somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

একজন ভদ্রমহিলা অথবা মায়ের গল্প

০২ রা মে, ২০১১ রাত ১১:২৯
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

তার সাজানো গোছানো ছোট্ট সংসার। নতুন নতুন বিয়ের রেশ এখনো কাটেনি। সারাদিন ফুর্তি আর আমুদে মেজাজে দিন কেটে যায়। খারাপ কাটে যখন মঈনুল সাহেব অফিসে চলে যান; স্ত্রী তাসনিমের একা একা কিচ্ছু ভাল্লাগেনা, হিন্দী সিরিয়ালের সিঁচকাদুনে মেয়েগুলোর ঢং অতিষ্ঠ লাগে।
মঈনুল সাহেব কিছুদিন ধরেই ভাবছিলেন সদ্য লজ্জা-ভাঙা স্ত্রীকে নিয়ে একটা ছুটি কাটিয়ে আসবেন। এমন সময় সুযোগটাও এল। তিনি একটা ডেভেলপার কোম্পানিতে চাকরি করেন। কাজের প্রয়োজনেই ঢাকার বাইরে যেতে হবে, কাজেই স্ত্রীকে নিয়ে সেখানেই যাওয়া যায়।
তাসনিম তখন দু’জনের জন্য ব্যাগ গোছাচ্ছিল, এমন সময় ফোনটা এল। “মিসেস মঈনুল বলছেন...?” “জ্বী বলছি” “আপনার জন্য একটা খারাপ খবর আছে... মঈনুল সাহেব অ্যাকসিডেন্ট করেছেন...” আর কিছু বলতে হয়নি ওপাশ থেকে। তাসনিম মাথা ঘুরিয়ে পড়ে গেল, বেড সাইড টেবিলে লেগে কেটে গেল কপাল, হুঁশ হারাল সাথে সাথে।
* * *
স্বামীকে শেষবারের মত দেখা হয়নি হতভাগ্য স্ত্রীর। সেই শোক যেন জায়গা না পেয়ে উপচে পড়ছে অল্পদিনের ইতি ঘটে যাওয়া সংসারের শোকপাত্র থেকে। সে গরলে তিক্ততা যুক্ত করছে ক্রমাগত নানা মায়াময় স্মৃতি - তার স্বামীর পিতৃ-মাতৃহীনতা, যে জন্য এই স্ত্রীকেই সর্বস্ব জ্ঞান করত স্বামী; তাদের শেষ বেড়াতে যাবার কথা যা আদৌ হয়ে উঠেনি...
শিয়রে মা বসে আছে। তিনি অক্লান্তভাবে সেধে চলেছেন কিছু খাবার জন্য, কিন্তু তাসনিম মুখে নিচ্ছেনা। তাসনিম কিছুটা দ্বিধান্বিত, তার এই শোক যে আসলেই সত্যি এটা সবাই বুঝতে পারছে কিনা, নাকি সবাই ভাবছে অল্পদিনের সংসারে কোন মায়া-ভালবাসাই ভিত গড়তে পারেনি তাই স্বল্পশোকে মৌন রয়েছে। পরের কথাটা সত্যি, কিন্তু ভালবাসা ভিত গড়েনি এটা সত্যি না। মায়া থেকে যে ভালবাসা সৃষ্টি হয় তার ব্যাপ্তি থাকে বিশাল। মায়া হল সংকীর্ণতা-সৃষ্ট, তাসনিম এসে সেই সংকীর্ণতাকে খুলে দিয়েছিল খোলা আকাশে। এই মুক্তকারিণীকে তাই প্রাণপনে ভালবাসত স্বামী।
ফুলহাতে এক ভদ্রলোক এলেন। ইনি বড়স্যার। তাসনিমের সাথে আগে দেখা হয়েছে। অবিশ্বাস্যভাবে এই ভদ্রলোক খুব ভালো মানুষ। তাসনিমের মা আগে দেখেনি তাই ঘোমটা টানলেন। তাসনিম দেখেও জানালা দিয়ে এক টুকরো আকাশের দিকে তাকিয়ে রইল।
“মিসেস তাসনিম, আপনার ক্ষতির জন্য আমি আমার কোম্পানী অত্যন্ত দুঃখিত” পরিচয় দেয়ার পর মা বসতে বললেও তিনি দাঁড়িয়ে কথা বলছেন, “মিস্টার মঈনুল আমাদের অত্যন্ত বিশ্বস্ত এবং গুরুত্বপূর্ণ একজন সহকর্মী ছিলেন...”
“কি বলবো ভাই, মেয়েটা আমার দু-মাসও সংসার করতে পারলনা,” কান্নায় ভেঙে পড়তে পড়তে বললেন “...বিধবা হয়ে গেল”।
“আপনাদের এমন ভেঙে পড়লে তো চলবেনা। সবারই দুঃসময় আসে, কিন্তু তারপরও তো আমাদের বাঁচতে হয়” এবার তিনি বসলেন, “আমি খুব খুশী হব, যদি আপনি আমাদের অফিসে একটা চাকরীতে যোগ দেন।”
বড়স্যার এপয়েন্টমেন্ট লেটার রেখে গেলেন।
* * *
অনেকদিন পর। তাসনিমের নতুনভাবে জীবন শুরু করার কোন চিন্তা মাথায় নেই। মা আর ভাইয়া খুব চাপ দিচ্ছে, ভাইয়ার এক প্রবাসী বন্ধু সব জানার পরও তাকে বিয়ে করতে রাজী হয়েছে। মা তার পক্ষে অনেক সাফাই গাইছেন, ভাবীও বোঝাতে চেষ্টা করছে। কিন্তু তাতেও সে টলছেনা। প্রয়াত স্বামীর অফিসে একটা চাকরী আর স্বামীর স্মৃতি এই দুই নিয়েই ভাল দিন যাচ্ছে। তবে মাঝে মাঝে খুব একা লাগে তার। খুব মা হতে ইচ্ছে করে।
খেলাঘর শিশু আশ্রম নামে একটি শিশু পুনর্বাসন কেন্দ্রের খোঁজ পেয়ে সেখানে আসে তাসনিম। পরিচালক মহিলার অফিসে বসে আছে, দুজন পরিচারিকা হাত ধরে একটা বাচ্চাকে নিয়ে আসে সে ঘরে। শিশু আশ্রমের পরিচালক তখন বললেন “বাবু, দেখ কে তোমাকে নিতে এসেছে। আজ থেকে ইনিই তোমার নতুন মা। তোমাকে অনেক আদর করবেন, কেমন?” বাবু নামের বাচ্চাটা ফ্যাল ফ্যাল করে তাসনিমের দিকে তাকিয়ে থাকল। হাত ধরে রাখা মহিলাটি তাগাদা দিল – যাও, নতুন মায়ের কাছে যাও। ছেলেটা মহিলার আঙুল আরো শক্ত করে আঁকড়ে ধরে। তাসনিমই তখন এগিয়ে যায়। হাঁটু গেড়ে বসে বাবুর সামনে, “বাবা, তোমার নাম কি?”
ছেলেটা নিশ্চুপ থাকে, যদিও পরিচারিকা তাগাদা দেয়। তার দুচোখে কেবল শূন্যতা, না বোঝার শূণ্যতা।
ময়লা একটা স্কুলব্যাগে করে বাচ্চাটার জীবনযাপনের সমস্ত উপকরন দিয়ে দেয়া হল। তার হাতে থাকল একটা ময়লা পুতুল। তাসনিম যখন তার হাত ধরে বেরিয়ে আসছিল, ছেলেটা তখন ময়লা পুতুলটা হাতে ধরে বার বার পেছনে তাকাচ্ছিল। সে জানেনা পৃথিবীতে তার বাবা-মা নামক আজন্ম স্থানহীনতার কারনে আর কত স্থান বদল করতে হবে। গেট দিয়ে বেরিয়ে আসার মূহূর্তে গত কয়েক বছর এখানে লালিত হবার বিনিময়টা দেয় একরাশ মায়া ঝরিয়ে। স্বভাবতই চার বছর বয়সী এই বাচ্চাটার কঠিন জীবন চোখের পানিকে স্থিতিশীল করে ফেলেছে, আরেকটা অনিশ্চিত জীবনে বদলি হবার মত মামুলি কারনে আর ঝরেনা অশ্রু।
* * *
বড়স্যারের রুমে তার অযাচিতভাবে ঢুকে পড়ার অনুমতি আছে, কারন বড়স্যার তাকে মেয়ে বানিয়েছেন। ডাকেন তুমি করে। তাসনিম অবশ্য কখনোই না নক করে ঢুকেনা। আজ ব্যাতিক্রম হল, এবং ব্যাতিক্রম হল বড়স্যারের চেয়ারে যার বসে থাকার কথা তাতেও।
“এক্সকিউজ মি,” বিষম খেয়ে সামলে নিল তাসনিম “হু আর ইউ?”
“হু আই অ্যাম!” বিস্ময় কন্ঠে, কন্ঠের মালিক সুদর্শন এক পুরুষ “হু আর ইউ?”
এরপর মূলক-অমূলক কিছু কাথাবার্তা চলল। তাসনিমকে দেখা গেল ঝড়ের বেগে নিজের টেবিলে ফিরে আসতে, ঘেমে গেছে সে। আর অপর মানুষটি অফিসের অন্য একজন কর্মকর্তাকে ডাকলেন। তিনি এসে খুলে বললেন। তাসনিম বাবুকে নিয়ে আসার জন্য অফিস থেকে কয়েকদিনের ছুটি নিয়েছিল। এদিকে বড়স্যারও বদলে গেছেন, কয়েকদিন ধরেই কথাবার্তা হচ্ছিল। তার জায়গায় এসেছে বড়স্যারের বিদেশ ফেরত একমাত্র ছেলে চার্লি। বড়স্যার যে তাসনিমকে আদর করতেন এটা জানতে পারল চার্লি। বাবাকে সে জন্য ফোন করে ভর্ৎসনাও উপহার দিল কেন অফিসকে বাসা বাড়ি বানিয়ে রেখেছে।
দ্বিতীয়বার যখন তাসনিম সে রুমে ঢুকল, তখন সে ক্ষমা চাইতেই ঢুকেছিল বেয়াদবির জন্য; কিন্তু প্রকৃতপক্ষে দু’জনকেই একে অপরের কাছে ক্ষমা চাইতে দেখা গেল।
* * *
বাবুকে দেখা শোনা করার জন্য একটা মহিলা রাখা হয়েছে। সে সকালে এসে বিকেলে চলে যায়। তবে তাসনিম বুঝতে পারছে হয় ছেলেটা তাকে পছন্দ করছেনা নতুবা বুয়াটাই কাজে ঢিল দিচ্ছে। কিন্তু তাসনিমের গত্যন্তর নেই। বেশ কিছুদিন হয়ে গেল, ভেবেছিল বাবুর মন জয় করবে ধীরে ধীরে। সেটাতে তেমন অগ্রগতি হয়নি। এখনো মনে হচ্ছে ছেলেটা মেনে নিতে পারছেনা। তাসনিম প্রতিদিনই বাবুকে গোছল করিয়ে দেয়, হাতে তুলে খাইয়ে দেয়, একসাথে কার্টুন দেখে। অনেক অনেক আদর করেও তাসনিম যখন জিজ্ঞেস করে “আমাকে মা বলে ডাকবেনা, সোনা?” ছেলেটা তখন নিশ্চুপ থাকে। রাতের বেলা ছেলেটাকে নিয়েই ঘুমায় সে, জড়িয়ে ধরে শিশুটার অপূর্ণতাটাকে মুছে দিতে চায়। হয়না, এক রাতে বাবু উঠে গিয়ে ডাইনিং টেবিলে ঘুমিয়ে ছিল। খুব কষ্ট পেয়েছে তাসনিম কিন্তু কিছু বলতে পারেনি। নিজেকেই ব্যার্থ ভাবল সে।
একাকীত্ব কাটাতে যাকে আনল সে, ক্রমে সেই একাকীত্ব বাড়িয়ে চলল।
* * *
অফিসের মতলুব ভাই বেশ সিনিয়র, সবদিকে তিনি খেয়াল রাখেন। এজন্য সবারই প্রিয় সহকর্মী তিনি। তাসনিমেরও তাই। মোটামুটি অনেক কথা মতলুব ভাইয়ের কাছে বলা যায়, নিঃসংকোচে পরামর্শ চাওয়া যায়। জিজ্ঞেস করতে হলনা, কয়েকদিন ধরে তাসনিমের মুখের অবস্থা দেখে সেদিন নিজে থেকেই জিজ্ঞেস করলেন “আপনার এ কি অবস্থা? কোন সমস্যা বলুন তো?”
তাসনিম আমতা আমতা করে সেদিন বলে ফেলে। মাতলুব ভাই ভেবে উত্তর দিলেন – বাচ্চাটাকে একদিন শাসন করে তারপর আদর করতে। এতে কাজ হতে পারে। প্রস্তাবটা ভালো, কিন্তু তাসনিম প্রচন্ড নেতিবাচকতার সাথে সরিয়ে দিল। না না, এ তার পক্ষে করা সম্ভব না। বাবুর উপর সে হাত তুলতে পারবেনা। হয়তো মা বলে ডাকেনা কিন্তু তাসনিম অনেক ভালবাসে ছেলেটাকে। মাতলুব ভাই মেনে নিলেন তবে অনেকক্ষন ভেবে আরেকটা কথা বললেন – “তাসনিম, বুঝলাম আপনার মাতৃত্বের শখ হয়েছে। আপনার তো জীবন শেষ হয়ে যায়নি। যদি আবার আপনি কারো সাথে জীবন শুরু করেন, তাহলে মাতৃত্বও পাচ্ছেন সবই পাচ্ছেন...”
একটু কি দাগ কাটল কথাটা?
* * *
একদিন এমনি এমনি বাবুকে জিজ্ঞেস করে তাসনিম “বাবু, তোমার কি ওখানকার বন্ধুদের কথা মনে পড়ে?” ছেলেটা হঠাৎ করে কেঁপে উঠে, ভয়ানকভাবে মাথা দোলাতে থাকে – তার মনে পড়েনা, নাকি পক্ষান্তরে বলল সে ওখানে ফিরে যেতে চায়না?
* * *
এটা ধোঁকা কিনা বুঝতে পারছেনা তাসনিম। চার্লি তাকে একদম ডেলিগেটের সাথে একান্তে মিটিং এর কথা বলে একটা নামী দামী রেস্টুরেন্টে নিয়ে এসেছে। অনেকক্ষন চুপ করে থাকল চার্লি। তাসনিম মুখ খুলল “এতো দেরী করছে কেন?”
“ও হ্যাঁ,” ধাতস্ত হল চার্লি, “ইয়ে তাসনিম, আসলে কোন ডেলিগেট আসার কথা নেই”।
একটা ধাক্কা খেল মেয়েটা। সামলে নিয়ে নরম করে জিজ্ঞেস করল, “তাহলে আমরা এখানে এসেছি কেন?”
“তাসনিম, আমি আপনাকে কিছু কথা বলব”। শ্রোতা চুপ করে রইল। “আমি অনেকদিন একা ছিলাম, মনে হয় কাউকে খুঁজছিলাম। আপনাকে দেখার পর মনে হল – আরে, আপনাকেই তো খুঁজছিলাম। এখন আমি আপনাকে তুমি করে বলতে চাই...”
একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলে তাসনিম “আর...”
“আর তোমাকে ভালবাসতে চাই”।
তাসনিম স্থবির হয়ে বসে রইল।
* * *
ভেবে দেখবে বলে সময় নিয়েছে তাসনিম। সেই রাতে বাবুকে নিয়ে শুয়ে আছে, চুলে বিলি কেটে দিচ্ছে; এমন সময় আবার জিজ্ঞেস করল “বাবু, তোমার কি আগের জায়গায় ফিরে যেতে মন চায়?” ছেলেটা সজোরে মাথা নাড়ে। অনেক দ্বিধান্বিত ভাবনায় পরে তাসনিম।
পরদিন চার্লির রুমে ঢুকলে সে জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে, তাসনিম শুধু বলে ‘হ্যাঁ’। আর তার খুশী দেখে কে? সেই খুশী সারাদিন থাকে তার। চার্লির পিওনটা রোজকার মত জঘন্য চা করে দিয়েও পাঁচশ’ টাকার কড়কড়ে একটা নোট উপহার পায়। নিজে উঠে গিয়ে সহকর্মীদের সাথে দেখা করে, আরো কত কি?
দিন গড়ায়। বড়স্যার মাঝে মাঝে আসেন। তবে ছোটস্যারের কাজকর্মে ততটা মন নেই। প্রতিদিন তাসনিমকে পথে নামিয়ে দিয়ে যায়। প্রতিদিনই তাকে বলা হয় বাসায় আসতে, কিন্তু বলে আজ না অন্যদিন, হঠাৎ কোন একদিন।
হঠাৎ কোন একদিন যে এই ছুটির দিনের অলস বিকেলে হবে তা ভাবেনি তাসনিম। কলিং বেল চেপে খুশী মনে দাঁড়িয়ে আছে চার্লি। ভ্রু কুঁচকে দরজা খুলে চক্ষু চরকগাছ হল “আরে চার্লস্‌, তুমি!” তাসনিম তাকে চার্লস বলেই ডাকে। “কেন, অনাকাঙ্ক্ষিত? তাহলে চলে যাই...” বলে সত্যিই ঘুরে গেল; ওমনি তাসনিম খপ করে তার হাত ধরে ফেলে। “এসো”।
ড্রয়িং রুমে বসিয়ে তাসনিম ভেতরে যায়, চুলগুলো একটু বিন্যস্ত করতে আর নাশতার ব্যবস্থা করতে। চার্লস ঘুরে ঘুরে রুমটা দেখে, চারপাশে তার প্রেমিকার সৃজনশীলতার ছাপ। হঠাৎ একটা বাঁধানো ফ্রেমে চোখ আটকে যায় তার। তাসনিমের পাশে একটা লোক, তাকে ধরে রেখেছে, বেশ অধিকার বলেই ধরে রেখেছে। আরেকটা ফ্রেমেও চোখ গেল, সেটা তাসনিম আর বাবুর একটা ছবি। চার্লির মাথায় আকাশ ভেঙে পড়ল।
চা নিয়ে ঢুকতে ঢুকতে তাসনিম চার্লিকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখল, জিজ্ঞেস করল “কি দেখ?” উত্তরে শক্ত কন্ঠে কথা বলে উঠল চার্লি, তাসনিম ভয় পেয়ে যায় “এই লোকটা কে?”
“কেন!” তাসনিমের কন্ঠে একই সাথে বিস্ময় ও জিজ্ঞাসা, “তুমি জাননা?”
“কে সে?”
“আমার প্রয়াত স্বামী, তুমি জাননা!”
“ও মাই গুড লর্ড! ও মাই গড...!” স্পষ্ট হতাশার স্বর চার্লির কন্ঠে। “তুমি আমাকে আগে বলনি কেন? কেন আমার জীবনটাকে তছ নছ করে দিলে?” একটু থেমে, “এই ছেলেটা নিশ্চয়ই তোমার ছেলে?”
“হ্যাঁ... তবে নিজের নয়, দত্তক”।
“গড! আর কি শুনব?”
হন হন করে বেরিয়ে গেল চার্লি, একটা উদ্ধত গা ঘষায় তাসনিমের হাত থেকে প্লেট-গ্লাস পড়ে শত-ধা হল।
* * *
তাসনিম ভেবেছিল চার্লি সব জেনে শুনেই তার সাথে সম্পর্কে জড়িয়েছে। দেখা গেল সেটা ভুল। সে শুধু জানত তার বাবা তাসনিমকে মেয়ের মত আদর করেন, কিন্তু কি কারনে তা জানতনা। সে রাতে অনেক অনেক বার ফোন দেয়ার পর চার্লি যা বলল তা হল – তাসনিমের বৈধব্য সে মেনে নিয়েছে কিন্তু ছেলেটাকে তার ত্যাগ করতে হবে, তাহলেই হারানো চার্লসকে সে ফিরে পাবে।
এই সিদ্ধান্ত সুরাহা করা আর সাত সাগর পাড়ি দেয়া একই কথা।
মুখে হাত দিয়ে বসে পড়ে অনেকক্ষন কান্নাও সিদ্ধান্তের তীরে পৌঁছে দিতে পারলনা। একটু শক্তি অর্জন করে উঠে গেল।
“বাবু, তোমার ব্যাগ গোছাও... তুমি চলে যাবে”।
আঁৎকে উঠল ছেলেটা। চকিতে চোখগুলো বড় বড় হয়ে গেল যেন ছিটকে বেড়িয়ে আসবে।
“না...”
“কি না, কেন না?” তাসনিম ঝড়ের বেগে গিয়ে ওর গালে একটা সজোরে চড় কষে দেয়। “বেয়াদ্দপ ছেলে...”
ছেলেটার বিকার ঘটলনা। সব ছেড়েছুড়ে প্রানপনে আঁকড়ে ধরল তাসনিমকে। কেঁদে কেঁদে বলল “আমি যাবনা মা”।
‘মা...!’ এই প্রথম শুনল ‘মা’। এতোদিনের মাতৃত্বের আহ্লাদ পূর্ণ হল আজ। জল নামল তাসনিমের চোখ বেয়ে। বাবুকে ধরল সে, পরম আদরে।
কি করবে এখন তাসনিম?
* * *
কক্সবাজার সমুদ্রতীরে একটা বাগানবাড়ি। এখানেই চার্লি নির্বাসনে এসেছে। সকালের পত্রিকায় চোখ বুলাচ্ছিল, এ সময় একটা ট্যাক্সিক্যাব ধুলো উড়িয়ে থামল। তাকিয়ে আছে যাত্রীর দিকে। তাসনিম একটা লাগেজ চাকার উপর টেনে আনছে, তার চুলে সানগ্লাস গোঁজা। তার হাঁটা খুবই ক্লান্তিকর আর মন্থর লাগছে, যেন একটা অপরাধ করে এসেছে। মুখে উজ্জ্বলতা নেই।
বারান্দায় এসে থামল সে, চার্লি উঠে দাঁড়াল। বাহু বাড়িয়ে আলিঙ্গনে নিল তাসনিমকে। চোখ ফেটে পানি বেড়িয়ে এল মেয়েটার। কল্পনার চোখে ভাসছে খেলাঘর শিশু আশ্রমের গেটে প্রচন্ড অভিমান নিয়ে ঢুকে যাওয়া বাবুর ছবি...
৫টি মন্তব্য ৫টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

ন্যায় বিচার প্রতিষ্ঠা করা সকলের দায়িত্ব।

লিখেছেন নাহল তরকারি, ০৫ ই মে, ২০২৪ রাত ৮:৩৮



এগুলো আমার একান্ত মতামত। এই ব্লগ কাউকে ছোট করার জন্য লেখি নাই। শুধু আমার মনে জমে থাকা দুঃখ প্রকাশ করলাম। এতে আপনারা কষ্ট পেয়ে থাকলে আমি দায়ী না। এখনে... ...বাকিটুকু পড়ুন

তাবলীগ এর ভয়ে ফরজ নামাজ পড়ে দৌড় দিয়েছেন কখনো?

লিখেছেন লেখার খাতা, ০৫ ই মে, ২০২৪ রাত ৯:২৬


আমাদের দেশের অনেক মসজিদে তাবলীগ এর ভাইরা দ্বীন ইসলামের দাওয়াত দিয়ে থাকেন। তাবলীগ এর সাদামাটাভাবে জীবনযাপন খারাপ কিছু মনে হয়না। জামাত শেষ হলে তাদের একজন দাঁড়িয়ে বলেন - °নামাজের... ...বাকিটুকু পড়ুন

ফেতনার সময় জামায়াত বদ্ধ ইসলামী আন্দোলন ফরজ নয়

লিখেছেন মহাজাগতিক চিন্তা, ০৫ ই মে, ২০২৪ রাত ১১:৫৮



সূরাঃ ৩ আলে-ইমরান, ১০৩ নং আয়াতের অনুবাদ-
১০৩। তোমরা একত্রে আল্লাহর রজ্জু দৃঢ়ভাবে ধর! আর বিচ্ছিন্ন হবে না। তোমাদের প্রতি আল্লাহর অনুগ্রহ স্মরণ কর।যখন তোমরা শত্রু ছিলে তখন তিনি... ...বাকিটুকু পড়ুন

=নীল আকাশের প্রান্ত ছুঁয়ে-৭ (আকাশ ভালোবেসে)=

লিখেছেন কাজী ফাতেমা ছবি, ০৬ ই মে, ২০২৪ দুপুর ২:১৯

০১।



=আকাশের মন খারাপ আজ, অথচ ফুলেরা হাসে=
আকাশের মন খারাপ, মেঘ কাজল চোখ তার,
কেঁদে দিলেই লেপ্টে যাবে চোখের কাজল,
আকাশের বুকে বিষাদের ছাউনি,
ধ্বস নামলেই ডুবে যাবে মাটি!
================================================
অনেক দিন পর আকাশের ছবি নিয়ে... ...বাকিটুকু পড়ুন

পানি জলে ধর্ম দ্বন্দ

লিখেছেন প্রামানিক, ০৬ ই মে, ২০২৪ বিকাল ৪:৫২


শহীদুল ইসলাম প্রামানিক

জল পানিতে দ্বন্দ লেগে
ভাগ হলোরে বঙ্গ দেশ
এপার ওপার দুই পারেতে
বাঙালিদের জীবন শেষ।

পানি বললে জাত থাকে না
ঈমান থাকে না জলে
এইটা নিয়েই দুই বাংলাতে
রেষারেষি চলে।

জল বললে কয় নাউযুবিল্লাহ
পানি বললে... ...বাকিটুকু পড়ুন

×