somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

জ্ঞান-বিজ্ঞানের রাজ্যে মুসলমানঃ উত্থান ও পতন পর্ব-১২

১৯ শে এপ্রিল, ২০১০ রাত ৯:০৮
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

বিভিন্ন সম্প্রদায়গত দর্শনের সারসংক্ষেপ
অন্যায় বিদ্রোহের ফলশ্রুতিতে উসমানের(রা) হত্যা, আলীর(রা) উত্তাল শাসনামল, মুয়াবিয়ার(রা) ক্ষমতাগ্রহনের মাধ্যমে উমাইয়া শাসনের সূচনা, বংশীয় ধারার বাইরে এসে উমর ইবন আবদুল আজীজের সংক্ষিপ্ত শাসনের সুদুরপ্রসারী প্রভাব এবং এসবের মিথস্ক্রিয়ায় শীআ ও খারেজীদের উদ্ভব এবং হাদিস ও ইসলামী ফিকহ্‌শাস্ত্রের বিকাশের প্রেক্ষাপট পর্যন্ত আলোচনা করা হয়েছিল আগের পর্বে। আজ সেখান থেকে মু’তাজিলাদের উদ্ভব পর্যন্ত আলোচনা রাখার চেষ্টা থাকবে। সেইসাথে, বিভিন্ন সম্প্রদায়ের দর্শনের সংক্ষিপ্তাসারও তুলে ধরা হবে।

এতগুলো ঘটনার মাঝে কিন্তু একটি বিশাল ব্যাপার ঘটে গিয়েছে। পর পর দুই উমাইয়া খলিফা পিতা আবদুল মালিক ইবন মারওয়ান(عبد الملك بن مروان‎; ৬৮৫-৭০৫) এবং পুত্র আল-ওয়ালিদ ইবন আবদুল মালিকের(الوليد بن عبد الملك‎; ৭০৫-৭১৫) শাসনামলে তাঁদেরই নিযুক্ত ইরাকের শাসনকর্তা হাজ্জাজ ইবন ইউসুফের(الحجاج بن يوسف‎; ৬৬১-৭১৪) প্রেরীত সেনাবাহিনীর হাতে প্রথমে কুফা এবং আরব উপদ্বীপের বিদ্রোহীদের নির্মমভাবে দমন করা হয় এবং একইসঙ্গে উত্তর আফ্রিকা, স্পেন, এশিয়া মাইনর এবং ভারতবর্ষের সিন্ধু বিজিত হয় এবং এ বিশাল বিজয়সমূহ সংঘটিত হয় মোটামুটি খৃষ্টীয় অষ্টম শতকের প্রথম দশকেই(৭০৯-৭১২)! উমরের(রা) খেলাফতের পর মুসলমানদের এত বড় বিজয়ের এই একটাই উদাহরন। এ বিজয়ের যত রকমের কারন এবং ফলাফলই থাকুক না কেন, সবচেয়ে বড় ফল হচ্ছে, প্রাচীন পৃথিবীর জ্ঞান-বিজ্ঞানের সিংহদ্বারের তড়িৎ উন্মোচন, যা মুসলমানদের বিজ্ঞানে উন্নয়নের পথে ধাবিত করে।

দামেস্কের উমাইয়া মস্‌জিদঃ উমাইয়া শাসনের কেন্দ্রভূমি

যাই হোক। আমরা ফিরে আসি দার্শনিক সম্প্রদায়ের আলোচনায়। শীআ-খারেজী-মুর্জিয়া এবং মু’তাজিলা সম্প্রদায়ের আবির্ভাব এবং বিকাশের মাঝামাঝি সময়ে আরো দুইটি ক্ষনস্থায়ী দর্শনের জন্ম হয়। মানুষের স্বাধীন ইচ্ছাশক্তি এবং অদৃষ্টবাদের ভূমিকা শীর্ষক বিতর্ক হতে এদের জন্ম। এদের প্রথমটি হচ্ছে 'জাবারিয়া'(Jabarites) সম্প্রদায় যাঁদের মতে, মানুষের স্বাধীন কোন ইচ্ছেই নেই, মন ও কর্মের স্বাধীনতা নেই। সে যন্ত্রের মত কাজ করে চলে। ফলে, স্বীয় কৃতকর্মের জন্য সে দায়ী নয়। স্বাভাবিকভাবেই এঁরা মুর্জিয়া প্রভাবে প্রভাবিত এবং জাহম্‌ ইবন সাফ্‌ওয়ান(جهم بن فوان; ?-৭৪৫) এ দর্শনের প্রবক্তা। ‘জাবারিয়া’ শব্দটি আরবী ‘জবর্‌’(جبر) শব্দ থেকে আগত, যার অর্থ ‘শক্তিধর বা ক্ষমতাবান’। সৃষ্টিকর্তার সার্বভৌম ক্ষমতার উপরেই এ সম্প্রদায়ের চিন্তা কেন্দ্রীভূত বলে এই নামকরন করা হয়েছে। অন্যদিকে, ‘ক্বাদ্‌রিয়া’(قدري) শব্দটির উৎপত্তি হচ্ছে ‘ক্বাদর’(قدر) হতে যার অর্থ 'শক্তি'। ক্বাদরিয়াই হচ্ছে, সেই দ্বিতীয় সম্প্রদায় যাঁরা জাবারিয়াদের বিরুদ্ধে গিয়ে মানুষের ইচ্ছা ও কর্মের স্বাধীনতা স্বীকার করেন এবং সকল অপকর্মের দায়-দায়িত্ব সৃষ্টিকর্তার উপর চাপিয়ে দেন না। দামেস্কের মা’বাদ আল-জুহানী(معبد الجهني; ?-৬৯৯) এবং বসরার হাসান আল-বস্‌রী(الحسن البصري; ৬৪২-৭৩৭) এ দর্শনের প্রবক্তা। ওয়াসিল ইবন আ’তা হাসান আল বস্‌রীরই ছাত্র এবং মু’তাজিলা সম্প্রদায় তাঁদের মুক্তচিন্তার জন্য ক্বাদ্‌রিয়াদের কাছে সরাসরি ঋনী। এখানে, আরেকটা কথা বলে রাখা ভাল। বর্তমানে মুসলমানদের মধ্যে যে ক্বাদেরিয়া(القادريه) সম্প্রদায়ের দেখা পাওয়া যায়, সেটি আর ক্বাদ্‌রিয়া সম্প্রদায় একই নয়। ক্বাদেরিয়া মূলতঃ একটি সূফী ভাবধারার সম্প্রদায়, যার প্রবক্তা দ্বাদশ শতকের সূফীবাদী আবদুল ক্বাদির জিলানী(عبد القادر گیلانی; ১০৭৮-১১৬৬)। আমাদের দেশে তিনি 'বড়পীর' নামেই পরিচিত।

কুফার কেন্দ্রীয় মসজিদ- ইসলামের অনেক মতাদর্শের পীঠস্থান- ১৯১৫ সালে তোলা ছবি

এখানে আরেকটি লক্ষ্যনীয় বিষয় হচ্ছে, উমাইয়া শাসনামলে রাজধানী সিরিয়ার দামেস্ক(Damascus; دِمَشقُ) হলেও জ্ঞানী-গুনীদের আনাগোনা ছিল মূলতঃ ইরাকের কুফা(Kufa; الكوفة) নগরীকে ঘিরেই। সে সময়ে ইসলামে যতগুলো দার্শনিক সম্প্রদায়ের উদ্ভব ঘটেছে তাদের প্রায় সবগুলো এ শহর থেকেই যাত্রা শুরু করেছে অথবা বিকশিত হয়েছে। মক্কা ও মদীনা ছাড়াও ফিকহ্‌শাস্ত্রের বড় বড় শিক্ষকেরা এখানেই(প্রধানতঃ মসজিদকেন্দ্রিক) তাঁদের শিক্ষায়তন(Schools) খুলে বসেছিলেন, যেখানে ছাত্র-শিক্ষকের মুক্ত আলোচনার মাধ্যমে কুরআন, হাদিস, ফিকহ্‌ এবং দর্শনের শিক্ষা প্রচার করা হোত। ইমাম হাসান আল বস্‌রী ছিলেন এমনই একজন। অবশ্য, তাঁর শিক্ষায়তনটি ছিল ইরাকেরই বস্‌রায়(Basra; البصرة)। একদিন, ধর্মতত্ত্ব সংক্রান্ত কোন একটি প্রশ্নে তাঁর সাথে শিষ্য ওয়াসিল ইবন আ’তার(واصل بن عطاء; ৭০০-৭৪৮) মতদ্বৈততা সৃষ্টি হয় এবং শিষ্য নিজের মতাবলম্বী কয়েকজনকে নিয়ে আলাদা হয়ে যান। তাঁর ব্যাপারে অন্যরা প্রশ্ন করলে শিক্ষক বলে বসেন, “ইতিযালা আন্না”(সে আমাদের দল থেকে পৃথক হয়ে গিয়েছে)। সেই থেকে ওয়াসিল ইবন আ’তা এবং তাঁর অনুসারীদের ‘আহ্‌লুল ইতিযাল’ বা মুতাজিলা(المعتزلة) বলে সম্বোধন করা হয়। তিনি এবং তাঁর শ্যালক আমর ইবন উবায়েদ(عمرو بن عبيد بن باب‎; ?-৭৬১) হচ্ছেন এ সম্প্রদায়ের প্রবক্তা। তবে, প্রভাব বিস্তার করার মত অবস্থায় আসার জন্য তাঁদের আব্বাসীয় শাসনমাল পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হয়। বিশেষ করে, আল-মা'মুনের(ابوجعفر عبدالله المأمون; ৮১৩-৮৩৩) সময়কালে রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতায় এবং অমিত প্রতিভাধর কিছু দার্শনিকের অবদানে মুক্তবুদ্ধি এবং মুক্তচিন্তার এই দর্শন সম্রাজ্যের আনাচে-কানাচে বিস্তৃত হয়ে পড়ে। পরবর্তীতে, আল-মুতাওয়াক্কিলের(المتوكل على الله جعفر بن المعتصم; ৮৪৭-৮৬১) সময়ে এই পৃষ্ঠপোষকতা সরিয়ে নেয়া হলে তাঁরা হারিয়ে যেতে বাধ্য হন। মু’তাজিলা দর্শনের সারবস্তু নিয়ে আলোচনা আসছে পরে।

ইসলামে দার্শনিক সম্প্রদায়ের মাঝে আরেকটি উল্লেখযোগ্য সম্প্রদায় হচ্ছে সুফী(صُوفِيّ) সম্প্রদায়। জ্ঞান-বিজ্ঞানে মুসলমানরা যখন উন্নতির চরম শিখরে তখন এঁদের খুব বেশী প্রভাব দেখা যায় না। দ্বাদশ শতকে মুসলমানদের পতনের পূর্ব মূহুর্তে এঁদের প্রভাব বৃদ্ধি পেতে থাকে। ফলে, বিজ্ঞানে মুসলমানদেরর উত্থান-পতনের সাথে এঁদের আলোচনা না করলেও চলত, যদি না ইমাম গায্‌যালী(যাঁকে অনেকেই বিজ্ঞানে মুসলমানদের পতনের জন্য দায়ী করেন) নিজে সূফী ভাবধারায় প্রভাবিত না হতেন! এছাড়া, মু’তাজিলাদের বিনাশে আরেকটি দার্শনিক সম্প্রদায় বেশ উল্লেখযোগ্য অবদান রাখে যেটি আশ’আরী(الأشاعرة) নামে পরিচিত। তাদের দর্শন ও আলোচনার দাবী রাখে।

এবারে, আমরা এই সব দার্শনিক সম্প্রদায়ের দর্শনের সারসংক্ষেপ নিয়ে আলোচনা করব। প্রথমেই খারেজী দর্শন। আরবী ‘খাওয়ারিজ’(خوارج) শব্দ হতে ‘খারেজী’ শব্দের উৎপত্তি, যার অর্থ হচ্ছে ‘যারা দলচ্যুত হয়ে গিয়েছে’। সিফফিনের যুদ্ধে আলী(রা) এবং মুয়াবিয়ার(রা) দ্বন্দ্ব নিরসনে সালিস আহবানের সময়েই এরা আলাদা হয়ে যায়। এরা আবুবকর(রা), উমর(রা) ছাড়া অন্য দুই খলিফাকে সত্যচ্যুত মনে করত। আলী(রা) এবং মুয়াবিয়া(রা)সহ আরো অনেক বড় বড় সাহাবীকে এরা প্রকাশ্যে কাফের সম্বোধন করত। অত্যন্ত কট্টর মনোভাব সম্পন্ন এই সম্প্রদায় কোন মুসলমান কর্তৃক বড় মাপের পাপ(কবীরা গুনাহ) সম্পাদিত হলে তাকেও কাফের বলত। এরা মুসলমানদের খেলাফতের ব্যাপারে কুরায়শ বংশের অগ্রাধিকার স্বীকার করত না। কুরআনকে ইসলামের মৌলিক উৎস হিসেবে মেনে নিলেও হাদীস এবং ইজ্‌মার ক্ষেত্রে এরা ভিন্নমত পোষন করত। খারেজীদের মাঝেও আবার কিছু উপ-সম্প্রদায়ের অস্তিত্ব ছিল। এদের মধ্যে ‘আয্‌রেকা’(al-Azaariqah) সবচাইতে বড় এবং সবচেয়ে কট্টর পন্থী। ‘আন-নাজদাত’(an-Najdaat) ছিল মোটামুটি মধ্যপন্থী। আর ‘ই’বাদী’(الاباضية) হচ্ছে সবচাইতে নরমপন্থী। আলী(রা) সাথে সংঘর্ষে প্রাথমিক যুগেই এদের বিপুল ক্ষয়-ক্ষতি হয়। পরবর্তীতে উমাইয়া এবং আব্বাসীয় শাসনামলে এরা বারবার বিদ্রোহের পতাকা তুলেছে এবং প্রতিবারেই নিষ্ঠুরভাবে দমিত হয়েছে। ফলে, বর্তমানে এই সম্প্রদায়ের দেখা খুব একটা পাওয়া যায় না। তবে, ওমান, জাঞ্জিবার এবং উত্তর আফ্রিকায় ই'বাদী সম্প্রদায় এখনো অস্তিত্বশীল, যারা অন্য মুসলমানদের কাছ হতে নিজেদের সযত্নে গুটিয়ে রাখায় সকলের কাছে খুব একটা পরিচিত নয়।

কারবালায় ইমাম হুসাইন(রা) মস্‌জিদঃ শী'আ সম্প্রদায়ের একটি বৃহৎ তীর্থস্থান (উপরে ১৯৩২ সালে তোলা ছবি, নিচে বর্তমানের ছবি)


এরপরেই আসি শী'আ দর্শন প্রসঙ্গে। আগেই বলা হয়েছে যে, প্রাথমিকভাবে শীআ’নে আলী(شيعة علي; আলীর অনুসারী) নামে পরিচিত এই দলটিকে পরবর্তী সময় হতে পরিভাষাগতভাবে শীআ’(شيعة) বলা হয়। এদের উদ্ভব নিয়েও আগেই কথা বলা হয়েছে। এরপরে, উমাইয়া এবং আব্বাসীয় শাসনামলে আলীর(রা) বংশধর এবং সমর্থকদের উপর নিরবিচ্ছিন্ন অত্যাচার এই মতবাদকে সাধারণ মানুষের কাছে জনপ্রিয় করে তোলে। পরবর্তীতে খৃষ্টীয় দশম শতকের শুরু হতে দ্বাদশ শতকের শেষভাগ পর্যন্ত মিসরের ফাতেমীয় শাসনামল(الفاطميون; ৯০৯-১১৭১) এবং ষোড়শ’ শতকের প্রারম্ভ হতে অষ্টাদশ শতকের প্রথম ভাগ পর্যন্ত ইরানের সাফাভীদ শাসনামলে(صفویان; ১৫০১-১৭৩৬) শী’আরা রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতা লাভ করে। ফলশ্রুতিতে, মুসলমানদের মূল ধারার বাইরে এ ধারাটিই আজপর্যন্ত সবচাইতে শক্তিশালী এবং প্রভাবশালী ভূমিকা রেখে চলেছে। এরা সাধারণ্যে প্রচলিত খেলাফতের ধারনার বিপরীতে ’ইমামত’(إمامة) নামে একটি আলাদা পরিভাষা ব্যবহারে অভ্যস্ত। আলীকে(রা) এরা মুহাম্মাদ(স) কর্তৃক নিযুক্ত ইমাম এবং এই ইমামত আলী(রা) এবং তাঁর অধস্তন পুরুষদের অধিকার বলে মনে করে। প্রত্যেক ইমাম তাঁর পূর্ববর্তী ইমাম কর্তৃক নিযুক্ত হবেন। ইমাম(নেতা) নির্বাচনে এরা জনগনের ভূমিকা স্বীকার করে না এবং তাঁকে সকল প্রকার ভুল-ত্রুটির উর্ধ্বে স্থান দেয়। এইসব সর্বসম্মত মতের বাইরে কিছু কিছু ব্যাপারে শী’আদের মাঝে ব্যাপক মত পার্থক্য দেখা দেয়। সবচাইতে চরমপন্থী শী’আরা আলী(রা) ছাড়া অন্য সকল খলিফা এবং তাদের সমর্থকদের ছিনতাইকারী, এমনকি কাফের বলে থাকে। মধ্যপন্থীরা আলীকে(রা) সকল মানুষের(নবী ব্যতীত) মাঝে সর্বোত্তম ব্যক্তি বলে মনে করে এবং আগের তিন খলিফার শাসন তিনি মেনে নিয়েছিলেন বলে, তাঁদের প্রতি এতটা কঠোর না হয়ে কেবল অপছন্দ করে। এই দুই দলই 'দ্বাদশ ইমামপন্থী'(The Twelvers) যারা চতুর্থ খলিফা আলী ইবন আবু তালিব(রা) হতে শুরু করে মুহাম্মাদ আল-মাহদী(الإمام محمد بن الحسن المهدى; ৮৬৯-?) পর্যন্ত বারজন ইমামের উপর আস্থাশীল। আর সবচেয়ে নরমপন্থী ‘জায়েদী’(الزيدية) সম্প্রদায়ও দ্বাদশ ইমামে বিশ্বাসী শুধুমাত্র পঞ্চম ইমামের ক্ষেত্রে তারা মুহাম্মাদ ইবন আলীর(محمد ابن علي الباقر; ৬৭৬-৭৪৩) বদলে তাঁরই ভ্রাতা জায়েদ ইবন আলীকে(زيد بن علي; ৬৯৫-৭৪০) মেনে চলে। এছাড়া ’মু’তা’ বিবাহের(نكاح المتعة‎; Marriage for Pleasure) ক্ষেত্রেও তারা অন্যদের সাথে ভিন্ন মত পোষন করে। শী’আদের আরেকটি শক্তিশালী উপশাখা হচ্ছে ইস্‌মাঈলী(الإسماعيليون‎)। প্রথম ছয় জন ইমামের ব্যাপারে এরা অন্যদের সাথে একমত। কেবল সপ্তম ইমামের ক্ষেত্রে মুসা ইবন জাফর আল-কাজিম(موسى بن جعفر الكاظم‎; ৭৪৫-৭৯৯) এর বদলে তাঁরই বড় ভাই ইস্‌মাঈল ইবন জাফর(إسماعيل بن جعفر; ৭২১-৭৫৫)কে স্বীকার করে। এ কারনে, এরা 'সপ্তমপন্থী'(Seveners) নামেও পরিচিত। ইস্‌মাঈলীরা ফাতেমীয় শাসকদের পৃষ্ঠপোষকতা পেয়েছিল। অন্যদিকে, দ্বাদশপন্থীরা পেয়েছিল সাফাভীদদের। এখানে, একটি মজার ব্যাপার বেশ লক্ষ্যনীয়। কুফাকেন্দ্রিক রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে শী’আ সম্প্রদায়ের উদ্ভব, মিসরীয় খলিফাদের পৃষ্ঠপোষকতা লাভ সত্ত্বেও এ সম্প্রদায় শেষপর্যন্ত শক্তিশালী আস্তানা গাড়ে ইরানে, যা আজো বিদ্যমান। অথচ, ইরানে তাদের পৃষ্ঠপোষক সাফাভীদেরা বিজ্ঞান ও শিল্পে অনেক উন্নত হলেও আঞ্চলিক শাসকের বেশী কিছু তারা কখনোই হতে পারে নি। এই শক্তিশালী ভীতের পেছনে একটি ভিন্নধর্মী ঐতিহাসিক এবং মনস্তাত্ত্বিক কারন রয়েছে, যা এ লেখার সাথে সম্পর্কিত নয় বলে আলোচনা করা হলো না। পরিশিষ্টাকারে পরে আলোচনা করা যেতে পারে।

ইরানে সাফাভীদ শাসনামলের রাজধানী ইস্‌ফাহানের অনিন্দ্যসুন্দর শাহ্‌ স্কোয়ার

শী’আ-খারেজী মারামারির বাইরে থেকে জীবনধারনের সবচেয়ে সহজ পন্থা গ্রহন করেছিলেন ’মুর্জিয়া’(المرجئة) সম্প্রদায়। আলী(রা) এবং মুয়াবিয়ার(রা) দ্বন্দ্বে কোন পক্ষে না গিয়ে নিরপেক্ষ থাকার প্রবনতায় এ সম্প্রদায়ের আবির্ভাব। মানুষের ভাল-মন্দ বিচারের সকল ভার সৃষ্টিকর্তার হাতে ছেড়ে দিতেই এঁরা আগ্রহী। আল্লাহ এবং তাঁর রাসূলকে(স) মেনে নিলে একজন ব্যক্তি যত পাপই করুক না কেন, তাকে এঁরা মুসলমানদের অন্তর্ভুক্ত মনে করতেন। একটি প্রতিষ্ঠিত সরকার ব্যবস্থা যত খারাপ কাজই করুক, এঁরা তার বিরুদ্ধে কথা বলাকে নিরুৎসাহিত করতেন। এ সকল চিন্তাধারা নিঃসন্দেহে অত্যাচার-নির্যাতনকে উৎসাহিত করেছে এবং অত্যাচারী উমাইয়া শাসকদের রক্ষাকবচ হিসেবে কাজ করেছে। একটু চিন্তাশীল ব্যক্তিই এ মতবাদকে পরিত্যাগ করতে বাধ্য।

এতক্ষন, যে তিনটি ভিন্নমতাবলম্বী সম্প্রদায়ের দর্শনের কথা আলোচিত হলো, সেগুলো মূলতঃ ধর্মতত্ত্ব আশ্রিত মতাদর্শ এবং অনেকক্ষেত্রেই রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে উদ্ভূত। এদেরকে ছাড়িয়ে গিয়ে মু’তাজিলারাই সম্ভবতঃ প্রথম দল যাঁরা রাজনীতি থেকে বেরিয়ে এসে ভিন্নধারায় দর্শনের আলোচনা শুরু করেন। ধর্মতত্ত্ব থেকে তারা পুরোপুরি বেরিয়ে আসতে পারেন নি, তৎকালীন বাস্তবতায় সেটি সম্ভবও ছিল না। তবে, যতদুর বোঝা যায় তাতে, তাঁরা সমষ্টির চাইতে ব্যক্তির উপর বেশী গুরুত্ব দিতেন। মু’তাজিলা দর্শন নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা থাকছে পরের পর্বে।

/*এই পর্বটি লিখতে গিয়ে অসম্ভব কষ্ট হলো, চরম অলসতায় প্রথম তিনটি বাক্য লিখতেই এক সপ্তাহ চলে গিয়েছে! বাকী লেখায়ও তার ছাপ সুষ্পষ্ট। তার উপর নেটের অবস্থা তো সবার জানাই। ক্ষমাপ্রার্থী, পাঠকের কাছে।*/

চলবে.....
আগের পর্বগুলোঃ
১. ভূমিকা পর্ব
২. বিজ্ঞানের দর্শন
৩. প্রাচীন বিজ্ঞানের ইতিহাস
৪. মৌলিক চিকিৎসাবিজ্ঞানে অবদান
৫. ব্যবহারিক চিকিৎসাবিজ্ঞানে অবদান
৬. রসায়নবিজ্ঞানে অবদান
৭. আলোকবিজ্ঞানে অবদান
৮. জ্যোতির্বিজ্ঞানে অবদান- প্রথম পর্ব
৯. জ্যোতির্বিজ্ঞানে অবদান- দ্বিতীয় পর্ব
১০. গণিতে অবদান
১১. ইসলামে বিভিন্ন দর্শনের উদ্ভব ও বিকাশ
সর্বশেষ এডিট : ১৯ শে এপ্রিল, ২০১০ রাত ৯:২৬
৩৪টি মন্তব্য ৩৪টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

ছাঁদ কুঠরির কাব্যঃ মিসড কল

লিখেছেন রানার ব্লগ, ০২ রা মে, ২০২৪ রাত ৯:৫৫



নতুন নতুন শহরে এলে মনে হয় প্রতি টি ছেলেরি এক টা প্রেম করতে ইচ্ছে হয় । এর পেছনের কারন যা আমার মনে হয় তা হলো, বাড়িতে মা, বোনের আদরে... ...বাকিটুকু পড়ুন

হিটস্ট্রোক - লক্ষণ ও তাৎক্ষণিক করণীয়

লিখেছেন ঢাকার লোক, ০২ রা মে, ২০২৪ রাত ১০:০৭

সাধারণত গরমে পরিশ্রম করার ফলে হিটস্ট্রোক হতে পারে। এতে দেহের তাপমাত্রা অতি দ্রুত বেড়ে ১০৪ ডিগ্রী ফারেনহাইট বা তারও বেশি হয়ে যেতে পারে।

হিটস্ট্রোক জরুরি চিকিৎসা প্রয়োজন। চিকিৎসা... ...বাকিটুকু পড়ুন

আল্লাহকে অবিশ্বাস করার সংগত কোন কারণ নাই

লিখেছেন মহাজাগতিক চিন্তা, ০২ রা মে, ২০২৪ রাত ১০:৪৩



সব কিছু এমনি এমনি হতে পারলে আল্লাহ এমনি এমনি হতে সমস্যা নাই। বীগ ব্যাং এ সব কিছু হতে পারলে আল্লাহও হতে পারেন। সব কিছুর প্রথম ঈশ্বর কণা হতে পারলে আল্লাহও... ...বাকিটুকু পড়ুন

যুক্তরাষ্ট্রে ইসরাইল বিরোধী প্রতিবাদ বিক্ষোভ

লিখেছেন হাসান কালবৈশাখী, ০৩ রা মে, ২০২৪ সকাল ৮:০২

গাজায় হামাস উচ্ছেদ অতি সন্নিকটে হওয়ায় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে নিউইয়র্ক ও লসএঞ্জেলসে কয়েকটি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে বিক্ষোভ ছড়িয়ে পরেছিল। আস্তে আস্তে নিউ ইয়র্ক ও অন্যান্ন ইউনিভার্সিটিতে বিক্ষোভকারীরা রীতিমত তাঁবু টানিয়ে সেখানে অবস্থান নিয়েছিল।


... ...বাকিটুকু পড়ুন

৫০১–এর মুক্তিতে অনেকেই আলহামদুলিল্লাহ বলছে…

লিখেছেন বিচার মানি তালগাছ আমার, ০৩ রা মে, ২০২৪ বিকাল ৩:০০



১. মামুনুল হক কোন সময় ৫০১-এ ধরা পড়েছিলেন? যে সময় অনেক মাদ্রাসা ছাত্র রাজনৈতিক হত্যাকান্ডের শিকার হয়েছিল। দেশ তখন উত্তাল। ঐ সময় তার মত পরিচিত একজন লোকের কীভাবে মাথায় আসলো... ...বাকিটুকু পড়ুন

×