একজন মুসলমান এবং উদার চিন্তার ব্যাক্তি তিনি হলেন এপিজে আবুল কালাম। সেই স্বপ্নের উপর ভর করে দেশটি এত বেপরোয়া হবে কেউ চিন্তা করেনি। উনি দেখিয়েছেন ভারত... ...বাকিটুকু পড়ুন

জামায়াত শিবির রাজাকারদের ফাসির প্রতিশোধ নিতে সামু ব্লগকে ব্লগার ও পাঠক শূন্য করার ষড়যন্ত্র করতে পারে।

লিখেছেন মোহাম্মদ গোফরান, ২৫ শে এপ্রিল, ২০২৪ রাত ১১:৪৯


সামু ব্লগের সাথে রাজাকার এর সম্পর্ক বেজি আর সাপের মধ্যে। সামু ব্লগে রাজাকার জামায়াত শিবির নিষিদ্ধ। তাদের ছাগু নামকরণ করা হয় এই ব্লগ থেকেই। শুধু তাই নয় জারজ বেজন্মা... ...বাকিটুকু পড়ুন

×