এক
হি: হি:, হু: হু:, খিল-খিল, ভেক -ভেক! শব্দ। হাসির শব্দ । দম ফাটানো হাসি নয় মুখ চাপানো হাসি। আর এই গুলো ডেলিভারি হচ্ছে আমার ঠিক পেছনে বসা বজ্জাত মেয়েগুলোর মুখ-গহ্বর থেকে। অন্য সময় হলে মন্দ লাগতো না; কিন্তু এখন ইচ্ছে করছে এক থাপ্পড়ে ঐ পাঁজি মেয়েগুলোর সবকটি দাঁতের ইন্তেকাল ঘটিয়ে দেই। তাদেরই বা দোষ কি? তারা তো হাসবেই, হাসতেই হবে। এ দিকে আমার বারোটা বেজে তেরোটা বেজে গেছে। শত জোড়া চক্ষু আমার দিকে তাক করা । তারা খুঁজে চলছে এই নন-স্টপ হাসির উৎস। ঐদিকে স্যারও রোল কল ছেড়ে দিয়ে আমার দিকে তার রক্ত চক্ষু নিক্ষেপ করলেন। এখন আমার অবস্থা ‘‘ছেড়ে দেন স্যার পালিয়ে বাঁচি’’। মনে মনে কয়েক শ’ বার দোয়া ইউনুস পড়ে নিয়ে আমার উপর অত্যাসন্ন বালা মুসিবতের জন্য মানসিকভাবে প্রস্তুত হলাম। স্যার বাজখাই গলায় আমার দিকে দৃষ্টি বান নিক্ষেপ করে বললেন- ‘‘What’s the matter?” পেছন থেকে পাট-কাঠির মতো লিকলিকে মেয়েটা দাড়িয়ে বলল- ‘‘Sir, mobile phone”। Mobile phone! স্যারও কিছুটা অবাক হলেন বটে। তবে সবাইকে সবচেয়ে বেশি অবাক করে দিয়ে স্যার নিজেও হাসতে শুরু করলেন হা: হা:। আর সে ঐতিহাসিক হাসির উৎস হচ্ছি আমি। আর কারণ আমার মোবাইল ফোনটি । আসলে ফোনটি ও নয় ফোনের অদ্ভুত রিং টোনটি। টোনটি আসলে খুব বেশি বাজে নয়। ঝর্ণা থেকে পানি পতনের কলকল ধ্বনি । তবে অনেক বেরসিক এই শব্দটিকে বাচ্চাদের বাথরুমের শব্দের সাথে মিলিয়ে ফেলে কিনা! আসলে সে দিন ঘুম থেকে একটু দেরী করে উঠেছিলাম,আর তাড়াহুড়া করে ক্লাসে চলে গিয়েছিলাম বলে ভুলে ফোনটি সাইলেন্ট করা হয়নি আর তাতেই ক্লাসের সময় কোন এক বেরসিকের কলে ফোনখানি বেজে উঠে আমার প্রেস্টিজ পাংচারের মহান দায়িত্ব পালন করে। সেদিন স্যার আমাকে ক্লাস থেকে বেরও করলেন না আবার হুমকিও দিলেন না। তবে অত্যন্ত সার্থকভাবে সম্মানের সাথে অপমান করলেন। ‘‘শুনুন জনাব, প্রেমালাপটা ক্লাসের পরেও করতে পারবেন, ক্লাসে ফোনটা অফ রাখুন । উনার সাথে খুব বেশি কথা থাকলে ক্লাসের পরে একা একা দরজা বন্ধ করে বলবেন কেমন।’’ এবার আর মুখ চাপানো হাসি নয় দম-ফাটানো হাসি । পুরো ক্লাস জুড়ে, ছেলে মেয়ে নির্বিশেষে। মনে হয় যেন ক্লাসের চেয়ার টেবিলগুলোও সে হাসিতে যোগ দিয়েছে। হি: হি:, হু: হু:, খিল-খিল, ভেক -ভেক।
দিলে বহুত চোট নিয়ে ক্লাস থেকে বের হলাম। তা স্যার লজ্জা দিয়েছেন বলে নয়- কারণ লজ্জা তো নারীর ভূষণ, আর আমিতো সাচ্চা পুরুষ হে: হে: । দুঃখে আমার কলজেটা ছিঁড়ে যাচ্ছিল, ঈশরে আমার যদি এমন একটা ইয়ে থাকতো যে আমাকে এভাবে ফোন করে ডিস্টার্ব করতো, সকাল বেলা ঘুম ভাঙ্গিয়ে দিত। কিন্তু মাশা আল্লাহ আমার যা সুরত। হে: হে: । এর অবশ্য কোনদিন ফোন সাইলেন্ট করতে ভুল হতনা। আমার ফোনটি হয়ে গিয়েছিল চির সাইলেন্ট মোবাইল ফোন। অমার অদ্ভুত রিং টোন শুনে বদের হাড্ডি মেয়েগুলো হাসতে পারতোনা বলে আমার খুব দুঃখ হত। আহারে তাদের ক্লোজ আপ মার্কা হাসি কত দিন দেখিনি সরি শুনিনি।
দুই
বাস চলছে, পিকনিকের বাস। সুন্দরবন যাব। মনটা খুব ফুরফুরে। হঠাৎ ভ্রাঃ ভ্রাঃ; জিন্স পেন্টের চিপা গলিতে রাখা ফোনখানি প্রচন্ড ভাইব্রেশনে কাঁপছে । দাঁড়ানো ব্যতীত ফোন বের করা সম্ভব নয় আর পাশে স্যার বসে থাকায় দাঁড়ানোও সম্ভব নয় সুতরাং যিনিই ফোন করুননা কেন এই মুহূর্তে সংযোগ দেয়া সম্ভব নয়। সারা পথেই নিয়মিত বিরতিতে ভ্রাঃ ভ্রাঃ। অনেক কষ্টে চেপে রাখলাম । অবশেষে সুন্দর বনে পৌঁছে দেখি অপরিচিত নাম্বার 32 32Missed call । আহারে কোন অভাগা দিল এতগুলো কল । ঠিক সে মুহূর্তেই সে নাম্বার থেকে ফোন । খপ করে থরে ফেললাম - ’’হ্যালো, আচ্ছালামু আলাইকুম, কে বলছেন প্লীজ।’’ - ’’আমাকে চেনা কি আপনার খুব বেশি প্রয়োজন?’’ ইথারের তরঙ্গে ভেসে আসলো একটি মেয়ের কণ্ঠ। - ‘‘অবশ্যই, না চিনলে কার সাথে কথা বলছি কি করে বুঝবো?’’ অত্যন্ত নীরস কণ্ঠে বললাম। - ’’ভাবুনতো কে হতে পারি আমি?’’ দারুণ দরদ-মাখা কণ্ঠে বলল সে । মেয়ে বলে গলে যাওয়ার মানুষ আমি নই, আমি বিজ্ঞের মতো ধরে ফেললাম যে আমাকে মদন বানানোর জন্য ঐ ফাজিল মেয়েগুলোর কোন একটি ন্যাকামো করছে। তাই আমল না দিয়ে বললাম ‘‘আমার এত ভাবা ভাবির সময় নেই , আপনি ভাবতে থাকুন আমি রাখলাম ’’ অতঃপর ফোনটি অফ করে সুন্দর বনের সৌন্দর্য উপভোগ করতে থাকলাম।
রাত বারোটার প্রায়। সারা দিনের ভ্রমণে শরীরটা বেশ ক্লান্ত । ঘুমানোর আয়োজন করছি। বাতিটা অফ করলাম ফোনটা বালিশের কাছে রেখে চোখ বন্ধ করলাম। ঘুম প্রায় চলে এসেছে ঠিক তখনি ভ্রোঃ ভ্রোঃ ফোনের ভাইব্রেশনে চোখ খুললাম; দেখি সেই নাম্বার থেকে ফোন কিছুটা বিরক্ত হলেও খুব আগ্রহ নিয়ে ফোন ধরলাম। রস-কসহীন গলায় বললাম- হ্যালো, কে? - জ্বী আমি- হ্যাঁ আপনি কিন্তু আপনার নাম নেই? - হ্যাঁ আছে।- তাহলে বলুন।-জ্বী বলছি, তার আগে বলুন সে সময়ের মতো ফোন রেখে দেবেননা। - না রাখবো না - সত্যি বলছেন। - আপনার কি মিথ্যে মনে হয়? আচ্ছা, আপনি কি পুষ্পিতা নামে কাউকে চিনতেন? পু- পু-পুষ্পিতা, আমার মাথায় বিদ্যুৎ চমকে গেল। মুহূর্তের মধ্যে চলে গেলাম বারো বছর পেছনে। এক সাথে কত কানা মাছি বৌছি খেলা, স্কুলে যাওয়া আম চুরি করা, মারামারি করা, স্যারের কাছে নালিশ করা আরও কত কি। বয়স খুব বেশি ছিলনা তবুও সে সময়ের স্মৃতিগুলো মনের পর্দায় চলচ্চিত্রের মত ভেসে আসছে এক এক করে। একদিন সকালে দেখলাম ঘরের মালপত্র বড় একটি ট্রাকে করে কোথায় যেন নিয়ে যাচ্ছে সাথে চলে যাচ্ছে ওরাও। তখন না যে ওর বাবা বদলি হয়েছে; তবে এটুকো বুঝতাম ওর সাথে বোধ হয় আর দেখা হবে না। হয়নিও আর। আমার চোখ বিন্দু বিন্দু অশ্রুতে ভরে আসছে। কাঁপা কাঁপা গলায় বললাম- ‘‘পুষ্পি, তুই পুউউষ্পি, কোথায় আছিস? কেমন আছিস? কি করছিস? ফুফা ফুফু কেমন আছে? আমার নাম্বার পেলি কোথায়?’’ ও পাশ থেকে শান্ত কন্ঠে বল্ল ’’ওরে বাবা, এত প্রশ্ন কোনটার জবাব আগে দেব। হি: হি: । টুট-টুট। অতঃপর হঠাৎ করে লাইনটা কেটে গেল। এরপর যত বার চেষ্টা করেছি বার বার শুধু একটি কথাই শুনেছি ’’দুঃখিত এই মুহূর্তে ...।’’
এখনো মাঝে মধ্যে সে নাম্বারে ট্রাই করি এই আশায় যদি কখনো খোলা পেয়ে যাই।