'সুফিয়া, অই সুফিয়া ।'
হাঁক শুনে বারান্দায় দৌড়ে গেলেন সুফিয়া বেগম । বারান্দা নয় বরং ছাদ বলা যায় একে । চারদিক খোলা এই ছাদটাকে প্রথম দৃষ্টিতে বারান্দা ভেবে ভুল হয় । দোতলা বাড়ি । না দেড় তলা । নিচে থাকেন বাড়িওয়ালা । ওপরে সুফিয়া বেগম তার ছেলে, ছেলের বউ আর নাতনিকে নিয়ে থাকেন । দোতলার অর্ধেক তৈরি হয়েছে । সেখানে থাকেন সুফিয়া বেগম । বাকি অর্ধেক সেভাবেই পড়ে আছে । সেটাকে নির্দ্বিধায় ছাদ কিংবা বারান্দা বলে চালিয়ে দেয়া যায় । তাদের ছাদ কিংবা বারান্দাটাকে উঠোন বলেও চালিয়ে দেয়া যায় । উঠোনটার সাথে গ্রাম্য উঠোনের বেশ মিল আছে । বেশ বড়। তবে অমিলটাও কম না । বৃষ্টি হলে এখানে সোঁদা মাটির ঘ্রাণ পাওয়া যায় না । যেটা পাওয়া যায় তা হল, দালানের চুনকাম ধুয়ে যাওয়া ঘ্রাণ আর এঁদোগলির জমে থাকা ময়লা পানির দুর্গন্ধ । তারচেয়ে বড় কথা সেই উঠোনের বসবাস মাটির সমতলে নয়, সমান্তরালে ।
ছাদ কিংবা বারান্দা কিংবা উঠোনের অর্ধসমাপ্ত রেলিং ধরে তিনি সামনে তাকান । তার ছানিপড়া চোখ হাতড়ে ফেরে গলির এ প্রান্ত থেকে ও প্রান্ত । তার বৃদ্ধ চোখের দৃষ্টি গলির শেষ অবধি পৌঁছায় না । তাই বিশ্বাস করতে ইচ্ছে করে ওখানেই আছে তার ভাইজান । মাঝে মাঝে মিথ্যাগুলোকে সত্যের চেয়েও বেশি ধ্রুব বলে মনে হয় । তবু মিথ্যা মিথ্যাই । তাকে নিরাশ হয়ে ফিরতে হয় । তাকাবেন না ভেবেও বার কয়েক পেছনে তাকান । সেই দৃষ্টিতে আশা থাকে না, তাই আশাভঙ্গের বেদনাও থাকে না । হয়তো অবুঝ প্রতীক্ষা থাকে, যা আশার চেয়েও বড় কিছু । যা কখনও শেষ হয় না ।
চোখ বন্ধ করলেই সচল হয়ে ওঠে স্মৃতির থিয়েটার, একরকম চিৎকার করতে করতেই প্রতিদিন তার বাসায় হাজির হতেন হানিফ ভাই । বয়সের ভারে নুয়ে পড়েছেন । তবু অদ্ভুত ক্ষিপ্রতা ছিল তার মাঝে । যেন বয়সের সাথে যুদ্ধ ঘোষণা করেছেন । এত বড় ছেলেদেরও এখনো কড়া মার দিয়ে শাসনে রেখেছেন । কিন্তু ছেলেদের হাত-পাও এখন শক্ত হয়েছে । শেষবার তার ছোট ছেলে সুজন তার গায়ে হাত তুলেছিল । ব্যাপারটা হয়তো অনেকের চিন্তার বাইরে । অবশ্য, নিম্নবিত্ত পরিবারে এমনটা অহরহই হয় । কিন্তু নিম্নমধ্যবিত্ত পরিবারে এটা অনিয়ম । তবু এই অনিয়মটাই এখানে নিয়মিত হয়ে উঠেছে আজকাল ।
সুফিয়া বেগম হানিফ ভাইকে প্রচুর অপমান করতেন । অবশ্য অন্য কোনো উপায়ও ছিল না । প্রতিদিন হানিফ ভাই "সুফিয়া, অই সুফিয়া" বলে চিৎকার করে গোটা পাড়া মাথায় তুলে বাসায় হাজির হতেন টাকা নেয়ার জন্য । সুফিয়া বেগমের প্রতিদিনের প্রথম কথা ছিল একটাই, 'কী হইছে এত সকাল সকাল?' সব জেনেও না জানার অভিনয় যেন ।
হানিফ ভাই সেটা ধরতে পারতেন না । বলতেন, 'ট্যাকা দে।'
সুফিয়া বেগম গলায় খানিকটা ঝাঁঝ মিশিয়ে বলতেন, 'তোমারে না কইছি আমার কাছে কোন ট্যাকা নাই । যাও অহন ।'
-আমি তরে যেই ট্যাকা দিছি হেইডা দে । দে আমার ট্যাকা দে ।
-তুমি আমারে কিয়ের ট্যাকা দিছ ?
-দিছি না, ১৩ হাজার ? জলদি দে ।
-হেই দিন না দুই হাজার ট্যাকা নিলা ? আমার কাছে অহন ট্যাকা নাই । আর জামিল তোমারে ট্যাকা দিতে না করছে ।
বড় ছেলের কথা শুনে হানিফ ভাই এক মুহূর্ত চুপ থাকতেন । তারপর আবার গর্জে উঠতেন, 'জামিইল্যা কেডা? তুই আমার ট্যাকা দে ।'
দোমড়ানো-মোচড়ানো কয়েকটা নোট ভাইয়ের হাতে গুজে দিয়ে আপাতত প্রবোধ দেয়ার চেষ্টায় সুফিয়া বলতেন, 'এই লও । আর এই সব প্রতিদিন ভাল্লাগে না । আমার কামাই আছে অহন ? আমি চলি আমার পুতের ট্যাকায় । জামাইডা অসুক কইরা বিছনায় পইড়া আছে । তার অষুদ কিনার ট্যাকা নাই । হের উপর আরও আপদ তুমি । যাও তো অহন ! যাও !'
সেদিনের মত মঞ্চের পর্দা পড়ত । পরদিন আবার সেই একই চিত্রনাট্য । কিছু সংলাপ বদলে আবার সেই একই নাটকের অভিনয় । পরের দিন হানিফ ভাইকে আবার দেখা যেত চিৎকার করে পাড়া মাথায় তুলতে । আসতেন টাকা চাইতে । শেষ দৃশ্যে কোনদিন কিছু মোচড়ানো নোটের দেখা মিলত । কোন দিন বাসায় যাবার ভাড়া হিসেবে দশ টাকা দিতেন । কোন দিন তাও নয় । তার করার কিছুই ছিল না । হানিফ ভাই এখন টাকা নিয়ে তার পরমুহূর্তে খরচ করে ফেলেন । টাকা যে তার প্রয়োজন তাও না । শেষবার দুই হাজার টাকা দেয়ার পর তিনি মুরগি, চাল-ডাল বাজার করে নিয়ে যান তার এক আত্মীয়ের বাসায় । টাকার কোন হিসাব তিনি রাখতেন না । হাতে এলেই খরচ করে ফেলেন । হাতে না এলে জোর করে খরচ করেন । হানিফ ভাইয়ের বউ তাই সুফিয়া বেগমকে বলেছিল, 'উনারে এমনে টাকা দিয়েন না । যেই ট্যাকা আছে আফনের কাছে থুইয়া দ্যান । বিপদে আপদে লাগব ।'
সুফিয়া বেগম নিজের সংসারের টনটনে অনটনের কথাও বুঝতেন । টাকাগুলো ছেলেকে দিয়েছিলেন । তিনি টাকা চাওয়া মাত্র তার ছেলে টাকা জোগাড় করে ফেলবে । শেষবার যখন হানিফ ভাই যাচ্ছিলেন তখন তিনি বলেছিলেন, 'নিজের মায়ের প্যাডের বইন হইয়াও তুই এই বেঈমানি করলি । তর মাফ নাইরে সুফিয়া, তর মাফ নাই ।'
হানিফ ভাই সেদিন চলে গিয়েছিলেন । অনেকটা অভিমান নিয়ে । আর ফিরে আসেননি । জামিল ফিরেছিল তার মৃত্যুসংবাদ নিয়ে । তিনি ছুটে গিয়েছিলেন । সারাজীবনের সঞ্চিত জলটুকু তার চোখ বেয়ে নেমে এসেছিল । ভাইয়ের জন্য তার যে মমতা ছিল, তা তিনি দারিদ্র্যের যাঁতাকলে পিষ্ট হয়ে প্রকাশ করতে পারেন নি । দারিদ্র্যের ভর বড় অকরুণ, তাতে ভালবাসাও পিষ্ট হয়ে যায় ।
তারপর...কেটে গেছে অনেকটা সময় । বদলে গেছে অনেককিছু । শুধু কিছু জিনিস বদলায় না । সুফিয়া বেগম আলমারিতে পুরো তের হাজার টাকা তুলে রেখেছিলেন । না জানি কবে হানিফ ভাই এসে টাকা চাইবেন । তিনি বিরক্ত মুখে টাকাগুলো তাকে দিয়ে বিদায় করবেন । হানিফ ভাই চোখে জল আর মুখে হাসি নিয়ে বেরিয়ে যাবেন । তৃপ্তির নোনা জল, সন্তুষ্টির হাসি । হানিফ ভাই আসেন নি । এসেছিল তার ছোট ছেলে সুজন । টাকাগুলো নিয়ে সে বেরিয়ে যাবার পরদিনই এসেছিল জামিল । সুজন সব টাকা নিয়ে গেছে শুনে সেও চিৎকার করে বাড়ি মাথায় তুলল । ঠিক হানিফ ভাইয়ের মত করে । পার্থক্য একটাই, সরলতার পরিবর্তে ছিল লোভ আর হিংস্রতা ।
তবু সুফিয়া বেগম আজও প্রতীক্ষায় থাকেন হানিফ ভাইয়ের । তার 'সুফিয়া, অই সুফিয়া' ডাক শোনার । অপেক্ষা শেষ হয় না । হানিফ ভাই আসেন না । অভিমানীরা ফিরে আসে না ।