সকাল ৯টায় বাসা থেকে বের হয়েছি, আমাদের গন্তব্য কক্সবাজার।
বিয়ের পর বউকে নিয়ে কোথাও বেড়াতে গেলে নাকি সব কিছুই নতুন নতুন লাগে, সমস্যা হচ্ছে আমার কাছে সবই পুরাতন মনে হচ্ছে। এইযে রিক্সা এটাও অনেক পুরানো, স্প্রে করে জং ধরা অংশ লোকানো হইছে। রাস্তাটা আরো বেশি খারাপ, কোথায় গর্ত আর কোথায় সমতল খুজে পাওয়াটা বড়ই কষ্টের।
বউকে যদি এই কথা বলি যে সবই পুরাতন মনে হচ্ছে তাহলে হইতো হানিমুন শেষ হয়ে শ্রাদ্ধ শুরু হতে পারে, এদিক সেদিক তাকিয়ে নতুন কিছু খুজতে চাচ্ছি যা দেখে বউকে বলবো "দেখছো বউ পাশে থাকলে সব কিছুই কেমন নতুন নতুন লাগে" কপাল খারাপ হলে যা হয়, কিছুই খুজে পেলাম না।
আকরাইন বাজারে আসতেই দেখলাম আর্মির একজন সৈনিক রাস্তার জ্যাম ছাড়াচ্ছেন, কোন রিক্সাতে বাড়ি দিচ্ছেন কাউকে গালি দিচ্ছেন। এবার নতুন কিছু মনে করে বউকে বল্লাম, নতুন বউ সাথে নিয়ে গেলে কেমন নতুন নতুন লাগে। বউ আমার বে-রশিকের মত বলেদিছে "অফিসারের গাড়ি জ্যামে পরলে আর্মিরা রাস্তায় নেমে এমনই করে, এটা নতুন কিছুনা"।
ভাবলাম আমার রোমান্টিক কথা শুনে বউ খুশিতে কিস ফিস করে বসবে, তা না করে বউ কেমন লজিক্যাল উত্তর দিছে। শীতের সকালে সব কিছু জমে যায়, কে যেনো বলেছে শীতে গ্যাসও জমে যায়। এই হিসাবে হইতো বউয়ের রোমান্টিকতা জমে গিয়ে বে-রশিক হয়ে গেছে।
ফুরফুর করে আমাদের অটো চলছে বিরোলিয়ার ব্রীজের কাছে, এই জায়গাটা আমার অনেক ভাল লাগে। ঢাকার খুবই কাছে অথচ কেমন শান্তি শান্তি একটা ভাব, নিরিবিলি আর খুলামেলা।
ড্রাইভারকে বলে ব্রীজে নামলাম, দুজনে কয়েকটা ফটো তুলে রাখলাম স্মৃতির এ্যালবামে জামানোর জন্য।
বিরোলিয়া ব্রীজের পর আমাদের অটো থেমে গেছে, এখান থেকে সিএনজি নিয়ে যেতে হবে। অটো থেকে নেমে খুজতে লাগলাম মটকা চা আছে নাকি, হতাশ হলাম এরা নাকি বিকালে শুধু বিক্রী করে। কি আর করার সামনে হেটে গিয়ে যে সিএনজিকে বলি এয়ারপোর্টে যাওয়ার কথা তারাই না করে দেই, একজন বয়স্ক ড্রাইভার জানালো সবুজ রং এর সবগুলি গাজীপুরের গাড়ি তাই এয়ারপোর্ট যেতে পারবেনা। "প্রাইভেট" লেখা গাড়ি খুজার জন্য।
দুজন একটু অপেক্ষা করছি, প্রাইভেট সিএনজি আসে কিনা। বসে থেকে ভাবছি এক কাপ চা খেতে পারলে ভালই হবে, সময় কাটবে সাথে চায়ের নেশাটাও। বউ আবার চা পছন্দ করেনা, তাই সাহস করতে পারলামনা। চা খাওয়ার কথা বলে ধমক খাওয়ার চেয়ে চুপচাপ বসে থাকি এটাই ভালো। পিছনের দোকানে কত সুন্দর করে টুংটাং শব্দ করে চা বানাচ্ছে, আহা!!!!!!
ঠান্ডা ভালই লাগছে, সুয়েটার গায়ে জড়িয়েও মনে হচ্ছে কাপছি। গরমে আমার তেমন সমস্যা হয়না তবে ঠান্ডাতে একটু বেশি কাপাকাপি করি, বউ না হয়ে যদি পাশে "গার্লফ্রেন্ড" বা "মানবিক বউ" হত তাখলে ভয় পাচ্ছি ভাবতাম কিন্তু যেহেতু "কাবিন" সহ বউ তাই নিশ্চিত হলাম ঠান্ডাতেই কাপছি।
১০/১৫ মিনিটের অপেক্ষা শেষে একটা সিএনজি পেলাম, দামাদামি করে দুজন উঠে বসলাম। বেড়িবাধের রাস্তা থেকে নেমে উত্তরার ১৮ নাম্বার সেক্টরের ভিতর দিয়ে চলছি, প্রজেক্ট নতুন হলেও এখানের রাস্তাগুলি বেশিরভাগই চলাচল অনুপযুক্ত। থেক্কের থেক্কের করে চলতে হয়।
দিয়াবাড়ি ব্রীজের কাছে আসতেই সিএনজি থামালাম, অপরূপ সুন্দর একটা জায়গা। প্রেমের দিন গুলিতে নিশিকে নিয়ে একবার এসেছিলাম, কাশবন আর বিকালের ফুচকার আড্ডা ভালই চলছিল আমাদের। কিছুটা সময় দুজন ব্রীজে হাটাহাটি আর কিছু ছবি ক্যামেরা বন্ধি করলাম, আরো কিছুটা সময় থাকতে পারলে ভালই লাগতো কিন্তু ফ্লাইটের সময় হয়ে যাচ্ছে তাই আর দেড়ি করতে পারলাম না।
ঝাক্কি টাক্কি খেয়ে ঠিক সময়ের আগেই আমরা এয়ারপোর্টে পৌছালাম, করোনার জন্য সবকিছু কেমন ছন্দহীন। লোকজনের ভিড়ও অনেক কম, চেয়ারগুলি ফাকা। লোকজন বসার চেয়ে দাড়িয়ে থাকতেই পছন্দ করছে বেশি।
আমার ফ্লাইট ১২টা বাজে, ইউএস বাংলা এয়ারলাইন্সের ATR 72-600 বিমানে। এটাকে বিমান না বলে উড়ন্ত বাস বলা চলে, ছোট্ট বিমান দেখতেই মায়া লাগে। আহারে বেচারা ঠিকমতো পৌছাতে পারলেই শুকরিয়া।
হানিমুনের পুরোটা প্যাকেজই গিফট পেয়েছি সিঙ্গাপুরের ৫জন ফ্রেন্ড এর কাছ থেকে, মুহিন ভাই, খলিল ভাই, জসিম ভাই, নজরুল ভাই আর মিঠু ভাই দিয়েছে। মুহিন ভাইেয়র দায়িত্বে ছিলো সবকিছু কনফার্ম করা, উনি আবার ইউএস বাংলা এয়ালাইন্সের প্রতি দূর্বল। সবসময় এই এয়ারের টিকেটই কাটে, কোন আন্ডার টেবিল আছে কিনা জানিনা। নাকি এই এয়ারলাইন্সের বিমানবালাদের প্রেমে পরে বারবার ইউএসবাংলার টিকেট কাটে কে জানে। এইসব জেনে আমি কি করমু, ফ্রিতে পাইছি এটাই বড় কথা।
লোকাল বাসে উঠতে গেলে যেমত ধাক্কা ধাক্কি করে ডমেষ্টিক ফ্লাইটেও ঠিক এমটাই চোখে পরছে, বুকিং কাউন্টারে কার আগে কে যাবে এই নিয়ে শুরু হয় দৌড় ঝাপ। আমি আর নিশি চুপচাপ দক্ষিন কর্নারের চেয়ারগুলিতে বসে আছি, ভিড় কমলে আমরা যাবো।
বুকিং শেষ করে আমরা ফাইনাল চেকিং এর জন্য ভিতরে আসতেই মেশিন নষ্ট, অপেক্ষা করছি প্রায় ১৫/২০ মিনিট হবে। টেকনিশিয়ান আসছে কিন্তু স্ক্যান মেশিন ঠিক করতে পারছেনা, কর্তৃপক্ষ বাধ্য হয়ে সবইকে ভিআইপি রুমের মাধ্যমে স্ক্যান করতে বল্ল।
ধাক্কা ধাক্কি করে সবাই স্ক্যান শেষ করে বিমানে উঠার জন্য অপেক্ষমান জায়গাতে বসছে, আমরাও সবার সাথে অপেক্ষা করছি। অপেক্ষার সময়টা একটু লম্বা মনে হচ্ছে তাই দুইটা কোকের ক্যান নিয়ে আসলাম, বউ যাত্রা পথে নেকাব একেবারেই খুলেনা তাই একটা ধমক আশা করে সামনে আসলাম কিন্তু ক্যান খুলার আগেই আমাদের ফ্লাইটের কল আসছে। যাক, কোক আর ধমক কোনটাই খাওয়া হলনা। সামনে বাস দাড়িয়ে আছে, সবাই লাইন দিয়ে উঠছে। আমরা প্রথম বাসেই উঠলাম, সবাই যারযার মত করে ছবি উঠাচ্ছে ভিডিও করছে। নিশিও সবার সাথে মিলে গেছে, হানিমুনে যাচ্ছি বউয়ের হাতে আমার হাত থাকবে একটা রোমান্টিক ব্যাপার কাজ করবে অথচ বউয়ের হাতে মোবাইল।
বাসটা রানওয়ের নির্দিষ্ট রাস্তা ধরে এগিয়ে যাচ্ছে, যতক্ষন চলছে তাতে আমার মনেহয় আর একটু সময় চল্লে বাসেই কক্সবাজার পৌছে যেতাম বিমানের আগে।
বাস থেকে নেমে সবাই বিমানের কাছাকাছি দৌড়ে যাচ্ছে ছবি উঠানোর জন্য, আমিও বউ বলার আগেই মোবাইল হাতে তৈরী বউয়ের ছবি তুলে দেয়ার জন্য। সবাই ছবি তুলতে এতই ব্যস্ত হয়ে পরেছে যে কর্তৃপক্ষ একপ্রকার বার বার এনাউন্স করে সবাইকে বিমানে উঠাতে হচ্ছে, সিড়িতে উঠেও ভিড় লেগে গেছে। বিষয়টা যেনো বিমানে উঠার চেয়ে বিমানের পাশে ছবি তুলাতেই সবার মুগ্ধতা।
বিমানের মাঝামাঝি আমাদের সীট, নিয়ম মত নিশি জানালার পাশে আমি তার পাশে। ছোট বিমান একটুতেই কেমন কাপাকাপি করে, আমার একটু আধটু ভয় হচ্ছে। সাহস আছে ভাব দেখিয়ে বউকে বল্লাম ভয় পেওনা, আমি আছি। বউ আস্তে আস্তে বলছে, তুমি আছো বলেইতো বেশি ভয়। বউ কি সাহস দিলো নাকি লজ্জা দিছে এটা বুঝে উঠার আগেই বিমান চলতে শুরু করছে।
ডমিষ্টিক ফ্লাইটের ক্ষেত্রে একমাত্র বিমান বাংলাদেশে এয়ারলাইন্স ছাড়া সবগুলিই ঠিক সময়ে ছাড়ে, বিমানের সমস্যা কোথায় জানিনা। প্রতিবারই ঘন্টার বেশি লেইট করে। আমাদের বিমানটা ঠিক সময়ে ছেড়েছে বলা যায়না, ১০/১৫ মিনিট লেইট করেছে। ঘন্টার জায়গাতে ১০/১৫ মিনিট কোন বিষয় মনে হলনা।
বিমান চলতে শুরু করছে, নিশি ভিডিও করছে। বিমানের গতি বাড়ার সাথে সাথে নিশিরও কেমন একা বোমান্চকর ভাব কাজ করছে, জানালার গ্লাস হাতে পরিষ্কার করছে কখনো ওয়েট তাওয়াল দিয়ে পরিষ্কার করার চেষ্টা করছে। সব কিছু ছাপিয়ে বউয়ের একমনে ভিডিও করা দেখতে আমার খুবই ভাল লাগছে, কেমন বাচ্চামিতে মেতে উঠেছে। বিমানের গতি যত বাড়ছে নিশির বাচ্চামির মাত্রাও ততই বাড়ছে, চোখের সামনে দেখতে দেখতে ঢাকার শহরকে কেমন খেলনার শহর মনে হচ্ছে। একটা সময় ঢাকার শহরের ২৫/৩০ হাজার ফিট উপরে উঠে মেঘের সাথে খেলা করতে করতে আমরা এগিয়ে যাচ্ছি কক্সবাজারের দিকে।
নিশি একমনে আকাশ দেখছে, নিচে তাকিয়ে পাহাড় খুজছে, কখনো কখনো বিমানের নিচে তুলার মত বাসতে থাকা মেঘরাশি গুলিতে কল্পনা সাজাচ্ছে। বিমান জার্নিও যে এতটা ভল লাগতে পারে দীর্ঘ্য ১৪ বছরে আজকেই প্রথম ফিল করতে পারলাম।
নিশি আকাশ মেঘ আর পাহাড় দেখছে, আমি পাশে বসে নিশিকে দেখতে দেখতে গন্তব্যের দিকে ছুটে চলছি...........
সর্বশেষ এডিট : ১৫ ই জুন, ২০২১ বিকাল ৪:৩৮

অনুগ্রহ করে অপেক্ষা করুন। ছবি আটো ইন্সার্ট হবে।




