somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

মিতা ('রাতের জর্নাল'র পরে)

১৩ ই জুলাই, ২০০৮ রাত ৮:১১
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

মিতা

রাতের সে মেয়েটা আর চোরের মধ্যে কোন সম্পর্ক নাই কিন্তু মেয়েটা আর চোরের কথাটাই আমাকে কাঠগড়ায় দাঁড় করিয়ে ফেলেছে! ('রাতের জর্নাল' লেখাটা ছুটির দিনে/ প্রথম আলোতে প্রকাশের পর অনেকের মেল পেয়ে এ লেখাটা লিখেছিলাম কিন্তু পরে আর পাঠানো বা ছাপানো হয়নি।) বেশির ভাগ সবারই অভিযোগ কেন আমি সে মেয়েটার কথা আর লিখলাম না! আসলে সেখানে আমি একটা রাতের গল্প বলতে চেয়েছি এবং সে রাতের মত সেখানেই মেয়েটার গল্প শেষ হয়ে গিয়েছিল! সে যদি রাতে আবার বের হত তবে হয়ত ভাবনাটা আরও দীর্ঘায়িত হত।

দুঃখের বিষয় আমি সে মেয়ের নামটা পর্যন্ত জানিনা! এখানে তার নাম দিচ্ছি মিতা। মিতাকে কোন সময়ে দেখতে পাওয়া যাবে তা আমার কাছে মুখস্ত রুটিনের মত ছিল। সে বাইরে গেলে মেইন গেইট খোলা হত। আমি বুঝতে পারতাম তিন মিনিটের মাথায় কালো টয়োটা করোল্লা গাড়িটা বের হবে, তার দুমিনিটের মধ্যে মিতা বের হবে। সেই পাঁচ মিনিটের অপোটা মনে হত অনন্তকাল ধরে চলছে। সাদা রঙটা বোধহয় তার প্রিয় ছিল। সাদা রঙের পোষাকে মিতাকে পরীর মত লাগত। পরীর মত মেয়েটা হাঁটতে হাঁটতে গিয়ে গাড়িতে উঠছে.. এটা ছিল সে সময়ে আমার সবচেয়ে প্রিয় দৃশ্য। মাঝে মাঝে বিকালেও সে বাইরে যেত। বিকালে বোধহয় গান বা পিয়ানো বাজানো শিখত। তার রুমের মধ্যে সেরকম অনেক বাদ্যযন্ত্র দেখেছিলাম। কিংবা নাচও শিখতে যেতে পারে। হালকা মিউজিকের তালে কয়েকদিন তাকে নাচতে দেখেছি।
সন্ধ্যাবেলায় সে ইজি চেয়ারে শরীরটাকে অবিন্যাস্তভাবে এলিয়ে দিত। হাতে থাকত মোটা একটা মগ। মগ থেকে চা বা কফির গরম ধোঁয়া উঠত। একই বয়সের দুটো তরুন তরুণী খানিকটা দুরে দুজনের মুখোমুখি বসে আছে। কেউ কাউকে স্পষ্ট দেখছে না। পেছনের আবছা আলোয় দুজন দুজনের অবয়বটা দেখছে। দুজনই তাকিয়ে আছে আকাশের দিকে। কেউ মুখোমুখি কথা বলছে না। আকাশ তাদের কথার মাধ্যম।
সে সময়ে আমি রবীন্দ্রনাথ পড়ার চেষ্টা করছি। গীতবিতান পড়ি। অনেক কিছু বুঝতে পারি না। সাবির মামা গীতবিতান থেকে পড়ে শোনান, বুঝিয়ে দেন। আমার অসাধারন লাগে। বদরুল দুলাভাই বলেন, কি রবীন্দ্রনাথ পড়ছ? তারপর ঠাট্টার সুরে বলবেন, এ সব পড়ার লন কিন্তু খুব বেশী ভাল ঠেকছে না! সাবির মামা যখন পড়ে শোনান তখন আমি চোখ বন্ধ করে মিতাকে সামনে দাঁড় করায়! অস্ফুট স্বরে বলি, মামা বলেনতো রবীন্দ্রনাথ কি সব অসাধারন কথা লিখে গেছেন!

রাত দশটার দিকে মিতাকে আরেকবার দেখা যায়। সে তার বাবার প্রেসার মেপে দেয়। সে সময় মিতা লাল রঙের টি সার্ট অথবা চেক ফতুয়া পরে। গলায় ঝোলানো থাকে স্টেথিসকোপ। তার বাবার রুম থেকে তাকে সরাসরি দেখা যেত না। ড্রেসিং টেবিলের বড় আয়নার প্রতিবিম্বে দেখতাম মিতা সামনের দিকে একটু ঝুঁকে প্রেসার মাপছে। তারপর কৌটা থেকে বের করে সাদা ছোট্ট একটা ওষুধ এগিয়ে দেবে। পানির গ্লাস নিয়ে কিছুণ দাঁড়াবে।

একদিন দুপুরবেলায় মিতার রুমে ঝড়ের গতিতে ফ্যান ঘুরছে। সে মাত্র গোসল সেরে এসেছে। এসময় বোধহয় মেয়েদের দেখতে সবচেয়ে সুন্দর লাগে। মিতাকে খুব সজীব সতেজ লাগছে। সে অনিপুন হাতে কাঁচা কলাপাতা রঙের শাড়ি পরেছে। আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে চুলের জট ছাড়াচ্ছে। এমন সময় তার রুমে একটা ছেলে এলো। এই প্রথম তার রুমে এমনি তাদের বাসায় প্রথমবারের মত কোন ছেলেকে দেখলাম। কয়েকদিনের বিষন্ন মিতাকে আজ একটু উচ্ছসিত মনে হল! মিতা ছেলেটার সাথে হেসে হেসে কথা বলছে! আমার সেদিন খুব রাগ হয়েছিল। এক বুক অভিমানে মনটা ভরে গিয়েছিল।

দুলাভাই মাঝেমধ্যে বিয়ের ঘটকালী করেন। এখনও বিয়ের ব্যাপারে কারও সাথে কথা বলতে বলতে আমার সামনে চলে এলেন। তারপর বুঝলাম না, আমাকে বাজিয়ে দেখার জন্য নাকি সত্যি সত্যি তিনি ঘটকালী করছেন। তিনি বলছেন, আমাদের সামনের বাসায় একটা মেয়ে আছে। বিয়ের ব্যপারে আমি ভদ্রলোকের সাথে কথা বলি! আমার কান গরম হয়ে যাচ্ছে, বুকের ভেতরটা জ্বালা করছে। মনে মনে ভাবলাম, এপথ থেকে আমার ইস্তফা দেয়া দরকার! তারপর নিজেকেই প্রশ্ন করি, কোন পথ থেকে ইস্তফা? আমি কি তাকে ভালবাসি? আমি জানি না। তবে মিতাকে অন্য ছেলের সাথে গল্প করতে দেখে আমার অভিমান হওয়া, হিংসা হওয়া, তার বিয়ের কথায় কান গরম হওয়া, বুক জ্বালা করা.. এসব অনুভুতির নাম যদি ভালাবাসা হয়, তবে হয়ত মিতাকে আমি গভীর গোপন ভালবেসেছিলাম।

সেদিন সন্ধ্যাবেলায় আমার মনটা ভীষণ খারাপ। একা একা বসে আছি। উচ্ছসিত মিতা লাফাতে লাফাতে রুমে প্রবেশ করল। সিডি প্লেয়ারে হালকা মিউজিক ছাড়ল। কয়েকবার ক্যাসিক নৃত্যের ভঙ্গি করল। আমি বুঝলাম না তার উচ্ছাসের কারন! হঠাৎ সে পোষাক পরিবর্তন করতে লাগল.. আমি ভাবলাম আজ কেল্লা ফতে.. ভাবার সাথে সাথে লাইট অফ হয়ে গেল!

তারপর কয়েকদিন আর দেখতে পায়নি। আমিও ছিলাম না। দুপুরবেলায় বাঘা যতীন ষ্ট্রীটের এক বাড়িতে শুয়ে আছি। আরেকটু পর কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়, কফি হাউজ ঘুরতে যাব। হঠাৎ বাইরে কুকুর বিড়াল বৃষ্টি আরম্ভ হল। মিতাকে খুব মনে পড়ছে। আমি জানি সেও এ শহরেই আছে। তার বাবার হার্ট এ্যাটাক করেছে। বাইপাস সার্জারীর জন্য মিতাদের সবাই এখানে। সে আমাকে দেখলে নিশ্চয়ই ভুত দেখার মত চমকে উঠবে। একটা মানুষকে বার বার দেখলে তার উপর নিশ্চয়ই মায়া পড়ে যায়। আর বিদেশ বিভুয়ে যদি সে মানুষটার সাথে দেখা হয় তবে ভালবাসা প্রকাশ পেতে বেশী সময় লাগে না। আমার মন বলছে এখন মিতার সাথে দেখা হলে সে অর্নগল কথা বলবে, আমাকে বলার কোন সুযোগই দেবে না। মনটা কি একটু স্যাঁতসেতে হয়ে গেল? তাকে কাছে পেতে কেন ইচ্ছা করছে? বাইরে বৃষ্টি আরও প্রবল হয়েছে। ঘুরতে যাবার কোন সম্ভাবনা দেখছি না। টেবিল থেকে ডায়রীটা টেনে নিলাম।

ডায়রীতে লিখলাম.. আজ ২৫শে এপ্রিল ১৯৯৮, দুপুর ১টা ৫৫, বাঘা যতীন ষ্ট্রীট, কলকাতা ।
.. মিতা তোমাকে খুউব বেশী মনে পড়ছে...। তারপর মিতাকে নিয়ে একটা কবিতা লিখলাম..

তোমায় (মিতা)
হঠাৎ খুব বেশী মনে পড়ছে তোমায়
হয়ত মুষল ধারে বৃষ্টি হচেছ।
তুমি দাঁড়িয়ে আছো রেলিং ধরে
হয়তোবা কবিতা পড়ছো উপুড় হয়ে শুয়ে
এলোমেলো বৃষ্টি ছিটকে পড়ছে কাঁচে
সামনের রাস্তাটা ডুবে গেছে জলে
গাড়ির ধাক্কায় জল আছড়ে পড়ছে ওয়ালে
তুমি তাকিয়ে আছো আকাশের দিকে
বুঝি ভাবছ আমার কথা?
না! না! হয়তো ভাবছ মেঘের কথা
মেঘেতে জল থাকে কি করে!

সময় বয়ে চলছে। আশপাশের কিছু থেমে নেই। জীবন নামের গদ্য থেকে মিতা ক্রমেই হারিয়ে যাচ্ছে। আমি তার মুখটা এখন আর পুরোপুরি তৈরী করতে পারছি না! স্মৃতি আমার সাথে প্রতারনা করছে। Short absence quickens love but long absence kills it.
সর্বশেষ এডিট : ১৩ ই জুলাই, ২০০৮ রাত ৮:২৯
৬টি মন্তব্য ৬টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

তোমাকে লিখলাম প্রিয়

লিখেছেন মায়াস্পর্শ, ০২ রা মে, ২০২৪ বিকাল ৫:০১


ছবি : নেট

আবার ফিরে আসি তোমাতে
আমার প্রকৃতি তুমি,
যার ভাঁজে আমার বসবাস,
প্রতিটি খাঁজে আমার নিশ্বাস,
আমার কবিতা তুমি,
যাকে বারবার পড়ি,
বারবার লিখি,
বারবার সাজাই নতুন ছন্দে,
অমিল গদ্যে, হাজার... ...বাকিটুকু পড়ুন

ছাঁদ কুঠরির কাব্যঃ মিসড কল

লিখেছেন রানার ব্লগ, ০২ রা মে, ২০২৪ রাত ৯:৫৫



নতুন নতুন শহরে এলে মনে হয় প্রতি টি ছেলেরি এক টা প্রেম করতে ইচ্ছে হয় । এর পেছনের কারন যা আমার মনে হয় তা হলো, বাড়িতে মা, বোনের আদরে... ...বাকিটুকু পড়ুন

হিটস্ট্রোক - লক্ষণ ও তাৎক্ষণিক করণীয়

লিখেছেন ঢাকার লোক, ০২ রা মে, ২০২৪ রাত ১০:০৭

সাধারণত গরমে পরিশ্রম করার ফলে হিটস্ট্রোক হতে পারে। এতে দেহের তাপমাত্রা অতি দ্রুত বেড়ে ১০৪ ডিগ্রী ফারেনহাইট বা তারও বেশি হয়ে যেতে পারে।

হিটস্ট্রোক জরুরি চিকিৎসা প্রয়োজন। চিকিৎসা... ...বাকিটুকু পড়ুন

আল্লাহকে অবিশ্বাস করার সংগত কোন কারণ নাই

লিখেছেন মহাজাগতিক চিন্তা, ০২ রা মে, ২০২৪ রাত ১০:৪৩



সব কিছু এমনি এমনি হতে পারলে আল্লাহ এমনি এমনি হতে সমস্যা নাই। বীগ ব্যাং এ সব কিছু হতে পারলে আল্লাহও হতে পারেন। সব কিছুর প্রথম ঈশ্বর কণা হতে পারলে আল্লাহও... ...বাকিটুকু পড়ুন

যুক্তরাষ্ট্রে ইসরাইল বিরোধী প্রতিবাদ বিক্ষোভ

লিখেছেন হাসান কালবৈশাখী, ০৩ রা মে, ২০২৪ সকাল ৮:০২

গাজায় হামাস উচ্ছেদ অতি সন্নিকটে হওয়ায় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে নিউইয়র্ক ও লসএঞ্জেলসে কয়েকটি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে বিক্ষোভ ছড়িয়ে পরেছিল। আস্তে আস্তে নিউ ইয়র্ক ও অন্যান্ন ইউনিভার্সিটিতে বিক্ষোভকারীরা রীতিমত তাঁবু টানিয়ে সেখানে অবস্থান নিয়েছিল।


... ...বাকিটুকু পড়ুন

×