somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

গল্পঃ অপেক্ষক

২৭ শে জুন, ২০১৩ রাত ১০:৪৫
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

'সুফিয়া, অই সুফিয়া ।'



হাঁক শুনে বারান্দায় দৌড়ে গেলেন সুফিয়া বেগম । বারান্দা নয় বরং ছাদ বলা যায় একে । চারদিক খোলা এই ছাদটাকে প্রথম দৃষ্টিতে বারান্দা ভেবে ভুল হয় । দোতলা বাড়ি । না দেড় তলা । নিচে থাকেন বাড়িওয়ালা । ওপরে সুফিয়া বেগম তার ছেলে, ছেলের বউ আর নাতনিকে নিয়ে থাকেন । দোতলার অর্ধেক তৈরি হয়েছে । সেখানে থাকেন সুফিয়া বেগম । বাকি অর্ধেক সেভাবেই পড়ে আছে । সেটাকে নির্দ্বিধায় ছাদ কিংবা বারান্দা বলে চালিয়ে দেয়া যায় । তাদের ছাদ কিংবা বারান্দাটাকে উঠোন বলেও চালিয়ে দেয়া যায় । উঠোনটার সাথে গ্রাম্য উঠোনের বেশ মিল আছে । বেশ বড়। তবে অমিলটাও কম না । বৃষ্টি হলে এখানে সোঁদা মাটির ঘ্রাণ পাওয়া যায় না । যেটা পাওয়া যায় তা হল, দালানের চুনকাম ধুয়ে যাওয়া ঘ্রাণ আর এঁদোগলির জমে থাকা ময়লা পানির দুর্গন্ধ । তারচেয়ে বড় কথা সেই উঠোনের বসবাস মাটির সমতলে নয়, সমান্তরালে ।



ছাদ কিংবা বারান্দা কিংবা উঠোনের অর্ধসমাপ্ত রেলিং ধরে তিনি সামনে তাকান । তার ছানিপড়া চোখ হাতড়ে ফেরে গলির এ প্রান্ত থেকে ও প্রান্ত । তার বৃদ্ধ চোখের দৃষ্টি গলির শেষ অবধি পৌঁছায় না । তাই বিশ্বাস করতে ইচ্ছে করে ওখানেই আছে তার ভাইজান । মাঝে মাঝে মিথ্যাগুলোকে সত্যের চেয়েও বেশি ধ্রুব বলে মনে হয় । তবু মিথ্যা মিথ্যাই । তাকে নিরাশ হয়ে ফিরতে হয় । তাকাবেন না ভেবেও বার কয়েক পেছনে তাকান । সেই দৃষ্টিতে আশা থাকে না, তাই আশাভঙ্গের বেদনাও থাকে না । হয়তো অবুঝ প্রতীক্ষা থাকে, যা আশার চেয়েও বড় কিছু । যা কখনও শেষ হয় না ।



চোখ বন্ধ করলেই সচল হয়ে ওঠে স্মৃতির থিয়েটার, একরকম চিৎকার করতে করতেই প্রতিদিন তার বাসায় হাজির হতেন হানিফ ভাই । বয়সের ভারে নুয়ে পড়েছেন । তবু অদ্ভুত ক্ষিপ্রতা ছিল তার মাঝে । যেন বয়সের সাথে যুদ্ধ ঘোষণা করেছেন । এত বড় ছেলেদেরও এখনো কড়া মার দিয়ে শাসনে রেখেছেন । কিন্তু ছেলেদের হাত-পাও এখন শক্ত হয়েছে । শেষবার তার ছোট ছেলে সুজন তার গায়ে হাত তুলেছিল । ব্যাপারটা হয়তো অনেকের চিন্তার বাইরে । অবশ্য, নিম্নবিত্ত পরিবারে এমনটা অহরহই হয় । কিন্তু নিম্নমধ্যবিত্ত পরিবারে এটা অনিয়ম । তবু এই অনিয়মটাই এখানে নিয়মিত হয়ে উঠেছে আজকাল ।



সুফিয়া বেগম হানিফ ভাইকে প্রচুর অপমান করতেন । অবশ্য অন্য কোনো উপায়ও ছিল না । প্রতিদিন হানিফ ভাই "সুফিয়া, অই সুফিয়া" বলে চিৎকার করে গোটা পাড়া মাথায় তুলে বাসায় হাজির হতেন টাকা নেয়ার জন্য । সুফিয়া বেগমের প্রতিদিনের প্রথম কথা ছিল একটাই, 'কী হইছে এত সকাল সকাল?' সব জেনেও না জানার অভিনয় যেন ।



হানিফ ভাই সেটা ধরতে পারতেন না । বলতেন, 'ট্যাকা দে।'



সুফিয়া বেগম গলায় খানিকটা ঝাঁঝ মিশিয়ে বলতেন, 'তোমারে না কইছি আমার কাছে কোন ট্যাকা নাই । যাও অহন ।'



-আমি তরে যেই ট্যাকা দিছি হেইডা দে । দে আমার ট্যাকা দে ।



-তুমি আমারে কিয়ের ট্যাকা দিছ ?



-দিছি না, ১৩ হাজার ? জলদি দে ।



-হেই দিন না দুই হাজার ট্যাকা নিলা ? আমার কাছে অহন ট্যাকা নাই । আর জামিল তোমারে ট্যাকা দিতে না করছে ।



বড় ছেলের কথা শুনে হানিফ ভাই এক মুহূর্ত চুপ থাকতেন । তারপর আবার গর্জে উঠতেন, 'জামিইল্যা কেডা? তুই আমার ট্যাকা দে ।'



দোমড়ানো-মোচড়ানো কয়েকটা নোট ভাইয়ের হাতে গুজে দিয়ে আপাতত প্রবোধ দেয়ার চেষ্টায় সুফিয়া বলতেন, 'এই লও । আর এই সব প্রতিদিন ভাল্লাগে না । আমার কামাই আছে অহন ? আমি চলি আমার পুতের ট্যাকায় । জামাইডা অসুক কইরা বিছনায় পইড়া আছে । তার অষুদ কিনার ট্যাকা নাই । হের উপর আরও আপদ তুমি । যাও তো অহন ! যাও !'



সেদিনের মত মঞ্চের পর্দা পড়ত । পরদিন আবার সেই একই চিত্রনাট্য । কিছু সংলাপ বদলে আবার সেই একই নাটকের অভিনয় । পরের দিন হানিফ ভাইকে আবার দেখা যেত চিৎকার করে পাড়া মাথায় তুলতে । আসতেন টাকা চাইতে । শেষ দৃশ্যে কোনদিন কিছু মোচড়ানো নোটের দেখা মিলত । কোন দিন বাসায় যাবার ভাড়া হিসেবে দশ টাকা দিতেন । কোন দিন তাও নয় । তার করার কিছুই ছিল না । হানিফ ভাই এখন টাকা নিয়ে তার পরমুহূর্তে খরচ করে ফেলেন । টাকা যে তার প্রয়োজন তাও না । শেষবার দুই হাজার টাকা দেয়ার পর তিনি মুরগি, চাল-ডাল বাজার করে নিয়ে যান তার এক আত্মীয়ের বাসায় । টাকার কোন হিসাব তিনি রাখতেন না । হাতে এলেই খরচ করে ফেলেন । হাতে না এলে জোর করে খরচ করেন । হানিফ ভাইয়ের বউ তাই সুফিয়া বেগমকে বলেছিল, 'উনারে এমনে টাকা দিয়েন না । যেই ট্যাকা আছে আফনের কাছে থুইয়া দ্যান । বিপদে আপদে লাগব ।'



সুফিয়া বেগম নিজের সংসারের টনটনে অনটনের কথাও বুঝতেন । টাকাগুলো ছেলেকে দিয়েছিলেন । তিনি টাকা চাওয়া মাত্র তার ছেলে টাকা জোগাড় করে ফেলবে । শেষবার যখন হানিফ ভাই যাচ্ছিলেন তখন তিনি বলেছিলেন, 'নিজের মায়ের প্যাডের বইন হইয়াও তুই এই বেঈমানি করলি । তর মাফ নাইরে সুফিয়া, তর মাফ নাই ।'



হানিফ ভাই সেদিন চলে গিয়েছিলেন । অনেকটা অভিমান নিয়ে । আর ফিরে আসেননি । জামিল ফিরেছিল তার মৃত্যুসংবাদ নিয়ে । তিনি ছুটে গিয়েছিলেন । সারাজীবনের সঞ্চিত জলটুকু তার চোখ বেয়ে নেমে এসেছিল । ভাইয়ের জন্য তার যে মমতা ছিল, তা তিনি দারিদ্র্যের যাঁতাকলে পিষ্ট হয়ে প্রকাশ করতে পারেন নি । দারিদ্র্যের ভর বড় অকরুণ, তাতে ভালবাসাও পিষ্ট হয়ে যায় ।



তারপর...কেটে গেছে অনেকটা সময় । বদলে গেছে অনেককিছু । শুধু কিছু জিনিস বদলায় না । সুফিয়া বেগম আলমারিতে পুরো তের হাজার টাকা তুলে রেখেছিলেন । না জানি কবে হানিফ ভাই এসে টাকা চাইবেন । তিনি বিরক্ত মুখে টাকাগুলো তাকে দিয়ে বিদায় করবেন । হানিফ ভাই চোখে জল আর মুখে হাসি নিয়ে বেরিয়ে যাবেন । তৃপ্তির নোনা জল, সন্তুষ্টির হাসি । হানিফ ভাই আসেন নি । এসেছিল তার ছোট ছেলে সুজন । টাকাগুলো নিয়ে সে বেরিয়ে যাবার পরদিনই এসেছিল জামিল । সুজন সব টাকা নিয়ে গেছে শুনে সেও চিৎকার করে বাড়ি মাথায় তুলল । ঠিক হানিফ ভাইয়ের মত করে । পার্থক্য একটাই, সরলতার পরিবর্তে ছিল লোভ আর হিংস্রতা ।



তবু সুফিয়া বেগম আজও প্রতীক্ষায় থাকেন হানিফ ভাইয়ের । তার 'সুফিয়া, অই সুফিয়া' ডাক শোনার । অপেক্ষা শেষ হয় না । হানিফ ভাই আসেন না । অভিমানীরা ফিরে আসে না ।
১৩টি মন্তব্য ৫টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

কুড়ি শব্দের গল্প

লিখেছেন করুণাধারা, ২৪ শে এপ্রিল, ২০২৪ রাত ৯:১৭



জলে ভাসা পদ্ম আমি
কোরা বাংলায় ঘোষণা দিলাম, "বিদায় সামু" !
কিন্তু সামু সিগারেটের নেশার মতো, ছাড়া যায় না! আমি কি সত্যি যাবো? নো... নেভার!

সানমুন
চিলেকোঠার জানালায় পূর্ণিমার চাঁদ। ঘুমন্ত... ...বাকিটুকু পড়ুন

ধর্ম ও বিজ্ঞান

লিখেছেন এমএলজি, ২৫ শে এপ্রিল, ২০২৪ ভোর ৪:২৪

করোনার (COVID) শুরুর দিকে আমি দেশবাসীর কাছে উদাত্ত আহবান জানিয়ে একটা পোস্ট দিয়েছিলাম, যা শেয়ার হয়েছিল প্রায় ৩ হাজারবার। জীবন বাঁচাতে মরিয়া পাঠকবৃন্দ আশা করেছিলেন এ পোস্ট শেয়ারে কেউ একজন... ...বাকিটুকু পড়ুন

তালগোল

লিখেছেন বাকপ্রবাস, ২৫ শে এপ্রিল, ২০২৪ সকাল ৯:৩৫


তু‌মি যাও চ‌লে
আ‌মি যাই গ‌লে
চ‌লে যায় ঋতু, শীত গ্রীষ্ম বর্ষা
রাত ফু‌রা‌লেই দি‌নের আ‌লোয় ফর্সা
ঘু‌রেঘু‌রে ফি‌রে‌তো আ‌সে, আ‌সে‌তো ফি‌রে
তু‌মি চ‌লে যাও, তু‌মি চ‌লে যাও, আমা‌কে ঘি‌রে
জড়ায়ে মোহ বাতা‌সে ম‌দির ঘ্রাণ,... ...বাকিটুকু পড়ুন

মা

লিখেছেন মায়াস্পর্শ, ২৫ শে এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ১২:৩৩


মায়াবী রাতের চাঁদনী আলো
কিছুই যে আর লাগে না ভালো,
হারিয়ে গেছে মনের আলো
আধার ঘেরা এই মনটা কালো,
মা যেদিন তুই চলে গেলি , আমায় রেখে ওই অন্য পারে।

অন্য... ...বাকিটুকু পড়ুন

কপি করা পোস্ট নিজের নামে চালিয়েও অস্বীকার করলো ব্লগার গেছে দাদা।

লিখেছেন প্রকৌশলী মোঃ সাদ্দাম হোসেন, ২৫ শে এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ২:১৮



একটা পোস্ট সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে বেশ আগে থেকেই ঘুরে বেড়াচ্ছে। পোস্টটিতে মদ্য পান নিয়ে কবি মির্জা গালিব, কবি আল্লামা ইকবাল, কবি আহমদ ফারাজ, কবি ওয়াসি এবং কবি... ...বাকিটুকু পড়ুন

×