somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

সব কিছু মাথা পেতে নেব, তবে…

০১ লা জানুয়ারি, ২০১৬ সন্ধ্যা ৭:৫৭
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :


১.
ঘর নেই। তবু ঘরে ফেরার ভীষণ তাড়া। সেই তাড়না থেকেই হয়ত প্রিয় বাইকে দ্রুত প্যাডেল মারছি। বছরের প্রথম দিনে শীতের মিষ্টি বিকেলে হাতিরঝিলের প্রশস্ত মসৃণ রাস্তা ধরে খুব দ্রুত এগিয়ে চলছি গন্তব্যে। হঠাৎ এক তীব্র চিৎকার। আনমনেই ব্রেক কষলাম। এর পর যা দেখলাম, তা মুহূর্ত আগেও ভাবনার অতীত ছিল।
একটা পালসার মটর সাইকেল বাঁ দিক থেকে সাঁ করে এসে ডান দিকে বাঁক নিচ্ছিল। গতির সাথে বাঁকের তাল মেলাতে না পেরে ঠিক আমার সামনে ভেঙে পড়ল। আরোহী মেয়েটি উড়ে উল্টে পড়ল পাশের উঁচু ফুটপাথের কানায়। ছেলেটি আইমিন ড্রাইভার উড়ে গিয়ে ধাক্কা খেল পাশের দেয়ালে। মটোর সাইকেলটি তিন চারটা উল্টানি খেয়ে ঠিক আমার সামনে এসে স্থির হল।
আমিও স্থির হয়ে দাড়িয়ে আছি । আরেকটু হলে আমি সহই...। ওদের দিকে তাকাতে পারছিলাম না । আমার হৃদপিণ্ড তো বটেই, হাত, পাসহ সারা শরীর ভীষণ কাঁপা কাঁপছিল, কারণ এই প্রথম যমদূত আমার এতো কাছাকাছি এসে ফিরে গেলেন ।
২.
ঠিক আগের দিন। ৩১ শে ডিসেম্বর ২০১৫ । হাতির ঝিলে মাঝখানের ব্রিজটাতে দাঁড়িয়ে যন্ত্র-দাবন এক্সকেভেটরের মাটি কাটার দৃশ্য দেখছিলাম। অনেকের মতো আমিও অবাক হয়ে তাকিয়ে দেখছিলাম কিভাবে এই যন্ত্রটি অনন্ত জলিলের মতো অসম্ভবকে সম্ভব করার কাজ করছে। মাটির উপরে থেকে পানির অন্তত তিরিশ ফুট নিচ থেকে মাটি কি অনায়াসে তুলে এনে ট্রাকে ফেলছে। যেটি ৫০০ শ্রমিকও এত সুন্দর করে করতে পারতো না। আমার মুগ্ধতা কাটল ঠিক পেছনে মটর সাইকেলের ভীষণ কান ফাটানো শব্দে। কয়েকটি ছেলে মটর সাইকেলের সামনের চাকা শূন্যে তুলে পেছনের চাকায় ভর করে স্টান্ট করেছে । কেউবা সামনের চাকায় ভর করে পেছনের চাকার উপরে তুলছে হুইলি করেছে । ভীষণ উত্তেজনার। পাশে একটি মেয়ে ইয়া আল্লাহ বলে বিকট চিৎকার দিয়ে উঠল। ও ভাবছে মটর সাইকেলটি হয়তো এখনই উল্টে হয়তো যাবে। না, সে নিজের ভুল বুঝতে পেরে কিছুটা লাজুক হাসি দিল। পাশে হাত ধরে দাড়িয়ে থাকা ছেলেটি দেখল ওর অবাক হওয়ার দৃশ্য। সে ও হাসল। এই হাসি কিছুটা অভিজ্ঞতার হাসি। ভাবখানা এমন যে, এ আর কী, সে নিজেই এর চেয়ে বহুগুণ ভাল মটর সাইকেল স্টান্ট করতে পারে। অন্য কারো দিকে তাকিয়ে মেয়েটির অবাক হওয়ার দৃশ্য ছেলেটির মোটেও ভাল লাগে না। মেয়েটিকে যেন সব অবাক ওই করতে চায়। ঠিক তখনি আরেকটা মটর সাইকেল আমার পাশ কাটিয়ে গেল। ইয়াহামার এফ জেড সিরিজের বাইক। কালো কোট, কাল হেলমেট পড়ে সামনের দিকে ঝুঁকে থাকা চালক ছেলেটিকে মটর সাইকেলেরই অংশ বলেই মনে হচ্ছে। পেছনে আরোহী সুন্দরী ফর্সা মেয়েটির এলোমেলো চুল বাতাসে খেলা করছে। আরেকটু ভালভাবে দেখার আগেই এই এক্সপার্ট চালক ও আরোহী আমার দৃষ্টি সীমার বাইরে চলে গেল। বাতাসে শব্দ মিলিয়ে গেল। পাশের মেয়েটির চোখ তখনো স্থির হয়ে আছে মাত্র চলে যাওয়া বাইকের পথে। মেয়েটির এমন আচরণ ছেলেটা একদমই সহ্য করতে পারছে না। ও কেন, কেউ পারে না। প্রিয়তমার হৃদয় থেকে নায়কের আসন হারানোটা কেউ সহ্য করতে পারে না।
ওদের বেশভূষা আর চাল-চলন দেখে মনে হল দুজনই পোশাক শ্রমিক। ভীষণ কর্মব্যস্ত সময়ের মাঝে এই প্রথম ওরা একসাথে হাতিরঝিলে ঘুরতে এসেছে। মেয়েটির কষ্ট ক্লিষ্ট মুখ আনাড়ি মেক আপের প্রলেপ ঢাকতে পারেনি। তবু সে প্রিয় মানুষের সাথে আসতে পারার আনন্দে উদ্বেলিত। ছেলেটিও অনভ্যস্ত পোশাকের ভেতরে ঢুকে বেশ অস্বস্তিতে আছে। ও হয়তো আজকের দিনটির জন্যই গতবছর বাণিজ্য মেলা থেকে কেনা মেরুন শার্টটি সযত্নে তুলে রেখেছিল। ওদের জীবনের সবচে বড় প্যারাডক্স- সবার জন্য সুন্দর সুন্দর পোশাক বানালেও ওই পোশাক নিজেদের গায়ে জড়াতে পারেনা। প্রথমত সাইজ, দ্বিতীয়ত অনভ্যস্ততা। মেয়েটি তখনও তাকিয়ে ছিল ওই পথের দিকে। ওর কালো চোখে মিশে আছে এক ধরণের হাহাকার। এই হাহাকারটা ছোট্ট একটা ইচ্ছে, ছোট্ট একটা স্বপ্ন পূরণ করতে না পারার করুণ হাহাকার। ওর ইচ্ছেটা খুব বেশি না। সামান্যই । প্রিয় মানুষটির পেছনে বসে বাইকে এক চক্কর দেয়ার ইচ্ছে। ও কেন সব মেয়েরই এটুকো ইচ্ছে হয়। ইচ্ছের কথাটা ও মুখ ফুটে প্রিয় মানুষটিকে বলতে পারেনা। কারণ ও তার সামর্থ্যের কথা জানে। যেখানে সারাদিন আর ওভার টাইম খাটার পরেও মাসের ২০ তারিখেই বাকি দশ দিন কিভাবে যাবে সেই চিন্তায় পেরেশান থাকতে হয়; চাল কেনা হয় বটে, কিন্তু সে চাল খাওয়ার জন্য ডাল কেনার পয়সা থাকেনা, তার ওপর নতুন বছরে বাসা মালিকের বাড়তি ভাড়ার হুমকি তো আছেই সেখানে ওরকম ইচ্ছে হওয়াটা বড্ড বেমানান। ছেলেটা জ্যোতিষীর চোখ দিয়ে প্রিয় মানুষটার মুখে না বলা ভাষা পড়ে নেয়। কোমলভাবে বহুতে জড়িয়ে বলে “ময়না, কাইলকা বছরের প্রথম দিনে আমরাও এই রকম কইরা হোন্ডায় ঘুরমু”। মেয়েটি শুধু বলে বলে “হাসা কইতাছো!”। ময়না অসম্ভব সুন্দর একটা হাসি দেয়। সত্য কি মিথ্যে ছেলেটি জানে না। ও শুধু সারা জীবন ময়নার ময়না ঠোঁটে এই হাসি দেখতে চায়, ময়নার চোখে নায়ক থাকতে চায়। আর এজন্য সে সব অসম্ভবকে সম্ভব করতে পারে।
৩.
আমি সাহস করে আমার সামনে পড়ে থাকা মানুষ দুটোর দিকে তাকালাম। আমি বুঝতে পারছিনা ওদেরকে আর মানুষ বলা যাবে কিনা। কারণ মানুষের মাথা থাকে। ওদের পোশাকগুলো দেখলাম। আমার চেনা, খুব চেনা। ছেলেটি মেয়েটির সব আবদার মাথা পেতে নিলেও তাদের পতন আর কারও মাথাই নিতে পারলনা না। দুজনের মাথাই থেঁতলানো তরমুজের মত হয়ে গেল।
মেয়েটি যদি একবা ছেলেটিকে হেলমেট পড়তে বলতো!
[পুনশ্চ: এই নববর্ষ আমাদের অঙ্গিকার হোক- কেউ হেলমেট ছাড়া বাইক চালাবো না; কাউকে চালাতে দেবও না। সব কিছু মাথা পেতে নেব; তবে তার আগে মাথায় একটি হেলমেট পরে নেব। শুভ নববর্ষ, হ্যাপি রাইডিং ]
সর্বশেষ এডিট : ০১ লা জানুয়ারি, ২০১৬ সন্ধ্যা ৭:৫৮
২টি মন্তব্য ০টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

ঝিনুক ফোটা সাগর বেলায় কারো হাত না ধরে (ছবি ব্লগ)

লিখেছেন জুন, ০৩ রা মে, ২০২৪ রাত ৮:০৯

ঐ নীল নীলান্তে দূর দুরান্তে কিছু জানতে না জানতে শান্ত শান্ত মন অশান্ত হয়ে যায়। ১৯২৯ সালে রবার্ট মোস নামে এক ব্যাক্তি লং আইল্যান্ড এর বিস্তীর্ণ সমুদ্র... ...বাকিটুকু পড়ুন

মামুনুলের মুক্তির খবরে কাল বৃষ্টি নেমেছিল

লিখেছেন অনিকেত বৈরাগী তূর্য্য , ০৩ রা মে, ২০২৪ রাত ৯:৪৯


হেফাজত নেতা মামুনুল হক কারামুক্ত হওয়ায় তার অনুসারীদের মধ্যে খুশির জোয়ার বয়ে যাচ্ছে। কেউ কেউ তো বলল, তার মুক্তির খবরে কাল রাতে বৃষ্টি নেমেছিল। কিন্তু পিছিয়ে যাওয়ায় আজ গাজীপুরে... ...বাকিটুকু পড়ুন

'চুরি তো চুরি, আবার সিনাজুরি'

লিখেছেন এমজেডএফ, ০৩ রা মে, ২০২৪ রাত ১০:৪৮


নীলসাধুকে চকলেট বিতরণের দায়িত্ব দিয়ে প্রবাসী ব্লগার সোহানীর যে তিক্ত অভিজ্ঞতা হয়েছিল তা বিলম্বে হলেও আমরা জেনেছি। যাদেরকে চকলেট দেওয়ার কথা ছিল তাদের একজনকেও তিনি চকলেট দেননি। এমতাবস্থায় প্রায়... ...বাকিটুকু পড়ুন

বরাবর ব্লগ কর্তৃপক্ষ

লিখেছেন নীলসাধু, ০৩ রা মে, ২০২৪ রাত ১১:২২

আমি ব্লগে নিয়মিত নই।
মাঝে মাঝে আসি। নিজের লেখা পোষ্ট করি আবার চলে যাই।
মাঝেমাঝে সহ ব্লগারদের পোষ্টে মন্তব্য করি
তাদের লেখা পড়ি।
এই ব্লগের কয়েকজন ব্লগার নিজ নিক ও ফেইক... ...বাকিটুকু পড়ুন

ছাঁদ কুঠরির কাব্যঃ অপেক্ষা

লিখেছেন রানার ব্লগ, ০৩ রা মে, ২০২৪ রাত ১১:২৩



গরমের সময় ক্লাশ গুলো বেশ লম্বা মনে হয়, তার উপর সানোয়ার স্যারের ক্লাশ এমনিতেই লম্বা হয় । তার একটা মুদ্রা দোষ আছে প্যারা প্রতি একটা শব্দ তিনি করেন, ব্যাস... ...বাকিটুকু পড়ুন

×